পিঠে ব্যথার কারণ ও করণীয়। পিঠে ব্যথা (Back Pain) একটি সাধারণ শারীরিক সমস্যা যা বিভিন্ন কারণে হয় এবং প্রায় প্রতিটি বয়সের মানুষের মধ্যে কোমর ব্যথা হতে দেখা যায়। পিঠে ব্যথার মূল কারণ গুলির মধ্যে রয়েছে মাংসপেশির টান বা আঘাত লাগা, ভারী বস্তু তোলা, মেরুদণ্ডের গঠনগত সমস্যা, যেমন ডিস্কের সমস্যা (হার্নিয়েটেড ডিস্ক) এবং বিভিন্ন ধরণের আথ্রাইটিস (অস্টিওআর্থ্রাইটিস) ইত্যাদি।

পিঠে ব্যথার কারণ ও করণীয়

দীর্ঘ মেয়াদী ব্যথার ক্ষেত্রে, মেরুদণ্ডে অস্টিওপরোসিস বা মেরুদণ্ডের স্নায়ুর প্রদাহের কারণেও পিঠে ব্যথা হতে পারে। এছাড়া, কায়িক শ্রমের অভাব, অস্বাস্থ্যকর ভংগিতে বসা, অতিরিক্ত ওজন এবং মানসিক চাপও পিঠে ব্যথার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রায় ৮০% মানুষ জীবনের কোনো এক সময়ে পিঠে ব্যথায় ভুগে থাকেন, যা জীবন যাত্রার মান কে মারাত্মক ভাবে প্রভাবিত করতে পারে ()।

পিঠের মাঝখানে ব্যথার কারণ

পিঠের মাঝ খানে ব্যথা (Mid-back Pain) সাধারণত মেরুদণ্ডের থোরাসিক (thoracic) অঞ্চলে অনুভূত হয়, যা ঘাড়ের নিচ থেকে পিঠের নিচের অংশ পর্যন্ত বিস্তৃত। বিভিন্ন কারণে এই অঞ্চলে ব্যথা হতে পারে, যার মধ্যে অন্যতম হলো

পেশি বা লিগামেন্টের টান: পিঠের মাঝখানে ব্যথার অন্যতম কারণ হলো পেশি বা লিগামেন্টের টান (Muscle or Ligament Strain), যা সাধারণত অতিরিক্ত কাজের চাপ, ভুল ভাবে বসা বা হঠাৎ মুভমেন্টের ফলে হতে পারে। পিঠের মাঝখানের পেশি গুলি মেরুদণ্ডকে দেহের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। ভারী বস্তু তোলা বা দীর্ঘক্ষণ একটানা কুজো হয়ে বসা, সামনে ঝুঁকে কাজ করা বা কোন আকস্মিক মুভমেন্ট করার সময় এই পেশি গুলিতে অতিরিক্ত চাপ পড়তে পারে, যার ফলে পেশিতে টান পড়ে।

এই অবস্থায় পেশি গুলিতে মাইক্রো-টিয়ার (ছোট ছোট অংশ ছিঁড়ে যাওয়া) ঘটে, যার ফলে প্রদাহ ও ব্যথা দেখা দেয়। এছাড়াও অনিয়মিত কাজের ধরন, শারীরিক ফিটনেসের অভাব, এবং যথাযথ প্রস্তুতি ছাড়া ব্যায়াম শুরু করা পেশি বা লিগামেন্টের টানের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। পিঠের ডান পাশে ব্যথা হওয়ার কারণ ও তার সমাধান (ভিডিও সহ)

পেশীর স্ট্রেইন বা মায়োফেসিয়াল পেইন সিন্ড্রোম: যখন পিঠের মাঝখানের পেশি গুলো অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে দুর্বল বা ক্ষতিগ্রস্ত হয় তখন পেশীর স্ট্রেইন ঘটে। এই সমস্যা সাধারণত অতিরিক্ত কাজ করা, ভারী ওজন তোলা, বাঁকা হয়ে বসা বা দীর্ঘ সময় ধরে একই অবস্থানে থাকার কারণে হয়। মায়োফেসিয়াল পেইন সিন্ড্রোম এমন একটি রোগ যেখানে শরীরের নির্দিষ্ট পয়েন্টে পেশীর টান বা চাপ অনুভূত হয় এবং তা আশে পাশের মাংসপেশীতে ব্যথার সৃষ্টি করে।

