পিঠে ব্যথা (Back Pain) এমন একটি স্বাস্থ্যগত সমস্যা, যা প্রায়শই মানুষের দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলে। এটি হঠাৎ শুরু হতে পারে কিংবা ধীরে ধীরেও বৃদ্ধি পেতে পারে এবং বিভিন্ন কারণে উদ্ভূত হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের প্রায় ৮০% মানুষ তাদের জীবনে অন্তত একবার হলেও পিঠে ব্যথার সম্মুখীন হন।

Table of Contents hide

পিঠে ব্যথার প্রধান কারণসমূহ

পিঠের উপরের ও মাঝের অংশের ব্যথা (ডরসাল পেইন), বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা, স্নায়ুর জটিলতা ও অন্যান্য শারীরিক রোগের কারণে হতে পারে। এখানে গবেষণা-ভিত্তিক কিছু মূল কারণ তুলে ধরা হলো।

মেকানিক্যাল কারণ

এই ধরনের ব্যথা মূলত মেরুদণ্ডের গঠনগত সমস্যা, পেশির টান, বা বয়সজনিত পরিবর্তনের কারণে হয়ে থাকে।

  • পেশির টান ও লিগামেন্টের আঘাত: দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা, ভুল ভঙ্গিতে কাজ করা বা হঠাৎ নড়াচড়া করলে পিঠের পেশি ও লিগামেন্টে টান পড়ে ব্যথা হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘক্ষণ ডেস্কে বসে কাজ করলে পিঠের পেশি শক্ত হয়ে যায়, যা দীর্ঘস্থায়ী ব্যথার কারণ হতে পারে (Liao et al., 2024)।
  • হাড়ের ডিস্ক সরে যাওয়া (Herniated Thoracic Disc): পিঠের মেরুদণ্ডের ডিস্ক ফেটে গেলে বা স্থানচ্যুত হলে তা নার্ভের উপর চাপ দেয়, যা তীব্র ব্যথার কারণ হতে পারে। যদিও এই সমস্যা বেশিরভাগ ঘাড় (সার্ভিক্যাল) ও কোমরে (ল্যাম্বার) হয়, তবে থোরাসিক ডিস্কের সমস্যার হার ০.২৫-০.৭৫% (Liao et al., 2024)।
  • স্পাইনাল স্টেনোসিস (Spinal Stenosis): থোরাসিক মেরুদণ্ডের সংকুচিত হওয়া (স্টেনোসিস) নার্ভের উপর চাপ সৃষ্টি করে ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই সমস্যা বেশি দেখা যায় এবং এটি নড়াচড়া সীমিত করে দিতে পারে (Finnerup et al., 2019)।
  • মেরুদণ্ডের বাত (Osteoarthritis of the Thoracic Spine): বয়স বাড়ার সাথে সাথে মেরুদণ্ডের জয়েন্টের কার্টিলেজ নষ্ট হয়ে যায়, যার ফলে পিঠে ব্যথা হয় ও পেশী শক্ত হয়ে যায়। গবেষণায় বলা হয়েছে, ৫০ বছরের বেশি বয়সীদের ২০-৩০% এই সমস্যায় আক্রান্ত (Hartvigsen et al., 2018)।

স্নায়ুবিক (Neurological) কারণ

স্নায়ুর সমস্যা হলে ব্যথা সাধারণত তীব্র, জ্বালাপোড়ার অনুভূতি তৈরি করে বা পিঠ থেকে শরীরের অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে।

