সায়াটিকা এমন এক ধরণের ব্যথা, যা মেরুদণ্ডের নিচের অংশ থেকে শুরু হয়ে নিতম্ব, উরু ও পায়ের পেছন দিয়ে পায়ের পাতা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এর মূল কারণ হলো সায়াটিক নার্ভে চাপ পড়া, যা সাধারণত ঘটে ডিস্ক ফেটে যাওয়া (প্রল্যাপ্স), স্পাইনাল স্টেনোসিস বা পাইরিফর্মিস সিন্ড্রোম এর মতো গঠনগত সমস্যার কারণে (Valat et al., 2010; Deyo & Mirza, 2016)। এই ব্যথা অনেক সময় খুব তীব্র হয়, অনেকেই বলেন যেন “বিদ্যুৎ শকের মতো ব্যথা”, যা কিনা বসা, দাঁড়ানো বা হাঁটাচলার মতো সাধারণ কাজগুলোতেও কষ্ট দেয়।

বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি প্রচলিত ধারণা হলো—সায়াটিকার একমাত্র চিকিৎসা হলো অস্ত্রোপচার। বিশেষ করে ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হলে বা ওষুধে কাজ না করলে রোগীরা মনে করেন, অপারেশন ছাড়া গতি নেই।

অন্যদিকে, অনেকে আবার অস্ত্রোপচার শুনেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন—

  • “সার্জারির পর আবার ব্যথা হবে না তো?”,
  • “পরিপূর্ণ সুস্থতা ফিরবে তো?”,
  • “চলাফেরায় কোনো সমস্যা হবে কি না?”

এইসব প্রশ্ন রোগীর মনে সংশয় তৈরি করে এবং চিকিৎসা গ্রহণের সিদ্ধান্তেও প্রভাব ফেলে (Atlas & Deyo, 2001)।

তবে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক গাইডলাইন বলছে ভিন্ন কথা। অধিকাংশ সায়াটিকা রোগীই কনজারভেটিভ চিকিৎসা, যেমন ওষুধ, ফিজিওথেরাপি এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন অনুসরণের মাধ্যমে ভালো হয়ে উঠতে পারেন (Qaseem et al., 2017; Chou et al., 2007)।

সুতরাং, সায়াটিকা মানেই অস্ত্রোপচার প্রয়োজন—এই ধারণা একেবারেই সঠিক নয়। বরং প্রতিটি রোগীর অবস্থা অনুযায়ী চিকিৎসা নেওয়াই সবচেয়ে কার্যকর ও নিরাপদ পথ।

Table of Contents hide

সায়াটিকা ব্যথার কারণ ও গঠনগত ব্যাখ্যা

সায়াটিক নার্ভ হলো মানবদেহের সবচেয়ে বড়, দীর্ঘ এবং পুরু স্নায়ু, যা মেরুদণ্ডের নিচের অংশ—L4, L5, S1, S2 এবং S3 স্নায়ুমূল থেকে শুরু হয়ে নিতম্ব, উরু, হাঁটু এবং পায়ের পেছনের দিক দিয়ে পায়ের পাতা পর্যন্ত বিস্তৃত। এই নার্ভ আমাদের পায়ে অনুভূতি, চলাফেরা এবং ভারসাম্য রক্ষার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ (Ropper & Zafonte, 2015)।

যখন কোনো কারণে এই নার্ভে চাপ পড়ে বা প্রদাহ তৈরি হয়, তখনই সায়াটিকার ব্যথা শুরু হয়। এটি কোনো একটি রোগ নয়, বরং এমন একটি উপসর্গ যার পেছনে থাকে বিভিন্ন গঠনগত বা প্যাথোলজিক্যাল সমস্যা।

ডিস্ক হার্নিয়েশন (Herniated Disc)

সায়াটিকার সবচেয়ে সাধারণ এবং গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো ডিস্ক হার্নিয়েশন।

