গর্ভাবস্থায় ওজন বৃদ্ধি ও হরমোনের পরিবর্তনের ফলে অনেক নারী কোমর ব্যথায় আক্রান্ত হন। যদিও অনেকে গর্ভধারণের আগে থেকেই এ বিষয়ে সচেতন থাকেন, কিন্তু সি-সেকশনের পরের প্রসবোত্তর কোমর ব্যথা সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা নেই। এ প্রসঙ্গে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব।
সন্তান জন্মদানের পর, অনেক মায়েরাই কোমর ব্যথায় কষ্ট পান। এই ব্যথা প্রসবের কয়েক ঘণ্টা পর শুরু হয়ে বেশ কিছু সপ্তাহ বা মাস ধরে থাকতে পারে।
সিজারিয়ান সেকশনের পর কোমর ব্যথা হবার কারণ?
হরমোনগত পরিবর্তন
গর্ভাবস্থায় কেবল পেটের আকার বৃদ্ধি পায় এমনটি নয়, বরং বিভিন্ন ধরনের শারীরিক পরিবর্তনও ঘটে যা প্রসবের পর কোমর ব্যথার কারণ হতে পারে। গর্ভাবস্থায় শরীর প্রসব প্রক্রিয়াকে সহায়তা করতে রিলাক্সিন নামক এক ধরনের হরমোনের ক্ষরণ হয়, যা জয়েন্ট ও লিগামেন্টগুলিকে নমনীয় করে তোলে। এই হরমোন শরীরে নিঃসৃত হওয়ার ফলে, মাংশপেশি ও জয়েন্টের উপরের চাপ বৃদ্ধি পায়, যার ফলে কোমর ব্যথার সৃষ্টি হয় (১)। সুখবর হল, সন্তান জন্মানোর পরের কয়েক মাসে, জয়েন্ট ও লিগামেন্টগুলি আবার স্বাভাবিক শক্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে পায়।
ওজন বৃদ্ধি
সিজারিয়ান সেকশনের পর প্রায়ই কোমর ব্যথার সমস্যা দেখা যায়, যার মূল কারণ হল গর্ভাবস্থায় ওজন বৃদ্ধি। গর্ভাবস্থায় ওজন বৃদ্ধি স্বাভাবিক, কারণ আপনার শরীরে একটি নতুন প্রাণের বিকাশ ঘটে। এই বাড়তি ওজন ভারসাম্যের কেন্দ্রবিন্দুকে স্থানান্তরিত করে যার দরুণ মেরুদণ্ড ও কোমরে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়, ফলে কোমরে ব্যথার সৃষ্টি হতে পারে।
বাচ্চাকে কোলে নেওয়া
আপনার সন্তানের ওজন যদিও শুধুমাত্র ছয় থেকে সাত পাউন্ড হতে পারে, এটি আপনার শরীরের জন্য একটি অতিরিক্ত বোঝা যা আপনাকে প্রতিদিন বহন করতে হচ্ছে। বাচ্চাকে বিছানা থেকে তুলে নেওয়া বা কোলে নেওয়ার সময় আপনাকে বারবার ঝুঁকতে হয়, যা আপনার মেরুদণ্ড ও কোমরে চাপ সৃষ্টি করে। এই চাপ কোমরে ব্যথা সৃষ্টির একটি প্রধান কারণ হতে পারে (২)।
বুকের দুধ খাওয়ানো
দীর্ঘ সময় ধরে স্তন্যপান করানোর ফলে ঘাড়ের উপর চাপ সৃষ্টি হয়, যা ক্রমান্বয়ে ঘাড়ে ব্যথা উৎপন্ন করে। এই ব্যথা ধাপে ধাপে ঘাড় থেকে কোমরে প্রসারিত হতে পারে, যাকে চিকিৎসাশাস্ত্রে “রেডিয়েটিং পেইন” বলা হয়। স্তন্যপানের সময় পজিশনিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; যদি আপনি অনুপযুক্ত অবস্থানে থাকেন, বিশেষত যদি আপনার কাঁধ শিশুর দিকে অতিরিক্ত ঝুঁকে থাকে, তাহলে এটি কোমরে ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে (৪)।
এনেস্থেশিয়ার প্রভাব
