হাঁটু ব্যথা কমানোর উপায়. হাঁটু ব্যথা এমন একটি সমস্যা যা বিভিন্ন বয়সের ব্যক্তিদের মধ্যে আমরা কম বেশী দেখতে পারি। হাঁটু ব্যথা বিভিন্ন কারণে হতে পারে। তীব্র আঘাত থেকে শুরু করে বাতের মতো রোগের কারণেও হাঁটু ব্যথা হতে পাড়ে। দিনে দিনে হাঁটুর ব্যথার প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিশেষ করে বয়স্কদের এবং হাঁটুতে চাপ পরে এমন কাজকর্ম যারা বেশী করে থাকেন। হাঁটু ব্যথা হলে চলফেরার গতি এবং দৈনন্দিন কাজকর্মে ব্যঘাত ঘটে পরে।
হাঁটু ব্যথা কমানোর উপায়
হাঁটু ব্যথার সঠিক চিকিৎসা না হলে ব্যথাটি সহজে সেড়ে যায়না এবং যত দিন যায় কাজ করার ক্ষমতা তত কমতে থাকে। এই আলোচনায় আমরা জানবো হাঁটুর ব্যথা থেকে কিভাবে পরিত্রাণ পাওয়া যায় এবং কিভাবে চললে হাটু ব্যথা হবার সম্ভাবনা কমে যায়। হাঁটু ব্যথার চিকিৎসা
হাঁটুর গঠন এবং কার্যকারিতা
হাঁটু শরীরের সবচেয়ে জটিল জয়েন্টগুলির মধ্যে একটি। হাঁটুর জয়েন্ট ফিমার (উরুর হাড়), টিবিয়া (শিনের হাড়) এবং প্যাটেলা (হাঁটুর ক্যাপ) নিয়ে গঠিত। এতে তরুণাস্থি, লিগামেন্ট এবং টেন্ডন রয়েছে যা স্থিতিশীলতা এবং নড়াচড়া করতে একসাথে কাজ করে। কার্টিলেজ ও মিনিস্কাস কুশন বা স্প্রিং এর মত কাজ করে। লিগামেন্টগুলি হাড়কে সংযুক্ত করে বা বেধে রাখতে সাহায্য করে এবং স্থিতিশীলতা প্রদান করে এবং টেন্ডনগুলি হাড়ের সাথে পেশীকে সংযুক্ত করে, চলাচলে সহায়তা করে। হাঁটুর ব্যথার কারণ শনাক্ত করার জন্য হাঁটুর কাঠামো বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
হাঁটু ব্যথার সাধারণ কারন
আর্থ্রাইটিসঃ গবেষণায় দেখা গিয়েছে হাটু ব্যথার জন্য অস্টিওআর্থ্রাইটিস সবচেয়ে বেশি দায়ী। এছারাও রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, অটোইমিউন ডিজিজ এর কারণেও হাঁটু ব্যথা হতে পাড়ে।
ইনজুরিঃ হাঁটুর লিগামেন্ট ইনজুরি (ACL, MCL), মিনিস্কাস টিয়ার, এবং ফ্র্যাকচার।
ওভার ইউজ ইনজুরিঃঅ্যাথলেট বা যে সকল পেশায় হাঁটুর ব্যবহার বেশি হয় তাদের হাটু ব্যথা বেশি হয়। অন্যান্য কারণগুলির মধ্যে রয়েছে এছাড়াও বার্সাইটিস, টেন্ডোনাইটিস এবং বেকারস সিস্ট এর কারণেও হাটু ব্যথা হয়।
হাটু ব্যথার চিকিৎসা
ওষুধের চিকিৎসা
ব্যথার ওষুধঃ যে ওষুধগুলি প্রায়ই হাঁটু ব্যথা কমানোর জন্য ব্যবহৃত হয়
ওভার-দ্য-কাউন্টার (OTC) ওষুধঃ ননস্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ড্রাগ (NSAIDs) যেমন Ibuprofen এবং Naproxen প্রদাহ এবং ব্যথা কমায় যা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে খওয়া যেতে পাড়ে।