আমাদের মেরুদণ্ডের কশেরুকার (vertebra) মাঝে থাকে একটি নরম ডিস্ক, যেটির বাইরের আবরণকে বলে annulus fibrosus এবং ভেতরের নরম অংশকে বলে nucleus pulposus।

যখন কোনো কারণে বাইরের আবরণটি ছিঁড়ে যায়, তখন ভেতরের জেলির মতো নরম অংশটি বেরিয়ে এসে সায়াটিক নার্ভ বা তার মূল অংশে চাপ সৃষ্টি করে।

এর ফলে দেখা দেয়:

  • তীব্র ব্যথা
  • পায়ে ঝিঁঝিঁ বা অবশভাব
  • কোনো কোনো ক্ষেত্রে পেশির দুর্বলতা বা ভারসাম্যহীনতা

গবেষণায় পাওয়া গেছে —ডিস্কের গঠন ভেঙে গেলে স্নায়ুতে সরাসরি চাপ পড়ে, আর তাতেই সায়াটিকার লক্ষণ দেখা দেয়। (Adams & Roughley, 2006; Deyo & Mirza, 2016)।

সুতরাং, সায়াটিকার চিকিৎসায় এর মূল গঠনগত কারণ বোঝা খুবই জরুরি, যাতে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

স্পাইনাল স্টেনোসিস (Spinal Stenosis)

স্পাইনাল স্টেনোসিস হলো এমন একটি রোগ, যেখানে মেরুদণ্ডের ভিতরে স্নায়ুর চলাচলের জায়গা সংকুচিত হয়ে যায়। এই সংকোচনের ফলে স্নায়ুর ওপর চাপ পড়ে এবং ধীরে ধীরে সায়াটিকা ব্যথা শুরু হয়।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটে—হাড়ের অতিরিক্ত বৃদ্ধি (osteophyte), লিগামেন্ট মোটা হয়ে যাওয়া, কিংবা ডিস্কের উচ্চতা কমে যাওয়া বা ক্ষয়—এইসব কারণে মেরুদণ্ডের ভেতরের ফাঁকা জায়গা সরু হয়ে যায়। এর ফলে সায়াটিক নার্ভে চাপ পড়ে, বিশেষ করে হাঁটার সময় বা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে ব্যথা আরও তীব্র হয়ে ওঠে (Konstantinou & Dunn, 2008)।

পাইরিফর্মিস সিন্ড্রোম (Piriformis Syndrome)

এই সমস্যা তুলনামূলকভাবে কম পরিচিত হলেও সায়াটিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। নিতম্বের ভেতরে পাইরিফর্মিস নামে একটি পেশি থাকে, যা কখনো কখনো শক্ত হয়ে গেলে বা খিঁচে গেলে সায়াটিক নার্ভের ওপর চাপ তৈরি করে। কারণ, সায়াটিক নার্ভ প্রায়ই এই পেশির নিচ দিয়ে বা মাঝখান দিয়ে চলে যায়।

এই অবস্থায় রোগী নিতম্বে ব্যথা, পায়ে অবশভাব, টান বা ঝিঁঝিঁ অনুভব করেন, যা অনেক সময় সোজা হয়ে বসা বা হাঁটার সময় আরও বেড়ে যায় (Boyajian-O’Neill et al., 2008)।

কোন অবস্থায় সায়াটিকার ব্যথা বেশি তীব্র হয়?

সায়াটিকার ব্যথা সব সময় একরকম থাকে না—নিম্নোক্ত পরিস্থিতিতে ব্যথা হঠাৎ বেড়ে যেতে পারে:

