অ্যাঙ্কাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস (Ankylosing spondylitis, AS) হলো একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহজনিত রোগ, যা প্রধানত শরীরের হাড় ও জয়েন্টকে প্রভাবিত করে। রোগটির বৈশিষ্ট্য হলো শরীরের হাড় ও জয়েন্টকে শক্ত করে তোলা, বিশেষ করে স্যাক্রোইলিয়াক জয়েন্ট ও মেরুদণ্ডে, যার ফলে ধীরে ধীরে চলাচলের ক্ষমতাকমে যায় এবং রোগীর কার্যক্ষমতার দিন দিন কমতে থাকে। এই রোগে প্রদাহের কারণে হাড় ও লিগামেন্টের সংযোগস্থলে ক্ষয় হয় এবং ক্রমশ নতুন হাড় তৈরি হয়, যা মেরুদণ্ডের নমনীয়তা স্থায়ীভাবে কমতে থাকে(Braun & Sieper, 2007)

AS সাধারণত কিশোর বয়সের শেষ ভাগ থেকে তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে শুরু হয়, বিশেষ করে ১৫–৩০ বছরের মধ্যে। মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা কিছুটা বেশি, যদিও সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে নারী-পুরুষ উভয়ের মধ্যেই এটি কমবেশি সমান হারে হতে পারে, তবে নারীদের ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয়ে বিলম্ব হয় এবং লক্ষনগুলো তুলনামূলকভাবে ভিন্নভাবে প্রকাশ পায় (Rudwaleit et al., 2009)।

যুবকরা কেন আক্রান্ত হয়

অ্যাঙ্কাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস (Ankylosing spondylitis, AS) একটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত প্রদাহজনিত রোগ, তবে এর প্রকোপ ভৌগোলিক এলাকা ও জাতিগত বৈচিত্র্যের ওপর নির্ভরশীল। বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, বিশ্বব্যাপী AS এর প্রাদুর্ভাব ০.১% থেকে ১.৪% এর মধ্যে, যা মূলত কোনো জনগোষ্ঠীতে HLA-B27 জিনের উপস্থিতির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত (Dean et al., 2014) ।

উত্তর ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার জনগোষ্ঠীতে এই রোগের প্রাদুর্ভাব তুলনামূলকভাবে বেশি, কারণ সেখানে HLA-B27 এর হারও বেশি। অন্যদিকে জাপান, আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের কিছু অঞ্চলে এর হার অপেক্ষাকৃত কম। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক জাতীয় পরিসংখ্যান না থাকলেও, বিশেষজ্ঞ মতামত অনুযায়ী যুব সমাজে দীর্ঘস্থায়ী কোমর ব্যথার একটি বড় অংশের পেছনে AS ভূমিকা রাখছে।

এঙ্কাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস এর বিকাশের কিছু কারন রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো HLA-B27 জিনের উপস্থিতি, যা প্রায় ৯০–৯৫% ইউরোপীয় AS রোগীর মধ্যে পাওয়া যায় (Reveille, 2012) ।

সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, অন্ত্রের মাইক্রোবিয়াল ভারসাম্যের পরিবর্তন ইমিউন সিস্টেমকে প্রভাবিত করে প্রদাহের ঝুঁকি বাড়াতে পারে (Costello et al., 2015)

AS সাধারণত যুবক বয়সে শুরু হয়, কারণ এই সময়ে ইমিউন সিস্টেম সক্রিয় থাকে এবং হরমোনাল ও শারীরিক পরিবর্তন ঘটে। পাশাপাশি, তরুণদের দৈনন্দিন জীবনে শ্রম, খেলাধুলা ও শারীরিক চাপে ব্যথার উপসর্গগুলো খুবই সাধারন মনে হয়, ফলে প্রাথমিক পর্যায়ে সঠিক রোগনির্ণয় কঠিন হয়ে পড়ে। এ কারণেই কিশোর-কিশোরী থেকে তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে AS এর সচেতনতা বৃদ্ধি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

