ঘন ঘন প্রস্রাবের সমস্যায় যারা ভোগেন, তারা দৈনন্দিন জীবনে নানারকম অসুবিধার সম্মুখীন হন। এক্ষেত্রে এ সমস্যায় ভুক্তভোগী রোগীরা দিনে, রাতে বা উভয় সময়েই স্বাভাবিক পরিমাণে বা স্বাভাবিকের চেয়ে কম পরিমাণে অনেকবার প্রস্রাব করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে থাকেন। ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার সমস্যাটি ‘পলিইউরিয়া’ নামক মেডিকেল কন্ডিশন থেকে আলাদা। আমাদের শরীরের নিম্ন জনন-মূত্র নালি বা লোয়ার ইউরোজেনিটোল ট্রাক্ট এ কোন ডিজঅর্ডারের কারণে ঘন ঘন প্রস্রাবের সমস্যা দেখা দিতে পারে।

মূত্রাশয় অথবা মূত্রনালি বা উভয়েই প্রদাহ হলে ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ আসতে পারে। এক্ষেত্রে মূত্রাশয় খালি করার মাধ্যমে এই সংবেদন বা প্রস্রাবের বেগের উপশম হয় না। তাই মূত্রাশয় খালি হয়ে গেলেও রোগীরা অকার্যকরভাবে প্রস্রাবের চেষ্টা চালিয়ে যায় কিন্তু অল্প পরিমাণেই প্রস্রাব করে।

ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার কারণ

ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার সাথে বিভিন্ন কারণ যুক্ত থাকতে পারে, যেমন:

* মূত্রাশয়ে সংক্রমণ, রোগ, আঘাত বা জ্বালাপোড়া

* মূত্রাশয়ের কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করে এমন পেশি, স্নায়ু বা অন্যান্য টিস্যুতে গাঠনিক বা শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন

* সুনির্দিষ্ট কিছু ক্যান্সারের চিকিৎসা

* ওষুধ বা পানীয়, যা প্রস্রাবের উৎপাদন বাড়ায়

আপনার ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার পেছনে কোন কারণটি দায়ী, তার উপর নির্ভর করে আপনি প্রস্রাবজনিত অন্যান্য সমস্যা অনুভব করতে পারেন, যেমন:

* প্রস্রাবের সময় ব্যথা বা অস্বস্তি

* প্রস্রাব করার প্রবল তাগিদ

* প্রস্রাব করতে অসুবিধা বোধ করা

* মূত্রাশয়ের নিয়ন্ত্রণ হারানো

* প্রস্রাবের অস্বাভাবিক রঙ

কিছু রোগ, অবস্থা বা ত্রুটি – যা ঘন ঘন প্রস্রাবের কারণ হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে:

১. সিস্টোসেল – সিস্টোসেল হলো যখন মূত্রাশয় এবং যোনির মধ্যবর্তী প্রাচীর দূর্বল হয়ে যায়

২. এনজাইটি ডিজঅর্ডার বা উদ্বেগজনিত সমস্যা

৩. বিনাইন প্রোস্ট্যাটিক হাইপারপ্লাসিয়া

৪. মূত্রাশয়ে পাথর

৫. কিডনির কার্যকারিতায় পরিবর্তন

৬. ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস

৭. মূত্রবর্ধক

৮. পানি, অ্যালকোহল বা ক্যাফেইন এর অতিরিক্ত গ্রহণ

৯. ইন্টারস্টিশিয়াল সিস্টাইটিস (পেইনফুল ব্লাডার সিনড্রোম)

১০. কিডনি সংক্রমণ – পাইলোনেফ্রাইটিস

১১. অতি সক্রিয় মূত্রাশয়

১২. গর্ভাবস্থা

১৩. প্রোস্টেটের সংক্রমণ বা প্রদাহ – প্রোস্টাটাইটিস

১৪. রেডিয়েশন ট্রিটমেন্ট বা বিকিরণ চিকিৎসা যা শ্রোণি বা তলপেটে প্রভাবিত করে

১৫. টাইপ ১ ডায়াবেটিস

১৬. টাইপ ২ ডায়াবেটিস

১৭. ইউরেথ্রাল স্ট্রিকচার (মূত্রনালি সরু হয়ে যাওয়া)

১৮. ইউরিনারি ইনকন্টিনেন্স (প্রস্রাবে অসংযম)

১৯. মূত্রনালিতে সংক্রমণ(ইউটিআই)

