হাঁটু ব্যথা কেন হয়? দ্রুত সেরে উঠার উপায়

হাঁটু ব্যথা কেন হয় ? হাটুর জয়েন্টে ব্যথা দ্রুত কমানোর উপায় হাঁটু মানবদেহের একটি বড়, জটিল প্রকৃতির এবং গুরুত্বপূর্ণ জয়েন্ট, যা চলাফেরায় এবং শরীরের ওজন বহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফিমার (উরুর হাড়), টিবিয়া (শিনের হাড়) এর সাথে মিলিত হয়ে হাঁটুর জয়েন্ট তৈরি হয়, প্যাটেলা (হাঁটুর ক্যাপ) জয়েন্টের সামনে থাকে।

হাঁটু ব্যথা কেন হয়?

হাড়ঃ ফিমার, টিবিয়া এবং প্যাটেলা মিলে জয়েন্ট গঠিত হয়। এই হাড়গুলি জয়েন্টের কাঠামো তৈরি করে এবং মুভমেন্ট বা চলাফেরা করতে সাহায্য করে।

লিগামেন্টঃ হাঁটু বেশ কয়েকটি মূল লিগামেন্ট দ্বারা গঠিত হয়, যার মধ্যে রয়েছে অ্যান্টিরিয়র ক্রুসিয়েট লিগামেন্ট (ACL), পোস্টেরিয়র ক্রুসিয়েট লিগামেন্ট (PCL), মিডিয়াল কোল্যাটারাল লিগামেন্ট (MCL), এবং ল্যাটারাল কোল্যাটারাল লিগামেন্ট (LCL)। এই লিগামেন্টগুলি হাড়গুলিকে একে অপরের সাথে সংযুক্ত করে এবং জয়েন্ট কে শক্ত করে বেধে রাখে। । হাঁটু ব্যথা কেন হয়? দ্রুত সেরে উঠার উপায়

টেন্ডনঃ টেন্ডন হাড়ের সাথে মাংস পেশীকে সংযুক্ত করে। কোয়াড্রিসেপস টেন্ডন কোয়াড্রিসেপ পেশীকে প্যাটেলার সাথে সংযুক্ত করে এবং প্যাটেলার টেন্ডন প্যাটেলাকে টিবিয়ার সাথে সংযুক্ত করে।

কার্টিলেজঃ হাঁটুতে দুই ধরনের তরুণাস্থি থাকে।

  • মেনিস্কাস একটি সি-আকৃতির তরুণাস্থি, প্রতি হাঁটুতে দুইটি করে মিনিস্কাস থাকে, যা শিনবোন এবং উরুর হাড়ের মধ্যে স্প্রিং বা রাবার হিসেবে কাজ করে ।
  • আর্টিকুলার কার্টিলেজ ফিমার এবং টিবিয়ার উপরপ্রান্তে এবং প্যাটেলার পিছনে আবৃত থাকে, জয়েণ্টে হাটু ভাঁজ করার জন্য একটি মসৃণ, লুব্রিকেটেড পৃষ্ঠ তৈরি করে।

এই উপাদানগুলির প্রত্যেকটি হাঁটুর নড়াচড়া, যেমন বাঁকানো, সোজা করা এবং শরীরের ওজন বহন করার ক্ষেত্রে এক সাথে কাজ করে, বিশেষ করে হাঁটা, দৌড়ানো এবং লাফ দেওয়ার মতো কাজ করার ক্ষেত্রে।

হাঁটু ব্যথার সাধারণ কারণ

হাঁটুর ব্যথা তীব্র আঘাত বা দীর্ঘস্থায়ী ক্ষয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন উৎস থেকে হতে পারে। এই কারণগুলি বোঝা এবং সঠিক চিকিৎসা নেওয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

আঘাত জনিত কারণসমূহ

হাঁটু ব্যথা কেন হয়? দ্রুত সেরে উঠার উপায়

বিশেষ করে ক্রীড়াবিদ বা বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে বেশী দেখা যায় বা সড়ক দুর্ঘটনা এর কারনেও হতে পারে।

লিগামেন্ট ইঞ্জরিঃ হাঁটুর লিগামেন্ট, যেমন ACL, ছিঁড়ে যেতে পারে বা লিগামেন্টে টান লাগতে পারে । এই আঘাতগুলি প্রায়ই খেলাধুলার সাথে সম্পর্কিত এবং যার কারনে হাঁটু ব্যথা হতে পারে।

