সায়াটিকা একধরনের নার্ভের ব্যথা, যা মূলত কোমরের নিচের অংশ অর্থাৎ লাম্বার স্পাইনের (L4–S3) অংশ থেকে শুরু হয়ে নিতম্ব, উরু, পা এবং কখনও পায়ের আঙুল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এটি শুধু কোমর বা পায়ে সীমাবদ্ধ নয়—অনেক সময় এই ব্যথা এতটাই তীব্র হয় যে তা রোগীর স্বাভাবিক কাজকর্ম, মানসিক অবস্থা এবং জীবনের গুণগত মানকেও মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী প্রাপ্তবয়স্কদের প্রায় ১৩ থেকে ৪০ শতাংশ জীবনের কোনো না কোনো সময় সায়াটিকার মতো ব্যথায় আক্রান্ত হন (Konstantinou & Dunn, 2008)। অনেক ক্ষেত্রেই এই ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে যায়, ফলে চিকিৎসার খরচও বেড়ে যায় এবং কর্মক্ষমতাও হ্রাস পায়।

বর্তমানে প্রযুক্তিনির্ভরতা, অফিস ভিত্তিক কাজ এবং দীর্ঘ সময় ধরে বসে পড়াশোনা করার কারণে আমরা প্রায় সারাদিনই এক জায়গায় বসে থাকি। বেশিরভাগ সময় আমরা সঠিকভাবে বসি না—ঝুঁকে বসি, কুঁজো হয়ে বসি বা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসি। এতে মেরুদণ্ডের স্বাভাবিক গঠন বিঘ্নিত হয় এবং কোমরের ডিস্কের ওপর অস্বাভাবিক চাপ পড়ে।

Wilke et al. (1999) এর গবেষণায় দেখা গেছে, সোজা দাঁড়িয়ে থাকার সময় মেরুদণ্ডের ডিস্কে চাপ থাকে প্রায় ১০০ ইউনিট, অথচ সোজা বসলে তা বেড়ে যায় ১৪০ ইউনিটে এবং যদি সামনের দিকে ঝুঁকে বসা হয় তবে চাপ বেড়ে যায় ১৮৫ ইউনিট পর্যন্ত।

এছাড়াও, অনেক সময় আমরা দাঁড়িয়ে কাজ করার সময় এক পায়ে বেশি ভর দিই বা কোমর বাঁকিয়ে থাকি—এই অভ্যাসগুলো ধীরে ধীরে postural asymmetry তৈরি করে, যার ফলে মেরুদণ্ড এবং সায়াটিক নার্ভে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয় এবং ব্যথা বাড়ে।

Table of Contents hide

সায়াটিকার সাথে অঙ্গবিন্যাসের সম্পর্ক

বর্তমান সময়ের কর্মজীবী মানুষ কিংবা শিক্ষার্থীরা দিনের বেশিরভাগ সময়ই এক জায়গায় বসে কাটায়। কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেকেই ঠিকভাবে বসার নিয়ম জানেন না বা মানেন না।

বিশেষ করে সামনে ঝুঁকে বা কুঁজো হয়ে বসা (slouched posture) মেরুদণ্ডের স্বাভাবিক বাঁক (lordosis) নষ্ট করে দেয়। এর ফলে কোমরের ডিস্কের সামনের দিকে অতিরিক্ত চাপ পড়ে।

Wilke et al. (1999) এর এক গবেষণায় দেখা গেছে—

  • সোজা দাঁড়িয়ে থাকলে কোমরের ডিস্কে চাপ থাকে প্রায় ১০০ ইউনিট,
  • কিন্তু চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেও সেই চাপ বাড়ে ১৪০ ইউনিটে,
  • আর যদি সামনের দিকে ঝুঁকে বসা হয়, তখন চাপ বেড়ে ১৮৫ ইউনিট পর্যন্ত পৌঁছে যায়।

এই অতিরিক্ত চাপ disc-এর ভেতরের নরম অংশ (nucleus pulposus) কে পেছনের দিকে ঠেলে দেয়, যেখানে disc-এর বাইরের আবরণ (annulus fibrosus) ফেটে যেতে পারে। তখন disc হার্নিয়েশন ঘটে, যা সায়াটিক নার্ভে চাপ সৃষ্টি করে। এর ফলেই ব্যথা কোমর থেকে শুরু হয়ে নিতম্ব, উরু হয়ে পা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে—যা আমরা সায়াটিকা ব্যথা নামে জানি।