ভার্টিব্রাল ডিস্কের সমস্যা: মেরুদণ্ডের থোরাসিক স্পাইনের ডিস্কগুলো তে আঘাত বা ক্ষয়জনিত কারণে ব্যথা হতে পারে। যেমন, ডিস্ক হর্নিয়েশন (herniation) বা ডিস্কের ক্ষয় (degeneration)।

স্পাইনাল স্টেনোসিস: পিঠের মাঝখানে ব্যথার আরেকটি গুরুত্ব পূর্ণ কারণ হলো স্পাইনাল স্টেনোসিস (Spinal Stenosis), যা মেরুদণ্ডের হাড়ের সংকোচন বা সরু হয়ে যাওয়ার একটি রোগ। সাধারণত, মেরুদণ্ডের মধ্যবর্তী স্থান বা স্পাইনাল ক্যানেল সংকীর্ণ হয়ে গেলে স্নায়ুর উপর চাপ পড়ে এবং এই চাপ পিঠের মাঝখানে ব্যথার সৃষ্টি করতে পারে। পিঠের বাম পাশে ব্যথা কেন হয়? ছবি এবং ভিডিও সহ

স্পাইনাল স্টেনোসিসের কারণ গুলির মধ্যে রয়েছে হাড়ের বৃদ্ধির ফলে মেরুদণ্ডের কশেরুকার মধ্যে জায়গা সংকীর্ণ হওয়া, ডিস্কের ডিজেনারেশন (ক্ষয়) এবং মেরুদণ্ডে অস্টিওআর্থ্রাইটিস বা অন্যান্য প্রদাহ জনিত রোগের কারণে ক্যালসিয়ামের জমাট বাঁধা। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্পাইনাল স্টেনোসিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়, কারণ মেরুদণ্ডের গঠন এবং ডিস্কগুলো ক্ষয় হতে শুরু করে। স্পাইনাল স্টেনোসিসের কারণে স্নায়ু সংকুচিত হয়ে পড়ে, যা মাঝে মধ্যে পিঠের মাঝ খানে তীব্র ব্যথা, কোমর থেকে পায়ে ব্যথা ছড়ানো অথবা অসাড়তার মতো উপসর্গের সৃষ্টি করে।

বুকে ও পিঠে ব্যথা হওয়ার কারণ

অস্টিওআর্থ্রাইটিস: অস্টিওআর্থ্রাইটিস একটি ডিজেনারেটিভ আর্থ্রাইটিস যা বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মেরুদণ্ডের থোরাসিক অঞ্চলে জয়েন্ট কার্টিলেজের পরিধান ও ক্ষয় ঘটায়। এটি হাড়ের প্রান্তে ক্যালসিয়ামের ছোট ছোট স্পার (বাড়তি হাড়) তৈরি করে, যা মেরুদণ্ডের জয়েন্টের নড়াচড়ায় সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করে এবং ব্যথার উদ্রেক করে। অস্টিওআর্থ্রাইটিসের কারণে মেরুদণ্ডের জয়েন্টে ঘর্ষণ বাড়ে, যা প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং পিঠের মাঝখানে ব্যথার সৃষ্টি করতে পারে। সাধারণত পিঠের মাঝখানে এই ব্যথা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে এবং দীর্ঘ সময় ধরে বসে থাকা, শারীরিক কাজকর্ম বা চলাফেরায় আরও বেড়ে যায়।