মিনিস্কাস টিয়ারঃ মিনিস্কাস ফিমার এবং টিবিয়া হাড়ের মধ্যে কুশন হিসেবে কাজ করে , কোনো কারনে যদি এতে বেশী চাপ পরে ফলে মিনিস্কাস টিয়ার হতে পারে। মিনিস্কাস টিয়ার হলে হাটু ব্যথা হয়, ফুলে যায় এবং হাঁটু নড়াচড়ায় বাধা দিতে পারে।

ফ্র্যাকচার বা ভেঙ্গে যাওয়াঃ হাঁটুর হাড় এবং প্যাটেলা সরাসরি আঘাতের ফলে ভেঙ্গে যেতে পারে। হাড় ভেংগে গেলে অর্থাৎ ফ্র্যাকচার হলে অবশ্যই অর্থোপেডিক সার্জন এর সরনাপন্ন হতে হবে।

হাড় সরে যাওয়াঃ যখন হাঁটুর হাড়গুলি কোনো কারনে জয়েন্ট লাইন থেকে সরে যায় এর ফলে লিগামেন্ট, স্নায়ু বা নার্ভে এমনকি রক্তনালীগুলির ক্ষতি করতে পারে এবং হাঁটু ব্যাথা হতে পারে।

ডিজেনারেটিভ কন্ডিশন

হাঁটু ব্যথা কেন হয়? দ্রুত সেরে উঠার উপায়

এটা দীর্ঘস্থায়ী ক্ষয়জনিত রোগ যেখানে মাংসপেশি ও হাড়ের কার্যক্ষমতা ও গঠন সময়ের সাথে সাথে খারাপের দিকে যায় এবং হাঁটুতে ব্যাথা করে ।

অস্টিওআর্থ্রাইটিসঃ এই অবস্থায় হাঁটুর জয়েন্টে তরুণাস্থি বা কার্টিলেজ ক্ষয় হয়ে যায় এবং জয়েন্ট এর ফাকা অংশ কমে যায়। এটি বয়স্ক ও ৪০ পরবর্তীদের হয়ে থাকে।

রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসঃ অটোইমিউন ডিজিজ যা জয়েন্টে প্রদাহ বা ইনফ্লামেশন সৃষ্টি করে যার ফলে ব্যথা হয়, হাঁটু ফুলে যায় এবং হাঁটুর মুভমেন্ট কমে যায়।

অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে ইঞ্জুরি

একই কাজ দীর্ঘ দিন ধরে করলে হাঁটুর উপরে চাপ পরে এবং হাঁটুর মাংশপেশী দুর্বল হয়ে যায় এবং হাটুতে ব্যাথা করে, যেমন মাংসপেশি ছিড়ে যেতে পাড়ে, বার্সাইটিস, টেন্ডনাইটিস, মাংশ পেশীর অসামঞ্জস্যতাসহ আরোও অন্যান্য সমস্যা দেখা দিতে পাড়ে। সাধারণত ক্রীড়াবিদ বা যারা বেশী খেলাধুলা করে এবং হাঁটুতে চাপ পরে এই ধরনের কাজ যারা বেশী করে তাদের ওভার ইউজ ইঞ্জরি বেশি হয়।

অন্যান্য কারন

হাঁটু জয়েন্টে প্রদাহ বা ইনফ্লামেশন জনিত সমস্যা যেমন সেপটিক আর্থ্রাইটিস জয়েন্টে আক্রমণ করতে পারে, যার ফলে ব্যথা, ফোলাভাব এবং লালভাব দেখা দেয় এবং হাঁটু ব্যাথা করতে পাড়ে। গাউট এবং সিউডো গাউট হলে হাঁটুতে ব্যথা হয় এবং হাঁটু ফুলে যায়।

এই প্রতিটি কারণ বিভিন্ন উপায়ে হাঁটুকে প্রভাবিত করে এবং ব্যাথা হয়। এই রোগ গুলোর চিকিৎসা, প্রতিকার ও কিভাবে প্রতিরোধ কারা যায় তা জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

যে ধরনের লক্ষণ থাকে

ব্যাথাঃ হাটুর সমস্যায় ব্যথা সবচেয়ে সুস্পষ্ট লক্ষণ, যার তীব্রতা এবং অবস্থান কারণের উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে। ব্যথা তীব্র প্রকৃতির বা মৃদু হতে পারে এবং হাঁটা, হাটু ভাঁজ করা বা ওজন বহন করার সময় আরও খারাপ হতে পারে ।

