পেটের বাম পাশে ব্যথা একটি সাধারণ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ শারীরিক উপসর্গ, যা বিভিন্ন  সমস্যার ইঙ্গিত দিতে পারে। এই অংশে অবস্থিত প্রধান অঙ্গগুলোর মধ্যে রয়েছে Descending ও Sigmoid Colon, যা পরিপাকতন্ত্রের অন্তর্গত এবং কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডাইভার্টিকুলাইটিসের কারণে ব্যথা হতে পারে (Stollman & Raskin, 2004)। এছাড়াও, কিডনী ও মূত্রনালীএই পাশে থাকে এবং কিডনিতে পাথর বা সংক্রমণের কারণেও তীব্র ব্যথা অনুভূত হতে পারে (Türk et al., 2020)। নারীদের ক্ষেত্রে বাম পাশের ডিম্বাশয় (left ovary)ফ্যালোপিয়ান টিউব (fallopian tube)এ সিস্ট, টিউবিউল প্রেগন্যান্সি বা এন্ডোমেট্রিওসিসের মতো গাইনী সমস্যা থেকেও ব্যথা সৃষ্টি হতে পারে। Abdominal wall বা পেটের সামনের পেশিগুলোতে টান বা ইনজুরি থাকলে মায়োফেসিয়াল পেইন হতে পারে, যা পেশি ও ফ্যাসিয়ার টেনশনের কারণে হয় (Travell & Simons, 1999)। পাশাপাশি, কোমরের মেরুদন্ড থেকে আগত নার্ভের সমস্যা, যেমন ডিস্ক হার্নিয়েশন বা নার্ভে চাপ পড়লে referred pain হিসেবে পেটের বাম দিকে ব্যথা ছড়াতে পারে।

পেটের বাম পাশে ব্যথার সম্ভাব্য কারণগুলো কী হতে পারে ?

পেটের বাম পাশে ব্যথার সম্ভাব্য কারণগুলো কী হতে পারে
পেটের বাম পাশে ব্যথার সম্ভাব্য কারণগুলো কী হতে পারে

পরিপাকতন্ত্র (Gastrointestinal): বাম পার্শ্বে ব্যথার অন্যতম প্রধান কারণ পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা। কোষ্ঠকাঠিন্য হলে সিগময়েড কোলনে মল জমে ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়াও পরিপাকতন্ত্রে গ্যাস জমে পেট ফাঁপা এবং ব্যথা হতে পারে। আইবিএস (Irritable Bowel Syndrome) পেটের ব্যথা, গ্যাস, ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্যসহ বিভিন্ন উপসর্গের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।

মূত্রতন্ত্র (Urological): কিডনি বা ইউরেটারে পাথর থাকলে পেটের বাম পার্শ্বে তীব্র ব্যথা অনুভূত হতে পারে। এছাড়াও ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (UTI) বা প্রসাবে ইনফেকশন থাকলে জ্বালা-পোড়া, ঘন ঘন প্রস্রাবের অনুভূতি এবং পেটের বাম দিকে ব্যথা হতে পারে।

প্রজননতন্ত্র (Gynecological): নারীদের ক্ষেত্রে পেটের বাম পার্শ্বে ব্যথার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো ডিম্বাশয়ের সিস্ট, যা ডিম্বাশয়ে তরলে ভরা সিস্ট থাকার কারণে ব্যথা এবং চাপ অনুভূত হয়। এছাড়াও এন্ডোমেট্রিওসিস, যেখানে জরায়ুর অভ্যন্তরের টিস্যু জরায়ুর বাইরে বেড়ে যায়, তা তীব্র মাসিকের ব্যথা ও ক্রোনিক পেলভিক ব্যথার কারণ হতে পারে।

মাংসপেশি ও নার্ভ সম্পর্কিত কারণ (Musculoskeletal): মেরুদণ্ডের লাম্বার অংশ থেকে আসা নার্ভে চাপ বা ডিস্কের সমস্যার ফলে পেটের বাম পাশে রেফার্ড পেইন হতে পারে। এছাড়া পেশীতে টান বা ফ্যাসিয়াল টেনশনও ব্যথার অন্যতম কারণ, যা অতিরিক্ত চাপ বা আঘাতের ফলে হতে পারে।

কিভাবে বোঝা যাবে ব্যথার কারণ ?

