আমাদের মস্তিষ্ক প্রতিনিয়ত অক্সিজেন ও পুষ্টির জন্য রক্তপ্রবাহের উপর নির্ভরশীল। এই রক্তপ্রবাহে সামান্যতম ব্যাঘাত ঘটলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা দ্রুত হ্রাস পায়। অনেক সময় হঠাৎ করে এই রক্তপ্রবাহ কিছু সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে গেলে, শরীরের কিছু অংশে দুর্বলতা, কথা জড়ানো, দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হওয়া বা শরীরের ভারসাম্য হারানোর মতো লক্ষণ দেখা দেয়, তবে কিছু সময় পর এগুলো আবার ঠিক হয়ে যায়। এই সাময়িক অবস্থাকে বলা হয় মিনি স্ট্রোক, যার চিকিৎসাবিজ্ঞানে নাম ট্রানজিয়েন্ট ইসকেমিক অ্যাটাক বা সংক্ষেপে TIA

Table of Contents hide

মিনি স্ট্রোক কী

মিনি স্ট্রোকের চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষা হলো Transient Ischemic Attack (TIA)। মিনি স্ট্রোক হচ্ছে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচলের সাময়িক বন্ধ হওয়া বা হঠাৎ কমে যাওয়া, যা কয়েক মিনিট থেকে এক ঘণ্টার মধ্যে আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। এর ফলে যে লক্ষণ দেখা দেয়, তা সাধারণ স্ট্রোকের মতো হলেও, এতে স্থায়ী ক্ষতি সাধিত হয় না। তবে এটি একটি সতর্ক সংকেত, যেটি ভবিষ্যতে বড় স্ট্রোক হওয়ার পূর্বাভাস দিতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব ব্যক্তি একবার মিনি স্ট্রোকে আক্রান্ত হন যদি সময়মতো চিকিৎসা না নেওয়া হয় তবে তাদের মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ব্যক্তি পরবর্তী ৩ মাসের মধ্যে বড় ধরনের স্ট্রোকে আক্রান্ত হন, (Kleindorfer et al., 2021)। চিকিৎসকেরা একে অনেক সময় “warning stroke” বা “সতর্ক সংকেতস্বরূপ স্ট্রোক” বলেও অভিহিত করেন, কারণ এটি ভবিষ্যতে বড় ধরণের স্ট্রোকের সম্ভাবনা সম্পর্কে ইঙ্গিত দেয়। আরেকটি গবেষনাতে দেখা গেছে, TIA দেখা দেওয়ার পর প্রথম ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই বড় ধরনের স্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি (Amarenco, 2020)।

সাধারণ স্ট্রোক থেকে পার্থক্য

মিনি স্ট্রোক এবং সাধারণ স্ট্রোকের লক্ষণ অনেকাংশে এক হলেও, এই দুইয়ের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে সময় ও প্রভাবের ক্ষেত্রে। মিনি স্ট্রোকের ক্ষেত্রে রক্ত চলাচল সাময়িকভাবে ব্যাহত হয় এবং নিজে থেকেই তা আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। ফলে এতে মস্তিষ্কের কোষে স্থায়ী কোনো ক্ষতি হয় না।

সাধারণত যে ধরনের স্ট্রোক হয়ে থাকে

সাধারণত যে ধরনের স্ট্রোক হয়ে থাকে
সাধারণত যে ধরনের স্ট্রোক হয়ে থাকে

স্ট্রোক প্রধানত তিনটি ধরণের হতে পারে:

ইস্কেমিক স্ট্রোক (Ischemic Stroke): এটি সবচেয়ে সাধারণ ধরণের স্ট্রোক, যা মোট স্ট্রোকের প্রায় ৮৭% ক্ষেত্রে ঘটে। এতে মস্তিষ্কের কোনো রক্তনালী ব্লক হয়ে যায় এবং রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, ফলে মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে কোষ মারা যেতে থাকে (Greenberg et al., 2022)।

হেমোরেজিক স্ট্রোক (Hemorrhagic Stroke): এই ধরণের স্ট্রোক ঘটে যখন মস্তিষ্কে কোনো রক্তনালী ফেটে গিয়ে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হয়। এর ফলে আশপাশের কোষগুলোর কার্যক্ষমতা ব্যাহত হয়। উচ্চ রক্তচাপ ও মস্তিষ্কে দুর্বল রক্তনালী এর প্রধান কারণ (Feigin et al., 2022)।