বায়োমেকানিক্স ও স্নায়ুর উপর প্রভাব

আমাদের মেরুদণ্ড ও পেশিগুলোর যদি সঠিক ভারসাম্য না থাকে বা অঙ্গবিন্যাস সঠিক না হয়, তাহলে শরীরের ওজন ঠিকভাবে বণ্টিত হয় না। এর ফলে মেরুদণ্ডের কিছু নির্দিষ্ট অংশে চাপ বেশি পড়ে, যা ধীরে ধীরে ডিস্ক ও লিগামেন্টের ক্ষয় (degeneration) সৃষ্টি করে।

একটানা বসে থাকলে বা দাঁড়িয়ে থাকলে কোমরের পেছনের অংশে যেমন facet joint, ligamentum flavum এবং intervertebral foramen সংকুচিত হয়ে যায়।

এই সংকোচনের কারণে সায়াটিক নার্ভ ও অন্যান্য লাম্বার নার্ভ রুটের ওপর চাপ পড়ে, ফলে স্নায়বিক প্রদাহ (neuroinflammation) তৈরি হতে পারে।

গবেষক Bogduk (2009) ব্যাখ্যা করেন, কোমরের ডিস্কে যদি কোনো ধরনের সমস্যা যেমন bulge বা protrusion দেখা দেয়, তাহলে তা দুটি উপায়ে নার্ভকে প্রভাবিত করে—

  1. Mechanical compression: সরাসরি নার্ভে চাপ পড়ে।
  2. Chemical irritation: disc থেকে বের হওয়া inflammatory cytokines নার্ভকে অতিসংবেদনশীল করে তোলে।

এই দুই ধরণের প্রভাবই সায়াটিক নার্ভে দীর্ঘমেয়াদি উত্তেজনা তৈরি করে এবং ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে কোমর থেকে পা পর্যন্ত।

সঠিকভাবে বসার কৌশল

সঠিকভাবে বসার কৌশল
সঠিকভাবে বসার কৌশল

শুধু আরাম পাওয়ার জন্য নয়—সঠিক ভঙ্গিতে বসা আমাদের মেরুদণ্ড, ডিস্ক এবং স্নায়ুর ওপর অতিরিক্ত চাপ কমিয়ে সায়াটিকার মতো ব্যথা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

অপরদিকে, ভুলভাবে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকলে কোমরের হাড় ও ডিস্কের উপর mechanical চাপ সৃষ্টি হয়, যা ধীরে ধীরে স্নায়বিক প্রদাহ ও ব্যথায় পরিণত হতে পারে।

সঠিকভাবে বসার নিয়ম কী হবে?

সঠিকভাবে বসার জন্য কিছু সহজ ও কার্যকর নিয়ম অনুসরণ করা উচিত:

  • পিঠ সোজা রাখুন, এবং কাঁধ যেন স্বাভাবিকভাবে ঝুলে থাকে।
  • কোমরের নিচে (lumbar অংশে) একটি ছোট বালিশ বা লাম্বার রোল দিন, যাতে মেরুদণ্ডের প্রাকৃতিক বাঁক (lordotic curve) ঠিক থাকে।
  • হাঁটু ও নিতম্ব যেন একই লেভেলে থাকে, অর্থাৎ পা ৯০ ডিগ্রি কোণে বাঁকানো থাকবে।
  • পা মেঝেতে রাখুন, এবং প্রয়োজনে ফুটরেস্ট ব্যবহার করুন যেন পা ঝুলে না থাকে।

Waongenngarm et al. (2018)-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা সোজা হয়ে এবং লাম্বার সাপোর্ট নিয়ে বসেন, তাঁদের পেশির ক্লান্তি ও অস্বস্তি অন্যদের তুলনায় অনেক কম হয়।

কাজের সময় কোন বিষয়গুলো খেয়াল রাখবেন?