  • দীর্ঘক্ষণ বসে থাকলে: এতে ডিস্কের ওপর চাপ বেড়ে যায় এবং স্নায়ুর ওপর টান পড়ে, ফলে ব্যথা বাড়ে।
  • হাঁটা বা ভারী বস্তু তুললে: মেরুদণ্ডের ওপর অতিরিক্ত লোড পড়ে, এতে স্নায়ুতে আরও চাপ পড়ে এবং ব্যথা বাড়ে।
  • হাঁচি, কাশি বা বাঁকা হয়ে কিছু তোলার সময়: এইসব ক্রিয়ায় মেরুদণ্ডের ভেতরে চাপ (intradiscal pressure) বেড়ে যায়, যার ফলে আচমকা ব্যথা বাড়তে পারে।
  • রাতে শোয়ার সময় বা সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর: অনেক সময় পেশি ও স্নায়ু বেশি শক্ত বা কাঠ হয়ে থাকে, তখন ব্যথা বেশি অনুভূত হয়।

অস্ত্রোপচার ছাড়া সুস্থ হওয়ার বৈজ্ঞানিক সম্ভাবনা

অস্ত্রোপচার ছাড়া সুস্থ হওয়ার বৈজ্ঞানিক সম্ভাবনা
অস্ত্রোপচার ছাড়া সুস্থ হওয়ার বৈজ্ঞানিক সম্ভাবনা

সায়াটিকা দেখা দিলে অনেকে ভয় পেয়ে যান এবং প্রথমেই অপারেশনের কথা ভাবতে শুরু করেন—বিশেষ করে যদি ব্যথা তীব্র হয়। কিন্তু বর্তমান চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণাগুলো বলছে, অস্ত্রোপচার ছাড়াও বেশিরভাগ সায়াটিকা রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হতে পারেন, যদি শুরু থেকেই সঠিকভাবে চিকিৎসা শুরু করা যায় এবং ধৈর্য ধরে কঞ্জারভেটিভ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।

Atlas & Deyo (2001)-এর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সায়াটিকা রোগীদের মধ্যে প্রায় ৭০–৮০ শতাংশ রোগীই ৬ থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যে শুধু বিশ্রাম, ব্যথানাশক ও এক্সারসাইজের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্যভাবে সুস্থ হয়ে ওঠেন। এরা অনেকেই ধীরে ধীরে ব্যথামুক্ত হন কোনো রকম অস্ত্রোপচার ছাড়াই। এতে প্রমাণিত হয়—প্রাথমিক পর্যায়ে তাড়াহুড়ো করে অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেওয়া সব সময় জরুরি নয়।

শরীরের নিজস্ব নিরাময় প্রক্রিয়া

মানবদেহের নিজেরও রয়েছে অসাধারণ নিরাময় ক্ষমতা। সঠিক যত্ন ও চিকিৎসা পেলে শরীর নিজেই ধীরে ধীরে সেরে উঠতে পারে। যেমন:

  • ডিস্ক শুকিয়ে যাওয়া বা ছোট হয়ে আসা (Resorption): অনেক সময় হার্নিয়েটেড ডিস্কের ফেটে বেরিয়ে আসা অংশ শরীর নিজে থেকেই ধীরে ধীরে শোষণ করে নেয়, ফলে স্নায়ুর ওপর চাপ কমে যায় এবং ব্যথা হ্রাস পায় (Komori et al., 1996)।
  • প্রদাহ কমে যাওয়া: প্রাথমিক পর্যায়ে ডিস্ক বা স্নায়ুতে যে প্রদাহ তৈরি হয়, তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমে আসে। এতে ব্যথাও অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসে।
  • পেশির শক্তি ও নার্ভের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা: সঠিক এক্সারসাইজ ও ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে পেশি ও নার্ভগুলো আগের অবস্থায় ফিরে আসে।

অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার অনেক ক্ষেত্রে এড়ানো যায়

Weinstein et al. (2006) পরিচালিত SPORT Trial (Spine Patient Outcomes Research Trial)-এ বলা হয়েছে, সায়াটিকা রোগীদের মধ্যে যারা অস্ত্রোপচার না করে শুধুমাত্র কনজারভেটিভ চিকিৎসা গ্রহণ করেছিলেন, তারাও ১–২ বছরের মধ্যে সার্জারি করা রোগীদের মতোই ভালো ফল পেয়েছেন।
এমনকি দীর্ঘমেয়াদে ব্যথা কমে যাওয়া, কাজের ক্ষমতা ফিরে পাওয়া ও জীবনমান উন্নয়নের দিক থেকেও বেশ ভালো থাকেন।

