স্ট্রোক একটি জীবন বিপন্নকারী ঘটনা, যা হঠাৎ করে মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহ বন্ধ বা কমে যাওয়ার ফলে ঘটে থাকে। এর ফলে প্যারালাইসিস, কথা বলার সমস্যা, স্মৃতিশক্তি লোপ এবং মানসিক চাপ বৃদ্ধি পাওয়ার মতো গুরুতর জটিলতা দেখা দিতে পারে (Feigin et al., 2014, The Lancet)। স্ট্রোকের পরবর্তী পুনর্বাসনে ও ভবিষ্যতে পুনরায় স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি কমাতে খাদ্যাভ্যাস একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সঠিক পুষ্টি মস্তিষ্কের কোষ পুনর্গঠনে সাহায্য করে, নিউরোপ্লাস্টিসিটি তরান্বিত করে এবং উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও উচ্চ কোলেস্টেরলের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কারণগুলো নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে (Gomez-Pinilla, 2008, Nature Reviews Neuroscience)। এ ছাড়াও, সুষম খাদ্যাভ্যাস শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি করে, যা দৈনন্দিন কাজকর্মে অংশগ্রহণে সাহায্য করে।
স্ট্রোক রোগীদের পুষ্টি চাহিদা

স্ট্রোক থেকে সেরে ওঠা একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া, যার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সঠিক পুষ্টি। সুষম খাদ্য শরীরের কোষ মেরামত, নার্ভ সংস্কার এবং এক্সারসাইজ করতে শক্তি সরবরাহে সহায়তা করে।
ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্টস:
- কার্বোহাইড্রেট: শর্করা জাতীয় খাবার যেমন লাল চাল, ওটস, বা আটা রুটি ধীরে ধীরে শক্তি সরবরাহ করে, যা ক্লান্তি কমায় এবং এক্সারসাইজ করতে সহায়তা করে (American Stroke Association, 2020)।
- প্রোটিন: পেশি পুনর্গঠনের জন্য অপরিহার্য, বিশেষত যাদের এক পাশে দুর্বলতা (hemiparesis) রয়েছে। মাছ, ডিম, ডাল, ও দেশি মুরগি প্রোটিনের চমৎকার উৎস।
- চর্বি: মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য উন্নত করতে ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ ইলিশ মাছ, বাদাম, তিসি বীজ খাওয়া উচিত। তবে ঘি বা মাখনের মতো স্যাচুরেটেড ফ্যাট কম খাওয়া উচিত (Calder, 2017, Nutrients).
মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস:
- পটাশিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম: উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। কলা, পালং শাক, ও কচু শাকে এগুলোর পরিমাণ বেশি (Houston, 2011).
- সোডিয়াম: উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে লবণ কম খাওয়া প্রয়োজন।
- অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট: কমলা, পেয়ারা, বেরি জাতীয় ফলে ভিটামিন C ও ফ্ল্যাভোনয়েড থাকে, যা প্রদাহ হ্রাস করে (Polidori et al., 2014).
