ডায়াবেটিস হলে কি কি সমস্যা হয়

ডায়াবেটিস হলে কি কি সমস্যা হয়

ডায়াবেটিস হলে কি কি সমস্যা হয়? ডায়াবেটিস একটি জটিল প্রকৃতির রোগ যা অনেক গুরুতর জটিলতার সৃষ্টি করে। এই আর্টিকেলে আমরা বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করব যে ডায়াবেটিস হলে কী কী সমস্যা হতে পারে।

দীর্ঘকাল ধরে উচ্চ শর্করার মাত্রা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের রক্তনালী গুলোর গুরুতর ক্ষতি করতে পারে, যা অবশেষে শরীরের বিভিন্ন অংশের কার্যকারিতা হ্রাস করে। যদি রক্তনালী গুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে তা শরীরের গুরুত্বপূর্ণ টিস্যু এবং অঙ্গগুলিতে পর্যাপ্ত রক্ত প্রবাহিত করতে পারবে না, ফলে স্নায়ুগুলো সঠিকভাবে কাজ করবে না।

এই স্নায়ুর ক্ষতির ফলে রোগীরা তাদের শরীরের কিছু অংশে অনুভূতি হারাতে পারেন এবং এটি অন্যান্য অঙ্গের আরও জটিলতা গুলির জন্য পথ প্রশস্ত করে। ডায়াবেটিস যখন অনিয়ন্ত্রিত থাকে, তখন এটি হৃদযন্ত্র, চোখ, কিডনি, স্নায়ু সিস্টেম এবং দাঁত এর মতো গুরুত্বপূর্ণ সিস্টেম গুলিকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করে।

ডায়াবেটিস সংক্রমণের প্রবণতা বাড়ায় এবং বিশ্বের উচ্চ-আয়ের দেশ গুলিতে এটি কার্ডিওভাস্কুলার রোগ, অন্ধত্ব, কিডনি ফেইলর, এবং অঙ্গ প্রত্যঙ্গের বিচ্ছেদের একটি প্রধান কারণ হিসেবে পরিচিত।

অতএব, রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা, রক্তচাপ এবং কোলেস্টেরলের স্তরকে স্বাভাবিক পরিসীমার মধ্যে রাখা খুবই জরুরি। নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে, সঠিক ডায়েট, নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম এবং সচেতনতা দ্বারা ডায়াবেটিসের এই সমস্ত জটিলতা গুলি প্রতিরোধ করা সম্ভব।

আরও পড়ুনঃ ডায়াবেটিস বেড়ে গেলে করনীয়

ডায়াবেটিস বেড়ে গেলে কি কি সমস্যা দেখা দিতে পারে?

ডায়াবেটিস এর দুই ধরণের জটিলতা আছে।

১. দীর্ঘস্থায়ী জটিলতা

২. অ্যাকিউট বা সাময়িক জটিলতা

সময়ের সাথে সাথে যে গুরুতর জটিলতা গুলো তৈরী হয়, সেগুলোকে বলে দীর্ঘস্থায়ী জটিলতা। আর অ্যাকিউট জটিলতা গুলো ডায়াবেটিস বেড়ে গেলে যে কোন সময় দেখা দিতে পারে।

দীর্ঘস্থায়ী জটিলতা

এগুলো দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা, যা ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করে এবং যদি সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করা না হয় এবং চিকিৎসাবিহীন অবস্থায় থাকে, তবে গুরুতর ক্ষতি হতে পারে৷ যেমন:

চোখের সমস্যা (রেটিনোপ্যাথি): ডায়াবেটিস বেড়ে গেলে ‘ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি’ নামে একটি চোখের রোগ তৈরি করে, যা দৃষ্টি শক্তিকে প্রচন্ড ভাবে প্রভাবিত করতে পারে। যদি রেটিনোপ্যাথি ধরা পড়ে; সাধারণত চোখের স্ক্রীনিং পরীক্ষা থেকে, তবে দ্রুত চিকিৎসক এর পরামর্শ অনুযায়ী যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

