ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি. ডায়াবেটিস বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে পরিচিত রোগগুলির মধ্যে অন্যতম। দিন দিন এটি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ত্রুটিপূর্ণ খাদ্যাভ্যাস, মানসিক চাপ, বংশগত ধারা ইত্যাদি কারণে এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে চলছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে প্রতি ৮জন ব্যক্তির মধ্যে একজন ব্যক্তি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। সারা বিশ্বে ২০৬ মিলিয়ন মানুষ ডায়াবেটিসসে আক্রান্ত এবং ২০৩০ সালে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত সংখ্যা ২৩৮ মিলিয়নে গিয়ে দাঁড়াবে।

এছাড়াও ২০২১ সালে ২.৩ মিলিয়ন মানুষ ডায়াবেটিসের কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন। ডায়াবেটিস নিরব ঘাতকের ন্যায় শরীরের প্রায় সকল অঙ্গের উপর প্রভাব ফেলে তার মধ্যে নার্ভ বা স্নায়ু অন্যতম। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কারণে নার্ভ বা স্নায়ুতে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়, যা ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি নামে পরিচিত। সারা বিশ্বে ৫০ শতাংশ ডায়াবেটিকসে আক্রান্ত রুগী ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথিতে ভুগে থাকেন। অটোনমিক নিউরোপ্যাথি

ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি কি?

ডায়াবেটিক নিউরপ্যাথি হচ্ছে নার্ভা বা স্নায়ুর উপর ডায়াবেটিসের প্রতিক্রিয়া জনিত প্রভাব। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিকস অথবা দীর্ঘ সময় নিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের ফলে শরীরের স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা কর্মহীনতা লক্ষ্য করা যায় যার ফলে হাত পায়ে ঝিঁ ঝিঁ, অসাড়তা, মাংসপেশি দুর্বলতা এবং ব্যথা অনুভূত হয়। সাধারণতডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীরা ১০ থেকে ১৫ বছর সময়ের মধ্যেই ডায়াবেটিক নিরপ্যাথিতে আক্রান্ত  হয় অনেক ক্ষেত্রে সেটা পাঁচ বছরের মধ্যেই লক্ষ্য করা যায়।

ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথির ধরন এবং এদের উপসর্গগুলি

পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি: পেরিফেরার নিউরোপ্যাথিতে শরীরের পেরিফেরাল নার্ভাস সিস্টেম অর্থাৎ ওই সকল স্নায়ু যারা আমাদের হাত পায়ের নড়াচড়া এবং অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করে তার আক্রান্ত হয়। এই ধরনের নিউরোপ্যাথিক এ “স্টকিং গ্লোভ”প্যাটার্ন হিসেবে অভিহিত করা হয় কারণ শরীরের অন্যান্য অংশের তুলনা হাত ও পায়ের উপর বেশি প্রভাব ফেলে। এক্ষেত্রে শরীরের  উভয় পাশেপাশের সমানভাবে আক্রান্ত হতে পারে।

উপসর্গ:

  • পা এবং পায়ের পাতার অনুভূতি হারানো।
  • হাত পায়ে জ্বালাপোড়ার অনুভূতি হওয়া।
  • হাত পায়ে ব্যথা ও ঝিঁ ঝিঁ অনুভব হওয়া।
  • হাঁটাচলাযর সময় ভারসাম্যহীনতা।
  • সমন্বয় হীনতা।
  • স্পর্শে অধিক সংবেদনশীলতা।
  • মাংসপেশী দুর্বলতা।
  • পায়ের হাড় এবং জয়েন্টে আলছার অথবা ইনফেকশন হওয়া।

অটোনমিক নিউরোপ্যাথি: অটোনমিক নার্ভাস সিস্টেম আমাদের দেহের অন্ত্রের গতিবিধি হৃদস্পন্দন, হৃদপিন্ডের সংকোচন ও প্রসারণ, প্রস্রাব পায়খানার এবং রক্তা চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।অটোনমিক নিউরোপ্যাথি ক্ষেত্রে এই অটোনমিক নার্ভাস সিস্টেম (অনৈচ্ছিক স্নায়ুগুলি) আক্রান্ত হয়ে থাকে। সাধারণত গুরুতর ডায়াবেটিক্স, কিডনি ফেইলর এবং ক্যান্সারের ফলে অটোনমিক নিউরোপ্যাথি হয়ে থাকে।

উপসর্গ:

  • খাদ্য পরিপাক বা হজমে সমস্যা হওয়া।
  • খাবার চাবাতে এবং গিলতে সমস্যা হয়।
  • অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ।
  • অসংযম।
  • মাথা ঘুরানো এবং অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।
  • অতিরিক্ত ঘাম হওয়া।
  • প্রস্রাবে প্রদাহ হওয়া।
  • কস্টিপেশন।
  • প্রস্রাব পায়খানা নিয়ন্ত্রণের সমস্যা হওয়া।
  • সেক্সচুয়াল ডিসফাংশন: পুরুষদের ক্ষেত্রে ইরেকটাইল ডিসকাশন এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে ভ্যাজাইনাল ড্রাইনেস মত সমস্যা হওয়া।