অস্ত্রোপচার ছাড়া চিকিৎসার প্রধান উপায়

অস্ত্রোপচার ছাড়া চিকিৎসার প্রধান উপায়
অস্ত্রোপচার ছাড়া চিকিৎসার প্রধান উপায়

সায়াটিকার ব্যথা দেখা দিলে অনেকেই ভেবে বসেন যে, অপারেশন ছাড়া এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু বাস্তবে বিষয়টি একেবারে উল্টো—গবেষণায় দেখা গেছে, বেশিরভাগ সায়াটিকা রোগীই অস্ত্রোপচার ছাড়াই সুস্থ হয়ে ওঠেন, যদি শুরু থেকেই সঠিক চিকিৎসা নেওয়া হয় এবং নিয়ম মেনে চলা যায় (Qaseem et al., 2017)। নিচে এমন কিছু প্রধান এবং কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি তুলে ধরা হলো যেগুলো অস্ত্রোপচার ছাড়াও সায়াটিকার ব্যথা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক:

ফিজিওথেরাপি ও নিয়মিত এক্সারসাইজ

সায়াটিকা চিকিৎসায় ফিজিওথেরাপি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

  • এটি কোমর ও পায়ের পেশিকে নমনীয় এবং শক্তিশালী করে তোলে, ফলে নার্ভের ওপর চাপ কমে যায়।
  • SDM বা Williams exercise, lumbar stabilization এর মতো এক্সারসাইজ বিশেষভাবে কার্যকর।
  • গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত ফিজিওথেরাপি করলে ৬০–৭০% রোগীর ব্যথা ও অক্ষমতা অনেকটাই কমে যায় (Fernandez et al., 2015)।

ব্যথানাশক ও প্রদাহনাশক ওষুধ (NSAIDs)

  • আইবুপ্রোফেন, ন্যাপ্রোক্সেন, মেলক্সিক্যাম ইত্যাদি ওষুধ সাধারণত ব্যবহৃত হয়।
  • এসব ওষুধ স্নায়ুর আশেপাশের প্রদাহ কমিয়ে ব্যথা উপশমে সহায়তা করে।
  • চিকিৎসকের পরামর্শে এই ওষুধ ব্যবহার করলে অস্ত্রোপচার ছাড়াই অনেক সময় ব্যথা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব (Chou et al., 2007)।

তবে দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে গ্যাস্ট্রিক বা কিডনির সমস্যা হতে পারে, তাই সাবধানে ও সীমিত সময়ের জন্য ব্যবহার করতে হয়।

স্ট্রেচিং ও কোর স্ট্যাবিলিটি এক্সারসাইজ

  • পাইরিফর্মিস ও হ্যামস্ট্রিং স্ট্রেচ, পেলভিক টিল্ট এবং ব্রিজিং এক্সারসাইজ স্নায়ুর ওপর চাপ কমাতে সাহায্য করে।
  • Plank বা leg raise-এর মতো কোর মাংসপেশি শক্তিশালী করার এক্সারসাইজ কোমরের ভারসাম্য বজায় রাখে ও ব্যথা কমায় (Hides et al., 2001)।
  • নিয়মিত এই এক্সারসাইজগুলো করলে ব্যথার পুনরাবৃত্তি কমে এবং শরীরের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা বাড়ে।

ইপিডুরাল স্টেরয়েড ইনজেকশন (ESI)

