যদি কোনো বাহ্যিক উৎস ছাড়াই কানে বিভিন্ন ধরনের শব্দ শোনা যায়, যেমন ঝিঁ ঝিঁ, শোঁ শোঁ, গুঞ্জন বা ঘন্টা ধ্বনি তাহলে সেটাকে টিনিটাস বলা হয়। এই শব্দগুলি কেবল ব্যক্তি নিজেই অনুভব করেন এবং সাধারণত এটি অন্য কেউ শুনতে পান না। টিনিটাস নিজে কোনো রোগ নয়, বরং এটি অন্য কোনো শারীরিক সমস্যার লক্ষণ হতে পারে।
কানে ভোঁ ভোঁ শব্দ হওয়া
কানে ভোঁ ভোঁ শব্দ হওয়া, যাকে টিনিটাস বলা হয়, এটি মূলত কোনো বাহ্যিক উৎস ছাড়াই কানের ভেতরে ঘন্টা বাজার শব্দ, শোঁ শোঁ বা গুঞ্জনের মতো শব্দ অনুভূত হয়। টিনিটাস সাধারণত কানের নার্ভের সমস্যা, বয়সজনিত শ্রবণ ক্ষমতার হ্রাস বা দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ শব্দে থাকার ফলে ঘটে। এছাড়া কানে মোম (সেরুমেন) জমা, কানের সংক্রমণ, উচ্চ রক্তচাপ, কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং মানসিক চাপও এই সমস্যার কারণ হতে পারে। অনেক সময় মেনিয়ার্স ডিজিজের মতো অভ্যন্তরীণ কানের সমস্যার কারণেও টিনিটাস দেখা দিতে পারে (1)।
কানের ভিতর ফরফর শব্দ হয় কেন
কানের ভিতরে ফরফর বা ফটফট শব্দ হওয়ার বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। এটি সাধারণত তেমন গুরুতর কোনো সমস্যা না হলেও কিছু নির্দিষ্ট রোগের কারণেও হতে পারে। নিচে কানের ভিতর ফরফর শব্দ হওয়ার কয়েকটি বিস্তারিত কারণ উল্লেখ করা হলো:
ইউস্টেশিয়ান টিউবের কার্যকারিতা ব্যাহত হওয়া: ইউস্টেশিয়ান টিউব কানের ভিতরের চাপ এবং বাইরের চাপের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখে। যখন এই টিউবটি সঠিকভাবে কাজ না করে, তখন কানের মধ্যে বাতাস আটকে যায়, যা ফরফর বা ফটফট ধরনের শব্দ সৃষ্টি করতে পারে। সাধারণত ঠান্ডা লাগা, অ্যালার্জি, সাইনাসের সংক্রমণ বা ফ্লুয়ের কারণে এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। এই ধরনের সমস্যায় কানে ফাটফাট আওয়াজের সাথে চাপ বা ভাড় ভাড় অনুভূতিও হয়।
কানে মোম (সেরুমেন) জমে যাওয়া: কানের মোম আমাদের কানের ভিতরে প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষার অংশ হিসেবে কাজ করে, কিন্তু কখনো কখনো অতিরিক্ত মোম জমে গেলে এটি কানের মধ্যে চাপ সৃষ্টি করে এবং শোনার ক্ষমতা কমে যেতে পারে। এর ফলে বাতাস চলাচলের বাধা সৃষ্টি হয়, যা ফরফর শব্দের কারণ হতে পারে। রিংগিং অফ দ্যা ইয়ার বা, টিনিটাস বা কানের ঝিঝি শব্দ এবং ফিজিওথেরাপি
কানে পানি ঢোকা: কানে পানি ঢুকে গেলে, বিশেষ করে সাঁতার কাটার পর বা শাওয়ার নেওয়ার সময়, পানি কানের ভিতরে আটকে থাকতে পারে। এই পানি বাতাসের সাথে মিশে ফরফর শব্দের সৃষ্টি করতে পারে। সাধারণত, পানি বের হয়ে গেলে এই শব্দটি বন্ধ হয়ে যায়। (2)
কানের সংক্রমণ (ইনফেকশন): কানে ইনফেকশন বা প্রদাহ হলে কানের ভেতরের ফ্লুইড জমে যায় এবং ফরফর বা ফটফট ধরনের শব্দ শোনা যেতে পারে। কানের সংক্রমণ শিশুদের মধ্যে বেশি সাধারণ, তবে প্রাপ্তবয়স্কদেরও হতে পারে। সংক্রমণের কারণে কানে ব্যথা, ফুলে যাওয়া এবং শ্রবণ শক্তি কমে যেতে পারে।