প্রেসক্রিপশন ওষুধঃ গুরুতর ব্যথার জন্য, চিকিৎসক শক্তিশালী NSAIDs, অপয়েডস, বা অন্যান্য ব্যথার ওষুধ প্রয়োজন অনুযায়ী দিতে পারেন।
ইনজেকশনঃ স্টেরয়েড এবং হায়ালুরোনিক অ্যাসিড ইনজেকশন হাঁটু ব্যথা থেকে মুক্তি দিতে পারে। কর্টিকোস্টেরয়েড ইনজেকশন প্রদাহ কমায় এবং অস্থায়ী ব্যথা উপশম করে।
হায়ালুরোনিক অ্যাসিড ইনজেকশন জয়েন্টের সাইনোভিয়াল ফ্লুইড এর ঘাটতি কমায়, জয়েন্টের লুব্রিকেশন বাড়ায় এবং ব্যথা কমায়।
ফিজিওথেরাপি এবং পুনর্বাসন
ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা হাঁটুর ব্যথা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ব্যথা এবং প্রদাহ বা ইনফ্লামেশন কমানোঃ ঠান্ডা বা গরম সেক, আল্ট্রাসাউন্ড থেরাপী ব্যথা ও প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।
জয়েন্টের মুভমেন্ট এবং নমনীয়তাঃ সঠিক এক্সারসাইজ এবং স্ট্রেচিং জয়েন্টের কাঠামকে ঠিক রাখতে সাহায্য করে। জয়েন্টকে আরও ভাল রাখার জন্য হাঁটুর চারপাশের পেশীগুলিকে শক্তিশালী করন এক্সেরসাইজ করা যেতে পাড়ে। ফিজিওথেরাপী চিকিৎসক হাটু ব্যথার রোগীদের ব্যথা এবং ক্ষতির মাত্রা কমিয়ে তাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম বা খেলাধুলায় ফিরে যেতে সাহায্য করেন।
এক্সারসাইজ
মাংস পেশী শক্তিশালী করার এক্সারসাইজঃ হাঁটুর চারপাশের পেশীগুলির শক্তি বাড়ানো এক্সারসাইজ করা যেতে পাড়ে যেমন কোয়াড্রিসেপ এবং হ্যামস্ট্রিং এর।
রেঞ্জ–অব–মোশনএক্সারসাইজঃ হাঁটুর নমনীয়তা বজায় রাখার মাধ্যমে হাটুর রেঞ্জ বাড়ানো ।
ব্যালেন্স এক্সারসাইজঃ হাটার ব্যালেন্স উন্নত করা এবং পরে যাওয়া রোধ করার জন্য ব্যালেন্স ট্রেনিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
স্ট্রেচিংঃ হাঁটুর নমনীয়তা উন্নত করতে এবং হাঁটুর পেশীর টান কমাতে সাহায্য করে।
দীর্ঘস্থায়ী হাঁটু ব্যথার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পুনর্বাসন কৌশল
পেশী শক্তি এবং জয়েন্টের স্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য নিয়মিত এক্সারসাইজ করা যেতে পাড়ে।হটুতে যাতে চাপ কম পরে সেই ধরনের কৌশল শিখিয়ে দেওয়া এবং সঠিক পোশ্চার মেইনন্টেন করা। একজন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক সাথে নিয়মিত ফলো-আপ রাখা। প্রয়োজন অনুযায়ী এক্সারসাইজ প্রোগ্রামগুলি মডিফাই করা।
সব থেকে ভালো হয় একজন অভিজ্ঞ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক এর কাছ কারেকশন থেরাপি চিকিৎসা নেওয়া, কারেকশন থেরাপিতে ম্যানুয়াল ও ম্যানুপুলেশন এবং বিভিন্ন ধরেনের টেকনিক ব্যবহার করে মাক্যানিকাল কারেকশন করা হয় । এর ফলে ব্যথা কমে যায় এবং ভবিষ্যতে ব্যথা হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যায় । কারেকশন থেরাপি চিকিৎসায় রুগিরা তাড়াতাড়ি ভাল হয় এবং রুগিরা প্রতিদিনের কাজ সহজ ভাবে করতে পারে, যেমন হাঁটু ভেঙ্গে নামাজ পড়া, টয়লেটে বসা, সিঁড়ি উঠানামা করা ।