২০. যোনিতে প্রদাহ – ভ্যাজাইনাইটিস ইত্যাদি।

আরও পড়ুনঃ ফ্রোজেন শোল্ডার এর কারণ ও করণীয়

ঘন ঘন প্রস্রাব দূর করার ঘরোয়া উপায়

ঘন ঘন প্রস্রাব হবার সমস্যাটি দূর করার জন্য বেশ কিছু ঘরোয়া উপায় আছে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হলো:

* বিছানায় যাওয়ার আগে তরল জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলা।

* মূত্রাশয়ে ইরিটেশন হয়, এমন খাবার ও পানীয় সীমিত করা। এদেরকে মেডিকেলীয় ভাষায় ডায়ইউরেটিকস বলে। যেমন:

১. কফি বা ক্যাফেইনযুক্ত খাদ্যদ্রব্য

২. চা

৩. অ্যালকোহল

৪. সোডা

৫. কিছু সাইট্রাস ফল

৬. টমেটো ভিত্তিক খাবার

৭. চকোলেট (সাদা চকলেট নয়)

৮. কিছু মশলাযুক্ত খাবার ইত্যাদি।

* প্রতিরক্ষামূলক প্যাড বা অন্তর্বাস পরিধান করা। এটি একটি স্বল্পমেয়াদী সমাধান।

* ওজন কমানো – অতিরিক্ত ওজন মূত্রাশয়ের উপর চাপ ফেলে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব স্থুলকায় রোগীরা তাদের ওজনের দশ শতাংশ কমিয়েছে,  তাদের মূত্রাশয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ আগের চেয়ে প্রায় ৫০ শতাংশ উন্নত হয়েছে। নিয়মিত স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া ও ব্যায়াম এর মাধ্যমে অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।

আরও পড়ুনঃ গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা

* মূত্রাশয়ের পেশি শিথিল করার জন্য বেশ কিছু ব্যায়াম করতে পারেন।

১. কেগেল এক্সারসাইজ

ঘন ঘন প্রস্রাবের সমস্যা দূর করতে আপনার দৈনন্দিন রুটিনে কেগেল এক্সারসাইজ যোগ করুন। এই ব্যায়ামটি আপনার পেলভিক ফ্লোর মাসলগুলো শক্তিশালী করে। পাশাপাশি মূত্রাশয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ উন্নত করতে পারে।

২. কুইক ফ্লিকস বা দ্রুত ঝাঁকুনি

কুইক ফ্লিকস হলো যখন আপনি আপনার পেলভিক ফ্লোর মাসলগুলো বারবার দ্রুত চেপে শিথিল করেন। যখনই আপনি প্রস্রাবের তাগিদ অনুভব করবেন, তখন যদি এই ব্যায়াম করেন তাহলে ঘন ঘন প্রস্রাব করার যে তাগিদ, সেই অনুভূতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে। একজন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক আপনাকে এই ব্যায়াম শিখিয়ে দিতে পারেন।

৩. বায়োফিডব্যাক

বায়োফিডব্যাক নামক একটি কৌশল আপনাকে কেগেল এক্সারসাইজ আরও কার্যকরভাবে করতে সাহায্য করবে। বায়োফিডব্যাক পদ্ধতিতে আপনি কেগেল ব্যায়ামের সময় কোন পেশি সংকোচন করছেন, তা শনাক্ত করার উপায় আছে। এটি আপনাকে আপনার পেলভিক পেশিগুলো কীভাবে নাড়াচাড়া করে এবং তারা কতটা শক্তিশালী, তা শেখাতে সাহায্য করবে। এজন্য একজন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক এর শরণাপন্ন হতে পারেন।

৪. ইলেকট্রিকাল স্টিমুলেশন

ইলেক্ট্রিকাল স্টিমুলেশন বা বৈদ্যুতিক উদ্দীপনা আপনাকে আপনার মূত্রাশয়ের নিয়ন্ত্রণ পেতে সাহায্য করতে পারে। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসায় ইলেক্ট্রোথেরাপি নামক ট্রিটমেন্ট প্রটোকল এক্ষেত্রে আপনার জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।

আরও পড়ুনঃ রগে টান ধরার কারণ ও প্রতিকার

ঘন ঘন প্রস্রাবের চাপ হলে যা খাবেন

১. ফল

কলা, আপেল, আঙ্গুর, নারকেল,  তরমুজ, স্ট্রবেরি, ব্লাকবেরি ইত্যাদি।

২. শাকসবজি

অ্যাসপারাগাস, ব্রোকলি, শসা, গাজর, লেটুস, মরিচ ইত্যাদি।

৩. ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার

ডায়েটে উচ্চ ফাইবারযুক্ত খাবারগুলোও যোগ করা গুরুত্বপূর্ণ। ফাইবারযুক্ত খাবার কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে, যা মূত্রাশয়ের উপর অতিরিক্ত চাপ দিতে পারে। ফাইবার সমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে আছে মসুর ডাল, মটরশুঁটি, বার্লি, কাজুবাদাম ইত্যাদি।