জলশূন্যতা (ডিহাইড্রেশন): শরীর যখন পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পায় না, তখন শরীরের বিভিন্ন সিস্টেমে ব্যাঘাত ঘটে, যার মধ্যে স্নায়ুতন্ত্রও অন্তর্ভুক্ত। জলশূন্যতা হলে কানের স্নায়ু এবং সঞ্চালন ব্যবস্থায় সমস্যা দেখা দিতে পারে, যার ফলে ঝিঁ ঝিঁ বা শোঁ শোঁ ধরনের শব্দ শোনা যায়।
টেম্পোরোম্যান্ডিবুলার জয়েন্ট (TMJ) ডিসঅর্ডার: এই সমস্যা চোয়ালের হাড় এবং কান সংলগ্ন এলাকার হাড়ের সাথে যুক্ত থাকে। TMJ সমস্যা থাকলে চোয়াল চলার সময় কানে ফরফর শব্দ শোনা যেতে পারে, কারণ চোয়ালের হাড় এবং কানের সংযোগস্থলে ঘর্ষণ হয়।
উচ্চ রক্তচাপ ও রক্তপ্রবাহজনিত সমস্যা: কানের ভিতরের ফরফর শব্দ কখনো কখনো রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার কারণেও হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপের কারণে কানের ভিতরে রক্ত প্রবাহের সময় অতিরিক্ত চাপ অনুভূত হয়, যা থেকে ফরফর শব্দ হতে পারে। এছাড়া, রক্তের সংবহনজনিত বিভিন্ন সমস্যাও কানে এমন শব্দের কারণ হতে পারে। (3)
কানের আঘাত: কানে ঝিঁ ঝিঁ শব্দ হওয়ার একটি সাধারণ কারণ হলো কানের আঘাত, যা সরাসরি কানের পেশি, স্নায়ু বা ঝিল্লিতে ক্ষতি করতে পারে। এমন আঘাতের ফলে কানের স্নায়ুতে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, যার ফলে ঝিঁ ঝিঁ বা শোঁ শোঁ ধরনের শব্দ শোনা যায়।
মানসিক চাপ বা উদ্বেগ: অনেক সময় অতিরিক্ত মানসিক চাপ বা উদ্বেগের কারণে স্নায়ুতে অতিরিক্ত উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, যা ফরফর ধরনের শব্দের কারণ হতে পারে। এটি মূলত মানসিক চাপের কারণে শরীরের স্নায়ুতন্ত্রের অতিরিক্ত উত্তেজনার ফল।
কানে ঝিঁ ঝিঁ শব্দ দূর করার উপায়
কানে ঝিঁ ঝিঁ শব্দ হওয়া, বা টিনিটাস, একটি অস্বস্তিকর অবস্থা হতে পারে, তবে এর প্রতিকার এবং নিয়ন্ত্রণের কিছু উপায় রয়েছে। নীচে কিছু কার্যকর উপায় উল্লেখ করা হলো যা কানে ঝিঁ ঝিঁ শব্দ দূর করতে সহায়ক হতে পারে:
কানের মোম পরিষ্কার করা: কানের মোম স্বাভাবিকভাবে শরীরের প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে, তবে কখনো কখনো এটি জমে গিয়ে কানের ভিতরের পথ বন্ধ করে দিতে পারে, যার ফলে ঝিঁ ঝিঁ বা অন্যান্য অস্বস্তিকর শব্দ শোনা যায়। কানে মোম জমে থাকলে তা নিজে পরিষ্কার করার পরিবর্তে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাহায্য নেওয়া উচিত, কারণ ভুলভাবে পরিষ্কার করতে গেলে কানের ঝিল্লি বা শ্রবণযন্ত্রে ক্ষতি হতে পারে। চিকিৎসক নিরাপদ উপায়ে মোম সরানোর জন্য স্প্রে, ওটিক ড্রপ বা সুক্ষ্ম যন্ত্র ব্যবহার করে মোম অপসারণ করতে পারবেন।
ইউস্টেশিয়ান টিউবের কার্যকারিতা উন্নত করা: ইউস্টেশিয়ান টিউব কানের ভিতরের চাপ এবং বাইরের চাপের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। যখন এই টিউবটি সঠিকভাবে কাজ না করে, তখন কানে বায়ু চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হয়, যা ঝিঁ ঝিঁ বা শোঁ শোঁ ধরনের শব্দের সৃষ্টি করতে পারে। ইউস্টেশিয়ান টিউবের কার্যকারিতা উন্নত করতে কিছু সাধারণ পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, যেমন নাকের ডিকনজেস্ট্যান্ট স্প্রে ব্যবহার করা, যা নাসারন্ধ্রের বাধা দূর করতে সহায়ক। এছাড়া, গরম পানি দিয়ে বাষ্প নেওয়া বা চুইংগাম চিবানোও ইউস্টেশিয়ান টিউবের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে।