স্নায়ুবিক (Neurological) কারণ
  • নিউরোপ্যাথিক ব্যথা ও সেন্ট্রাল সেনসিটাইজেশন: স্নায়ুর দীর্ঘমেয়াদী উত্তেজনার কারণে ব্যথা অনুভূতির মাত্রা বেড়ে যায়। গবেষণায় বলা হয়েছে, আগের কোনো আঘাত বা নার্ভজনিত সমস্যা থাকলে এই ধরনের ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে (Liao et al., 2024)।
  • থোরাসিক রেডিকুলোপ্যাথি (Thoracic Radiculopathy): মেরুদণ্ডের নার্ভ রুট চাপে পড়লে তা বুক ও পিঠজুড়ে ব্যথা তৈরি করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, সব স্পাইনাল রেডিকুলোপ্যাথির মাত্র ২-৫% পিঠের অংশে হয়, তবে এটি অত্যন্ত কষ্টদায়ক হতে পারে (Van Oosterwijck et al., 2025)।
  • মাইলোপ্যাথি (Myelopathy – স্পাইনাল কর্ডে চাপ পড়া): যদি স্পাইনাল কর্ডে কোনো কারণে চাপ পড়ে, তবে এটি দুর্বলতা, অবশ-অবশ ও পিঠে ব্যথার কারণ হতে পারে। গবেষণায় বলা হয়েছে, এটি চলাফেরা ও অনুভূতির উপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে যদিও এটি তুলনামূলকভাবে বিরল (Finnerup et al., 2019)।

রোগভিত্তিক ও অন্যান্য কারণ

কিছু রোগ ও শারীরিক অবস্থা রয়েছে, যা পিঠের ব্যথার মূল কারণ হতে পারে।

  1. অস্টিওপোরোসিস ও হাড় ভাঙা (Osteoporosis and Compression Fractures): মেরুদন্ডের হাড় দুর্বল হয়ে গেলে তা সহজেই ভেঙে যেতে পারে, যা পিঠের তীব্র ব্যথার কারণ হয়।
  2. কিডনির সমস্যা (Kidney Disorders): কিডনি সংক্রমণ বা কিডনিতে পাথর হলে পিঠের নিচের অংশে ব্যথা হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, কিডনি ব্যথা অনেক সময় পেশির ব্যথার মতো মনে হতে পারে, যা সঠিকভাবে নির্ণয় করা জরুরি (Cohen & Mao, 2014)।
  3. অটোইমিউন রোগ (Autoimmune Disorders – রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, অ্যাঙ্কিলোজিং স্পন্ডাইলাইটিস): রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস বা অ্যাঙ্কিলোজিং স্পন্ডাইলাইটিসের কারণে মেরুদণ্ডের জোড়ায় প্রদাহ হতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদী ব্যথার কারণ হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যাঙ্কিলোজিং স্পন্ডাইলাইটিসে আক্রান্ত রোগীদের পিঠে ব্যথার ঝুঁকি ৪.৩ গুণ বেশি (Sherman, 2007)।
  4. মেরুদণ্ডের টিউমার ও ইনফেকশন (Spinal Tumors and Infections): পিঠের মেরুদন্ডে টিউমার বা ইনফেকশন হলে তা স্থায়ী পিঠে ব্যথার কারণ হতে পারে। গবেষণায় বলা হয়েছে, যদি পিঠের ব্যথার সাথে ওজন কমে যাওয়া, জ্বর আসে, বা রাতে ব্যথা থাকে, তাহলে দ্রুত ডাক্তার দেখানো উচিত (Baron et al., 2010)।

পিঠে ব্যথার উপসর্গ যা চিন্তার কারণ হতে পারে (Red Flag Symptoms)

রোগীদের অবশ্যই সতর্ক হওয়া উচিত যদি পিঠে ব্যথার সাথে নিচের উপসর্গগুলি দেখা দেয়:

  • পিঠের ব্যথার পাশাপাশি বুকের ব্যথা বা শ্বাসকষ্ট (Cardiac Symptoms)
  • প্রস্রাব বা পায়খানার নিয়ন্ত্রণ হারানো (Cauda Equina Syndrome)
  • হাত-পায়ে অবশভাব বা দুর্বলতা (Nerve Compression)
  • রাতে ব্যথা বৃদ্ধি পাওয়া (Possible Tumor or Infection)