হাঁটু ফোলা ও শক্ত হয়ে যাওয়াঃ আঘাত বা প্রদাহের (ইনফ্লামেশন) কারণে হাঁটু ফুলে যেতে পারে ,লাল হয়ে যাওয়া এবং গরম হওয়া ও হাঁটু শক্ত হয়ে যেতে পাড়ে, হাঁটু বাঁকা করতে কষ্ট হতে পাড়ে এবং হাঁটুতে ব্যাথা হতে পাড়ে।

(পপিং বা ক্রাঞ্চিং) কট কট শব্দঃ এই শব্দগুলি হাঁটু জয়েন্টের তরুণাস্থি বা কার্টিলেজ ক্ষয় বা সমস্যা নির্দেশ করতে পারে।

কি ধরনের চিকিৎসা নিবেন

হাঁটুর ব্যথার চিকিৎসার মধ্যে ব্যাথার নির্দিষ্ট কারণ এবং ব্যাথার ধরনের উপর নির্ভর করে চিকিৎসা পদ্ধতি ঠিক করা হয় ।

কঞ্জারভেটিভ চিকিৎসা

হাঁটু ব্যথা কেন হয়? দ্রুত সেরে উঠার উপায়

(RICE): যেকোন আঘাতজনিত ব্যথায় তাৎক্ষণিকভাবে (বিশ্রাম নেয়া, বরফ দেয়া, কম্প্রেশন, উঁচু করে রাখা) এটি আদর্শ প্রাথমিক চিকিৎসা পদ্ধতি। হাঁটুর ব্যাথায় বিশ্রাম নিলে স্ট্রেনের মাত্রা কমে যায়, ২ঘণ্টা পর পর বরফ ব্যাবহার করলে হাঁটু ফোলা ও ব্যথা কমাতে সাহায্য করে, ব্যান্ডেজ দিয়ে কম্প্রেশন করে রাখলে ফোলা কমে যায়, এবং পা হার্ট লেভেলের উপরে উঁচু করে রাখলেও ফোলা এবং ব্যাথা কমে যায়।

ওষুধঃ একজন চিকিৎসক এর পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করা যেতে পাড়ে ,অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি ওষুধ, যেমন আইবুপ্রোফেন বা অ্যাসিটামিনোফেন, ব্যথা এবং প্রদাহ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর। আরও গুরুতর অবস্থার ক্ষেত্রে শক্তিশালী ওষুধগুলি একজন চিকিৎসক এর পরামর্শ নিয়ে সেবন করা উচিৎ।

ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা

হাঁটু ব্যথা কেন হয়? দ্রুত সেরে উঠার উপায়

ফিজিওথেরাপি চিকিৎসায় ম্যানুয়াল ও মেনুপুলেশন থেরাপি সহ বিভিন্ন ধরনের কৌশল বাবহার করে মেকানিক্যাল কারেকশন করা হয় যার করনে ব্যাথা দ্রুত কমে যায় এবং ভবিষ্যতে ব্যাথা হওয়ার প্রবনতা কমে যায় । একজন ফিজিওথেরাপিস্ট হাঁটুর চারপাশের পেশীগুলিকে শক্তিশালী করতে, নমনীয়তা বাড়াতে এবং হাটার ব্যালেন্স ঠিক রাখতে সুস্পষ্ট ভুমিকা পালন করতে পারেন। ব্যাথার কারণ ও ধরনের উপর নির্ভর করে উপযোগী নির্দিষ্ট এক্সারসাইজ হাঁটুর কাজ করার ক্ষমতা বাড়ায় এবং ব্যথা কমাতে সাহায্য করে পারে। যেমন হাঁটুর বিভিন্ন ধরনের স্ট্রেচিং, পেশীর শক্তি বাড়ানোর এক্সারসাইজ এবং রেঞ্জ-অফ-মোশন এক্সারসাইজসহ বিভিন্ন ধরনের কারেকশনথেরাপী থাকতে পারে।