টিআইএ (Transient Ischemic Attack TIA): যদিও এটি পূর্ণ স্ট্রোক নয়, তবে উপসর্গ প্রায় একইরকম। এখানে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয় অস্থায়ীভাবে এবং তা নিজে থেকেই ঠিক হয়ে যায়। তবে এটি বড় স্ট্রোকের পূর্বাভাস হিসেবে বিবেচিত হয়।

প্রধান কারণসমূহ

রক্ত সঞ্চালনে সাময়িক বাধা

মিনি স্ট্রোক বা Transient Ischemic Attack (TIA)-এর প্রধান কারণ হচ্ছে মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালনে অস্থায়ী বাধা তৈরি হওয়া। সাধারণত এটি ঘটে যখন মস্তিষ্কের কোনো রক্তনালীতে ছোট থ্রম্বাস (clot) বা চর্বি, প্ল্যাক, অথবা বাতাসের বুদবুদের মতো কোনো বস্তু সাময়িকভাবে আটকে যায়, ফলে রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়। এ ধরনের রক্ত চলাচলের অস্থায়ী প্রতিবন্ধকতা সাধারণত হয় যাদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস (artery-তে চর্বি জমা হওয়া), বা ডায়াবেটিস রয়েছে।

মস্তিষ্কে ক্ষণস্থায়ী অক্সিজেন ঘাটতি

TIA-র সময় মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল কমে গেলে সেই অঞ্চলে পর্যাপ্ত অক্সিজেন পৌঁছায় না। যেহেতু আমাদের মস্তিষ্কের কোষগুলো খুব দ্রুত অক্সিজেনের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাই হঠাৎ করে মস্তিস্কে অক্সিজেনের গাটতির ফলে কথা জড়ানো, চলাচলে সমস্যা বা দৃষ্টিশক্তির অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। তবে এই ঘাটতি যদি কিছু সময়ের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়, তাহলে কোষগুলো পুনরায় স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরে আসে। অক্সিজেন সরবরাহ কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো অস্থায়ী ইসকেমিয়া, অর্থাৎ যে কোনো কারণে রক্তনালীতে রক্তের প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়া। এই অবস্থা যদি কয়েক মিনিট স্থায়ী হয়, তাহলেও এটি TIA সৃষ্টি করতে পারে।

হৃদরোগ এবং উচ্চ রক্তচাপ

হৃদরোগ এবং উচ্চ রক্তচাপ
হৃদরোগ এবং উচ্চ রক্তচাপ

হৃদরোগ এবং উচ্চ রক্তচাপের ভূমিকা

হৃদরোগ বলতে হৃৎপিণ্ডের বিভিন্ন রোগ বা অবস্থাকে বোঝায়, যা হৃৎপিণ্ডের স্বাভাবিক কার্যকারিতাকে ব্যাহত করে। এর মধ্যে রয়েছে করোনারি আর্টারি ডিজিজ, হার্ট ফেইলিওর, অ্যারিথমিয়া এবং ভালভ সংক্রান্ত সমস্যা। উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন এই রোগগুলোর একটি প্রধান ঝুঁকির কারণ হিসেবে কাজ করে। উচ্চ রক্তচাপের কারণে হৃৎপিণ্ডকে রক্ত পাম্প করতে অতিরিক্ত চাপ সহ্য করতে হয়, যা সময়ের সাথে হৃৎপিণ্ডের পেশি দুর্বল করে এবং রক্তনালীগুলোর ক্ষতি করে। উচ্চ রক্তচাপ শুধু হৃৎপিণ্ডের উপরই প্রভাব ফেলে না, বরং মস্তিষ্ক, কিডনি এবং চোখের মতো অন্যান্য অঙ্গেরও ক্ষতি করতে পারে।

হাইপারটেনশন

হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ এমন একটি অবস্থা, যেখানে রক্তনালীর দেয়ালের উপর রক্তের চাপ স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি থাকে। সাধারণত, রক্তচাপ ১৪০/৯০ মিলিমিটার পারদ (mmHg) বা তার বেশি হলে তাকে হাইপারটেনশন বলা হয়। এটি প্রায়শই “নীরব ঘাতক” নামে পরিচিত, কারণ এটি দীর্ঘদিন কোনো লক্ষণ ছাড়াই শরীরের ক্ষতি করতে পারে। হাইপারটেনশনের কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে জেনেটিক প্রবণতা, অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ, স্থূলতা, ধূমপান, মানসিক চাপ এবং শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা। দীর্ঘমেয়াদে, হাইপারটেনশন রক্তনালীগুলোর দেয়ালকে শক্ত এবং সংকীর্ণ করে (অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস), যা হৃৎপিণ্ডে রক্ত সরবরাহ কমিয়ে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়।