মানসিক চাপ কমানো: মানসিক চাপ বা উদ্বেগ টিনিটাসের উপসর্গকে বাড়িয়ে তুলতে পারে, কারণ দীর্ঘমেয়াদি চাপ স্নায়ুতন্ত্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা কানের ঝিঁ ঝিঁ বা শোঁ শোঁ শব্দের কারণ হতে পারে। মানসিক চাপ কমানোর জন্য নিয়মিত মেডিটেশন, শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম, এবং যোগব্যায়াম খুবই উপকারী। এই পদ্ধতিগুলো মানসিকভাবে প্রশান্তি এনে দেয় এবং শরীরের স্নায়ুতন্ত্রকে শান্ত রাখে, যা টিনিটাস কমাতে সহায়ক। পর্যাপ্ত ঘুম, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, এবং শারীরিক ব্যায়ামও মানসিক চাপ হ্রাস করতে সাহায্য করে। এছাড়া স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টের অংশ হিসেবে একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিৎ।
কানের মধ্যে শোঁ শোঁ শব্দ
হিয়ারিং এইড: হিয়ারিং এইড মূলত বাইরের শব্দকে বর্ধিত আকারে কানে পৌঁছে দেয়, যা কানের ভিতরে সৃষ্ট ঝিঁ ঝিঁ বা শোঁ শোঁ শব্দকে ঢেকে দেয় এবং শ্রবণশক্তি উন্নত করে। এতে করে মস্তিষ্কে বাহ্যিক শব্দের সঠিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনা হয়, ফলে টিনিটাসের উপসর্গ কমে যায়। ডিভাইসটি সঠিকভাবে কাজ করার জন্য একজন অডিওলজিস্টের পরামর্শ অনুযায়ী সেটআপ করা উচিত, যা ব্যবহারকারীর নির্দিষ্ট শ্রবণ সমস্যার ওপর ভিত্তি করে কাস্টমাইজ করা যেতে পারে। এছাড়া, কিছু আধুনিক শ্রবণ সহায়ক ডিভাইসে টিনিটাস মাস্কিং ফিচারও থাকে, যা বিশেষ ধরনের শব্দ ব্যবহার করে কানের অভ্যন্তরের অস্বাভাবিক শব্দকে প্রশমিত করে।
পর্যাপ্ত পানি পান করা: শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি না থাকলে ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য নষ্ট হয়, যা স্নায়ুতন্ত্রে প্রভাব ফেলে এবং এর ফলে কানে ঝিঁ ঝিঁ বা শোঁ শোঁ ধরনের শব্দ শোনা যেতে পারে। প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি পান করলে শরীরের অভ্যন্তরীণ সিস্টেমগুলো সঠিকভাবে কাজ করে, স্নায়ুর কার্যকারিতা বজায় থাকে এবং রক্তপ্রবাহ সুষ্ঠু হয়, যা কানের অস্বাভাবিক শব্দ কমাতে সহায়ক। এছাড়া জলসমৃদ্ধ ফলমূল ও সবজি খাওয়াও শরীরের পানির চাহিদা পূরণে সহায়ক। পর্যাপ্ত পানি পান করার মাধ্যমে শুধুমাত্র কানের সমস্যা নয়, অন্যান্য শারীরিক অসুবিধাও হ্রাস পায়, যা সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ওষুধ পরিবর্তন: অনেক সময় কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে টিনিটাস বা কানে ঝিঁ ঝিঁ শব্দ হতে পারে। বিশেষ করে, কিছু এন্টিবায়োটিক, ডিউরেটিক, অ্যাসপিরিন, বা ক্যান্সারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত কিছু ওষুধ কানের স্নায়ুর উপর প্রভাব ফেলে এবং ঝিঁ ঝিঁ শব্দ সৃষ্টি করতে পারে। যদি কোনো ওষুধ সেবনের পর থেকে কানে এই ধরনের শব্দ শুরু হয়, তবে দ্রুত একজন চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত।
