সায়াটিকা (Sciatica) হলো একটি নিউরোলজিক্যাল রোগ, যা সায়াটিক নার্ভে চাপ লাগলে বা প্রদাহের কারণে ঘটে। এই নার্ভটি কোমর থেকে পায়ের পেছন দিক দিয়ে পায়ের পাতা পর্যন্ত বিস্তৃত। সায়াটিকার ফলে সাধারণত এক পায়ে ব্যথা, ঝিনঝিন অনুভূতি বা দুর্বলতা দেখা যায়। গবেষণা অনুসারে, বিশ্বব্যাপী একজন মানুষের সারাজীবনে সায়াটিকায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ১৩% থেকে ৪০% পর্যন্ত হতে পারে (Stafford., et al., 2007)।
সায়াটিকার কারণ

সায়াটিকা সাধারণত বিভিন্ন কারণে হতে পারে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
হার্নিয়েটেড বা স্লিপড ডিস্ক (Herniated Disc): সায়াটিকা সাধারণত মেরুদণ্ডের বিভিন্ন সমস্যার কারণে হয়, যার মধ্যে হার্নিয়েটেড ডিস্ক (Herniated Disc) অন্যতম প্রধান কারণ। মেরুদণ্ডের কশেরুকাগুলির মধ্যে থাকা নরম ডিস্কের বাইরের স্তর দুর্বল বা ছিঁড়ে গেলে অভ্যন্তরীণ জেলি সদৃশ পদার্থ বেরিয়ে আসে, যা সায়াটিক নার্ভের উপর চাপ সৃষ্টি করে এবং সায়াটিকার লক্ষণগুলো দেখা দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ১০০০ জন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে প্রায় ৫ থেকে ২০ জন মানুষ হার্নিয়েটেড ডিস্কের সমস্যায় ভোগেন, যা সাধারণত ৩০ থেকে ৫০ বছর বয়সীদের মধ্যে বেশি দেখা যায় (Rajesh, R.M., et al .,2019)। হার্নিয়েটেড ডিস্কের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে বয়সজনিত ডিস্কের ক্ষয় এবং মেরুদণ্ডে আঘাত পাওয়া উল্লেখযোগ্য।
স্পাইনাল স্টেনোসিস (Spinal Stenosis): স্পাইনাল স্টেনোসিস (Spinal Stenosis) হলো স্পাইনাল ক্যানেল সংকীর্ণ হয়ে যাওয়া। এই অবস্থার ফলে সায়াটিক নার্ভে চাপ পড়ে, যা কোমর থেকে পায়ের নিচ পর্যন্ত ব্যথা, ঝিনঝিন অনুভূতি বা দুর্বলতা সৃষ্টি করতে পারে। স্পাইনাল স্টেনোসিস সাধারণত বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মেরুদণ্ডের গঠনগত পরিবর্তনের কারণে ঘটে, যেমন হাড়ের অতিরিক্ত বৃদ্ধি (বোন স্পার) বা লিগামেন্টে মোটা হয়ে যাওয়া। এটি স্পাইনাল ক্যানেল সংকুচিত করে স্নায়ুর ওপর চাপ দেয়, ফলে সায়াটিকার লক্ষণগুলো দেখা দেয়।
ডিজেনারেটিভ ডিস্ক ডিজিজ (Degenerative Disc Disease): ডিজেনারেটিভ ডিস্ক ডিজিজ (DDD) হলো মেরুদণ্ডের ডিস্কগুলোর বয়সজনিত অবক্ষয়, যা সায়াটিকার অন্যতম কারণ। মেরুদণ্ডের ডিস্কগুলো কশেরুকাগুলোর মধ্যে শক এবজর্বার এবং কুশন হিসেবে কাজ করে, যা মেরুদণ্ডকে নমনীয় রাখে। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই ডিস্কগুলোতে ক্ষয় হতে পারে, ফলে তাদের কার্যকারিতা হ্রাস পায়। এতে ডিস্কগুলো পাতলা ও শক্ত হয়ে যায়, যা মেরুদণ্ডের স্থিতিশীলতা কমায় এবং স্নায়ুর উপর চাপ সৃষ্টি করে। ফলে সায়াটিক নার্ভে প্রদাহ বা চাপে সায়াটিকার লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে।
পাইরিফরমিস সিনড্রোম (Piriformis Syndrome): পাইরিফরমিস সিনড্রোম (Piriformis Syndrome) হলো এমন একটি রোগ যেখানে নিতম্বের গভীরে অবস্থিত পাইরিফরমিস পেশী সংকুচিত বা শক্ত হয়ে গেলে সায়াটিক নার্ভে চাপ পড়ে, যার ফলে কোমর থেকে পায়ের নিচ পর্যন্ত ব্যথা, ঝিনঝিন অনুভূতি বা দুর্বলতা দেখা দিতে পারে। সাধারণত দীর্ঘ সময় বসে থাকা, ভারী এক্সারসাইজ করা, দুর্ঘটনাজনিত আঘাত, বা পুনরাবৃত্তিমূলক গতিবিধির ফলে এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, পাইরিফরমিস সিনড্রোম প্রায় ৬-৮% সায়াটিকার রোগীদের মধ্যে পাওয়া যায় (Hopayian, K., et al., 2010)।