পিঠে ব্যথার মূল কারণ

অ্যাঙ্কাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস (AS) মূলত একধরনের ক্রনিক ইনফ্লেমেটরি স্পন্ডাইলোআর্থ্রোপ্যাথি, যেখানে প্রধান টার্গেট হল হাড় এবং জয়েন্ট। রোগের মূল বৈশিষ্ট্য হলো – প্রদাহজনিত ক্ষয় (erosion), হাড়ের পুনর্গঠন (new bone formation) যা মেরুদণ্ডকে শক্ত করে তোলে। এ কারণে রোগীর পিঠে স্থায়ী ব্যথা ও নড়াচড়া কঠিন হয়ে পরে।

হাড় ক্ষয়

AS রোগের প্রথম এবং মৌলিক প্যাথোলজিক্যাল পরিবর্তন হলো হাড় ক্ষয়। এখানে প্রদাহের ফলে প্রাথমিকভাবে লিগামেন্ট ও টেন্ডনের সাথে হাড়ের সংযোগস্থলে ইমিউন সেল জমে যায়, যার ফলশ্রুতিতে অস্টিওক্লাস্ট বা হাড় ক্ষয় হয়। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই জায়গায় নতুন হাড় জমতে থাকে, যা সিন্ডেসমোফাইট (syndesmophyte) তৈরি করে এবং শেষপর্যন্ত মেরুদণ্ডের ফিউশন ঘটায় (Sieper & Poddubnyy, 2017)।

স্যাক্রোইলাইটিস

AS-এর রোগীদের প্রথম এক্স-রে এর পরিবর্তন দেখা যায় স্যাক্রোইলাইটিস – অর্থাৎ স্যাক্রোইলিয়াক জয়েন্টে প্রদাহ। পরবর্তী ধাপে প্রদাহ মেরুদণ্ডের ইন্টারভার্টিব্রাল ডিস্ক ও লিগামেন্ট পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। ধীরে ধীরে syndesmophyte bridging গঠন হয়, যা সম্পূর্ণ মেরুদণ্ডকে একক অস্থি-স্তম্ভে রূপান্তর করে (bamboo spine) (Braun & Sieper, 2007) ।

মেকানিক্যাল স্ট্রেস

অতিরিক্ত শারীরিক শ্রম, ক্রীড়া-সম্পর্কিত আঘাত বা বারবার মেকানিক্যাল স্ট্রেস মাইক্রো-ট্রমা সৃষ্টি করে। এই ক্ষতস্থানগুলো প্রদাহের প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করতে পারে। ফলে, যেসব তরুণ বয়সে শারীরিক শ্রম বা খেলাধুলায় সক্রিয় থাকে তাদের মধ্যে রোগের প্রাথমিক প্রকাশ বেশি দেখা যায় (Benjamin & McGonagle, 2001) ।

ক্লিনিক্যাল প্রেজেন্টেশন

অ্যাঙ্কাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস (AS) তরুণ বয়সীদের মধ্যে কোমর ব্যথার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। এর ক্লিনিক্যাল বৈশিষ্ট্য “মেকানিক্যাল কোমর ব্যথা” থেকে আলাদা, তাই সঠিকভাবে এই রোগ চিহ্নিত করা জরুরি।

Inflammatory Mechanical ব্যথার বৈশিষ্ট্য ও তুলনা

অ্যাঙ্কাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিসে (AS) প্রথমে inflammatory back pain (IBP) এর ব্যথার মত শুরু হলেও এবং প্রায়শই ৪০ বছরের কম বয়সের মধ্যে এর লক্ষণ প্রকাশ পায়। ব্যথা বেশি হয় সকালের দিকে, সাধারণত ≥৩০ মিনিটের morning stiffness সহ। হালকা ব্যায়াম বা শারীরিক নড়াচড়া করলে ব্যথা কমে যায়, কিন্তু দীর্ঘ সময় বিশ্রামে থাকলে ব্যথা বেড়ে যায়। এছাড়া, রাতের শেষভাগ বা ভোরবেলা ব্যথা IBP-এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