হাইপারটেনশনের চিকিৎসার জন্য জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং ওষুধের সমন্বয় প্রয়োজন। জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে কম লবণযুক্ত খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম, ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং ধূমপান ত্যাগ। চিকিৎসকরা প্রায়শই অ্যান্টি-হাইপারটেনসিভ ওষুধ যেমন ACE ইনহিবিটর, বিটা-ব্লকার বা ডাইইউরেটিক ব্যবহারের পরামর্শ দেন। গবেষণায় দেখা গেছে, রক্তচাপ ১০ mmHg কমানোর মাধ্যমে হৃদরোগের ঝুঁকি প্রায় ২০% কমানো সম্ভব (Law et al., 2009)।

কার্ডিয়াক অ্যারিদমিয়া (যেমন: অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশন)

হার্ট অ্যারিদমিয়া হলো হৃৎপিণ্ডের অনিয়মিত বা অস্বাভাবিক ছন্দ, যা হৃৎপিণ্ডের রক্ত পাম্প করার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। এর মধ্যে অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশন (AF) একটি সাধারণ এবং গুরুতর ধরন। অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশনে হৃৎপিণ্ডের উপরের প্রকোষ্ঠগুলো (অ্যাট্রিয়া) দ্রুত এবং অনিয়মিতভাবে কাঁপে, যা রক্তের স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। এর ফলে রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি বাড়ে, যা মস্তিষ্কে গিয়ে স্ট্রোকের কারণ হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশনের একটি প্রধান কারণ, কারণ এটি হৃৎপিণ্ডের প্রকোষ্ঠগুলোর গঠন এবং কার্যকারিতার উপর চাপ সৃষ্টি করে (Lip et al., 2016)। অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশনের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, ক্লান্তি এবং মাথা ঘোরা।

ধমনী সংকোচন এবং অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস

ধমনী সংকোচন এবং অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস
ধমনী সংকোচন এবং অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস

রক্তনালীর দেওয়ালে প্লাক জমা

রক্তনালীর দেওয়ালে প্লাক জমা অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিসের মূল বৈশিষ্ট্য। প্লাক হলো চর্বিজাতীয় পদার্থ, কোলেস্টেরল, ক্যালসিয়াম এবং প্রদাহজনক কোষের সমন্বয়ে গঠিত একটি জটিল গঠন। এই প্রক্রিয়া শুরু হয় যখন রক্তনালীর অভ্যন্তরীণ আস্তরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সাধারণত উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল বা ধূমপানের কারণে। ক্ষতিগ্রস্ত স্থানে নিম্ন-ঘনত্বের লিপোপ্রোটিন (LDL) বা “খারাপ কোলেস্টেরল” জমা হয়, যা প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং ইমিউন কোষগুলোকে আকর্ষণ করে। সময়ের সাথে, এই জায়গায় প্লাক গঠিত হয়, যা ধমনীর গহ্বরকে সংকীর্ণ করে এবং রক্ত প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। যদি প্লাক ফেটে যায়, তবে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে, যা ধমনীকে সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়ে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের কারণ হয় (Falk et al., 2013)।

সংকুচিত আর্টারির প্রভাব

সংকুচিত ধমনী শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে রক্ত সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করে, যা নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যার দিকে নিয়ে যায়। সংকুচিত ধমনীর প্রভাব নির্ভর করে কোন ধমনী আক্রান্ত এবং সংকোচনের মাত্রার উপর। প্রধান প্রভাবগুলো হলো:

  • করোনারি আর্টারি ডিজিজ: হৃৎপিণ্ডের ধমনী সংকুচিত হলে হৃৎপিণ্ডে অক্সিজেন এবং পুষ্টি সরবরাহ কমে যায়, যা অ্যানজাইনা বা হার্ট অ্যাটাকের কারণ হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, করোনারি ধমনীতে ৫০% বা তার বেশি সংকোচন হলে হৃৎপিণ্ডের কার্যকারিতা ব্যাহত হয় (Cassar et al., 2009)।
  • স্ট্রোক: মস্তিষ্কের ধমনী সংকুচিত হলে বা প্লাক ফেটে রক্ত জমাট বাঁধলে মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়, যা ইস্কেমিক স্ট্রোকের কারণ হয়।
  • পেরিফেরাল আর্টারি ডিজিজ: পায়ের ধমনী সংকুচিত হলে পায়ে ব্যথা, হাঁটতে অসুবিধা এবং গুরুতর ক্ষেত্রে টিস্যু মৃত্যু (গ্যাংগ্রিন) হতে পারে।
  • কিডনি রোগ: কিডনির ধমনী সংকুচিত হলে কিডনির কার্যকারিতা কমে যায়, যা উচ্চ রক্তচাপ এবং কিডনি ফেইলিওরের কারণ হতে পারে।

ডায়াবেটিস

ডায়াবেটিস হলো এমন একটা রোগ, যেখানে শরীর রক্তে গ্লুকোজ বা শর্করার মাত্রা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এটি প্রধানত দুই ধরনের: টাইপ ১ ডায়াবেটিস এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিস। টাইপ ১ ডায়াবেটিসে অগ্ন্যাশয় পর্যাপ্ত ইন্সুলিন উৎপাদন করতে পারে না, যা সাধারণত শৈশব বা কৈশোরে শুরু হয়। অন্যদিকে, টাইপ ২ ডায়াবেটিসে শরীর ইন্সুলিনের প্রতি সাড়া দিতে অক্ষম হয় (ইন্সুলিন রেজিস্ট্যান্স) বা অগ্ন্যাশয় পর্যাপ্ত ইন্সুলিন উৎপাদন করতে ব্যর্থ হয়। টাইপ ২ ডায়াবেটিস বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিসের প্রায় ৯০-৯৫% ক্ষেত্রের জন্য দায়ী। গবেষণায় দেখা গেছে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের হৃদরোগের ঝুঁকি ২-৪ গুণ বেশি থাকে (American Diabetes Association, 2022)।

হাইপারগ্লাইসেমিয়া

হাইপারগ্লাইসেমিয়া হলো রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেশি হওয়ার অবস্থা, যা ডায়াবেটিসের প্রধান জটিলতা। এটি সাধারণত তখন ঘটে যখন রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ১৮০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার (mg/dL) বা তার বেশি হয়। হাইপারগ্লাইসেমিয়ার লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত তৃষ্ণা, ঘন ঘন প্রস্রাব, ক্লান্তি, ঝাপসা দৃষ্টি এবং মাথাব্যথা। দীর্ঘমেয়াদে, নিয়ন্ত্রণ না করা হাইপারগ্লাইসেমিয়া শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ এবং টিস্যুর ক্ষতি করে। হাইপারগ্লাইসেমিয়ার প্রভাবগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • কার্ডিওভাসকুলার রোগ: উচ্চ গ্লুকোজের মাত্রা রক্তনালীর দেওয়ালের ক্ষতি করে, যা অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
  • নিউরোপ্যাথি: উচ্চ গ্লুকোজ স্নায়ুর ক্ষতি করে, যা হাত-পায়ে অবশ ভাব, ঝিনঝিন অনুভূতি এবং ব্যথার কারণ হয়।
  • রেটিনোপ্যাথি: চোখের রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা দৃষ্টিশক্তি হ্রাস বা অন্ধত্বের কারণ হতে পারে।
  • নেফ্রোপ্যাথি: কিডনির ক্ষতি হয়, যা কিডনি ফেইলিওরের দিকে নিয়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘমেয়াদী হাইপারগ্লাইসেমিয়া ডায়াবেটিস-সম্পর্কিত জটিলতার ঝুঁকি ২০-৩০% বাড়ায় (Nathan et al., 2005)। হাইপারগ্লাইসেমিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়মিত রক্তে শর্করার মাত্রা পর্যবেক্ষণ, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম এবং ওষুধ (যেমন ইন্সুলিন বা মৌখিক ওষুধ) গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

জীবনধারা-সম্পর্কিত কারণ

জীবনধারা সম্পর্কিত কারণ
জীবনধারা সম্পর্কিত কারণ

ধূমপান ও অ্যালকোহল

ধূমপান এবং অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ধূমপান ফুসফুসের ক্যানসার, হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং দীর্ঘস্থায়ী ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (COPD) এর প্রধান কারণ। সিগারেটের ধোঁয়ায় থাকা নিকোটিন, টার এবং অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ রক্তনালীর দেওয়ালের ক্ষতি করে, অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস সৃষ্টি করে এবং রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি বাড়ায়।