দুর্ঘটনা বা আঘাত:দুর্ঘটনা বা আঘাত সায়াটিকার একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হতে পারে। যেমন, সড়ক দুর্ঘটনা, উচুস্থান থেকে পড়ে যাওয়া বা ভারী বস্তু তোলার সময় আকস্মিক মোচড়ের ফলে মেরুদণ্ডের হাড়, ডিস্ক বা মাংসপেশীতে আঘাত লাগতে পারে, যা সায়াটিক নার্ভকে সংকুচিত বা চাপ দিতে পারে। ফলে, কোমর থেকে শুরু করে নিতম্ব, উরু এবং পায়ের নিচ পর্যন্ত তীব্র ব্যথা, ঝিনঝিনে অনুভূতি বা দুর্বলতা অনুভূত হতে পারে।
সায়াটিকার লক্ষণ

সায়াটিকা হলো একটি অবস্থা যেখানে সায়াটিক নার্ভে চাপ বা প্রদাহের কারণে কোমর থেকে পায়ের দিকে ব্যথা অনুভূত হয়। সায়াটিকার প্রধান লক্ষণগুলো নিম্নরূপ:
কোমর, নিতম্ব ও পায়ে ব্যথা: সায়াটিকার অন্যতম প্রধান লক্ষণ হলো কোমর, নিতম্ব ও পায়ে ব্যথা, যা সাধারণত সায়াটিক স্নায়ুর উপর চাপ পড়ার কারণে হয়। এই ব্যথা সাধারণত এক পায়ে ছড়িয়ে পড়ে কোন কোন ক্ষেত্রে দুই পায়েও হতে পারে এবং কোমর থেকে নিতম্ব হয়ে উরু, হাঁটু এবং কখনও কখনও পায়ের পাতার দিকে বিস্তৃত হয়। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা, ভারী কিছু তোলা বা সঠিকভাবে না বসলে ব্যথার তীব্রতা বেড়ে যেতে পারে।
ঝিনঝিন বা জ্বালাপোড়া অনুভূতি: সায়াটিকার আরেকটি সাধারণ লক্ষণ হলো ঝিনঝিনে বা জ্বালাপোড়া অনুভূতি, যা সাধারণত সায়াটিক স্নায়ুর উপর চাপ পড়ার ফলে সৃষ্ট হয়। এই অনুভূতি মূলত কোমর থেকে নিতম্ব, উরু, হাঁটু, পায়ের পেছনের অংশ হয়ে পায়ের পাতার দিকে বিস্তৃত হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, ৭৫% সায়াটিকা এর রোগীই এই ধরনের ঝিনঝিনে বা অসাড় অনুভূতির সম্মুখীন হন, যা বিশেষ করে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকলে, হাঁটলে বা সিঁড়ি ভাঙলে বাড়তে পারে (Ropper, A.H. and Zafonte, R.D., 2015)।
পায়ে দুর্বলতা ও অসাড়তা: যখন নার্ভটি সংকুচিত হয় বা প্রদাহের শিকার হয়, তখন এটি মস্তিষ্ক থেকে পায়ের পেশিগুলোর মধ্যে সঠিক সিগনাল পাঠাতে ব্যর্থ হয়, যার ফলে পায়ে শক্তি কমে যেতে পারে, পা দুর্বল অনুভূত হতে পারে এবং কখনো কখনো পা অবশ হয়ে পড়তে পারে। কিছু ক্ষেত্রে পায়ের আঙুল বা গোড়ালির পেশি দুর্বল হয়ে যায়, যার ফলে হাঁটার সময় স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে (Ropper, A.H. and Zafonte, R.D., 2015)। এই সমস্যা গুরুতর হলে রোগীদের ফুট ড্রপ (Foot Drop) বা সম্পূর্ণভাবে পায়ের কার্যকারিতা হ্রাস পাওয়ার মতো জটিলতা দেখা দিতে পারে।
নড়াচড়ায় ব্যথা বৃদ্ধি: যখন রোগী হাঁটেন, বসেন, দাঁড়ান বা শরীর মোচড়ানোর চেষ্টা করেন, তখন ব্যথা তীব্র হতে পারে। বিশেষ করে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার পর উঠে দাঁড়ানোর সময় বা হঠাৎ দেহের ভঙ্গি পরিবর্তন করলে ব্যথা বেশি অনুভূত হয়। বিশেষত, হাঁচি, কাশি বা মলত্যাগের সময় ব্যথা হঠাৎ বেড়ে যেতে পারে, কারণ এই মুহূর্তগুলোতে পেটের চাপ বৃদ্ধি পায় এবং স্নায়ুর উপর আরও বেশি চাপ পড়ে (Ropper, A.H. and Zafonte, R.D., 2015)।