এই ধরনের উপসর্গ থাকলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক।

পিঠে ব্যথা সাধারণত স্বল্পমেয়াদী হয়, তবে কিছু উপসর্গের উপস্থিতি গুরুতর সমস্যার ইঙ্গিত দিতে পারে। নিচে এমন কিছু রেড ফ্ল্যাগ উপসর্গ উল্লেখ করা হলো, যা পিঠে ব্যথার সাথে দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত:

১. পিঠের ব্যথার পাশাপাশি বুকের ব্যথা বা শ্বাসকষ্ট(Cardiac Symptoms): যদি পিঠে ব্যথার সাথে সাথে বুকের ব্যথা বা শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়, এটি হৃদরোগের লক্ষণ হতে পারে, যেমন মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন (হার্ট অ্যাটাক)। এ ধরনের উপসর্গ অবহেলা করা উচিত নয়, কারণ তা জীবন-ঝুকির কারণ হতে পারে।

২. প্রস্রাব বা পায়খানার নিয়ন্ত্রণ হারানো (Cauda Equina Syndrome): Cauda Equina Syndrome একটি জরুরি অবস্থা, যেখানে মেরুদণ্ডের নিচের অংশের স্নায়ুর ওপর চাপ পড়ে। এর ফলে প্রস্রাব বা পায়খানার নিয়ন্ত্রণ হারানো, যৌন অক্ষমতা, এবং পায়ের দুর্বলতা দেখা দিতে পারে। দ্রুত চিকিৎসা না করালে স্থায়ীভাবে স্নায়ুর ক্ষতি হতে পারে।

৩. হাত-পায়ে অবশভাব বা দুর্বলতা (Nerve Compression): পিঠে ব্যথার সাথে যদি হাত বা পায়ে অবশভাব, ঝিনঝিনে অনুভূতি, বা পেশির দুর্বলতা দেখা দেয়, এটি স্নায়ুর উপর চাপ পড়ার লক্ষণ হতে পারে, যেমন হার্নিয়েটেড ডিস্ক বা স্পাইনাল স্টেনোসিসের ক্ষেত্রে এমনটা হতে পারে। এ ধরনের উপসর্গ অবহেলা করলে স্থায়ীভাবে স্নায়ুর ক্ষতি হতে পারে।

৪. রাতে ব্যথা বৃদ্ধি পাওয়া (Possible Tumor or Infection): যদি পিঠের ব্যথা রাতে বৃদ্ধি পায় এবং বিশ্রামের পরও না কমে তাহলে এটি মেরুদণ্ডের সংক্রমণ (ইনফেকশন) বা টিউমারের লক্ষণ হতে পারে। বিশেষ করে যদি জ্বর থাকে, ওজন কমে যাওয়া, বা সাধারণ অসুস্থতার লক্ষণ থাকে, তবে দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন।

উপরোক্ত উপসর্গগুলির যেকোনো একটি পিঠে ব্যথার পাশাপাশি দেখা দিলে, তা অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। সঠিক সময়ে চিকিৎসা গ্রহণ গুরুতর জটিলতা প্রতিরোধে সহায়তা করে এবং রোগীর সুস্থতা নিশ্চিত করে।

পিঠের ব্যথায় কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন?

পিঠে ব্যথা সাধারণত স্বল্পমেয়াদী এবং স্ব-সীমাবদ্ধ হয়, তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি দীর্ঘস্থায়ী বা গুরুতর সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি পিঠে ব্যথা ৬ সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হয় বা দৈনন্দিন কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করে, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি (Watari, 2024).

চিকিৎসকের মূল্যায়ন প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত করতে পারে:

  1. শারীরিক নীরিক্ষণ (Physical Examination): চিকিৎসক পিঠের গঠন, নড়, এবং ব্যথার স্থানের উপর ভিত্তি করে শারীরিক পরীক্ষা পরিচালনা করেন। শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে পেশী, লিগামেন্ট, এবং স্নায়ুর কার্যকারিতা মূল্যায়ন করা যায়, যা সঠিক রোগ নির্ণয়ে সহায়তা করে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে ৮০% ক্ষেত্রে ব্যথার প্রধান কারণ চিহ্নিত করা যায় (Srinivas et al., 2024).
  2. ইমেজিং পরীক্ষা (Imaging Tests):
    • X-ray: হাড়ের পরিবর্তন, যেমন অস্টিওআর্থ্রাইটিস বা ফ্র্যাকচারের উপস্থিতি নির্ণয়ে সহায়তা করে।
    • MRI বা CT scan: সফট টিস্যু, ডিস্ক, এবং স্নায়ুর বিস্তারিত চিত্র প্রদান করে, যা হার্নিয়েটেড ডিস্ক বা স্পাইনাল স্টেনোসিস সনাক্ত করতে ব্যবহৃত হয়। ইমেজিং পরীক্ষার মাধ্যমে পিঠে ব্যথার অন্তর্নিহিত কারণ নির্ণয় এবং উপযুক্ত চিকিৎসা পরিকল্পনা নির্ধারণ করা যায়।
  3. নিউরোলজিকাল টেস্ট (Neurological Tests): রিফ্লেক্স, পেশীর শক্তি, এবং সংবেদনশীলতা পরীক্ষা করে স্নায়ুর কার্যকারিতা যাচাই করা হয়। নিউরোলজিকাল পরীক্ষার মাধ্যমে স্নায়ুর ক্ষতির মাত্রা বা চাপে পড়ার লক্ষণ সনাক্ত করা যায়, যা দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে।

পিঠে ব্যথার চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা (Treatment & Management)

পিঠে ব্যথার চিকিৎসা এবং ব্যবস্থাপনা নির্ভর করে ব্যথার তীব্রতা, স্থায়িত্ব, এবং মূল কারণের ওপর। গবেষণা অনুসারে, অধিকাংশ রোগী সংযত চিকিৎসা ও জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমে ব্যথা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হন, তবে কিছু ক্ষেত্রে বিশেষায়িত চিকিৎসা বা সার্জারি প্রয়োজন হয় (Sheth et al., 2024).

প্রাথমিক চিকিৎসা (Self-Management & Home Remedies)

  • পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও ব্যথানাশক ওষুধ (NSAIDs): শুরুর দিকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং ওভার-দ্য-কাউন্টার নন-স্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ড্রাগস (NSAIDs) যেমন আইবুপ্রোফেন বা ন্যাপ্রোক্সেন ব্যথা ও প্রদাহ কমাতে সহায়তা করে।
  • বরফ ও গরম সেক (Cold & Heat Therapy): তীব্র ব্যথা হলে বরফের সেক প্রদাহ কমাতে এবং দীর্ঘদিনের পুরনো ব্যথার ক্ষেত্রে গরম সেক পেশি শিথিল করতে কার্যকর।
  • স্ট্রেচিং ও যোগব্যায়াম: নিয়মিত স্ট্রেচিং এবং যোগব্যায়াম পিঠের পেশির নমনীয়তা বাড়িয়ে ব্যথা কমাতে সহায়তা করে। গবেষণায় দেখা গেছে, হাঠাৎ পিঠে ব্যথা শুরু হলে ৮ সপ্তাহ নিয়মিত স্ট্রেচিং করলে ব্যথা ৪৫%-৫০% হ্রাস পেতে পারে (Juneja, 2024).

ফিজিওথেরাপি ও পুনর্বাসন (Physiotherapy & Rehabilitation)

  • কোর স্ট্রেন্থেনিং এক্সারসাইজ (Core Strengthening Exercises): পিঠের পেশি শক্তি বাড়াতে বিশেষ এক্সারসাইজ ব্যথা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
  • ম্যানুয়াল থেরাপি (Manual Therapy): হাতের মাধ্যমে বিশেষ পদ্ধতিতে পেশি ও জয়েন্টে চাপ প্রয়োগ করে ব্যথা ও স্টিফনেস কমানো হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ম্যানুয়াল থেরাপির মাধ্যমে ব্যথা উপশমের হার প্রায় ৬৫%-এরও বেশি (Gilligan et al., 2025).
  • নিউরোমাসকুলার রি-এডুকেশন (Neuromuscular Re-education): স্নায়ু ও পেশির সমন্বয় উন্নত করতে বিশেষ থেরাপি ব্যবহৃত হয়, যা কার্যকারিতা বাড়ায়। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, এটি পেশির কার্যক্ষমতা উন্নত করতে সহায়তা করে এবং ব্যথা পুনরাবৃত্তি হওয়ার সম্ভাবনা কমায় (Vesper, 2025).