আমাদের দেশের সরকারি বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে আপনারা এই ফিজিওথেরাপী সেবাটি নিতে পারেন। সেসবের মধ্যে বেসরকারি পর্যায়ে যারা ম্যানুয়াল থেরাপী নিয়ে কাজ করেন তারা হচ্ছেন পক্ষাঘাতগ্রস্থদের পুনর্বাসন কেন্দ্র (সিআরপি) এবং এএসপিসি ম্যানিপুলেশন থেরাপী সেন্টার (ASPC) সহ অন্যান্য প্রতিস্থান আছে। ASPC ম্যানিপুলেশন থেরাপী সেন্টার তে কারেকশন থেরাপী সেবা নেয়ার মাধ্যমে যেসকল রোগীরা হাটু ব্যথার কারণে চলাফেরা করতে সমস্যা হয় দাড়াতে পারেন না, কিংবা লিগামেন্ট ইনজুরি পরবর্তী হাটু ব্যথা অল্প সময়ের মধ্যে ভাল হয়ে যায় এবং প্রত্যেকেই ব্যথামুক্তভাবে যার যার কাজে ফিরে যেতে পারেন।
সার্জারি বা হাটুর অপারেশন
কখন সার্জারি করা জরুরী
বড় ধরনের দুর্ঘটনায় যদি হাটুর হাড় ভেঙ্গে যায়, লিগামেন্ট স্প্রেইন বা স্ট্রেইন হয় অথবা দীর্ঘদিনের বাতজনিত কারণে যদি হাটু নষ্ট হয়ে যায় তাহলে অপারেশন করা জরুরী।
হাঁটু সার্জারিঃ আর্থ্রোস্কোপি, হাঁটু প্রতিস্থাপন ধরনের হাটুর অপারেশন হয়ে থাকে।
করা হয়।
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
হাঁটুর ব্যথা এবং ব্যথা সম্পর্কিত জটিলতার ঝুঁকি এরাতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুস্বাস্থ্য বজায় রাখা, আঘাত এড়ানো, এবং ক্ষয়জনিত হাঁটুর রোগের কারন হয়ে দারায় তা নির্ণয় এবং নির্মূল করা খুব প্রয়োজন।
খেলাধুলা এবং দৈনন্দিন কাজকর্ম করার সময় হাঁটু ব্যাথা রক্ষা করতে আপনি কি করবেন
ওয়ার্ম–আপঃ খেলাধুলা বা ভারি কোনো কাজের আগে যথাযথ ওয়ার্ম-আপ করা বা শরীরকে এক্সারসাইজ এর মাধমে রেডি করে রাখা, এতে করে ইনজুরির ঝুকি কমে যায়।
প্রতিরক্ষামূলক ডিভাইজ ব্যবহারঃ যেমন খেলাধুলার সময় বা ভারি কাজের হাঁটুর প্যাড বা নিক্যাপ বাবহার করলে ইনজুরি থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে।
টেকনিকঃহাঁটুতে যাতে কম চাপ পরে সেই ভাবে কাজ করা উচিৎ এবং সঠিক পোশ্চার মেনে কাজ করলে হাঁটু ব্যাথা হওয়ার ঝুকি কম থাকে ।
লাইফস্টাইল পরিবর্তন
ওজন নিয়ন্ত্রনঃ শরীরের অতিরিক্ত ওজন হাঁটুর জয়েন্টগুলিতে চাপ বাড়িয়ে দেয়। ওজন কম থাকলে জয়েন্টগুলোতে কম চাপ পড়ে এবং হাঁটুর ব্যথাকে কমাতে সাহায্য করে। বিশেষ করে যাদের অস্টিওআর্থ্রাইটিস আছে তাদের শরীরের অতিরিক্ত ওজন ব্যথা বাড়িয়ে দেয় এবং ওজন হ্রাস করলে জয়েন্টের ক্ষয়ের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে।