কিভাবে বোঝা যাবে ব্যথার কারণ
কিভাবে বোঝা যাবে ব্যথার কারণ

ব্যথার সঠিক কারণ নির্ণয়ের জন্য রোগীর বিস্তারিত তথ্য নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেমনঃ ব্যথার ধরন, সময়কাল এবং খাদ্যগ্রহণ বা চলাফেরা ইত্যাদি। উদাহরণস্বরূপ, কিছু রোগীর পেটের ব্যথা খাবার খাওয়ার পর বৃদ্ধি পেতে পারে, আবার কারো ক্ষেত্রে হাটাচলার সময় বা পরে ব্যথা বেড়ে যেতে পারে। এছাড়াও প্রস্রাবের সমস্যা যেমন পেশীতেব্যথা বা জ্বালা অনুভূতি, অনিয়মিত মাসিক চক্র ও তীব্রতা, এবং মানসিক চাপের মাত্রাও ব্যথার কারনের সাথে সম্পর্কিত হতে পারে।

পরীক্ষা ও নিরীক্ষা:

শারীরিক পরীক্ষায় চিকিৎসক সাধারণত পেটের বাম পাশে স্পর্শ করে ব্যথার মাত্রা নির্ধারণ করেন এবং পেশীতে টান বা শক্তি অনুভব করেন। এছাড়া, রেফার্ড পেইন প্যাটার্ন চিহ্নিত করার মাধ্যমে মেরুদণ্ড বা অন্য কোনো অঙ্গ থেকে ব্যথা পেটের ওই অংশে আসছে কিনা তা বোঝার চেষ্টা করা হয়। শারীরিক পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে উপযুক্ত পরীক্ষাগুলো নির্ধারণ করা হয়।

প্রয়োজনীয় ল্যাব ও ইমেজিং টেস্টের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে আল্ট্রাসনোগ্রাফি (USG) এবং কম্পিউটেড টমোগ্রাফি (CT Scan), যা পেটের ভেতরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অবস্থা বিশ্লেষণে সাহায্য করে। সাধারণ রক্ত পরীক্ষা (CBC) সংক্রমণ বা প্রদাহের তথ্য দেয়, আর ইউরিন রুটিন, মাইক্রোস্কোপিক এনালাইসিস (Urine R/M/E) মূত্রতন্ত্রের সমস্যার কারণ নির্ণয়ে সহায়ক। নারীদের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে গাইনোকোলজিক্যাল স্ক্যান করানো হয় ডিম্বাশয় ও গর্ভাশয়ের সমস্যা নির্ণয়ের জন্য।

চিকিৎসার ধাপ ও পদ্ধতি:

পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা: পরিপাকতন্ত্র সংক্রান্ত ব্যথা ও সমস্যা যেমন কোষ্ঠকাঠিন্য বা গ্যাসের ক্ষেত্রে অ্যান্টি-স্পাসমোডিক ঔষধ ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। প্রোবায়োটিক গ্রহণ গাট ফ্লোরাকে সঠিক রাখতে সহায়ক এবং ল্যাক্সেটিভ কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে ব্যবহার করা হয়। যদি সংক্রমণ থাকে, তবে উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ অপরিহার্য।

মূত্রতন্ত্র সংক্রান্ত ব্যথা: কিডনির পাথর বা ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করা এবং প্রয়োজনে ব্যথানাশক ঔষধ ব্যবহৃত হয়। গুরুতর ক্ষেত্রে Lithotripsy পদ্ধতি ব্যবহার করে পাথর ভাঙা হয়, যা ব্যথা ও সমস্যা নিরসনে কার্যকর।

প্রজননতন্ত্রের সমস্যা: ডিম্বাশয়ের সিস্ট বা এন্ডোমেট্রিওসিসের জন্য হরমোনাল থেরাপি কার্যকর হতে পারে। গাইনোকোলজিস্টের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা শুরু করা উচিত, যা রোগীর শারীরিক অবস্থা ও লক্ষণ অনুসারে ভিন্ন হতে পারে।

ফিজিওথেরাপি ও পুনর্বাসন পদ্ধতি:  ফিজিওথেরাপি ও পুনর্বাসন পদ্ধতি আধুনিক চিকিৎসার একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা, যা Musculoskeletal বা মাংসপেশি ব্যথার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে কার্যকর। Thoracolumbar fascia ও abdominal oblique muscle releasing পিঠ ও কোমরের ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। Core muscle activation (যেমন: Transversus abdominis ও Multifidus) পেশির স্থিতিশীলতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া এক্সারসাইজের মধ্যে Pelvic tilts, bridges ও Stretching (quadratus lumborum, psoas major) পেশির নমনীয়তা ও শক্তি বাড়ায়, এবং ডায়াফ্রাম্যাটিক ব্রিদিং স্ট্রেস-জনিত ব্যথা কমাতে সহায়তা করে।