  • মনিটর এমন উচ্চতায় রাখুন যেন চোখের বরাবর থাকে—ঘাড় উপরে বা নিচের দিকে যেন না ঝুঁকে যায়।
  • কীবোর্ড ও মাউস শরীরের কাছাকাছি রাখুন, যাতে হাত বাড়িয়ে ধরতে না হয়, এবং কাঁধে চাপ না পড়ে।
  • কনুই রাখুন ৯০ ডিগ্রির কোণে, আর কব্জি থাকবে সোজা।

Grandjean ও Hunting (1977) দেখিয়েছেন, ডেস্ক ও মনিটরের উচ্চতা সঠিক না হলে ঘাড় ও মাথার উপর চাপ পড়ে, যার ফলে ঘাড়ে ব্যথা এবং পিঠে চাপ অনুভূত হতে পারে।

প্রতি ৩০–৪৫ মিনিট পর পর বিরতি নিন ও শরীর নাড়াচাড়া করুন

একটানা বসে থাকলে মেরুদণ্ডের ডিস্কের পানি শুকিয়ে যায় এবং পেশি ও লিগামেন্ট শক্ত হয়ে যায়। এর ফলে পিঠে ও কোমরে অস্বস্তি ও ব্যথা তৈরি হয়। তাই:

  • প্রতি ৩০–৪৫ মিনিটে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান,
  • ১–২ মিনিট হাঁটুন বা হালকা স্ট্রেচ করুন,
  • পিঠ, গলা, কোমরের স্ট্রেচিং করুন।

Callaghan & McGill (2001) তাদের গবেষণায় দেখিয়েছেন, একইভাবে অনেকক্ষণ বসে থাকলে মেরুদণ্ডে চাপ বেড়ে যায়। আর মাঝেমধ্যে উঠে দাঁড়ানো বা নড়াচড়া করলে সেই চাপ হ্রাস পায় এবং ব্যথাও কমে।

সঠিকভাবে দাঁড়ানোর কৌশল

সঠিকভাবে দাঁড়ানোর কৌশল
সঠিকভাবে দাঁড়ানোর কৌশল

সঠিকভাবে দাঁড়ানো কেন জরুরিঃ দীর্ঘ সময় ভুলভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে মেরুদণ্ড, হিপ জয়েন্ট এবং পায়ের পেশির উপর বাড়তি চাপ পড়ে। সময়ের সঙ্গে এই চাপ থেকে তৈরি হতে পারে lumbar disc ক্ষয়, পেশির ভারসাম্যহীনতা এবং সায়াটিক নার্ভে জ্বালাপোড়া বা ব্যথা
সঠিকভাবে দাঁড়ানোর অর্থ হচ্ছে—মেরুদণ্ড, পেলভিস, হাঁটু ও গোড়ালি যেন এক সোজা লাইনে থাকে এবং শরীরের ওজন দুই পায়ে সমানভাবে ভাগ হয়ে পড়ে।

সোজা হয়ে দাঁড়ান এবং ওজন দুই পায়ে সমানভাবে ভাগ করুন

সোজা হয়ে দাঁড়ালে—

  • মেরুদণ্ডের স্বাভাবিক বাঁক (lordotic curve) ঠিক থাকে,
  • কোমরে অতিরিক্ত চাপ পড়ে না,
  • এবং ডিস্ক ও হাড়ের জয়েন্টে (facet joint) ভারসাম্যপূর্ণ চাপ সৃষ্টি হয়।

অনেকে অভ্যাসগতভাবে এক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ান, যার ফলে অনেক সময় কোমরের একপাশ উচু বা নিচু হতে পারে (lateral tilt)। এতে মেরুদণ্ড ও পায়ের ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং ধীরে ধীরে sciatic nerve-এ চাপ সৃষ্টি হতে থাকে। Konz & Johnson (2000) উল্লেখ করেছেন, দুই পায়ে সমানভাবে দাঁড়ালে মেরুদণ্ডের উপর চাপ কমে এবং ডিস্কের মধ্যে প্রাকৃতিক জেলী বজায় থাকে, যা ব্যথা প্রতিরোধে সহায়ক।

দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে কাজ করলে এক পা একটু উঁচুতে রাখুন

যদি আপনাকে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয়, তাহলে মাঝেমধ্যে এক পা সামান্য উঁচু স্থানে (যেমন ছোট স্টুল বা ফুটরেস্টে) রাখুন। এতে পেলভিস কিছুটা সামঞ্জস্য করে নেয়, ফলে কোমরের স্বাভাবিক বাঁক ঠিক থাকে।