নানা সমীক্ষায় উঠে এসেছে, ডায়াবেটিস বেড়ে গেলে এই সাধারণ চোখের রোগটি কর্মক্ষম প্রাপ্তবয়স্কদের অন্ধত্বের প্রধান কারণ। ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি হয় যখন রক্তে উচ্চ শর্করার উপস্থিতির কারণে রেটিনার রক্তনালিগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে (চোখের পিছনের কোষগুলোর একটি হালকা-সংবেদনশীল স্তর)।

ক্ষতিগ্রস্থ রক্তনালিগুলি ফুলে যেতে পারে এবং ফুটো হতে পারে, যার ফলে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায় বা রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। কখনো কখনো নতুন রক্তনালিগুলো বৃদ্ধি পায়, তবে সেগুলো স্বাভাবিক নয় এবং আরো দৃষ্টিজনিত সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি সাধারণত উভয় চোখকেই প্রভাবিত করে।

আরও পড়ুনঃ ডায়াবেটিস এর লক্ষণ গুলো জেনে নিন

ডায়াবেটিস বেড়ে গেছে এমন ব্যক্তিদের মধ্যে, রক্তে অত্যধিক শর্করা চোখের পিছনের দিকে ভিতরের প্রাচীরের (রেটিনা) ক্ষুদ্র রক্তনালি গুলোকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে বা তাদের সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধ করতে পারে। কখনো কখনো, ছোট ছোট ফুসকুড়ি (মাইক্রোঅ্যানিউরিজম) রক্তজালিকার দেয়াল থেকে বেরিয়ে আসে, পাশাপাশি রেটিনায় তরল পদার্থ এবং রক্ত বের হয়ে জমা হতে থাকে।

এই তরল রেটিনার (ম্যাকুলা) কেন্দ্রীয় অংশে ফোলাভাব (ইডিমা) ঘটাতে পারে। এটি একটি গুরুতর চোখের জটিলতা, যাকে ডায়াবেটিক ম্যাকুলার ইডিমা বলা হয়, যা দৃষ্টি সমস্যা বা অন্ধত্বের কারণ হতে পারে।

ছানিকে মেডিকেলীয় ভাষায় বলে ক্যাটারেক্ট। ছানি হল আপনার চোখের সাধারণ ভাবে পরিষ্কার লেন্সের মেঘ। যদিও বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রত্যেকের লেন্স মেঘলা হয়ে যায়, ডায়াবেটিস বেড়ে গেলে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ছানি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে এবং পাশাপাশি অল্প বয়সেও হতে পারে।

এর একটি কারণ হল যে রক্তে উচ্চ শর্করার কারণে সেগুলো লেন্সগুলোতে জমা হতে পারে এবং সেগুলোকে মেঘলা করে তুলতে পারে। অন্যান্য ঝুঁকির কারণ গুলির মধ্যে রয়েছে উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা, সময়ের সাথে সাথে অত্যধিক সূর্যের এক্সপোজার এবং ধূমপান।

গ্লুকোমা হল চোখের নানা রোগের একটি গ্রুপ, যা অপটিক স্নায়ুর ক্ষতি করে, সাধারণত চোখে অত্যধিক চাপ পড়ার কারণে। অনেক ধরনের গ্লুকোমার উপসর্গ থাকে না এবং দৃষ্টিশক্তি হ্রাস এত ধীরে হতে পারে যে আপনি এটি লক্ষ্য পর্যন্ত করেন না।

ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ওপেন-এঙ্গেল গ্লুকোমা হওয়ার সম্ভাবনা দ্বিগুণ, এটি গ্লুকোমার সবচেয়ে সাধারণ প্রকরণ। অন্যান্য ঝুঁকির কারণ গুলির মধ্যে রয়েছে গ্লুকোমার পারিবারিক ইতিহাস, ষাট বছরের বেশি বয়স এবং আফ্রিকান আমেরিকান, এশিয়ান বা হিস্পানিক / ল্যাটিনো হওয়া।