ডায়েটঃ পুষ্টিকর খাদ্য প্রদাহ বা ইনফ্লামেশন প্রতিরোধ করতে সাহায্য করতে পারে। সুষম খাদ্য ব্যথা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আন্টি–ইনফ্লামেটরিখাবারঃ ওমেগা -3 ফ্যাটি অ্যাসিড (মাছ, বাদাম এবং বীজ পাওয়া যায়), ফল এবং শাকসবজি (অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ) খাবার। এ খাবারগুলো খেলে শড়ীরের প্রদাহের মাত্রা কমে যায়।
হাড় মজবুতকারী খাবারঃদুগ্ধজাত দ্রব্য এবং শাক-সবজিতে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন ডি থাকে। এই দুটি উপাদান আমাদের হাড়কে মজবুত রাখে।
ইনফ্লামেটরি খাবার এড়িয়ে চলাঃ প্রক্রিয়াজাত খাবার, পরিশোধিত শর্করা এবং স্যাচুরেটেড ফ্যাট আর ট্রান্স ফ্যাট (মাখন, ঘি, মাংস, পনির, দুধ, আইসক্রিম ইত্যাদি) বেশী পরিমাণ খেলে তা থেকে উচ্চ ঘনত্বের লিপোপ্রোটিন কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেড়ে যায়। এসব খাবার আমাদের শরীরের হিলিং প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। সুতরাং শরীরের হিলিং প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করতে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড (মাছ, বাদাম এবং বীজে পাওয়া যায়), ফল ও শাকসবজি ইত্যাদি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া উচিৎ।
এক্সারসাইজ এবং ফিজিক্যাল একটিভিটি
হাঁটুর ব্যথা কমাতে সঠিক এক্সেরসাইজ বেছে নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
লো–ইমপ্যাক্ট এক্সারসাইজঃসাঁতার, সাইকেল চালানো এবং নিয়মিত হাঁটা এই এক্সারসাইজ করলে হাঁটুতে অতিরিক্ত চাপ পরে না এবং পেশীকে শক্তিশালী করে। উরুরপেশীর শক্তি বাড়ানোর এক্সারসাইজ, স্ট্রেচিং এক্সারসাইজ এবং যোগব্যায়াম বা ইয়োগা করা যেতে পারে।
হাঁটুর চাপ কমাতে আর্গোনোমিক অ্যাডজাস্টমেন্টের ভূমিকা
দৈনন্দিন জীবন এবং কাজের পরিবেশে, আর্গোনোমিক সমন্বয় সাহায্য করতে পারে:
বসনের অবস্থান সামঞ্জস্য করুনঃ দীর্ঘ সময় ধরে বসে থাকার সময় হাঁটুতে যাতে চাপ না পড়ে তা নিশ্চিত করা এবং প্রয়জনে বসার যায়গাকে কে সংশোধন করা।
পাদুকাঃ উপযুক্ত পাদুকা পরিধান করে চলাফেরা করলে হাটুর জন্য আরামদায়ক হবার পাশাপাশি হাঁটুতে কম চাপ পরে।
ভারি বস্তু উত্তোলনের কৌশলঃ ভারী বস্তু উত্তোলনের সময় হাঁটুর চাপ এড়াতে সঠিক পদ্ধতি ব্যবহার করা।
উচ্চ–প্রভাবমূলক ক্রিয়াকলাপগুলি এড়িয়ে চলুন: যে কাজ গুলো জয়েন্টে প্রচুর চাপ দেয়, যেমন দৌড়ানো বা লাফানো এগুলো ব্যথার কারণ হতে পারে তাই এই কাজ গুলো সীমিত করা উচিত।