  • এইভাবে দাঁড়ালে কোমরের পেছনের পেশি (lumbar erector spinae, quadratus lumborum) অনেকটাই চাপমুক্ত থাকে।
  • এটি lumbar extension bias তৈরি করে, যা সায়াটিকা রোগীদের জন্য অনেক আরামদায়ক হতে পারে।

Nelson-Wong & Callaghan (2010) এর গবেষণায় দেখা গেছে, যারা এক পা উঁচুতে রেখে দাঁড়িয়ে কাজ করেন, তাঁদের পিঠের ব্যথা অনেক কম হয় তাদের তুলনায় যারা সমান ভঙ্গিতে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন।

জুতার হিল ও গঠনও গুরুত্বপূর্ণ

জুতার ডিজাইন, বিশেষ করে হিলের উচ্চতা, আমাদের অঙ্গসংস্থান ও হাঁটার ধরনে সরাসরি প্রভাব ফেলে।

  • উচু হিল পরলে:
    • কোমরের বাঁক (lordosis) বেড়ে যায়,
    • শরীরের ওজন পায়ের সামনের দিকে বেশি পড়ে,
    • পিঠ ও হিপ ফ্লেক্সরের পেশিতে টান পড়ে—যা সায়াটিক নার্ভে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
  • অন্যদিকে, ফ্ল্যাট জুতা বা arch-support সহ জুতা পায়ের স্বাভাবিক গঠন বজায় রাখতে সহায়তা করে এবং হাঁটার সময় শরীরে কম ঝাঁকুনি পৌঁছায় (shock absorption), যা মেরুদণ্ডের জন্য ভালো।

Opila-Correia (1990) এর গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে, দীর্ঘ সময় উচ্চ হিল ব্যবহার করলে কোমরে চাপ ও পেলভিসের অঙ্গসংস্থান পরিবর্তিত হয়, যা সায়াটিকা হওয়ার ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

চলাফেরা ও অবস্থান পরিবর্তনের নিয়ম

চলাফেরা ও অবস্থান পরিবর্তনের নিয়ম
চলাফেরা ও অবস্থান পরিবর্তনের নিয়ম

সায়াটিকা বা কোমর থেকে পায়ে ছড়িয়ে পড়া ব্যথা শুধুমাত্র বসে বা দাঁড়িয়ে থাকার কারণেই হয় না—বরং একই ভঙ্গিতে দীর্ঘক্ষণ স্থির হয়ে থাকার কারণে মেরুদণ্ডের ডিস্ক, স্নায়ু ও পেশির ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে, যা ধীরে ধীরে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই শরীরকে নিয়মিত নাড়াচাড়া করা ও অঙ্গবিন্যাস পরিবর্তন করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

স্থিরভাবে না থেকে অবস্থান পরিবর্তনে অভ্যস্ত হোন

দাঁড়িয়ে থাকার সময় মাঝে মাঝে হাঁটুন বা এক পা একটু উঁচুতে রাখুন: দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে কাজ করলে পিঠ ও কোমরের পেশি ক্লান্ত হয়ে যায় এবং রক্ত চলাচল কমে যায়। মাঝে মাঝে কিছুক্ষণ হেঁটে নেওয়া বা এক পা ফুটরেস্টে রেখে কাজ করলে pelvis ও মেরুদণ্ডের ভারসাম্য বজায় থাকে, চাপ কমে।

Coenen et al. (2013) দেখিয়েছেন, যারা মাঝে মাঝে হাঁটেন বা নড়াচড়া করেন, তাঁদের মেরুদণ্ডে চাপ কম পড়ে এবং পিঠে ব্যথার সম্ভাবনাও কমে।

বসে থাকার সময় হালকা স্ট্রেচিং করুন: Microbreak বা অল্প সময়ের বিরতিতে কিছু স্ট্রেচিং করলে পিঠ ও ঘাড়ের পেশি আরাম পায় এবং স্নায়ুর উপর চাপও কমে। যেমন:

  • ঘাড় ধীরে ধীরে একপাশে কাত করা বা ডান-বামে ঘোরানো
  • পিঠ একটু পেছনে টেনে স্ট্রেচ করা
  • কোমর হালকা করে স্ট্রেচ করা

Liao & Drury (2000)এর গবেষণায় দেখা গেছে, কাজের ফাঁকে স্ট্রেচিং ও অঙ্গবিন্যাস পরিবর্তন করলে পিঠ ও কাঁধের ব্যথা অনেকটাই কমে।

ঘন ঘন অঙ্গবিন্যাস পরিবর্তন করলে কী উপকার?