৪. প্রোটিন

আপনার সামগ্রিক স্বাস্থ্যের জন্য প্রোটিন অপরিহার্য।  প্রোটিনের ভালো উৎসের মধ্যে রয়েছে: মাছ, মুরগি, টফু, ডিম ইত্যাদি।

৫. সাপ্লিমেন্ট বা সম্পূরক ও ভেষজ

সম্পূরক এবং ভেষজগুলি প্রাকৃতিক হতে পারে, তবে এগুলো গ্রহণের আগে অবশ্যই একজন পুষ্টিবিদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এড়াতে এটি সর্বোত্তম উপায়।

* এল-আরজিনিন

এল-আরজিনিন নামক অ্যামাইনো অ্যাসিড নাইট্রিক অক্সাইড তৈরি করতে সাহায্য করে। নাইট্রিক অক্সাইড লোয়ার ইউরিনারি ট্রাক্ট বা নিম্ন মূত্রনালির স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এল আরজিনিন সাপ্লিমেন্ট সহজলভ্য এবং বেশ কিছু খাবারেও এই অ্যামাইনো অ্যাসিড আছে, যেমন: মাংস ও দুগ্ধজাত পণ্য, আখরোট, নারিকেল, সয়াবিন, ছোলা ইত্যাদি।

তবে যদি আপনার আরজিনিনের প্রতি এলার্জি থাকে, কোন রক্তজনিত সমস্যা থাকে বা আপনি রক্ত পাতলা করার ওষুধ খাচ্ছেন, আপনার ডায়াবেটিস বা হাইপোগ্লাইসেমিয়া আছে, আপনি ইমিউন সিস্টেম ডিজঅর্ডারে ভুগছেন অথবা আপনার হাইপারক্যালেমিয়া আছে, তাহলে আপনার এই সম্পূরক এড়িয়ে চলা ভালো।

* পাম্পকিন সীডস বা কুমড়ার বীজ ও বীজের নির্যাস

কুমড়োর বীজে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে, যার প্রদাহ-বিরোধী বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কুমড়ার বীজের নির্যাস হলো ঘন ঘন প্রস্রাবের সমস্যার প্রতিকারের জন্য একটি জনপ্রিয় প্রাকৃতিক চিকিৎসা। সাম্প্রতিক গবেষণায় পাওয়া গেছে, কুমড়া বীজের তেল ঘন ঘন প্রস্রাবের সমস্যা কমাতে ও অন্যান্য প্রস্রাবজনিত ব্যাধির উপসর্গের চিকিৎসা করতে সক্ষম। গবেষকরা এ নিয়ে আরো বেশি কাজ করে যাচ্ছেন। আরেকটি জাপানি গবেষণায় দেখা গেছে যে কুমড়ার বীজ এবং সয়াবিন বীজের নির্যাস উল্লেখযোগ্যভাবে ঘন ঘন প্রস্রাবের সমস্যা হ্রাস করে।

আরও পড়ুনঃ মাথা ব্যথার কারণ

* ক্লেভার – এই গাছটি বহু শতাব্দী ধরে চর্মরোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কলিন্স অলটারনেটিভ হেলথ গাইড অনুসারে ক্লেভার গাছকে ‘ইউরিনারি হেলথ টনিক’ হিসেবে ধরা হয়। এদের প্রদাহ বিরোধী বৈশিষ্ট্য থাকার কারণে ঘন ঘন প্রস্রাবের সমস্যা খানিকটা উপশম করতে পারে।

* কোহকি চা

কোহকি চা দক্ষিণ চীনের একটি উপক্রান্তীয় উদ্ভিদের নির্যাস। এই মিষ্টি চায়ে উচ্চমাত্রায়

অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বিদ্যমান। নানা সমীক্ষায় পাওয়া গেছে, মূত্রাশয়ের উপর এর প্রতিরক্ষামূলক প্রভাব রয়েছে।

* অন্যান্য মূত্রাশয় বান্ধব পানীয়গুলির মধ্যে রয়েছে:

– বিশুদ্ধ খাবার পানি,

– সয়া দুধ,  যা গরুর দুধের চেয়ে বেশি মূত্রাশয় বান্ধব

– আপেল বা নাশপাতির জুস

– বার্লি জল

– ক্যাফেইন মুক্ত চা ইত্যাদি

তথ্যসূত্রঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This field is required.

This field is required.

পরামর্শ নিতে 01975451525