- বি ভিটামিন: নার্ভ এর কার্যকারিতা ও শক্তি বিপাকে সহায়ক (Kennedy, 2016), যেমন শস্যজাতীয় খাবার ও ডিমে পাওয়া যায়।
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়:
- ডিহাইড্রেশন প্রতিরোধে: পরিমাণমতো পানি বা ডাবের পানি খাওয়া উচিত।
- গিলতে সমস্যা (Dysphagia): মসৃণ ও নরম খাবার যেমন ডালের স্যুপ, পিষে দেওয়া শাক, খিচুড়ি খাওয়া প্রয়োজন।
- কো-মর্বিডিটি বিবেচনা: ডায়াবেটিস থাকলে চিনি পরিহার করা, উচ্চ রক্তচাপ থাকলে লবণ কম খাওয়া, হৃদরোগ থাকলে কম চর্বিযুক্ত খাদ্য প্রয়োজন।
স্ট্রোক রোগীদের জন্য খাদ্য তালিকা
স্ট্রোক রোগীদের জন্য সুষম ও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত খাদ্য তালিকা পুনর্বাসন প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করতে সহায়তা করে। বাংলাদেশের খাদ্যাভ্যাস ও সহজলভ্য উপকরণ বিবেচনা করে নিচে একটি খাদ্য তালিকা দেওয়া হলো, যা পুষ্টিগুণ অনুযায়ী শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে।
শাকসবজি (Vegetables)
- উদাহরণ: পালং শাক, লাল শাক, কচু শাক, ফুলকপি, গাজর, লাউ, মিষ্টি কুমড়া।
- উপকারিতা: ফাইবারসমৃদ্ধ, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও পটাশিয়ামযুক্ত — যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ও প্রদাহ হ্রাসে সাহায্য করে (Slavin, 2013)।
ফল (Fruits)
- কলা, কমলা, পেয়ারা, পেঁপে, আম।
- ভিটামিন C, A এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সরবরাহ করে, যা নার্ভ ও রক্তনালির স্বাস্থ্য উন্নত করে।
শস্যজাতীয় (Whole Grains)
- লাল চাল, ওটস, আটা রুটি, খই।
- ধীরে শক্তি দেয় ও হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় (Aune et al., 2016)।
প্রোটিন (Proteins)
- ইলিশ, রুই, মসুর ডাল, মুগ ডাল, মুরগি (চর্বি ছাড়া), ডিম।
- পেশির মেরামত ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
স্বাস্থ্যকর চর্বি (Healthy Fats)
- ইলিশ মাছ, বাদাম, চিনাবাদাম, অলিভ অয়েল, সরিষার তেল (পরিমিত)।
- ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড নার্ভ ও মস্তিষ্কের জন্য উপকারর (Calder, 2010)।
দুগ্ধজাত পণ্য (Dairy)
- কম চর্বিযুক্ত দুধ, টক দই।
- ক্যালসিয়াম ও প্রোটিন সরবরাহ করার মাধ্যমে হাড় ও পেশি শক্তিশালী করে (Rizzoli, 2022)।
হাইড্রেশন (Hydration)
- পানি, ডাবের পানি, লাল চা বা ভেষজ চা।
- পানিশূন্যতা রোধ করে এবং রক্ত চলাচল উন্নত করে (Popkin et al., 2010)।
স্ট্রোক রোগীদের জন্য যেসব খাবার এড়ানো বা কম উচিত
স্ট্রোকের পর পুনরুদ্ধারের সময়, কিছু খাবার রোগীর স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এবং দ্বিতীয়বার স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি বাড়াতে পারে। বিশেষত বাংলাদেশের খাদ্যসংস্কৃতিতে কিছু অভ্যাস যেমন অতিরিক্ত লবণ বা তেল ব্যবহার — এগুলো পরিবর্তন করা জরুরি।
লবণ ও সোডিয়ামসমৃদ্ধ খাবার:
আচার, লবণাক্ত শুটকি মাছ, প্রক্রিয়াজাত নুডলস, চানাচুর ও চিপস — এসব খাবারে অতিরিক্ত সোডিয়াম থাকে যা রক্তচাপ বাড়িয়ে তোলে। (He & MacGregor, 2010)
স্যাচুরেটেড ও ট্রান্স ফ্যাট:
গরুর মাংস, ঘি, সিঙ্গারা-পকোড়ার মতো ভাজা খাবার রক্তে কোলেস্টেরল বাড়ায়, যা ধমনিতে জমে স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। (Mozaffarian et al., 2006)
চিনিযুক্ত খাবার:
রসগোল্লা, সন্দেশ, কোমল পানীয় — এগুলো রক্তে গ্লুকোজ বাড়িয়ে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়, যা স্ট্রোকের অন্যতম সহায়ক কারণ (Malik et al., 2010)
অ্যালকোহল ও ক্যাফেইন:
অ্যালকোহল রক্তচাপ হঠাৎ বাড়িয়ে দিতে পারে, তাই একেবারেই পরিহার করা উচিত। চা বা কফি দিনে ১–২ কাপের বেশি খাওয়া উচিত নয়, কারণ এতে রক্তচাপ ওঠানামা করতে পারে। (Reynolds et al., 2003)
স্ট্রোক রোগীদের জন্য খাদ্য প্রস্তুতি ও পরামর্শ
স্ট্রোক রোগীদের পুনর্বাসনে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সঠিকভাবে পুষ্টিকর খাবার প্রস্তুত করা। রোগী বা পরিচর্যাকারী উভয়ের জন্যই এটি একটি চ্যালেঞ্জ, তবে কিছু সহজ পদ্ধতি অনুসরণ করলে এটি কার্যকরভাবে পরিচালনা করা যায়।
ডিসফেজিয়া ব্যবস্থাপনা (Dysphagia Management)
গিলতে অসুবিধা হলে নরম খাবার যেমন পিষে দেওয়া ডাল, শাকের পিউরি বা নরম খিচুড়ি খাওয়ানো যেতে পারে। তরল খাবার ঘন করার জন্য থিকেনার ব্যবহার করতে হবে (চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী) (Martino et al., 2005)।
খাবারের ফ্রিকোয়েন্সি ও পদ্ধতি
দৈনিক ৫–৬ বার অল্প পরিমাণে খাবার খেলে রক্তে শর্করার ভারসাম্য বজায় থাকে এবং হজমে চাপ কমে (especially in elderly stroke survivors)।
রান্নার পদ্ধতি ও পরিমাণ নির্ধারণ
ভাজা এড়িয়ে সিদ্ধ, ভাপ বা হালকা ভাজি পদ্ধতি অনুসরণ করা শ্রেয়। ছোট প্লেট ব্যবহার করে পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা যায়: যেমন ½ কাপ ভাত, ১ কাপ শাকসবজি, ১ টুকরো মাছ।
পরিবারের ভূমিকা
পরিচর্যাকারীদের উচিত খাদ্যে লবণ ও চিনি কমাতে উৎসাহিত করা এবং পুষ্টি-সমৃদ্ধ খাদ্য তৈরি করা।
সম্ভাব্য খাদ্যতালিকা
- সকালের খাবার: ওটস, কলা, লো-ফ্যাট দুধ
- মিড-মর্নিং: পেয়ারা বা টক দই
- দুপুর: লাল চাল, মসুর ডাল, পালং শাক ভাজি, সিদ্ধ রুই মাছ
- বিকাল: ৫–৬টি বাদাম বা ডাবের পানি
- রাত: শাকসবজির স্যুপ, আটা রুটি, মুরগির ঝোল (লবণ কম)
স্ট্রোক রোগীদের জন্য যে যে বিষয়ে লক্ষ রাখতে হবে
স্ট্রোক-পরবর্তী পুনর্বাসনে শুধু খাদ্য নয়, জীবনধারা, মানসিক অবস্থা এবং অন্যান্য চিকিৎসাগত বিষয়গুলোকেও গুরুত্ব দিতে হয়। খাদ্যাভ্যাস কেবল পুষ্টি নয়, বরং সার্বিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার অংশ।
চিকিৎসক বা ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ
যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা হৃদরোগ রয়েছে, তাদের জন্য ডায়েট চার্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ডায়েট চার্ট করলে ওষুধের কার্যকারিতাও উন্নত হয়র (Barrea et al., 2018)।
ফিজিওথেরাপির সঙ্গে খাদ্যাভ্যাসের সম্পর্ক

ফিজিওথেরাপির সময় পর্যাপ্ত প্রোটিন ও ক্যালোরি গ্রহণ পেশির পুনর্গঠন ও শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে (Wolfe, 2006)।