সি-সেকশন অপারেশনের আগে প্রদান করা এনেস্থেশিয়ার প্রকার এবং প্রয়োগের পদ্ধতি অনুযায়ী প্রসবের পরে কোমর ব্যথার সম্ভাবনা বিবেচিত হয়। সাধারণত, এপিডুরাল অথবা স্পাইনাল ব্লক এনেস্থেশিয়া প্রয়োগের দুটি প্রধান পদ্ধতি। এপিডুরাল এনেস্থেশিয়া ক্ষেত্রে, চিকিৎসক মেরুদণ্ডের চারপাশে এনেস্থেটিক ওষুধ ইঞ্জেক্ট করেন, অপরদিকে স্পাইনাল ব্লকে, মেরুদণ্ডের খুব কাছে ওষুধ ইঞ্জেক্ট করা হয় যা দ্রুত কাজ করে। এপিডুরালে অনুভূতি নাশক ওষুধের প্রভাব আসতে ২০ মিনিট প্রায় সময় নেয়।
এই এনেস্থেশিয়া পদ্ধতিগুলি অপারেশনের ধরণকে প্রভাবিত করতে পারে এবং এগুলির ব্যবহারের পরে মেরুদণ্ডের কাছাকাছি মাংশপেশি স্পাজম বা শক্ত হয়ে যেতে পারে, যা প্রসবের পর কোমর ব্যথার একটি সম্ভাব্য কারণ। এই মাংশপেশির অস্বাভাবিকতা কয়েক সপ্তাহ থেকে মাস ধরে ব্যাথা এবং অস্বস্তি সৃষ্টি করতে পারে।
আরও পড়ুনঃ হঠাৎ কোমর ব্যথা শুরু হলে কি করবেন?
সিজারের পর কোমর ব্যথায় আপনি কি করতে পারেন?
সিজারিয়ান সেকশনের পর কোমর ব্যথা একটি সাধারণ সমস্যা। এই ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে আপনি নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি নিতে পারেন:
আপনার বাচ্চাকে কোলে তোলার সময় ঝুঁকবেন না
বাচ্চাকে কোলে নেওয়ার সময় নিজেকে অযথা ঝুঁকাবেন না। নিজের মেরুদণ্ড সোজা রাখুন এবং কোলে উত্তোলনের সময় হাঁটু বাঁকানোর মাধ্যমে শক্তি প্রয়োগ করুন। বাচ্চাকে নামানোর সময়ও একই নিয়ম মেনে চলুন।
স্তন্যপানের সময় আপনার পিঠ সোজা রাখুন
স্তন্যপানের সময় আপনার মেরুদণ্ড সোজা রাখুন এবং আরামদায়ক চেয়ার বা সফা ব্যবহার করুন। প্রয়োজনে, বাচ্চার উচ্চতা বাড়ানোর জন্য বালিশ ব্যবহার করুন যাতে আপনাকে ঝুঁকতে না হয়।
গরম পানিতে গোসল করুন
গরম পানির স্নান মাংশপেশির টান এবং স্থিতিস্থাপকতার জন্য আরামদায়ক হতে পারে, কারণ গরম পানি রক্ত প্রবাহ বাড়ায় এবং পেশীগুলিকে শিথিল করে, ফলে প্রদাহ এবং ব্যথা উভয়ই হ্রাস পায়। যদিও সি-সেকশন একটি বড় ধরণের অস্ত্রোপচার, ডাক্তারের অনুমোদন ছাড়া গোসল করা উচিত নয়। তবে, কোমরের যন্ত্রণা হ্রাস করার জন্য হিটিং প্যাড ব্যবহার করা যেতে পারে, কিন্তু সার্জারির অংশে সরাসরি তাপ প্রয়োগ এড়িয়ে চলা উচিত (৩)।
বিশ্রাম নিন
সি-সেকশনের পরে অতিরিক্ত চলাফেরা আপনার কোমরের ব্যথাকে বৃদ্ধি করতে পারে। সেই কারণে, নিজের প্রতি যত্নশীল হতে হবে এবং যথেষ্ট বিশ্রাম নিশ্চিত করা জরুরি। সম্ভব হলে, সুযোগ পেলেই কিছু সময় ঘুমানোর চেষ্টা করুন কারণ ঘুমের সময় আপনার শরীর সেরে উঠার ও নিজেকে পুনর্নির্মাণের কাজ করে। একজন নতুন মা হিসেবে, বাচ্চার যত্নে ব্যস্ত থাকার ফলে অনেক সময় পর্যাপ্ত ঘুমানো কঠিন হয়ে পড়ে, তবে ঘুমের প্রতি নজর দেওয়া আপনার নিজের সেরে ওঠার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করবে।