পায়ের পাতায় ব্যথা: সায়াটিকার কারণে পায়ের পাতায় ব্যথা অনুভূত হতে পারে, যা সাধারণত সায়াটিক স্নায়ুর উপর দীর্ঘমেয়াদী চাপ বা প্রদাহের ফলে ঘটে। ব্যথাটি কোমর থেকে শুরু হয়ে নিতম্ব, উরু, হাঁটু ও পায়ের পেছনের দিক দিয়ে নেমে এসে পায়ের পাতায় অনুভূত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৩০-৫০% সায়াটিকা আক্রান্ত রোগীরা পায়ের পাতায় ব্যথা অনুভব করেন, যা দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা বা হাঁটার সময় বেড়ে যায় (Ropper, A.H. and Zafonte, R.D., 2015)। বিশেষত, যদি স্নায়ুর উপর অনেক বেশি চাপ লাগে, তবে ব্যথা পায়ের আঙুল পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে এবং কখনও কখনও পায়ের পাতার সংবেদনশীলতা হ্রাস পেতে পারে।
সায়াটিকার চিকিৎসা

সায়াটিকার চিকিৎসা রোগীর ব্যথার তীব্রতা ও কারণের উপর নির্ভর করে। সাধারণত চিকিৎসা নিম্নলিখিত তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত:
ঘরোয়া চিকিৎসা ও স্বাভাবিক ব্যবস্থা
- পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন, তবে খুব বেশি শুয়ে থাকবেন না।
- গরম বা ঠান্ডা সেঁক দিন (Cold/Hot Therapy)।
- ব্যথা কমানোর জন্য হালকা স্ট্রেচিং এবং হাঁটাহাঁটি করুন।
- শক্ত বা খুব নরম বিছানায় না শুয়ে মাঝারি ধরনের ফার্ম ম্যাট্রেস ব্যবহার করুন।
ফিজিওথেরাপি
- স্ট্রেচিং ও এক্সারসাইজ – সঠিক ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে স্নায়ুর উপর চাপ কমানো যায়।
- ম্যাসাজ ও ম্যানিপুলেশন থেরাপি – ঘাড় ও কোমরের ব্যথা কমাতে কার্যকর।
- ইলেকট্রোথেরাপি (TENS, Ultrasound Therapy) – ব্যথা উপশমে সহায়ক।
- আকুপ্রেশার ও ড্রাই নিডলিং – পেশি শিথিল করতে সহায়ক।
ওষুধ ও চিকিৎসকের পরামর্শ
- ব্যথানাশক ওষুধ – যেমন NSAIDs (Ibuprofen, Naproxen) ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।
- স্টেরয়েড ইনজেকশন – তীব্র ব্যথার ক্ষেত্রে নার্ভ ব্লক বা স্টেরয়েড ইনজেকশন দেওয়া হয়।
- সার্জারি – বেশ কিছু রেড ফ্ল্যাগ বা গুরুতর লক্ষণ থাকলে সার্জারি করা জরুরী। সেগুলো হচ্ছেঃ
১। যদি রোগী পায়ের পাতায় ভর দিয়ে হাঁটতে না পারে।
২। পায়ের গোড়ালি ভর দিয়ে হাটতে না পারে।
৩। প্রস্রাব ধরে রাখতে না পারে
৪। পায়খানা ধরে রাখতে না পারে
৫। মলদ্বারের অংশে অবশ অনুভুতি হয়
৬। ৬-৮ সপ্তাহের চিকিৎসাতেও উন্নতি না হয়, তবে Microdiscectomy বা Laminectomy সার্জারি করা যেতে পারে।
সায়াটিকা প্রতিরোধে করণীয়

- সঠিকভাবে বসা ও দাঁড়ানো – দীর্ঘক্ষণ বসে থাকলে প্রতি ৩০ মিনিট পরপর উঠে হাঁটাহাঁটি করুন।
- ওজন নিয়ন্ত্রণ – অতিরিক্ত ওজন মেরুদণ্ডের উপর চাপ ফেলে, যা সায়াটিকার ঝুঁকি বাড়ায়।
- নিয়মিত ব্যায়াম – যোগব্যায়াম, হাঁটাহাঁটি ও কোমরের স্ট্রেচিং এক্সারসাইজ করুন।
- ভারী বস্তু তোলার সময় সতর্কতা অবলম্বন করুন – কোমরের উপর বেশি চাপ না পড়ে, এমনভাবে বস্তু তুলুন।
সায়াটিকা একটি গুরুতর ব্যথাজনিত সমস্যা, তবে সঠিক এক্সারসাইজ, ফিজিওথেরাপি ও জীবনধারার পরিবর্তনের মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। দীর্ঘস্থায়ী ব্যথার ক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
- পেটের বাম পাশে ব্যথা কমানোর উপায় - June 19, 2025
- কোমরের দুই পাশে ব্যথার কারণ কী? - June 19, 2025
- মহিলাদের মধ্যে স্ট্রোক: ঝুঁকি এবং প্রতিরোধ - June 18, 2025