এর বিপরীতে, mechanical pain সাধারণত হয় আঘাত, ভারী কাজ বা মেরুদণ্ডের degenerative পরিবর্তনের কারণে। এতে বিশ্রামে ব্যথা কমে এবং শারীরিক ক্রিয়াকলাপে ব্যথা বেড়ে যায় (Sieper et al., 2009) ।

প্রধান লক্ষণসমূহ

  • পিঠ ও কোমরের শেষ অংশে ব্যথা: AS-এর সবচেয়ে প্রাথমিক ও প্রধান উপসর্গ হলো স্যাক্রোইলিয়াক (SI) জয়েন্ট বা কোমরের শেষ অংশে ব্যথা। এই ব্যথা সাধারণত একপাশে শুরু হলেও সময়ের সাথে দুই পাশে ছড়িয়ে পড়ে।
  • বয়সের ভিন্নতা: AS সাধারণত ১৫–৩০ বছর বয়সে শুরু হয় এবং এই সময়কার সাধারণ কোমর ব্যথা (যেমন—দিনমজুরদের শ্রমজনিত মেকানিক্যাল ব্যথা) থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্য বহন করে।
  • পিঠের শক্তভাব: রোগের অগ্রগতির সাথে সাথে রোগীরা মেরুদণ্ডে শক্তভাব অনুভব করেন, যা দিনের প্রথমভাগে বেশি দেখা যায়।
  • কার্যক্ষমতার সীমাবদ্ধতা: দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা ও মেরুদণ্ডের শক্তভাব রোগীদের দৈনন্দিন কাজকর্ম, শিক্ষাজীবন ও পেশাগত জীবনে প্রভাব ফেলে।

বিভিন্ন বয়সে ভিন্ন প্রকাশ

  • প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে: অধিকাংশ রোগীর উপসর্গ শুরু হয় কোমর বা কোমরের শেষ অংশের ব্যথা দিয়ে।
  • কিশোরদের (Juvenile-onset AS): অনেক সময় প্রাথমিক উপসর্গ হয় হাঁটু বা গোড়ালি ব্যথা।

পিঠের ব্যথার সঠিক নির্ণয় প্রক্রিয়া

প্রাথমিক ল্যাবরেটরি টেস্ট

  • ESR, CRP: বাত ব্যথা নির্ণয় করার জন্য এই টেস্টগুল করা হয় যা অনেক সময় অ্যাঙ্কাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিসের (AS) লক্ষনের সাথে মিলে যায় ।
  • HLA-B27: HLA-B27 positive হলে তা সরাসরি অ্যাঙ্কাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস নির্দেশ করলেও HLA-B27 negative থাকলেও AS হতে পারে।
  • Additional labs: CBC, renal/hepatic function, infection markers অ্যাঙ্কাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিসের differential diagnosis প্রয়োজন।

রেডিওলজিক্যাল টেস্ট

  1. Plain X-ray of SI joints:
    • প্রাথমিক পর্যায়ে সাধারণত নরমাল থাকে।
    • Advanced stage-এ erosions, sclerosis, joint space narrowing দেখা যায়।
  2. MRI (STIR / Short-TI inversion recovery) of SI joints:
    • প্রাথমিক শনাক্তকরণের জন্য সাহায্য করে।
    • Bone marrow edema, synovitis এবং capsulitis দেখা যায়, যা X-ray এ প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়ে না।
  3. Spinal X-ray:
  • দীর্ঘমেয়াদি পর্যায়ে syndesmophytes এবং বাঁশের মতো মেরুদণ্ড (bamboo spine) দেখা যায়।

চিকিৎসা ও রিহ্যাবিলিটেশন

ঔষধ

অ্যাঙ্কাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিসের (AS) চিকিৎসায় NSAIDs (Non-Steroidal Anti-Inflammatory Drugs) ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা ব্যথা ও সকালের stiffness কমাতে কার্যকর। DMARDs (Disease Modifying Anti-Rheumatic Drugs), যেমন Sulfasalazine, সাধারণত peripheral arthritis-এ কার্যকর হলেও শারীরিক নড়াচড়াতে এর প্রভাব সীমিত। তবে ওষুধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই একজন রিমাটলজিস্ট বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