  • যখন ফিজিওথেরাপি ও ওষুধে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না এবং ব্যথা দীর্ঘমেয়াদি হয়ে যাচ্ছে, তখন এই ইনজেকশন দেওয়া হয়।
  • এটি প্রদাহ কমিয়ে দ্রুত ব্যথা উপশমে সহায়তা করে, বিশেষ করে হার্নিয়েটেড ডিস্কের ক্ষেত্রে কার্যকর।
  • অনেক ক্ষেত্রেই এটি অস্ত্রোপচার এড়াতে সাহায্য করে, যদিও দীর্ঘমেয়াদে উপকার পাওয়া সব সময় নিশ্চিত নয়।

সঠিক ঘুম, বসা ও দাঁড়ানোর অভ্যাস

  • কোমরে সাপোর্ট থাকে এমন চেয়ারে বসা, কাত হয়ে ঘুমানো ও হাঁটুর নিচে বালিশ রাখা—এই অভ্যাসগুলো মেরুদণ্ডের স্বাভাবিক গঠন বজায় রাখে এবং নার্ভে চাপ কমায় (Qaseem et al., 2017)।
  • ভার তুলতে গেলে হাঁটু ভাঁজ করে তোলা, দীর্ঘক্ষণ বসে না থেকে মাঝে মাঝে উঠে দাঁড়ানো ও হাঁটাহাঁটি করাও ব্যথা প্রতিরোধে কার্যকর।

কখন অস্ত্রোপচার অপরিহার্য হতে পারে?

সায়াটিকার ব্যথা সাধারণত চিকিৎসা, এক্সারসাইজ ও জীবনযাত্রার নিয়ম মেনে চললে অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। তবে কিছু গুরুতর ও জটিল অবস্থায় অস্ত্রোপচার করা জরুরী হয়ে পড়ে, যেখানে আর অপেক্ষা না করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়। চিকিৎসকরা রোগীর উপসর্গ, ব্যথার তীব্রতা, স্নায়ুর অবস্থা এবং কঞ্জারভেটিভ চিকিৎসায় সাড়া পাওয়া বা না-পাওয়ার ওপর ভিত্তি করে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।

পায়ের দুর্বলতা বা অবশভাব বাড়তে থাকলে

যদি নার্ভে দীর্ঘদিন ধরে চাপ পড়ে, তাহলে পায়ে অবশভাব, ঝিঁঝিঁ এবং পেশির শক্তি কম হতে পারে। বিশেষ করে যদি রোগীর পায়ের পাতা ঠিকভাবে না ওঠে (যাকে বলে foot drop), তাহলে সেটা গুরুতর সংকেত।

এমন পরিস্থিতিতে অস্ত্রোপচারে দেরি করা ঠিক নয়, কারণ এতে স্নায়ুর স্থায়ী ক্ষতি হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, সঠিক সময়ে অস্ত্রোপচার করলে পেশি ও নার্ভের কার্যক্ষমতা অনেকটাই ফিরিয়ে আনা যায় (Peul et al., 2007; Weinstein et al., 2006)।

মলমূত্র ধরে রাখতে না পারা (Cauda Equina Syndrome)

এটি একটি জরুরি চিকিৎসা পরিস্থিতি। যখন মেরুদণ্ডের নিচের দিকে থাকা স্নায়ুর গোড়া (cauda equina) কোনো ডিস্ক বা গঠনগত সমস্যার কারণে চেপে যায়, তখন নিচের উপসর্গগুলো দেখা দেয়:

  • হঠাৎ করে মল বা প্রস্রাব ধরে রাখতে না পারা
  • উরু ও যৌনাঙ্গের আশপাশে অবশভাব বা অনুভূতি কমে যাওয়া (saddle anesthesia)
  • উভয় পায়ে দুর্বলতা বা ভারসাম্যহীনতা

এই উপসর্গগুলো দেখা দিলে ৬ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অস্ত্রোপচার না করলে স্থায়ীভাবে স্নায়ুর ক্ষতি হয়ে যেতে পারে, এমনকি প্যারালাইসিস বা মলমূত্রের স্থায়ী সমস্যা তৈরি হতে পারে (Ahn et al., 2000)। তাই এই অবস্থাকে কখনোই অবহেলা করা উচিত নয়।