সার্জারি কখন প্রয়োজন?

যদি ৬ মাস বা তার বেশি সময় ধরে ব্যথা থাকে এবং কোনো চিকিৎসায় উন্নতি না হয়, তাহলে এটি দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় বড় ধরনের বাধা সৃষ্টি করতে পারে। সাধারণত ফিজিওথেরাপি, ব্যথানাশক ওষুধ, ইনজেকশন ইত্যাদি চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো কাজে না আসলে ব্যথার তীব্রতা আরও বাড়তে পারে। এই অবস্থায় ব্যথার কারণ খুঁজে বের করে উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতির প্রয়োজন হতে পারে, যাতে রোগী স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করতে পারেন। নিচে সার্জারির প্রয়োজনীয় কারণগুলো ব্যাখ্যা করা হলো:

স্নায়বিক সমস্যা (Neurological Deficits – স্পাইনাল কর্ডের চাপে সৃষ্টি হওয়া জটিলতা)

  • ক্রমাগত দুর্বলতা বা সংবেদনশীলতা হারানো (Progressive Weakness or Numbness): হাত, পা বা শরীরের কোনো অংশের দুর্বলতা যা সময়ের সাথে বাড়তে থাকে। হাঁটতে সমস্যা, ভারসাম্য হারানো বা সমন্বয়জনিত সমস্যা (Coordination Issues)।
  • মল-মূত্র নিয়ন্ত্রণ হারানো (Cauda Equina Syndrome): আকস্মিক প্রস্রাব বা পায়খানা ধরে রাখতে না পারা (Incontinence)। স্যাডল এরিয়া (কোমরের নিচের অংশ) ও উরুর সংবেদনশীলতা কমে যাওয়া।
  • তীব্র র‍্যাডিকুলোপ্যাথি (Severe Radiculopathy – নার্ভ রুটের চাপে ব্যথা): পাঁজর, বুক বা পেটে ছড়িয়ে পড়া তীব্র ব্যথা যা স্পাইনাল নার্ভের চাপে সৃষ্টি হয়। ওষুধ, ইনজেকশন বা ফিজিওথেরাপির পরেও ব্যথা না কমা।

মেরুদণ্ডের ভারসাম্যহীনতা (Spinal Instability)

  • মেরুদণ্ডের ফ্র্যাকচার ও আঘাত (Fractures & Trauma)ঃ পিঠের মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে যাওয়া (ভার্টিব্রাল ফ্র্যাকচার) বা স্পাইনাল কর্ডে চাপ পড়ার মতো সমস্যাগুলো মারাত্মক ব্যথার কারণ হতে পারে। সাধারণত গুরুতর আঘাত, অস্টিওপরোসিস বা ক্যান্সারজনিত হাড় ক্ষয় হলে এই ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। এতে মেরুদণ্ডের স্বাভাবিক গঠন নষ্ট হতে পারে, যা দৈনন্দিন চলাফেরা ও স্বাভাবিক কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটায়।
  • দীর্ঘমেয়াদী ক্ষয়জনিত সমস্যা (Degenerative Conditions – দীর্ঘদিন ধরে মেরুদণ্ডের সমস্যা): পিঠের মেরুদন্ডের ডিস্ক হার্নিয়েশন তখনই গুরুতর হয়ে ওঠে, যখন ডিস্কের কারণে দীর্ঘদিন ব্যথা থেকে যায় এবং নার্ভের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে, ফলে বিভিন্ন স্নায়বিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।

