স্ট্রোকের পর অনেক লক্ষণ ও পরিবর্তন দেখা দেয় যা সহজেই ধরা যায় না। গবেষণায় দেখা গেছে মাইনর স্ট্রোকের পরেও অল্প বয়সী রোগীদের মধ্যে স্নায়বিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতা প্রায়শই থেকে যায় (Vlachos et al., 2021)। চলাফেরায় অসুবিধা না থাকলেও রোগীরা অনেক সময় চোখের সমস্যা, মানসিক চাপ এবং হতাশার মতো সমস্যা নিয়ে জীবনযাপন করতে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ, স্ট্রোকের এক বছর পর অনেক রোগীর মনোযোগ, স্মৃতি, মানসিক চাপ গ্রহনের ক্ষমতা কমে যায় (Vlachos et al., 2021)। এই ধরনের সমস্যাগুলো চিহ্নিত না হলে রোগী ও পরিবারের জন্য পুনর্বাসন বা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়া প্রায় জটিল হয়ে উঠে। তাই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হল স্ট্রোকের পরে নিয়মিত কগনিটিভ ও মানসিক নীরিক্ষা করা, যাতে এই সমস্যাগুলি সময়মতো শনাক্ত ও সমাধান করা যায় (Vlachos et al., 2021)।
স্ট্রোকের পর সঠিক সময়ে সঠিক পুনর্বাসন চিকিৎসা না নেয়ার কারনে মাইনর স্ট্রোক হলেও আক্রান্ত ব্যক্তি তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারে না। কিন্তু মস্তিষ্কের কার্যকারিতা পুনরুদ্ধারের সর্বোত্তম সময় স্ট্রোকের পরের প্রথম কয়েক সপ্তাহ, যখন মস্তিষ্ক স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনর্গঠনের জন্য প্রস্তুত থাকে (Salter et al., 2006)। গবেষণা অনুযায়ী স্ট্রোকের ৩০ দিনের মধ্যে পুনর্বাসন শুরু করলে কার্যক্ষমতার উন্নতি বেশি হয় এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশেই বেড়ে যায় (Salter et al., 2006)। অর্থাৎ, পুনর্বাসন বিলম্বিত হলে রোগীর সুস্থতা লাভের সম্ভাবনা কমে যায় এবং অতিরিক্ত জটিলতা দেখা দিতে পারে।
স্ট্রোক পরবর্তী ম্যানুয়াল থেরাপির ভূমিকা

স্ট্রোক পুনর্বাসনে সঠিক অ্যাসেস্মেন্টের মাধ্যমে ম্যানুয়াল থেরাপি চিকিৎসা গ্রহনের করলে নিউরোপ্লাস্টিসিটি (মস্তিষ্কের পুনর্গঠন ক্ষমতা) বৃদ্ধি করা যায়। বাস্তবিকভাবে নিউরোপ্লাস্টিসিটি স্ট্রোক পুনর্বাসনের অন্যতম প্রধান ভিত্তি। এই চিকিৎসা মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের কাঠামো ও কার্যক্রমে পরিবর্তন আনতে সক্ষম – যা রোগীর কার্যক্ষমতা ফিরে পেতে সহায়তা করে।
বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণা ম্যানুয়াল থেরাপির উপকারিতা প্রমাণ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, একটি পর্যালোচনায় দেখা গেছে যে হাতে স্ট্রেচিং, জয়েন্ট মবিলাইজেশন,স্ট্রেন্থ ট্রেনিং ও সেন্সরি স্টিমুলেশন প্রয়োগ করলে হাতের কার্যকারিতার উন্নতি সম্ভব । আরেকটি গবেষণায় লক্ষ্য করা গেছে যে বিশেষ ম্যানুয়াল থেরাপি কৌশল (যেমন ইন্সট্রুমেন্ট–অ্যাসিস্টেড নিউরোমোবিলাইজেশন) ব্যবহারে প্যারালাইসিস রোগীর স্পাস্টিক মাংসপেশিকে নিষ্ক্রিয় করা এবং দুর্বল মাংসপেশিকে সক্রিয় করা সম্ভব হয়েছে (Winter et al., 2011) । ঐ গবেষনাতে