দীর্ঘ ৬–৮ সপ্তাহের বেশি তীব্র ব্যথা থাকলে

সায়াটিকার ব্যথা শুরু হলে সাধারণত প্রথম ধাপে ওষুধ, ফিজিওথেরাপি বা ইনজেকশনের মতো কঞ্জারভেটিভ চিকিৎসা দেওয়া হয়। তবে যদি এই চিকিৎসা নিয়ম মেনে চলার পরও টানা ৬ থেকে ৮ সপ্তাহ পার হয়ে যায়, এবং ব্যথা এতটাই তীব্র থাকে যে তা রোগীর হাঁটাচলা, ঘুম ও দৈনন্দিন কাজকে বাধাগ্রস্ত করে, তাহলে অস্ত্রোপচার করা যেতে পারে।

পুনরায় ডিস্ক বেরিয়ে এলে (Recurrent Disc Herniation)

পুনরায় ডিস্ক বেরিয়ে এলে (Recurrent Disc Herniation)
পুনরায় ডিস্ক বেরিয়ে এলে (Recurrent Disc Herniation)

অনেক রোগীর ক্ষেত্রেই একবার অপারেশনের পর কিছুদিন ভালো থাকার পর আবার ব্যথা শুরু হয়। MRI করার পর দেখা যায়, আগের জায়গায় আবার নতুন করে ডিস্ক বেরিয়ে এসেছে—যাকে বলে recurrent disc herniation।

এই অবস্থায় যদি ব্যথা আবার আগের মতো তীব্র হয় এবং ফিজিওথেরাপি, ওষুধ বা ইনজেকশন দিয়েও উপশম না হয়, তাহলে অস্ত্রোপচারই একমাত্র কার্যকর বিকল্প হিসেবে সামনে আসে (Kim et al., 2009)।

বারবার একই জায়গায় সমস্যা হলে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সুনির্দিষ্টভাবে নার্ভের চাপ সরিয়ে দেওয়া যেতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদি উপশমে সহায়তা করে।

সোজা ভাষায়, সব সময় নয়, কিন্তু কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে সঠিক সময়ে অস্ত্রোপচারই হতে পারে ব্যথামুক্ত জীবনে ফেরার কার্যকর পথ।

রোগীর দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিক প্রস্তুতির ভূমিকা

মানসিকভাবে ইতিবাচক থাকা ও পেইন ম্যানেজমেন্টে কাউন্সেলিং
মানসিকভাবে ইতিবাচক থাকা ও পেইন ম্যানেজমেন্টে কাউন্সেলিং

সায়াটিকা ব্যথা যদি দীর্ঘদিন ধরে চলে বা খুব তীব্র হয়, তখন শুধু শরীর নয়, রোগীর মানষিক অবস্থাও বড় একটি ভূমিকা রাখে। ওষুধ বা অস্ত্রোপচারের পাশাপাশি একজন রোগী কতটা ধৈর্য ধরে চিকিৎসা মেনে চলতে পারেন, নিজেকে নিয়ে কতটা সচেতন এবং মানসিকভাবে প্রস্তুত—এই বিষয়গুলোই অনেক সময় নির্ধারণ করে দেন তাঁর সুস্থ হয়ে ওঠার গতি ও ফলাফল।

আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রমাণ হয়েছে, “মনের সঙ্গে শরীরের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ”, বিশেষ করে যখন ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হয়। একজন রোগী যদি নিজের সুস্থতা নিয়ে আশাবাদী থাকেন, মনোবল বজায় রাখেন এবং চিকিৎসার প্রতি আস্থা রাখেন, তাহলে তাঁর আরোগ্য অনেকটাই দ্রুত হয় (Gatchel et al., 2007)।