এসব চিকিৎসা ও থেরাপির ক্ষেত্রে ASPC Manipulation Therapy Centre (U-64, Nurjahan Road, Mohammadpur, Dhaka-1207) বাংলাদেশের অন্যতম সেরা পুনর্বাসন কেন্দ্র, কারণ এটি SDM (Structural Diagnosis and Management) পদ্ধতির প্রবর্তক ডা. এম শাহাদত হোসেন-এর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়, যিনি একজন আন্তর্জাতিকমানের ফিজিওথেরাপিস্ট এবং ম্যানিপুলেশন থেরাপির ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। এখানে প্রতিটি রোগের আলাদা আলাদা এসেসমেন্ট, উন্নতমানের থেরাপি, এবং পুনর্বাসন ভিত্তিক আধুনিক সুবিধা থাকায় এটি Musculoskeletal ব্যথার চিকিৎসায় আদর্শ প্রতিষ্ঠান।

ফিজিওথেরাপি ও পুনর্বাসন পদ্ধতি
ফিজিওথেরাপি ও পুনর্বাসন পদ্ধতি

জীবনধারা সংশোধন: (Lifestyle Modifications)

পরিপাকতন্ত্রের ক্ষেত্রে: কোষ্ঠকাঠিন্য ও পরিপাকতন্ত্রের অন্যান্য সমস্যা এড়াতে ফাইবারসমৃদ্ধ খাদ্য এবং পর্যাপ্ত পানি পান অত্যন্ত জরুরি। ফাইবার মল নরম করে এবং পরিপাকতন্ত্রের গতি বৃদ্ধি করে, যা কোষ্ঠকাঠিন্য রোধে সাহায্য করে (Slavin, 2013)।

শরীরচর্চা ও মুভমেন্ট: দীর্ঘ সময় ধরে বসে থাকার অভ্যাস বিভিন্ন ধরনের পেশী ও মেরুদণ্ডের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তাই প্রতি ৩০ মিনিট অন্তর উঠে হাঁটা বা হালকা শরীরচর্চা করা উচিত। সঠিক ভঙ্গিতে বসা ও দাঁড়ানো মেরুদণ্ডের চাপ কমায় এবং ব্যথার ঝুঁকি হ্রাস করে (Parry & Straker, 2013)।

মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ: মানসিক চাপ কমানোর জন্য মেডিটেশন ও ব্রিদিং এক্সারসাইজ বেশ কার্যকর। এছাড়া, যোগব্যায়াম ও তাইচি-র মতো মাইন্ড-বডি ইন্টারভেনশন স্ট্রেস কমিয়ে শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রম উন্নত করে (Pascoe et al., 2017)।

সতর্কতা ও রেড ফ্ল্যাগস : (Red Flags)

পেটের ব্যথা বা অন্যান্য সমস্যায় কিছু গুরুতর লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা আবশ্যক। এর মধ্যে রয়েছে হঠাৎ করেই তীব্র পেট ব্যথা, পেট ফুলে যাওয়া, জ্বর, বমি বা রক্তপাত, প্রস্রাব বা মলত্যাগে সমস্যা, অতিরিক্ত দুর্বলতা এবং অপ্রত্যাশিতভাবে ওজন কমে যাওয়া। এই লক্ষণগুলো সাধারণত গর্ভাবস্থা, ইনফেকশন, অভ্যন্তরীণ রক্তস্রাব বা গুরুতর অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সমস্যার ইঙ্গিত দিতে পারে এবং তাৎক্ষণিক চিকিৎসা প্রয়োজন। এ কারণে এ ধরনের “রেড ফ্ল্যাগস” এড়িয়ে চলা উচিত নয় এবং দ্রুত স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

উপসংহার:

পেটের বাম পাশে ব্যথা একটি জটিল এবং বহুমাত্রিক সমস্যা, যা শুধু একটি অঙ্গের সমস্যা নয় বরং শরীরের বিভিন্ন কাঠামোগত, স্নায়বিক এবং অভ্যন্তরীণ অঙ্গের পারস্পরিক সম্পর্কের ফলাফল হতে পারে। সঠিক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য এই ব্যথাকে সমগ্র শরীরের কাঠামোগত ভারসাম্য এবং স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকারিতার সঙ্গে সম্পর্কিত করে মূল্যায়ন করা জরুরি।

তথ্যসূত্র:

0 0 প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা
পোস্ট রেটিং

0 মন্তব্য
প্রতিক্রিয়া
সমস্ত প্রতিক্রিয়া দেখুন
পরামর্শ নিতে 01877733322