অন্যদিকে, অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন লিভারের রোগ (যেমন সিরোসিস), উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ এবং বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। অ্যালকোহল হৃৎপিণ্ডের পেশির ক্ষতি করে, যা কার্ডিওমায়োপ্যাথির কারণ হতে পারে। এছাড়া, এটি রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা বাড়ায়, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘমেয়াদী অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন হৃদরোগের ঝুঁকি ১.৫-২ গুণ বাড়ায় (Piano, 2017)।

অলসতা

শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা আধুনিক জীবনযাত্রার একটি বড় সমস্যা, যা স্থূলতা, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ায়। শারীরিক কার্যকলাপের অভাবে শরীরের বিপাকীয় প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়, ইন্সুলিন সংবেদনশীলতা কমে এবং রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ে। নিয়মিত ব্যায়াম রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে, হৃৎপিণ্ডের কার্যকারিতা বাড়ায় এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। গবেষণায় দেখা গেছে, সপ্তাহে ১৫০ মিনিট মাঝারি তীব্রতার শারীরিক কার্যকলাপ হৃদরোগের ঝুঁকি ৩০% পর্যন্ত কমাতে পারে (Warburton et al., 2010)।

অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস

অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, যেমন অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত, চিনিযুক্ত বা প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণ, স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এই ধরনের খাদ্যাভ্যাস স্থূলতা, উচ্চ কোলেস্টেরল, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ রক্তচাপ বাড়ায়, যা হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের কারণ হতে পারে। একইভাবে, অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার ইন্সুলিন রেজিস্ট্যান্স এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং লাল মাংসের অতিরিক্ত গ্রহণ হৃদরোগের ঝুঁকি ২০-৩০% বাড়ায় (Micha et al., 2017)।

মানসিক চাপ ও স্নায়ুবিক কারণ

মানসিক চাপ হলো শরীর এবং মনের এমন একটি প্রতিক্রিয়া, যা বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ চাপের (স্ট্রেসর) প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট হয়। এটি স্নায়ুতন্ত্র, বিশেষ করে স্বায়ত্তশাসিত স্নায়ুতন্ত্র এবং হাইপোথ্যালামাস-পিটুইটারি-অ্যাড্রিনাল (HPA) অক্ষের মাধ্যমে শরীরে প্রভাব ফেলে। স্বল্পমেয়াদী মানসিক চাপ শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করলেও, দীর্ঘমেয়াদী বা ক্রনিক চাপ স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি করে এবং মস্তিষ্কের কার্যকারিতা ব্যাহত করে। মানসিক চাপ মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাস এবং প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের মতো অংশের গঠন ও কার্যকারিতার উপর প্রভাব ফেলে, যা স্মৃতিশক্তি, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপ বিষণ্ণতা এবং উদ্বেগজনিত রোগের ঝুঁকি ২-৩ গুণ বাড়ায় (McEwen, 2017)।

দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপ

শারীরিকভাবে, দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপ হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং স্থূলতার ঝুঁকি বাড়ায়। এটি ইন্সুলিন রেজিস্ট্যান্স সৃষ্টি করে, যা টাইপ ২ ডায়াবেটিসের দিকে নিয়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপে আক্রান্ত ব্যক্তিদের হৃদরোগের ঝুঁকি ৪০% পর্যন্ত বেড়ে যায় (Steptoe & Kivimäki, 2012)।

বংশগত ও পারিবারিক কারণ

বংশগত ও পারিবারিক ঝুঁকি হলো এমন জিনগত এবং পারিবারিক কারণ, যা কোনো ব্যক্তির নির্দিষ্ট রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাকে প্রভাবিত করে। এই ঝুঁকি জিনের মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত হয় এবং পারিবারিক জীবনযাত্রা, খাদ্যাভ্যাস এবং পরিবেশের প্রভাবের সাথে মিলিত হয়ে রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যানসার এবং এমনকি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার ক্ষেত্রে বংশগত ও পারিবারিক ঝুঁকি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই কারণগুলো বোঝা এবং সঠিক সময়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ রোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে। গবেষণায় দেখা গেছে, পারিবারিক ইতিহাস থাকা ব্যক্তিদের কার্ডিওভাসকুলার রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ১.৫ থেকে ২ গুণ বেশি হতে পারে (Scheuner et al., 2006)।