  • দীর্ঘক্ষণ বসে বা দাঁড়িয়ে থাকলে মেরুদণ্ডের ডিস্ক সাময়িকভাবে সংকুচিত হয়ে যায় এবং নার্ভ রুটের ওপর চাপ পড়ে।
  • কিন্তু ঘন ঘন ভঙ্গি বদলালে ডিস্ক নমনীয় থাকে এবং স্নায়ুর ওপরের চাপও হ্রাস পায়।

Adams & Dolan (2005) এর মতে, ভঙ্গি পরিবর্তন spinal tissues-এর স্বাভাবিকতা পুনরুদ্ধারে সাহায্য করে এবং দীর্ঘমেয়াদী mechanical চাপ থেকে রক্ষা করে।

কিছু কার্যকর অভ্যাস যা এখনই শুরু করতে পারেন

  • প্রতি ৩০–৪৫ মিনিট পর পর চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান
  • ১–২ মিনিট হাঁটুন বা কোমরপিঠ স্ট্রেচ করুন
  • একটানা একই চেয়ারে না বসে মাঝে মাঝে চেয়ার বা বসার ভঙ্গি বদলান
  • স্ট্যান্ডিং ডেস্ক থাকলে কখনও বসে আবার কখনও দাঁড়িয়ে কাজ করুন

কিছু ভুল অভ্যাস যা এড়াতে হবে

কিছু ভুল অভ্যাস যা এড়াতে হবে
কিছু ভুল অভ্যাস যা এড়াতে হবে

আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কিছু ছোট ছোট অবস্থানগত ভুল, যাকে বলা হয় micro-malposture”, দীর্ঘমেয়াদে মেরুদণ্ডের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এগুলো ধীরে ধীরে lumbar ডিস্কের ক্ষয়, পেশির ক্লান্তি এবং নার্ভে জ্বালাপোড়া বা চাপ সৃষ্টি করতে পারে। নিচে এমন কিছু সাধারণ ভুল ভঙ্গি এবং সেগুলোর ক্ষতিকর প্রভাব তুলে ধরা হলো:

সামনে ঝুঁকে বা একদিকে হেলে বসা

অনেক সময় আমরা চেয়ারে বসে সামনের দিকে ঝুঁকে যাই, কিংবা একদিকে হেলে বসি। এটি মেরুদণ্ডের স্বাভাবিক আকৃতি (alignment) নষ্ট করে দেয়।

এই ভঙ্গিতে ডিস্কের এক পাশে চাপ বেশি পড়ে, যার ফলে disc bulge বা herniation-এর সম্ভাবনা তৈরি হয়।

পাশাপাশি, দেহের ভার একদিকে চলে গেলে কোমর ও পেলভিসে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়, যা সায়াটিক নার্ভে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে।

Callaghan & McGill (2001) গবেষণায় দেখিয়েছেন, যারা চেয়ারে হেলে বা ঝুঁকে বসেন, তাঁদের মেরুদণ্ডে অতিরিক্ত axial চাপ পড়ে, যা ডিস্ক ও পেশির উপর ক্লান্তি সৃষ্টি করে।

চেয়ারে কুঁজো হয়ে বসা

অনেকেই ল্যাপটপ বা মোবাইল ব্যবহার করার সময় চেয়ারে বসে কুঁজো হয়ে যান, অর্থাৎ ঘাড় নিচু, কাঁধ সামনের দিকে ঝুঁকে থাকে। এই ভঙ্গিতে—

  • ঘাড় ও পিঠের মেরুদন্ডের বাঁক (lordosis/kyphosis) অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়,
  • পেটের গভীরের পেশি (core muscles) কম সক্রিয় থাকে,
  • এবং কোমরে flexion bias তৈরি হয়, যা ডিস্কের পেছনে বেশি চাপ সৃষ্টি করে।