গুরুতর সমসার জন্য অস্ত্রোপচার বা সার্জারি

হাঁটু ব্যথা কেন হয়? দ্রুত সেরে উঠার উপায়

যেসব ক্ষেত্রে কঞ্জারভেটিভ চিকিৎসা কার্যকর নয় বা গুরুতর আঘাত রয়েছে সে ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার (সার্জারি) প্রয়োজন হতে পারে। যেমন লিগামেন্ট ছিড়ে গেলে মেরামত করার জন্য আর্থ্রোস্কোপিক সার্জারি করা হয়।

লাইফস্টাইল পরিবর্তনের গুরুত্ব

ওজন নিয়ন্ত্রনঃ অতিরিক্ত ওজন হাঁটুতে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। কম ওজন ব্যথা কমাতে সাহায্য করে এবং জয়েন্টের ক্ষতি ও ক্ষয় প্রতিরোধ করতে পারে, বিশেষ করে অস্টিওআর্থ্রাইটিস এ আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে।

একটিভিটি পরিবর্তনঃ হাঁটুর ব্যথাকে বাড়িয়ে দেয় এমন ক্রিয়াকলাপ এড়িয়ে যাওয়া এবং সাঁতার বা সাইকেল চালানোর মতো এক্সারসাইজ নিয়মিত করা।

উপযুক্ত জুতো ব্যাবহারঃ সঠিক মাপের জুতো আমাদের সঠিক ভাবে চলতে সাহায্য করে এবং হাঁটুর চাপ কমাতে সাহায্য করতে পারে।

পুষ্টিকর খাবার গ্রহণঃ ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন ডি যুক্ত খাবার হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সবুজ শাক-সবজি ও ফলমূল প্রদাহ (ইনফ্লামেশন) কমাতে সাহায্য করে।

সামগ্রিকভাবে, হাঁটুর ব্যথার চিকিৎসার জন্য বহুমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন।

তথ্যসূত্র

  1. Petersen, W. and Zantop, T., 2007. Anatomy of the anterior cruciate ligament with regard to its two bundles. Clinical Orthopaedics and Related Research®, 454, pp.35-47. https://journals.lww.com/clinorthop/Fulltext/2007/01000/Anatomy_of_the_Anterior_Cruciate_Ligament_with.9.aspx
  2. Fox, A.J., Bedi, A. and Rodeo, S.A., 2012. The basic science of human knee menisci: structure, composition, and function. Sports health, 4(4), pp.340-351. https://journals.sagepub.com/doi/abs/10.1177/1941738111429419
  3. Griffin, L.Y., Agel, J., Albohm, M.J., Arendt, E.A., Dick, R.W., Garrett, W.E., Garrick, J.G., Hewett, T.E., Huston, L., Ireland, M.L. and Johnson, R.J., 2000. Noncontact anterior cruciate ligament injuries: risk factors and prevention strategies. JAAOS-Journal of the American Academy of Orthopaedic Surgeons, 8(3), pp.141-150. https://journals.lww.com/jaaos/fulltext/2000/05000/noncontact_anterior_cruciate_ligament_injuries_.1.aspx
  4. Englund, M., Guermazi, A., Gale, D., Hunter, D.J., Aliabadi, P., Clancy, M. and Felson, D.T., 2008. Incidental meniscal findings on knee MRI in middle-aged and elderly persons. New England Journal of Medicine, 359(11), pp.1108-1115. https://www.nejm.org/doi/full/10.1056/NEJMoa0800777
  5. McInnes, I.B. and Schett, G., 2011. The pathogenesis of rheumatoid arthritis. New England Journal of Medicine, 365(23), pp.2205-2219. https://www.nejm.org/doi/full/10.1056/NEJMra1004965
  6. Bleakley, C., McDonough, S. and MacAuley, D., 2004. The use of ice in the treatment of acute soft-tissue injury: a systematic review of randomized controlled trials. The American journal of sports medicine, 32(1), pp.251-261. https://journals.sagepub.com/doi/abs/10.1177/0363546503260757
  7. McAlindon, T.E., Bannuru, R., Sullivan, M.C., Arden, N.K., Berenbaum, F., Bierma-Zeinstra, S.M., Hawker, G.A., Henrotin, Y., Hunter, D.J., Kawaguchi, H. and Kwoh, K., 2014. OARSI guidelines for the non-surgical management of knee osteoarthritis. Osteoarthritis and cartilage, 22(3), pp.363-388. https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S1063458414000168
Dr. Sapia Akter
পরামর্শ নিতে 01877733322