স্কোলিওসিস: মেরুদণ্ডের অস্বাভাবিক বাঁক থাকার কারণেও পিঠের মাঝখানে ব্যথা হতে পারে। সাধারণত, মেরুদণ্ড সোজা থাকে, কিন্তু স্কোলিওসিসে এটি সাইডের দিকে বাঁকতে শুরু করে, যা মেরুদণ্ডের গঠনগত পরিবর্তন ঘটায় এবং পিঠের মাঝখানে ব্যথার কারণ হতে পারে। মেরুদণ্ডের থোরাসিক (মধ্য পিঠ) অঞ্চলে যদি বেঁকে যায় তাহলে ব্যথা, অস্বস্তি এবং মাংসপেশির চাপ অনুভূত হয়। পিঠের রগে টান লাগলে করণীয়

বিভিন্ন কারণে স্কোলিওসিস হতে পারে, যেমন জন্মগত ত্রুটি, আঘাত জনিত ক্ষতি বা বয়ঃসন্ধিকালে মেরুদণ্ডের বিকাশ জনিত সমস্যা। এছাড়া, অস্টিওপোরোসিস বা অস্টিওআর্থ্রাইটিসের কারণে মেরুদণ্ডের হাড় দুর্বল হয়ে গেলে স্কোলিওসিসের ঝুঁকি বাড়ে। স্কোলিওসিসের ফলে মেরুদণ্ডের উপর অস্বাভাবিক চাপ পড়ে, যা পিঠের মাঝখানে এবং আশেপাশের পেশিতে ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে।

অঙ্গ বা অস্থির সমস্যাজনিত কারণ: পিঠের মাঝখানে ব্যথার একটি কারণ হতে পারে ফুসফুসের সংক্রমণ বা প্রদাহ (নিউমোনিয়া)। এই রোগগুলির ক্ষেত্রে ফুসফুসের চারপাশের টিস্যু গুলি তে প্রদাহ হয় যা পিঠের পেশি এবং স্নায়ুতে চাপ ফেলে। তাছাড়া, কিডনির পাথর বা সংক্রমণের মতো কিডনি সমস্যাও মেরুদণ্ডের কাছাকাছি অবস্থিত স্নায়ুগুলি কে প্রভাবিত করে যার ফলে পিঠের মাঝখানে তীব্র ব্যথা হতে পারে । এ ছাড়া, অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ (প্যানক্রিয়াটাইটিস), পিত্তথলির পাথর, বা এমনকি হার্ট অ্যাটাকের মতো গুরুতর অসুস্থতার জন্যও পিঠের মাঝখানে ব্যথা হতে পারে। পিঠে ব্যথা হলে করণীয় । মুহূর্তেই পিঠের ব্যথা কমানোর ৬ উপায়

মনস্তাত্ত্বিক কারণ: গবেষণায় দেখা গেছে যে মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ মাংসপেশি কে টানটান করে রাখতে পারে, বিশেষ করে পিঠের মাংসপেশি গুলি কে। এই টানটান অবস্থা পেশি গুলিতে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে এবং পিঠের মাঝখানে ব্যথার অনুভূতি তৈরি করতে পারে। এছাড়া, দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপ বা উদ্বেগের কারণে শরীরের স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়, যা মাংসপেশির অস্বস্তি এবং ব্যথা বাড়িয়ে তোলে। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, মানসিক চাপ বা উদ্বেগের কারণে ঘুমের সমস্যা বা অনিদ্রার সৃষ্টি হতে পারে, যা পিঠের ব্যথা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে ()।

পিঠের ব্যাথা দূর করার উপায়

পিঠের ব্যথা দূর করার জন্য বেশ কিছু উপায় রয়েছে, যা ব্যথার তীব্রতা এবং প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে কার্যকর হতে পারে। পিঠের ব্যথা কমাতে এবং উপশম করতে নিচের পদক্ষেপ গুলো অনুসরণ করা যেতে পারে