অন্যদিকে, যদি কেউ হাল ছেড়ে দেন, হতাশায় ভোগেন বা ব্যথাকে অতিরিক্তভাবে ভয় পান, তাহলে চিকিৎসার কার্যকারিতাও অনেক সময় কমে যায়। তাই শুধু শরীরের নয়, মনের যত্নও ব্যথা কমানোর পথে সমান জরুরি।

ধৈর্য, সচেতনতা ও জীবনশৈলীর পরিবর্তনের গুরুত্ব

সায়াটিকা ব্যথা সাধারণত এক বা দুই দিনে সারার মতো নয়। এটি ধাপে ধাপে সেরে ওঠার একটি ধৈর্যের প্রক্রিয়া, যেখানে রোগীকে সময় দিতে হয় এবং নিয়ম মেনে চলতে হয়। অনেক সময় ৬–৮ সপ্তাহ বা তার চেয়েও বেশি সময় ধরে “ফিজিওথেরাপি, এক্সারসাইজ, ওষুধ এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন” অব্যাহত রাখতে হয়।

গবেষণায় দেখা গেছে, “যেসব রোগী ব্যথার কারণ, চিকিৎসা এবং সম্ভাব্য ফলাফল সম্পর্কে সচেতন”, তারা চিকিৎসায় ভালো সাড়া দেন এবং দ্রুত সুস্থ হন (Linton & Shaw, 2011)।

এছাড়াও, “সঠিকভাবে বসা ও ঘুমানো, শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, ধূমপান থেকে বিরত থাকা এবং নিয়মিত হালকা শরীরচর্চা করা”—এই সব অভ্যাসগুলো সায়াটিকা ব্যথার পুনরাবৃত্তি কমাতে দারুণভাবে সাহায্য করে।

সোজা কথায়, শুধু চিকিৎসা নয়, নিজের যত্ন নেওয়া ও সচেতন জীবনযাপনই দীর্ঘমেয়াদে ব্যথামুক্ত থাকার অন্যতম চাবিকাঠি।

মানসিকভাবে ইতিবাচক থাকা ও পেইন ম্যানেজমেন্টে কাউন্সেলিং

দীর্ঘদিন ধরে ব্যথা ভোগ করলে অনেক রোগীর মধ্যে “হতাশা, উদ্বেগ, এমনকি বিষণ্ণতা” তৈরি হয়। অনেকেই মনে করেন, এই ব্যথা আর কোনোদিন ঠিক হবে না বা তাঁরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন না। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এ ধরনের মানসিক অবস্থাকে বলা হয় “Pain Catastrophizing”—যেখানে রোগী ব্যথাকে নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে দেখেন এবং নিজেকে একপ্রকার অক্ষম ভাবতে শুরু করেন। এতে ব্যথার অনুভূতিও আরও বেশি তীব্র হয়।

তবে আশার বিষয় হলো, গবেষণায় দেখা গেছে, “যেসব রোগী মানসিকভাবে ইতিবাচক থাকেন এবং নিজেকে নিয়ে আত্মবিশ্বাসী হন, তারা ব্যথা অনেক ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারেন এবং দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন” (Gatchel et al., 2007; Turk et al., 2002)।

এই কারণেই অনেক দেশে দীর্ঘমেয়াদি ব্যথার চিকিৎসায় শুধু ওষুধ বা ফিজিওথেরাপি নয়, “পেইন ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামে মনো-পরামর্শ (Counseling)”, বিশেষ করে “Cognitive Behavioral Therapy (CBT)” অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই থেরাপির মাধ্যমে রোগীরা শেখেন—কীভাবে ব্যথাকে ইতিবাচকভাবে মেনে নিতে হয়, হতাশা বা ভয় কাটিয়ে উঠতে হয়, এবং ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে জীবনযাত্রায় স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে হয়।

সোজা কথায়, “শরীরের সঙ্গে মনকে প্রস্তুত রাখতে পারলে ব্যথা মোকাবিলাও অনেক সহজ হয়”।