দেখা গেছে স্ট্রোক আক্রান্ত পায়ের স্পাস্টিসিটি ৪৩% কমানো গেছে এবং দুর্বল পেশীর কার্যক্ষমতা ১৫০% বৃদ্ধি পেয়েছে; ফলস্বরূপ নড়াচড়ার ভারসাম্য উন্নত হয়েছে (Winter et al., 2011)। এ ধরণের নিউরাল মোবিলাইজেশন কৌশল স্পাস্টিক পেশির অস্বাভাবিক উদ্দীপনাকে কমিয়ে রোগীর চলাচলের গতি-নিয়ন্ত্রণ উন্নত করতে পারে, যা হাঁটা-চলার ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক (Winter et al., 2011)।
ম্যানুয়াল থেরাপি স্ট্রোক-পরবর্তী ব্যথা ব্যবস্থাপনাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে হেমিপ্লেজিক কাঁধে ব্যথা (পক্ষাঘাতগ্রস্ত হাতের কাঁধে ব্যথা) স্ট্রোকের সাধারণ জটিলতা, যা অস্বাভাবিক টান ও অচল অবস্থার কারণে হয়। ক্লিনিক্যাল গাইডলাইন অনুযায়ী এ ধরনের কাঁধের ব্যথা উপশমে স্ট্রেচিং ও জয়েন্ট মোবিলাইজেশন অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে। ম্যানুয়াল থেরাপি পেশি ও জয়েন্টের কর্মক্ষমতা বাড়িয়ে ব্যথা কমায় এবং দৈনন্দিন কাজ করা সহজ করে। এমনকি নিউরাল মোবিলাইজেশন কৌশলগুলি শুধু নড়াচড়া বৃদ্ধিই করে না, বরং গবেষণায় দেখা গেছে যে এই চিকিৎসায় স্পাস্টিক পেশির অস্বাভাবিক ইলেকট্রিক সংকেত হ্রাস করতে এবং ব্যথার অনুভূতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম (Tedeschi, 2025)। সুতরাং স্ট্রোক রোগীর ব্যথা ও স্পাস্টিসিটি নিয়ন্ত্রণে ম্যানুয়াল থেরাপি একটি মূল্যবান সংযোজন, যা ওষুধ বা অন্যান্য চিকিৎসার পাশাপাশি রোগীর পুনর্বাসন দ্রুত করতে এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সহায়তা করে।
ASPC-এর সাফল্য গাথা: স্ট্রোক পুনর্বাসনের নতুন দিগন্তে

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে Agrani Specialized Physiotherapy Centre (ASPC) একটি অগ্রগামী প্রতিষ্ঠান, যা স্ট্রোকসহ বিভিন্ন ব্যথা জনিত সমস্যার ফিজিওথেরাপিতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ২০০৬ সালে ডা. এম. শাহাদাত হোসেন ও ডা. সাপিয়া আক্তারের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত এই কেন্দ্রটি ধীরে ধীরে দেশের অন্যতম সেরা ফিজিওথেরাপি ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ASPC তার নিবেদিত থেরাপি সেবা ও পরিচর্যার মাধ্যমে দেশে পুনর্বাসন চিকিৎসায় নতুন মানদণ্ড স্থাপন করেছে। প্রতিষ্ঠার পর ক্ষুদ্র পরিসর থেকে শুরু করে আজ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার পেছনে রয়েছে তাদের মানসম্মত সেবা, আধুনিক কৌশলের প্রয়োগ এবং রোগীকে একনিষ্ঠভাবে সেবা দেয়ার দক্ষতা।
ASPC ম্যানিপুলেশন থেরাপি সেন্টারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এখানে উন্নত ম্যানুয়াল থেরাপি কৌশলগুলোর (SDM টেকনিক) ব্যবহার, বিশেষ করে জটিল ও ক্রনিক সমস্যাগুলোর সমাধানে। এখানে অভিজ্ঞ ফিজিওথেরাপিস্টরা স্পাইনাল অ্যালাইনমেন্ট ও স্নায়বিক কার্যক্রম পুনর্গঠনের জন্য আধুনিক ম্যানুয়াল এবং ম্যানিপুলেশন থেরাপি প্রয়োগ করেন।