প্রাথমিক চিকিৎসা: ব্যথা শুরু হলে প্রথম ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ঠান্ডা সেক দেয়া করা উচিৎ, যা প্রদাহ ও ফোলা ভাব কমাতে সাহায্য করে। এরপর হট প্যাক ব্যবহার করলে পেশি শিথিল হয় এবং ব্যথা কমে যায়। হট ও ঠান্ডা থেরাপি পর্যায় ক্রমে ব্যবহার করলে ব্যথা উপশমে কার্যকর হতে পারে।

ব্যথানাশক ওষুধ: একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে অস্থায়ী ব্যথা কমাতে ওষুধ যেমন অ্যানালজেসিক ওষুধ যেমন প্যারাসিটামল বা নন-স্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ড্রাগ (NSAIDs) যেমন আইবুপ্রোফেন এবং ন্যাপ্রোক্সেন ব্যবহার করা হয়। এই ওষুধ গুলি প্রদাহ কমাতে এবং ব্যথার অনুভূতি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। NSAIDs প্রদাহ জনিত ব্যথায় বিশেষ কার্যকর, কারণ এটি মাংসপেশি এবং টিস্যুর প্রদাহ কমিয়ে দেয়।

ফিজিওথেরাপি: পিঠের ব্যথা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় বা তীব্র হয়, তবে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা নেয়া উচিৎ। একজন গ্রাজুয়েট ফিজিওথেরাপিস্ট এর পরামর্শ অনুযায়ি চিকিৎসা নিলে দীর্ঘস্থায়ী পিঠে ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার মাধ্যমে পেশি ও মেরুদণ্ডের স্থিতিস্থাপকতা এবং শক্তি বৃদ্ধি করা যায়, যা পিঠের ব্যথা কমাতে সহায়ক। একজন গ্রাজুয়েট ফিজিওথেরাপিস্ট সাধারণত পিঠের জন্য বিভিন্ন স্ট্রেচিং এবং শক্তি বৃদ্ধির ব্যায়ামের মাধ্যমে পিঠের ব্যথার চিকিৎসা করে থাকেন ()।

জীবনধারার পরিবর্তন: ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, নিয়মিত ব্যায়াম করা, মানসিক চাপ কমানো, এবং পর্যাপ্ত ঘুমানো পিঠের ব্যথা কমানোর ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। দৈনন্দিন কাজে সঠিক সঠিক ভংগিতে করা গুরুত্বপূর্ণ। চেয়ারে সোজা হয়ে বসা, মেরুদণ্ড সঠিক ভাবে সমর্থিত রাখা, এবং ভারী বস্তু তোলার সময় সঠিক কৌশল প্রয়োগ করা পিঠের ব্যথা কমাতে সহায়তা করে। দৈনন্দিন কাজে সঠিক শারীরিক অবস্থান বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ।

তথ্যসূত্র

  1. Urits, I., Burshtein, A., Sharma, M., Testa, L., Gold, P.A., Orhurhu, V., Viswanath, O., Jones, M.R., Sidransky, M.A., Spektor, B. and Kaye, A.D., 2019. Low back pain, a comprehensive review: pathophysiology, diagnosis, and treatment.Current pain and headache reports23, pp.1-10 https://link.springer.com/article/10.1007/s11916-019-0757-1
  2. Littrell, J., 2008. The mind-body connection: not just a theory anymore.Social work in health care46(4), pp.17-37. https://www.tandfonline.com/doi/abs/10.1300/J010v46n04_02
  3. O’sullivan, P. and Lin, I., 2014. Acute low back pain.Pain1(1), pp.8-13. http://www.butheauphysio.com/uploads/9/1/3/7/91370926/osullivan-and-lin-pain-management-today-2014.pdf
Dr. M Shahadat Hossain
Follow me

Physiotherapist, Pain, Paralysis & Manipulative Therapy Specialist, Assistant Professor Dhaka College of Physiotherapy, Secretary-General(BPA), Secretary(CARD), Chief Consultant(ASPC), Conceptual Inventor(SDM), Faculty Member(CRP), Member-Bangladesh Rehabilitation Council

পরামর্শ নিতে 01877733322