ওষুধের প্রভাব ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

ওষুধগুলো নির্দিষ্ট রোগ বা উপসর্গ নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত হয়, তবে এগুলোর কার্যপ্রণালী শরীরের বিভিন্ন সিস্টেমের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। কিছু ওষুধ, যেমন জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি এবং রক্ত জমাট বাঁধার ওষুধ, রক্ত সঞ্চালন এবং হরমোনের ভারসাম্যের উপর প্রভাব ফেলে। এই ওষুধগুলোর প্রভাব কার্যকর হলেও, এদের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া গুরুতর হতে পারে, বিশেষ করে যদি দীর্ঘমেয়াদে বা ভুলভাবে ব্যবহার করা হয়। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলোর মধ্যে রয়েছে রক্ত জমাট বাঁধা, রক্তক্ষরণ, হরমোনাল ভারসাম্যহীনতা এবং অন্যান্য জটিলতা। গবেষণায় দেখা গেছে, জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি এবং রক্ত জমাট বাঁধার ওষুধ ব্যবহারকারীদের মধ্যে রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি ২-৬ গুণ বাড়তে পারে (Heinemann & Dinger, 2007)।

মিনি স্ট্রোক বা ট্রানজিয়েন্ট ইসকেমিক অ্যাটাক (টিআইএ) এর চিকিৎসায় ফিজিওথেরাপি গুরুত্ব

মিনি স্ট্রোক বা ট্রানজিয়েন্ট ইসকেমিক অ্যাটাক (টিআইএ) এর চিকিৎসায় ফিজিওথেরাপি গুরুত্ব
মিনি স্ট্রোক বা ট্রানজিয়েন্ট ইসকেমিক অ্যাটাক (টিআইএ) এর চিকিৎসায় ফিজিওথেরাপি গুরুত্ব

মিনি স্ট্রোক বা ট্রানজিয়েন্ট ইসকেমিক অ্যাটাক (টিআইএ) এর চিকিৎসায় ফিজিওথেরাপি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, এবং এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অন্যান্য ফিজিওথেরাপি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে #U64, নুরজাহান রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭ এ অবস্থিত অগ্রনি স্ট্রোক রিহ্যাবিলিটেশন থেরাপি সেন্টার (ASRC) একটি নেতৃস্থানীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে চলেছে। এই কেন্দ্রটি মিনি স্ট্রোক আক্রান্ত রোগীদের জন্য বিশেষায়িত ফিজিওথেরাপি সেবা প্রদান করে, যা তাদের শারীরিক সক্ষমতা পুনরুদ্ধার, পেশি শক্তি বৃদ্ধি এবং গতিশীলতা উন্নত করতে সহায়তা করে। এই প্রতিষ্ঠানটি মোহাম্মদপুরের কেন্দ্রীয় অবস্থানে থাকায় স্থানীয় এবং আশপাশের এলাকার রোগীদের জন্য সহজে প্রবেশযোগ্য। এটি শুধুমাত্র মিনি স্ট্রোক নয়, বৃহত্তর স্ট্রোক এবং অন্যান্য স্নায়বিক সমস্যার ক্ষেত্রেও বিশেষায়িত চিকিৎসা প্রদান করে। স্ট্রোক রিহ্যাবিলিটেশন থেরাপি সেন্টার তার নিবেদিত সেবা এবং রোগীকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে ঢাকার স্বাস্থ্যসেবা খাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, যা রোগীদের দ্রুত সুস্থতা এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।

উপসংহার

স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সচেতনতা ও জীবনধারা পরিবর্তন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সচেতনতা মানুষকে রোগের ঝুঁকি, লক্ষণ এবং প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে জানতে সহায়তা করে, যা প্রাথমিক নির্ণয় ও চিকিৎসার পথ সুগম করে। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং সঠিক তথ্য রোগ প্রতিরোধে সহায়ক। অন্যদিকে, জীবনধারা পরিবর্তন, যেমন স্বাস্থ্যকর খাদ্য, নিয়মিত ব্যায়াম, ধূমপান ত্যাগ এবং মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমায়।

পরামর্শ নিতে 01877733322