হালকা ব্যায়াম শুরু করুন
প্রসবোত্তর সময়ে সক্রিয় থাকা কোমর ও পেটের পেশিগুলিকে সুস্থ রাখতে এবং ব্যথা কমাতে অনেক সাহায্য করে। যোগ ব্যায়াম, পিলাটিস বা হালকা হাঁটা এই প্রক্রিয়ায় বিশেষভাবে কার্যকরী। এখানে আপনাদের কিছু সহজ ব্যায়াম সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছি যা বাড়িতে অনায়াসে করা যায়।
বেলি ব্রিদিংঃ বেলি ব্রিদিং হচ্ছে একটি চমৎকার শিথিলকরণ কৌশল যা আপনার কোর পেশি গুলিকে আবার কার্যকরী করে তোলে (৬)।
- প্রথমে একটি আরামদায়ক জায়গায় শুয়ে পড়ুন।
- হাত পেটের উপর রাখুন এবং শরীর শিথিল করুন।
- নাক দিয়ে গভীর শ্বাস নিন, পেটের প্রসারিত হওয়া অনুভব করুন।
- মুখ দিয়ে শ্বাস ছেড়ে দিন, নাভি মেরুদণ্ডের দিকে টানুন এবং পেটের পেশিগুলো সঙ্কুচিত করুন। ৩ সেকেন্ড ধরে রাখুন।
- প্রতিদিন তিনবার, প্রতিবার ৫ থেকে ১০ বার অনুশীলন করুন।
সিটেড কেগেল এক্সারসাইজঃ গবেষণা বলছে, প্রসবোত্তর অবস্থায় পেলভিক ফ্লোর পেশীকে সজীব রাখার জন্য কেগেল এক্সারসাইজ দারুণ উপকারী। সিজারিয়ান সেকশনের পর ইউরিনারি ক্যাথেটার থাকলে, ক্যাথেটার সরানোর পর এই ব্যায়ামটি আরম্ভ করুন (৫)।
- প্রথমে চেয়ারে সোজা হয়ে বসুন, পা মাটিতে রেখে।
- পেলভিক ফ্লোর পেশীগুলোকে সংকুচিত করুন যেন আপনি প্রস্রাব থামাচ্ছেন এমন ভাব।
- সংকোচন যতক্ষণ সম্ভব ধরে রাখুন, শুরুতে ৫ সেকেন্ড থেকে শুরু করে সময়কাল ধীরে ধীরে বাড়ান।
- গভীর শ্বাস নিয়ে শ্বাস ছেড়ে দিন এবং পেশীগুলো শিথিল করুন।
- বসে, দাঁড়িয়ে বা শুয়ে কেগেল এক্সারসাইজ করুন। প্রতিবার ২ মিনিটের বিরতি নিয়ে ৮-১২ বার অনুশীলন করুন, দিনে দুইবার।
ওয়াল স্কোয়াটঃ ওয়াল স্কোয়াট এক্সারসাইজটি আপনার কোয়াড্রিসেপস, হ্যামস্ট্রিং, পেলভিক ফ্লোর, কোর এবং লোয়ার ব্যাকের মাসলগুলোকে একসাথে কাজ করতে সাহায্য করে।
- প্রথমে দেয়ালের সাথে পিঠ দিয়ে দাঁড়ান, দেয়াল থেকে ১-২ ফুট দূরে।
- তারপর দেয়ালের দিকে ধীরে ধীরে ঝুঁকুন এবং বসার ভঙ্গিতে নেমে আসুন, যাতে আপনার কোমর ও হাঁটু ৯০ ডিগ্রী কোণে থাকে।
- গভীর শ্বাস নিয়ে, শ্বাস ছেড়ে দিন এবং এই সময় পেটের পেশিগুলোকে সংকুচিত করুন।
- এই অবস্থায় কেগেল এক্সারসাইজ করার চিন্তা করতে পারেন।
- যতক্ষণ সম্ভব অবস্থান ধরে রাখুন, তারপর ১ মিনিটের জন্য বিশ্রাম নিন। এটি ৫ বার পুনরাবৃত্তি করুন।
আপনার শারীরিক গঠন এবং অবস্থানুযায়ী, কোমর ব্যথার চিকিৎসায় একজন দক্ষ ফিজিওথেরাপিস্ট বিভিন্ন পদ্ধতিতে সাহায্য করতে পারেন। তাই যদি সিজারিয়ান সেকশনের পর কোমর ব্যথায় কষ্ট পেয়ে থাকেন তবে দেরি না করে একজন বিশেষজ্ঞ ফিজিওথেরাপিস্টের পরামর্শ নিন।