ফিজিওথেরাপি ও রিহ্যাবিলিটেশন (Physiotherapy & Rehabilitation)

ASPC Manipulation Therapy-তে অ্যাঙ্কাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস (AS) রোগীদের চিকিৎসা শুরু হয় বিস্তারিত ফিজিক্যাল অ্যাসেসমেন্টের মাধ্যমে, যেখানে রোগীর মেরুদণ্ড, হিপ জয়েন্ট এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নড়াচড়া, flexibility, posture, ব্যথার ধরন এবং দৈনন্দিন কার্যক্ষমতা সতর্কতার সাথে মূল্যায়ন করা হয়। এই মূল্যায়নের ভিত্তিতে কারেকশন থেরাপি প্রয়োগ করা হয়, যার লক্ষ্য হলো মেরুদণ্ডের সীমিত নড়াচড়া (restricted mobility) উন্নত করা এবং দীর্ঘমেয়াদি শক্তভাব (stiffness) ধীরে ধীরে হ্রাস করা। Manipulation-এর মাধ্যমে spinal alignment এবং joint mobility বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যথা কমে, শরীরের ভারসাম্য উন্নত হয় এবং রোগী সহজে দৈনন্দিন কাজ সম্পাদন করতে সক্ষম হন।

এছাড়াও, রোগীদের জন্য ব্যক্তিগতকৃত পরামর্শ ও লাইফস্টাইল গাইডলাইন প্রদান করা হয়, যেমন—দৈনিক stretching exercise, সঠিক posture বজায় রাখা, ধূমপান এড়ানো, সঠিক mattress ব্যবহার, নিয়মিত শ্বাস-প্রশ্বাস ও relaxation exercise করা ইত্যাদি। এই নির্দেশিকা মেনে চললে প্রদাহ ও ব্যথা নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং রোগী ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে যেতে পারেন। অর্থাৎ, ASPC Manipulation Therapy কেবল একটি থেরাপিউটিক ইন্টারভেনশন নয়, বরং এটি রোগীর দীর্ঘমেয়াদি জীবনমান উন্নত করার একটি সমন্বিত পদ্ধতি।

জীবনধারার পরিবর্তন

অ্যাঙ্কাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিসে জীবনধারার পরিবর্তন রোগের অগ্রগতি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রথমত, ধূমপান সম্পূর্ণভাবে বর্জন করতে হবে, কারণ ধূমপান শুধু প্রদাহ বাড়ায় না, বরং মেরুদণ্ডের ক্ষয় এবং রোগের দ্রুত অগ্রগতি ঘটায়।

দ্বিতীয়ত, শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি, কারণ অতিরিক্ত ওজনের কারণে হিপ ও স্পাইনাল জয়েন্টে অতিরিক্ত চাপ পড়ে যা ব্যথা ও stiffness বাড়িয়ে তোলে।

উপসংহার

তরুনদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষার মাধ্যমে এ রোগের চিহ্নিত করা একান্ত প্রয়োজন। একই সাথে, শারীরিক কার্যক্রম এবং সঠিক জীবন-যাপ্নের মাধ্যমে এই রোগের প্রভাব কমানো সম্ভব। সুতরাং, তরুণদের কোমর ব্যথার পেছনে এঙ্কাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিসকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে সময়মতো চিকিৎসা গ্রহণ এবং স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নেওয়া উচিত।

তথ্যসূত্র

কিভাবে সার্ভাইক্যাল স্পন্ডাইলোসিস স্থায়ীভাবে নিরাময় করা যায়

কিভাবে সার্ভাইক্যাল স্পন্ডাইলোসিস স্থায়ীভাবে নিরাময় করা যায়. সার্ভাইক্যাল স্পন্ডাইলোসিস হলো ঘাড়ের মেরুদণ্ডের…