আরও পড়ুনঃ ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকা

ডায়াবেটিস নিউভাসকুলার গ্লুকোমাও হতে পারে। এটি কখনো কখনো ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির সাথে ঘটে যখন আইরিসে (চোখের রঙিন অংশ) নতুন এবং অস্বাভাবিক রক্তনালি গজায়। নতুন রক্তজালিকা গুলো চোখের বাইরে তরল প্রবাহ বন্ধ করতে পারে, যা চোখের চাপ বাড়ায়।

পায়ের সমস্যা: ডায়াবেটিস বেড়ে যাওয়ার সাথে পায়ের সমস্যা গুলো গুরুতর আকার ধারণ করতে পারে এবং দীর্ঘদিন চিকিৎসা করা না হলে অঙ্গচ্ছেদ হতে পারে। স্নায়ুর ক্ষতি হলে এটি আক্রান্ত ব্যক্তির পায়ের অনুভূতি কে প্রভাবিত করে এবং রক্তে শর্করার বৃদ্ধি রক্ত সঞ্চালনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে পারে, যা ঘা এবং কাটা ছিড়া নিরাময়ের পদ্ধতিকে ধীর করে তোলে। এই কারণেই আপনার পায়ের পাতা বা অনুভূতিতে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করলে আপনার চিকিৎসক কে অবহিত করা গুরুত্বপূর্ণ।

হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোক: আপনার যখন ডায়াবেটিস থাকে, তখন রক্তে উচ্চ শর্করার উপস্থিতি আপনার রক্তনালি গুলোর ক্ষতি করতে পারে। এটি কখনো কখনো হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোক এর কারণ হতে পারে।

 কিডনির সমস্যা (নেফ্রোপ্যাথি): ডায়াবেটিস দীর্ঘ সময়ের জন্য আপনার কিডনির ক্ষতি করতে পারে, যা আপনার শরীর থেকে অতিরিক্ত তরল এবং বর্জ্য পরিষ্কার করা কঠিন করে তোলে। এটি রক্তে উচ্চ শর্করার মাত্রা এবং উচ্চ রক্ত চাপের কারণে হয়ে থাকে। এটি ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি বা কিডনি রোগ নামে পরিচিত।

স্নায়ুর ক্ষতি (নিউরোপ্যাথি): ডায়াবেটিসে আক্রান্ত কিছু লোকের রক্তে উচ্চ শর্করার মাত্রার জটিলতার কারণে স্নায়ুর ক্ষতি হতে পারে। এটি স্নায়ুর জন্য মস্তিষ্ক এবং রোগীর শরীরের প্রতিটি অংশের মধ্যে বার্তা বহন করা কঠিন করে তুলতে পারে। এর ফলে আমরা কীভাবে দেখি, শুনি, অনুভব করি এবং নড়া চড়া করি তা প্রভাবিত হয়।

মাড়ির রোগ এবং মুখের অন্যান্য সমস্যা: আপনার রক্তে অত্যধিক চিনি আপনার লালায় আরও চিনির কারণ হতে পারে। এটি ব্যাকটেরিয়া নিয়ে আসে, যা অ্যাসিড তৈরি করে। ফলে এটি দাঁতের এনামেল কে আক্রমণ করে এবং আপনার মাড়ির ক্ষতি করে। আপনার মাড়ির রক্তনালি গুলিও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যার ফলে মাড়িতে সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

অন্যান্য সম্পর্কিত অবস্থা, যেমন ক্যান্সার: আপনার যদি ডায়াবেটিস থাকে, তাহলে আপনার নির্দিষ্ট কিছু ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেশি। কিছু ক্যান্সারের চিকিৎসা আপনার ডায়াবেটিসকে প্রভাবিত করতে পারে এবং আপনার রক্তে শর্করাকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন করে তুলতে পারে।