প্রক্সিমাল নিউরোপ্যাথি:

প্রক্সিমাল নিউরোপ্যাথিতে ধড়ের কাছাকাছি অঙ্গগুলির স্নায়ু সমূহ আক্রান্ত হয়। যেমন- উপরের বাহু কাঁধ  এবং উরুস স্নায়ুগুলি। এটি সাধারণত অন্যান্য নিউরোপ্যাথি তুলনায় খুব কম সংখ্যক নিউরোপ্যাথি আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। সাধারণত প্রক্সিমাল নিউরোপ্যাথি একক ভাবে অথবা পেরিফেরার নিউরোপ্যাথির সাথে রোগীর শরীরে বিদ্যমান থাকতে পারে। এই ধরনের নিউরোপ্যাথি সাধারণত শরীরের উভয়দিকে সমানভাবে প্রভাবিত করে না।

উপসর্গ:

  • কোমর এবং উরুতে ব্যথা।
  • পিঠে ব্যথা।
  • বুকে ব্যথা হওয়া।
  • কোমর ও থাইতে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হওয়া।

ফোকাল নিউরোপ্যাথি:

ফোকাল নিউরোপ্যাথি এক ধরনের নিউরোপ্যাথি যেখানে সংকোচন ও প্রদাহের জন্য একটি নির্দিষ্ট স্নায়ু আক্রান্ত হয়। সাধারণত এটি পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি এবং অটোনমটিক নিউরোপ্যাথির তুলনায় কম লক্ষ্য করা যায়। যেমন- কারপাল টানেল সিন্ড্রোম, উলনার নিউরোপ্যাথি, ট্রাইজেমিনাল নিউরালজিয়া এবং বেলস পালসি ।

উপসর্গ:

  • চোখে দেখার সমস্যা হওয়া।
  • শোনার সমস্যা হওয়া।
  • ডাবল ভিশন।
  • ভাই একই বস্তু দুইটা দেখা।
  • মুখের এক পাশ প্যারালাইস হওয়া।
  • হাত এবং পায়ে ঝিঁঝিঁ এবং অসারতা অনুভ হওয়া।
  • হাঁটাচলা করার সময় পায়ের পাতা এবং উরুতে ব্যথা অনুভব হওয়া।

যে সকল রোগ ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথির ঝুঁকি বাড়ায়

  • অনিয়ন্ত্রিত রক্তের শর্করার উপস্থিতি ডায়াবেটিসের সাথে সাথে ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথির ঝুঁকি বাড়ায়।
  • দীর্ঘ সময় যাবত ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথির ঝুঁকি থাকেন।
  • ডায়াবেটিসের ফলে কিডনি বিকল হতে পারে এরফলে রক্তে টক্সিন এর পরিমাণ বৃদ্ধি পায়ে ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথির ঝুঁকি বাড়ায়।
  • ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের বি. এম. আই. ২৫ বা তার বেশি হলে ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথিতে আক্রান্তের ঝুঁকি বহু অংশে বৃদ্ধি পায়।
  • ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তিরা ধূমপান এবং মধ্যপ্রাণী হলে ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি এবং পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথির ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি

ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীরে যে সকল জটিলতা দেখা দেয়

  • হাইপোগ্লাইসেমিয়া: সাধারণত রক্তে শর্করার পরিমাণ প্রতি লিটার ৩.৯ মিলিমোলস এর নিচে হলে শরীরে কাঁপুনি, অতিরিক্ত ঘাম হওয়া এবং হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় কিন্তু অটোনমিক নিউরোপ্যাথির আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে এই সতর্কতা লক্ষণগুলি অনুভব করতে পারেন না। যা পরবর্তীতে হাইপোগ্লাইসেমিক সকে রূপান্তরিত হতে পারে।
  • পায়ের আঙ্গুল, পায়ের পাতা অথবা পা হারানো: ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি আক্রান্ত ব্যক্তিদের পায়ের আঙ্গুল এবং পাতার অনুভূতি সাধারণত কম থাকে, তাই ছোটখাটো কাটাও ঘা বা আলসারে পরিণত হতে পারে। গুরুতর ক্ষেত্রে একটির সংক্রমণ পায়ের হাড়ের মধ্যে ছড়িয়ে যেতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে এর জন্য পা  বা পায়ের অংশ অপসারণ (অঙ্গচ্ছেদ) প্রয়োজন হতে পারে।
  • মূত্রনালীর সংক্রমণ এবং মূত্র নালীর অসংযোগ: ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি জন্য মূত্র নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে প্রস্রাব করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করার ক্ষমতা বা প্রস্রাব নির্গমন কারি পেশীগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে। এছাড়াও মুত্রাশয় সহ এবং কিডনিতে ব্যাকটেরিয়া তৈরি হতে পারে যার ফলে মুত্রনালী সংক্রমণ হতে পারে।
  • পোস্টারাল হাইপুটেশন: সাধারণত অটোনমিক নিউরোপ্যাথির ক্ষেত্রে হৃদপিণ্ড এবং রক্ত প্রবাহ নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ুগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পোস্টারাল হাইপুটেশন মতো জটিলতা গুলি দেখা দিতে পারে।
  • খাদ্য হজমের সমস্যা হওয়া।
  • যৌনকর্মহীনতা: অটোনমিক নিউরোপ্যাথি যৌন অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে এমন স্নায়ুগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এতে করে পুরুষদের ক্ষেত্রে ইরেক্টাল ডিসফাংশন এবং মহিলাদের ভ্যাজাইনাল ড্রাইনেস এবং উত্তেজনা নিয়ে অসুবিধা হতে পারে।
ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি

ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথির চিকিৎসা পদ্ধতি

ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি চিকিৎসার ক্ষেত্রে দ্রুত রোগ নির্ণয় এবং যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা শুরু করতে হবে। গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা

ডায়াবেটিকস নিয়ন্ত্রণে রাখা: ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথিতে আক্রান্ত রোগীদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ রাখার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এর লক্ষ্যে একজন অভিজ্ঞ ডায়াবেটিস এবং এন্ড্রোকাইনোলজি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে ডায়াবেটিকস নিয়ন্ত্রণের চিকিৎসা গ্রহণ করা এবং শারীরিক পরিশ্রম ও শরীর চর্চার মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মনোনিবেশ করা।

ঔষধ: একজন অভিজ্ঞ নিউরোলজিস্ট এর পরামর্শে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা শুরু করতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যথা নাশক ওষুধ, অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট, অ্যান্টিসিজার, প্রিগাবালিন এবং লিডোক্রাইন এর মত ওষুধ ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি চিকিৎসায় অধিক ব্যবহৃত হয়।

ফিজিওথেরাপ: ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি চিকিৎসায় ফিজিওথেরাপি একটি গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা পদ্ধতি। একজন অভিজ্ঞ ফিজিওথেরাপিস্ট বিভিন্ন ধরনের শারীরিক পরীক্ষা মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দুর্বলতা নির্ণয় করে থাকেন এবং একই সাথে দুর্বল মাংসপেশীর শক্তি বৃদ্ধি, ভারসাম্য এবং গতির পরিধি বাড়ানো, ব্যথা নিরাময়, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে এবং দৈনন্দিন স্বাভাবিক কাজ কর্মের ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেন।

অকুপেশনাল থেরাপি: অকুপেশনাল থেরাপি দৈনন্দিনকাজের দক্ষতাগুলি আবার নতুন কর শিখতে সাহায্য করে। যেমন পোশাক পড়া, চলাফেরা করা, খাবার খাওয়া, ব্রাশ করা এবং টয়লেট ব্যবহার করা ইত্যাদি।

সুষম খাদ্য:  রোগীর ক্ষেত্রে সুষম খাদ্য নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, খাদ্য তালিকায় প্রতিদিন শাকসবজি ও ফলমূল রাখা বাঞ্ছনীয়, ভাত, চিড়া-মুড়ি এসব খাবার সবচেয়ে কম থাকবে ।

ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি রোগীদের করণীয়

  • খাবার তালিকায় প্রতিদিন শাক-সবজি, ফলমূল, লো ফ্যাট মিল্ক, শস্য দানা, মাছ, বাদাম, অল্প পরিমাণে মাংস রাখতে হবে একই সাথে ভাত, চিড়া, আলু মুড়ি, – চিনিযুক্ত এবং চর্বিযুক্ত সকল খাবার যথাসম্ভব কম খেতে হবে।
  • শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
  • মানসিক টেনশন কমিয়ে শরীরকে সতেজ রাখতে হবে।
  • প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট শরীর চর্চা করতে হবে।
  • শরীরে ভিটামিন ডি এর ঘাটতি পূরণে প্রতিদিন কিছু সময় রোদে থাকতে হবে।
  • পায়ের যত্ন নিতে হবে এবং সঠিক মাপের জুতা পরিধান করতে হবে।

তথ্যসূত্র

Dr. Sapia Akter

কিভাবে সার্ভাইক্যাল স্পন্ডাইলোসিস স্থায়ীভাবে নিরাময় করা যায়

কিভাবে সার্ভাইক্যাল স্পন্ডাইলোসিস স্থায়ীভাবে নিরাময় করা যায়. সার্ভাইক্যাল স্পন্ডাইলোসিস হলো ঘাড়ের মেরুদণ্ডের…
পরামর্শ নিতে 01877733322