ফলে স্পাইনাল নার্ভে চাপ (compression) তৈরি হতে পারে, যা সায়াটিকার অন্যতম কারণ।

O’Sullivan et al. (2002) উল্লেখ করেছেন, কুঁজো হয়ে বসার ফলে পিঠের পেশি দুর্বল হয়ে যায় এবং ডিস্কে চাপ বেড়ে যায়।

এক হাতে মোবাইল বা ল্যাপটপ দেখা

অনেকে মোবাইল বা ট্যাবলেট এক হাতে ধরে দীর্ঘ সময় ব্যবহার করেন। এতে শরীরের ভারসাম্য নষ্ট হয়:

  • একদিকে ঘাড় ও কাঁধে বেশি চাপ পড়ে, ফলে পেশির ভারসাম্য হারায়।
  • কোমর একদিকে ঝুঁকে পড়ে, pelvic tilt তৈরি হয়।

এই ভঙ্গিতে দীর্ঘক্ষণ থাকার ফলে ডিস্কের স্বাভাবিক অবস্থান নষ্ট হয়ে sciatic nerve pathway-তে চাপ সৃষ্টি হয়। Straker et al. (2009) এর মতে, এক হাতে ডিভাইস ব্যবহারের ফলে শরীরের অঙ্গবিন্যাস বিকৃত হয় এবং দীর্ঘমেয়াদি পিঠের ব্যথা তৈরি হয়।

দাঁড়িয়ে এক পা কুঁজো করে রাখা

দাঁড়িয়ে কাজ করার সময় অনেকেই এক পা মোড়ানো বা কুঁজো করে রাখেন, যা কোমড়ের ভারসাম্য নষ্ট করে।

  • এতে একদিকে পেলভিস উপরে উঠে যায় বা নিচে নেমে যায় (hip hike বা pelvic drop),
  • কোমরের মেরুদণ্ড একপাশে বাঁকিয়ে যায় (compensatory lateral flexion),
  • এই অস্বাভাবিক ভঙ্গি একপাশের নার্ভ রুটে চাপ সৃষ্টি করে, যা সায়াটিকা ব্যথার কারণ হতে পারে।

Griegel-Morris et al. (1992) গবেষণায় দেখিয়েছেন, এক পা কুঁজো করে দাঁড়ালে শরীরের অঙ্গসংস্থান (posture) ও পেশির কাজের ভারসাম্য নষ্ট হয়।

ফিজিওথেরাপি ও সচেতনতা

ফিজিওথেরাপি ও সচেতনতা
ফিজিওথেরাপি ও সচেতনতা

সায়াটিকার মতো ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে হলে শুধু ব্যথা কমানোই যথেষ্ট নয়। সঠিকভাবে বসা, দাঁড়ানো ও শোয়ার ভঙ্গি শেখা, পেশির ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা, এবং স্নায়ু ও ডিস্কের ওপরের চাপ কমানো—এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে ফিজিওথেরাপি। আধুনিক গবেষণায় এটি অত্যন্ত কার্যকর ও নিরাপদ চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।

ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে অঙ্গবিন্যাস বা পোশ্চার সঠিক করা ও পেশি শক্তিশালী করা

ভুল ভঙ্গিতে দীর্ঘদিন বসা বা দাঁড়ানোর ফলে মেরুদণ্ডে অতিরিক্ত চাপ পড়ে, যা ধীরে ধীরে সায়াটিক নার্ভে চাপ দেয় বা প্রদাহ তৈরি করে। ফিজিওথেরাপির সাহায্যে posture ঠিক করার মাধ্যমে—

কাঁধ ও পেলভিসের অবস্থান সঠিক রাখা যায়, কোমরের স্বাভাবিক বাঁক (lordosis) বজায় রাখা সহজ হয়, এবং শরীরের গভীর পেশিগুলো (যেমন: Transversus abdominis, Multifidus) সক্রিয় হয়ে মেরুদণ্ডকে সাপোর্ট করে।

Gordon & Bloxham (2016) এর গবেষণায় দেখা গেছে, সঠিক ব্যায়াম ও অঙ্গসংশোধনের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি পিঠ ও পায়ের ব্যথা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।