মহিলাদের যৌন সমস্যা: ডায়াবেটিস বেড়ে গেলে রক্তনালি এবং স্নায়ুর ক্ষতি আপনার যৌন অঙ্গে প্রবাহিত রক্তের পরিমাণকে সীমাবদ্ধ করতে পারে যাতে আপনি কিছুটা সংবেদন হারাতে পারেন। আপনার যদি রক্তে উচ্চ শর্করা থাকে, তবে আপনার থ্রাশ বা মূত্রনালির সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।

পুরুষদের মধ্যে যৌন সমস্যা: ডায়াবেটিস বেড়ে গেলে আপনার যৌন অঙ্গে প্রবাহিত রক্তের পরিমাণ সীমিত হতে পারে, যার কারণে আপনার উত্তেজিত হতে অসুবিধা হতে পারে। এটি ইরেক্টাইল ডিসফাংশন হতে পারে, কখনো কখনো এ অবস্থাকে পুরুষত্বহীনতাও বলা হয়।

আরও পড়ুনঃ ডায়াবেটিস কমানোর উপায়

অ্যাকিউট জটিলতা

এগুলো যে কোন সময় ঘটতে পারে এবং দীর্ঘস্থায়ী, বা দীর্ঘমেয়াদী জটিলতার দিকে নিয়ে যেতে পারে।

হাইপোস বা হাইপোগ্লাইসেমিয়া: যখন আপনার রক্তে শর্করা খুব কম হয়, সাধারণত চার মিলিমোল পার লিটার এর নিচে।

 হাইপারস বা হাইপারগ্লাইসেমিয়া: যখন আপনার রক্তে শর্করার পরিমাণ খুব বেশি হয়, সাধারণত খাবারের আগে সাত মিলিমোল পার লিটার এর উপরে এবং খাবারের দুই ঘন্টা পরে আট দশমিক পাঁচ মিলিমোল পার লিটার এর উপরে।

হাইপারওসমোলার হাইপারগ্লাইসেমিক স্টেট (এইচ এইচ এস): এটি একটি জীবন-হুমকিপূর্ণ জরুরী অবস্থা যা শুধুমাত্র টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রেই ঘটে। গুরুতর পানিস্বল্পতা এবং  রক্তে উচ্চমাত্রার শর্করার উপস্থিতিতে ( প্রায়শ চল্লিশ মিলিমোল পার লিটার) এই কন্ডিশন হয়।

ডায়াবেটিক কিটোঅ্যাসিডোসিস (ডিকেএ): ডায়াবেটিক কিটোঅ্যাসিডোসিস, যা ডিকেএ নামেও পরিচিত, এটি তখনই হয় যখন শরীরে ইনসুলিনের তীব্র অভাব হয়। এর মানে শরীর শক্তির জন্য চিনি ব্যবহার করতে পারে না এবং পরিবর্তে চর্বি ব্যবহার করতে শুরু করে। যখন এটি ঘটে, শরীরে কিটোন নামক রাসায়নিক নির্গত হয়। যদি চেক না করা হয়, কিটোন গুলি তৈরি হতে হতে আপনার রক্তকে অ্যাসিডিক করে তুলতে পারে – তাই নাম অ্যাসিডোসিস।

তথ্যসূত্র:

  1. Diabetes UK; Complications of Diabetes
  2. International Diabetes Federation; Diabetes Complications
  3. CDC; Heart Disease
  4. CDC; Nerve Damage
  5. Mayo Clinic; Diabetic Macular Edema
Dr. M Shahadat Hossain
Follow me

Physiotherapist, Pain, Paralysis & Manipulative Therapy Specialist, Assistant Professor Dhaka College of Physiotherapy, Secretary-General(BPA), Secretary(CARD), Chief Consultant(ASPC), Conceptual Inventor(SDM), Faculty Member(CRP), Member-Bangladesh Rehabilitation Council

পরামর্শ নিতে 01877733322