সাউন্ড থেরাপি: টিনিটাস বা কানে ঝিঁ ঝিঁ শব্দ হলে, মস্তিষ্ক কখনো কখনো শব্দের অনুপস্থিতিতে বা নিরব পরিবেশে অস্বাভাবিক শব্দ অনুভব করে। সাউন্ড থেরাপি মৃদু, শান্ত প্রাকৃতিক শব্দ, সাদা শব্দ (white noise), বা মৃদু সংগীত ব্যবহার করে মস্তিষ্ককে বিভ্রান্ত করতে সহায়ক। এর ফলে কানের ভেতরের ঝিঁ ঝিঁ শব্দ চাপা পড়ে যায় বা কম অনুভূত হয়। অনেক সময় সাউন্ড থেরাপির যন্ত্র বা অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করা হয়, যা নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ তৈরি করে এবং টিনিটাসের শব্দকে প্রশমিত করে। রাতে ঘুমানোর সময় বা শান্ত পরিবেশে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে কানের শব্দকে সহনীয় করে তোলা যায়। সাউন্ড থেরাপি একটি নিরাপদ এবং প্রাকৃতিক পদ্ধতি যা দীর্ঘমেয়াদি টিনিটাসের সমস্যা কমাতে সহায়ক।
চিকিৎসকের পরামর্শ: কানে ঝিঁ ঝিঁ শব্দ দূর করার জন্য সবচেয়ে নিরাপদ এবং কার্যকর উপায় হলো একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া। টিনিটাস বা কানে ঝিঁ ঝিঁ শব্দের বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে, যেমন স্নায়ুর ক্ষতি, কানে সেরুমেন জমা, উচ্চ রক্তচাপ, বা ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। সঠিকভাবে কারণ নির্ণয় না করলে এই সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে এবং তা আরও জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। একজন ইএনটি (কান, নাক, গলা) বিশেষজ্ঞ বা অডিওলজিস্ট কানের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সমস্যার প্রকৃত কারণ শনাক্ত করতে পারেন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদান করতে পারেন।
তথ্যসূত্র
- Peifer, K.J., Rosen, G.P. and Rubin, A.M., 1999. Tinnitus: etiology and management. Clinics in geriatric medicine, 15(1), pp.193-204. https://www.geriatric.theclinics.com/article/S0749-0690(18)30082-X/abstract
- Wang, M.C., Liu, C.Y., Shiao, A.S. and Wang, T., 2005. Ear problems in swimmers. Journal of the chinese medical association, 68(8), pp.347-352. https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S1726490109701741
- Sismanis, A., 2003. Pulsatile tinnitus. Otolaryngologic Clinics of North America, 36(2), pp.389-402. https://www.oto.theclinics.com/article/S0030-6665(02)00169-X/abstract
- ঘাড় ব্যথা কিসের লক্ষণ - February 9, 2025
- সায়াটিকা সারানোর উপায় - January 30, 2025
- ডেঙ্গু জ্বরের ৭টি সতর্কীকরণ লক্ষণ ২০২৪ | ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার - November 28, 2024