এছাড়া, স্কোলিওসিস, কাইফোসিস বা স্পন্ডাইলোলিস্থেসিসের কারণে মেরুদণ্ডের স্বাভাবিক গঠন বিকৃত হয়ে যেতে পারে। এই ধরনের পরিবর্তন তীব্র ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে এবং শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতায় বাধা দিতে পারে, যা দৈনন্দিন কাজকর্মকে কষ্টকর করে তোলে।

মেরুদণ্ডের টিউমার ও সংক্রমণ (Spinal Tumors & Infections)

  • স্পাইনাল টিউমার (Primary or Metastatic Tumors): যদি টিউমার মেরুদণ্ড বা স্পাইনাল কর্ডের ওপর চাপ সৃষ্টি করে, তাহলে এটি তীব্র ব্যথা, অস্থিরতা এবং স্নায়বিক সমস্যার কারণ হতে পারে। বিশেষ করে স্তন, ফুসফুস বা প্রোস্টেট ক্যান্সার থেকে ছড়িয়ে পড়া মেটাস্ট্যাটিক টিউমার মেরুদণ্ডে ছড়িয়ে পড়ে এবং মারাত্মক ব্যথা তৈরি করতে পারে।
  • মেরুদণ্ডে সংক্রমণ (Osteomyelitis, Epidural Abscess, Tuberculosis): গুরুতর সংক্রমণ যা মেরুদণ্ডের সংহতি নষ্ট করে এবং স্পাইনাল কর্ডে চাপ সৃষ্টি করে। অ্যাবসেস (Pus Formation) তৈরি হয়ে স্নায়বিক সমস্যার কারণ হলে সার্জারি প্রয়োজন হয়।

কিভাবে পিঠের ব্যথা প্রতিরোধ করবেন(Prevention Strategies)

পিঠের ব্যথা (Dorsal Pain) বর্তমানে কর্মজীবী, ছাত্র, ও প্রবীণদের মধ্যে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা, ভুল ভঙ্গিতে কাজ করা, ওজন বৃদ্ধি, এবং শারীরিক এক্সারসাইজের অভাবের কারণে হতে পারে।

সঠিক ভঙ্গি বজায় রাখা (Maintaining Proper Posture)

কিভাবে সঠিক ভঙ্গি বজায় রাখবেন?

  • চেয়ারে বসার সময় পিঠ সোজা ও ঘাড় সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখুন।
  • কম্পিউটার স্ক্রিন চোখের সমান্তরালে রাখুন।
  • পা মাটির সাথে সমান রাখুন ও দীর্ঘক্ষণ বসে থাকলে ব্রেক নিন।
  • Yilmaz et al. (2024) দেখিয়েছেন যে, সঠিক ভঙ্গি বজায় রাখলে থোরাসিক ব্যথার হার ৪০% কমে যায়।

এক্সারসাইজ ও স্ট্রেচিং (Exercise & Stretching)

কোন ব্যায়াম সবচেয়ে উপকারী?

  • থোরাসিক এক্সটেনশন ব্যায়াম: এই ব্যায়াম মেরুদণ্ডের নমনীয়তা বাড়ায়।
  • কোর স্ট্রেন্থ ব্যায়াম: পিঠ ও পেটের পেশি শক্তিশালী করে ব্যথা প্রতিরোধ করে।
  • কাঁধ ও ঘাড়ের স্ট্রেচিং: পেশির চাপ কমিয়ে ব্যথা কমায়।
  • Beneka et al. (2024) এর গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রতি সপ্তাহে ৩ দিন ২০-৩০ মিনিটের এক্সারসাইজ পিঠের ব্যথা ৫০% পর্যন্ত কমাতে পারে।

কর্মক্ষেত্রে বসার পরিবেশ ঠিক করা (Ergonomics & Workplace Adjustments)

কিভাবে অফিস বা বাড়িতে বসার ব্যবস্থা ঠিক করবেন?