ASPC তে অন্যান্য সাধারণ ম্যানুয়াল থেরাপি (যেমন জয়েন্ট মোবিলাইজেশন, মায়োফ্যাসিয়াল রিলিজ, প্রোপ্রিওসেপ্টিভ নিউরোমাসকুলার ফ্যাসিলিটেশন ইত্যাদি) ব্যবহার করা হয় রোগীর সমস্যা অনুযায়ী। প্রতিটি রোগীর জন্য তাদের সমস্যা, বয়স এবং সহনশীলতা বিবেচনা করে পৃথক থেরাপি পরিকল্পনা তৈরি করা হয়।
গবেষণা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে স্ট্রোক রোগীর করণীয়

উপরের আলোচনার আলোকে স্ট্রোক পুনর্বাসনে নিম্নলিখিত দিকনির্দেশনা প্রস্তাব করা যায়, যা সাম্প্রতিক গবেষণা প্রমাণ এবং ক্লিনিক্যাল অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রণীত:
- দ্রুত চিকিৎসা নিশ্চিত করা: স্ট্রোকের পর যত দ্রুত সম্ভব রোগীর সঠিক অ্যাসেসমেন্টের মাধ্যমে পুনর্বাসন চিকিৎসা শুরু করুন। শারীরিক অক্ষমতার পাশাপাশি কগনিটিভ ও মানসিক সমস্যাগুলোর জন্য স্ক্রিনিং অত্যন্ত জরুরি, যাতে হতাশা, উদ্বেগ, স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া ও ফ্যাটিগ এর মতো সমস্যা শুরুতেই ধরতে পারা যায় (Vlachos et al., 2021)। দ্রুতপুনর্বাসন ও থেরাপি শুরু করলে মস্তিষ্কের পুনর্গঠনের সুবিধা বেশি মেলে এবং কার্যক্ষমতার দ্রুত উন্নতি সম্ভব (Salter et al., 2006)।
- ম্যানুয়াল থেরাপিকে পুনর্বাসনের অংশ করুন: বিশেষজ্ঞ থেরাপিস্ট দ্বারা স্পাইনাল ম্যানিপুলেশন, জয়েন্ট মোবিলাইজেশন, নিউরোমোবিলাইজেশন ইত্যাদি প্রয়োগ করলে পেশি ও স্নায়ুর নমনীয়তা বাড়ে, ব্যথা কমে এবং দ্রুত কর্মক্ষমতা ফিরে পেতে সাহায্য হয় (Winter et al., 2011)।
- বহুমুখী চিকিৎসা পরিকল্পনা: প্রতিটি স্ট্রোক রোগীর ধরণ আলাদা। তাই ফিজিওথেরাপি, স্পীচ থেরাপি এবং ম্যানুয়াল থেরাপির সমন্বয়ে সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা পরিকল্পনা তৈরি করুন। একই সঙ্গে রোগীকে মানসিক সহায়তা ও উৎসাহ দেয়া জরুরি, কারণ ইতিবাচক মানসিক অবস্থা পুনর্বাসন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।
পরিশেষে বলা যায়, স্ট্রোক পুনর্বাসনে ম্যানুয়াল থেরাপি একটি শক্তিশালী চিকিতসা পদ্ধতি, যা রোগীর শারীরিক কর্মক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে, ব্যথা ও স্পাস্টিসিটি কমাতে এবং মস্তিষ্কের পুনর্গঠন প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। আধুনিক গবেষণা ও দেশীয় অভিজ্ঞতার আলোকে, ASPC ম্যানিপুলেশন থেরাপি সেন্টারের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো সফল ভাবে পুনর্বাসন সেবা প্রদানের উদাহরণ স্থাপন করেছে। যথাসময়ে সঠিক পদক্ষেপ, বহুমুখী থেরাপির সমন্বয় এবং যত্নের মাধ্যমে স্ট্রোক রোগী ফিরে পেতে পারে স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ, আর এই যাত্রায় ম্যানুয়াল থেরাপি ও গবেষণাভিত্তিক চর্চা হতে পারে একনিষ্ঠ পথপ্রদর্শক।
- পেটের বাম পাশে ব্যথা কমানোর উপায় - June 19, 2025
- কোমরের দুই পাশে ব্যথার কারণ কী? - June 19, 2025
- মহিলাদের মধ্যে স্ট্রোক: ঝুঁকি এবং প্রতিরোধ - June 18, 2025