ASPC ম্যানিপুলেশন থেরাপি সেন্টার স্ট্রোক রোগীদের জন্য একটি বিশেষায়িত ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নির্ভর পুনর্বাসন সেবা প্রদান করে থাকে। এখানে প্রতিটি রোগীকে একটি পূর্ণাঙ্গ এসেসমেন্টের (assessment) মাধ্যমে তার শারীরিক দুর্বলতা, চলাচলের সীমাবদ্ধতা এবং স্নায়বিক জটিলতা চিহ্নিত করা হয়। এই নির্ভুল এসেসমেন্টের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় রোগীর জন্য উপযুক্ত ম্যানুয়াল থেরাপি, নিউরো-মাসকুলার রি-এডুকেশন ও কার্যকরী অনুশীলন পরিকল্পনা।
ASPC-তে ব্যবহৃত ম্যানিপুলেশন থেরাপির মাধ্যমে নার্ভ ও মাংসপেশির সংযোগ উন্নত হয়, পেশি দুর্বলতা হ্রাস পায় এবং ব্যালেন্স ও কো-অর্ডিনেশনে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। এর ফলে স্ট্রোক-পরবর্তী পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীর চলাফেরা, দৈনন্দিন কাজ এবং আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে তুলনামূলকভাবে দ্রুত। অভিজ্ঞ ফিজিওথেরাপিস্ট ও গবেষণা-ভিত্তিক কৌশলের সমন্বয়ে ASPC শুধু চিকিৎসা নয়, রোগীকে মানসিকভাবে সাপোর্ট দেওয়ার দিকেও সমান গুরুত্ব দেয়।
এখানে থেরাপি শুরু হয় রোগীর মানসিক এবং শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে যেটি সঠিক পুনর্বাসনের প্রথম পদক্ষেপ। তাই বলা যায়, ASPC ম্যানিপুলেশন থেরাপি সেন্টার স্ট্রোক রোগীদের জীবনের মানোন্নয়নে একটি বিশ্বস্ত ও আধুনিক ঠিকানা।
মানসিক স্বাস্থ্য ও পুষ্টি
স্ট্রোকের পরে অনেক রোগী হতাশা ও মানসিক অবসাদে ভোগেন। ওমেগা-৩, বি ভিটামিনসমৃদ্ধ খাবার যেমন মাছ, বাদাম, ডিম— মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করে।
সাশ্রয়ী খাবারের পরামর্শ
মসুর ডাল, কচু শাক, পুঁটি মাছ— এগুলো বাংলাদেশের বাজারে সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী এবং প্রোটিন, আয়রন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সরবরাহ করে।
উপসংহার
স্ট্রোকের পর সঠিক খাদ্যাভ্যাস কেবল মস্তিষ্কের মেরামতের গতিই বাড়ায় না, বরং ভবিষ্যতে স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেকটাই হ্রাস করে। আপনি যদি আজ থেকেই লবণ, চিনি পরিহার করেন এবং বেশি আঁশযুক্ত খাবার গ্রহণ শুরু করেন, তাহলে সুস্থতা অর্জনের পথ সহজ হয়ে যাবে।
সঠিক চিকিৎসা, ফিজিওথেরাপি এবং পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্যের সমন্বয়ে একজন স্ট্রোক রোগী আবারও স্বাভাবিক ও সক্রিয় জীবনে ফিরে যেতে পারেন (Wolfe, 2006)।
FAQs (প্রায়শ জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন) –
১. স্ট্রোক রোগী কি ভাত খেতে পারেন?
হ্যাঁ, তবে সাদা চালের বদলে আঁশযুক্ত লাল চাল বা ব্রাউন রাইস অল্প পরিমাণে খাওয়া উত্তম, কারণ এটি রক্তে শর্করার মাত্রা ধীরে ধীরে বাড়ায় ও দীর্ঘস্থায়ী শক্তি দেয়। (Aune et al., 2016)
২. দিনে কতটা লবণ নিরাপদ?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য দিনে সর্বোচ্চ ৫ গ্রাম বা ১ চা-চামচ লবণ নিরাপদ (WHO, 2012)।
- পেটের বাম পাশে ব্যথা কমানোর উপায় - June 19, 2025
- কোমরের দুই পাশে ব্যথার কারণ কী? - June 19, 2025
- মহিলাদের মধ্যে স্ট্রোক: ঝুঁকি এবং প্রতিরোধ - June 18, 2025