  • এরগোনমিক চেয়ার ও ডেস্ক ব্যবহার করুন।
  • কম্পিউটার স্ক্রিন চোখের উচ্চতায় রাখুন।
  • কিবোর্ড ও মাউস এমন উচ্চতায় রাখুন যাতে হাত স্বাভাবিক অবস্থানে থাকে।
  • প্রতি ৩০-৪৫ মিনিট পর উঠে হাঁটুন বা স্ট্রেচ করুন।

সঠিক জীবনধারা অনুসরণ করা (Lifestyle Modifications)

স্বাস্থ্যকর জীবনধারার কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক:

  • ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা: অতিরিক্ত ওজন মেরুদণ্ডের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
  • পর্যাপ্ত ঘুম নেওয়া: সঠিক ঘুম মেরুদণ্ডের সুস্থতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
  • স্ট্রেস কমানো: মানসিক চাপ মাংসপেশির সংকোচন ঘটিয়ে ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে।
  • Guduru et al. (2022) এর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ওজন কমালে ও স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণে রাখলে ব্যথার সম্ভাবনা ৪৫% কমে যায়।

ভারী বস্তু সঠিকভাবে তোলা (Proper Lifting Techniques)

কিভাবে ভারী বস্তু তুলবেন?

  • পিঠ সোজা রেখে হাঁটু ভাঁজ করে বসুন, তারপর ওজন তুলুন।
  • হঠাৎ মেরুদণ্ড বাঁকানো বা মোচড়ানো এড়িয়ে চলুন।

দীর্ঘ সময় বসে থাকলে ব্রেক নিন (Taking Breaks from Prolonged Sitting)

দীর্ঘক্ষণ বসে থাকলে কী করবেন?

  • প্রতি ৩০-৪৫ মিনিট পর উঠে হাঁটুন।
  • বসার সময় মাঝে মাঝে মেরুদণ্ড প্রসারিত করুন (spinal extension)।
  • সোফা বা নরম চেয়ারে বসা কমিয়ে শক্ত চেয়ারে বসুন।
  • Saiklang et al. (2022) গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, প্রতি ঘণ্টায় ৫ মিনিটের মুভমেন্ট ব্রেক পিঠের ব্যথা ৩৫%-৪০% কমিয়ে দিতে পারে।

উপসংহার (Conclusion)

পিঠে ব্যথার কারণ ও প্রকৃতি একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম হতে পারে। স্বল্পমেয়াদী ব্যথা সাধারণত নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই সেরে যায়, কিন্তু দীর্ঘদিনের পুরনো ব্যথা পেশি, নার্ভ, বা হাড়ের সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। কিছু লক্ষণ যেমন প্রস্রাব বা পায়খানার নিয়ন্ত্রণ হারানো, পায়ে দুর্বলতা, রাতে ব্যথা বৃদ্ধি পাওয়া, বা ওজন কমে যাওয়া— গুরুতর সমস্যা নির্দেশ করতে পারে, যেখানে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। ব্যথা নিয়ন্ত্রণের জন্য জীবনধারা পরিবর্তন, নিয়মিত ব্যায়াম ও ফিজিওথেরাপি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী ব্যথার ক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপি, ওষুধ বা প্রয়োজন অনুযায়ী সার্জারি করা হতে পারে। তবে, সঠিক তথ্য ও সচেতনতা অনেক ক্ষেত্রে রোগীদের অপ্রয়োজনীয় চিকিৎসা বা সার্জারি থেকে রক্ষা করতে পারে। তাই, পিঠে ব্যথার প্রকৃতি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

Dr. M Shahadat Hossain
Follow me

Physiotherapist, Pain, Paralysis & Manipulative Therapy Specialist, Assistant Professor Dhaka College of Physiotherapy, Secretary-General(BPA), Secretary(CARD), Chief Consultant(ASPC), Conceptual Inventor(SDM), Faculty Member(CRP), Member-Bangladesh Rehabilitation Council

ব্রেন টিউমারের লক্ষন এবং ব্রেন টিউমারের কারন

ব্রেন টিউমারের লক্ষন এবং ব্রেন টিউমারের কারন। ব্রেন টিউমার হলো মস্তিষ্কে অস্বাভাবিক…
পরামর্শ নিতে 01877733322