SDM McKenzie পদ্ধতির কার্যকারিতা

SDM (Structural Diagnosis and Management)বাংলাদেশে কোমর ব্যথা বা লো ব্যাক পেইনের (LBP) চিকিৎসায় Structural Diagnosis and Management (SDM) পদ্ধতি দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এই আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে মেরুদণ্ড, জয়েন্ট এবং মাংসপেশির গঠনে যেসব মেকানিক্যাল অসামঞ্জস্য দেখা যায়, তা বিশ্লেষণ করে ব্যথার মূল কারণ খুঁজে বের করা হয়। এরপর নির্দিষ্ট থেরাপিউটিক কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী আরাম ও কার্যকরভাবে আরোগ্য নিশ্চিত করা হয়।

সাম্প্রতিক বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, লম্বার ডিস্ক হেরনিয়েশন (LDH), মেকানিক্যাল কোমর ব্যথা, এবং ব্যাক পোশ্চার ডিজঅর্ডার-এর মতো সমস্যায় SDM পদ্ধতি প্রচলিত চিকিৎসার তুলনায় বেশ কার্যকর (Hossain, K.A et. al., 2020)। ব্যথা হ্রাসের পাশাপাশি এটি রোগ পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনাও কমিয়ে দেয়।

McKenzie Method (Mechanical Diagnosis and Therapy) এই পদ্ধতিতে ব্যথার ধরণ বুঝতে repeated movement test করা হয় এবং ‘centralization’ ধারণার ভিত্তিতে ব্যথা সঠিক দিকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়। directional preference অনুযায়ী নির্দিষ্ট কিছু এক্সারসাইজ করে সায়াটিকার ব্যথা অনেকাংশে কমানো যায়।

Petersen et al. (2011) এর গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব রোগীর ব্যথা centralize হয়, তাঁদের ক্ষেত্রে McKenzie পদ্ধতি বেশ কার্যকর।

পেশি ও নার্ভের ভারসাম্য রক্ষায় স্ট্রেচিং ও স্ট্যাবিলাইজেশন এক্সারসাইজ

স্ট্রেচিং: Piriformis, Hamstring, Iliopsoas এর মতো পেশিগুলো যদি শক্ত হয়ে যায় বা টান পড়ে, তাহলে নার্ভে চাপ পড়ে।

এই পেশিগুলো নিয়মিত স্ট্রেচ করলে নার্ভের টান ও প্রদাহ কমে যায়।

স্ট্যাবিলাইজেশন: পিঠ ও কোমরের গভীর পেশি শক্তিশালী করতে pelvic bridge, bird-dog, plank ইত্যাদি এক্সারসাইজ অত্যন্ত কার্যকর।এগুলো মেরুদণ্ডকে স্থিতিশীল করে এবং ভবিষ্যতে ডিস্ক বা নার্ভের উপর চাপ পড়ার ঝুঁকি কমায়।

Akuthota & Nadler (2004) এর মতে, core stabilization exercise শুধু ব্যথা কমায় না, বরং lumbar spine-এর স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনে এবং নার্ভ সংবেদনশীলতা কমায়।

উপসংহার (Conclusion)

সায়াটিকা ব্যথা একটি জটিল স্নায়বিক সমস্যা হলেও, তা পুরোপুরি প্রতিরোধযোগ্য এবং নিয়ন্ত্রণযোগ্য—”যদি আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনধারা, বসা-দাঁড়ানোর ভঙ্গি ও কাজের ধরনে কিছু পরিবর্তন আনতে পারি”।

গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের “অঙ্গবিন্যাস (posture)” এবং “পেশির কার্যক্ষমতা (muscle function)” এর সঙ্গে সায়াটিকার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। তাই, যদি আমরা এসব বিষয়ে সচেতন হই, তাহলে সায়াটিকার ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। সঠিকভাবে বসা বা দাঁড়ানো শুধু শরীরের জন্য আরামদায়কই নয়, বরং তা কোমরের হাড় (lumbar spine)-এর উপর অতিরিক্ত চাপ পড়া থেকে রক্ষা করে। নিয়মিত শরীরচর্চা ও অঙ্গবিন্যাস সম্পর্কে সচেতনতা আমাদের মেরুদণ্ডকে সুস্থ রাখে এবং দীর্ঘমেয়াদি ব্যথার ঝুঁকি কমায়।

পরামর্শ নিতে 01877733322