অস্ত্রোপচারই শেষ উপায়’—এই ধারণার সংশোধন প্রয়োজন

অনেক রোগীর মনেই একটি ভ্রান্ত ধারণা গেঁথে থাকে—যদি সায়াটিকার ব্যথা দ্রুত না কমে, তাহলে নিশ্চয়ই অস্ত্রোপচার করতে হবে। অথচ বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং গবেষণায় দেখা গেছে, “বেশিরভাগ রোগীই ওষুধ, ফিজিওথেরাপি ও জীবনযাপনের পরিবর্তনের মতো কঞ্জারভেটিভ চিকিৎসায় ভালো হন”, এবং অনেক সময় অপারেশন ছাড়াই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেন (Weinstein et al., 2006; Atlas & Deyo, 2001)।

এই ব্যথা নিয়ে রোগীর দৃষ্টিভঙ্গি, ধৈর্য ও চিকিৎসার প্রতি আস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে রোগী চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতন এবং নিজের সুস্থতার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত, তাঁর চিকিৎসার ফলাফলও সাধারণত ভালো হয়। তাই চিকিৎসকেরও দায়িত্ব—”রোগীকে ভয় না দেখিয়ে, বিশ্বাসযোগ্য তথ্য দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করা”। এতে করে রোগী আত্মবিশ্বাস ফিরে পায় এবং চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় নিজেকে সক্রিয়ভাবে যুক্ত করতে পারে।

সায়াটিকা একটি সুপরিচিত এবং বেশ কষ্টদায়ক ব্যথা হলেও এর জন্য সবসময় অস্ত্রোপচার করতেই হবে—এই ধারণা সঠিক নয়। বর্তমান গবেষণা বারবার প্রমাণ করেছে, “বেশিরভাগ সায়াটিকা রোগী চিকিৎসা এবং নিয়ম মেনে চললে অস্ত্রোপচার ছাড়াই সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন”। বিশেষ করে যেসব রোগীর পায়ে দুর্বলতা বা স্নায়ুর স্থায়ী ক্ষতি নেই, তাদের ক্ষেত্রে “ওষুধ, ফিজিওথেরাপি, এক্সারসাইজ এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তনই সবচেয়ে কার্যকর চিকিৎসা” (Atlas & Deyo, 2001; Weinstein et al., 2006)।

তবে সবার চিকিৎসা এক রকম হবে—এমন নয়। কার কতদিন ধরে ব্যথা, ব্যথা কতটা তীব্র, রোগীর বয়স, ওজন, অন্যান্য স্বাস্থ্যগত সমস্যা (যেমন ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ), এসব বিবেচনা করে চিকিৎসক ঠিক করেন কোন পদ্ধতিটি সবচেয়ে উপযুক্ত—”ওষুধ, ফিজিওথেরাপি, ইনজেকশন নাকি প্রয়োজনে অপারেশন”।

অনেক সময় এক ধরনের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদে যথেষ্ট না-ও হতে পারে। তাই “ফিজিওথেরাপি, এক্সারসাইজ, মানসিক প্রস্তুতি, ব্যথা নিয়ন্ত্রণ এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের সমন্বয়ই সায়াটিকার স্থায়ী সমাধানের সেরা উপায়” (Qaseem et al., 2017; Gatchel et al., 2007)।

সবশেষে, রোগী হিসেবে শুধু চিকিৎসকের ওপর ভরসা করলেই চলবে না। নিজেকেও বুঝতে হবে ব্যথা কেন হচ্ছে, কী করলে সেটা কমবে এবং কোন অভ্যাসগুলো পরিবর্তন করতে হবে। কারণ, সচেতনতা ও ধৈর্যই একমাত্র রাস্তা, যা দীর্ঘমেয়াদে ব্যথা মুক্ত এবং সুস্থ জীবন উপহার দিতে পারে।

ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি এবং কত প্রকার ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি

ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি এবং কত প্রকার ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি. ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি হল এক ধরনের…
পরামর্শ নিতে 01877733322