স্ট্রোক কি এবং এর প্রতিকার

স্ট্রোক কি এবং এর প্রতিকার, বিশ্বব্যাপী অসংক্রামক রোগগুলির মধ্যে স্ট্রোক প্রধান একটি রোগ যা প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুকে ঘটায়। প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে প্রায় ১৩.৭ মিলিয়ন লোক স্ট্রোকে আক্রান্ত হন, এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৭৯৫,০০০ জন স্ট্রোকের শিকার হয়, যাদের মধ্যে ৬১০,০০০ হলেন নতুন রোগী।

স্ট্রোক কি এবং এর প্রতিকার

বাংলাদেশে, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ নিউরোসাইন্স এন্ড হসপিটালের হিসেব অনুযায়ী, প্রতি ১০০০ জন মানুষের মধ্যে প্রায় ১২ জন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, যদিও দেশে স্ট্রোকের সঠিক পরিসংখ্যানের অভাব রয়েছে। স্ট্রোক শুধু একজন ব্যক্তির জীবনকেই বিপন্ন করে না, বরং তার পরিবারের জীবনযাত্রায়ও গভীরভাবে প্রভাব ফেলে। দ্রুত চিকিৎসা ও পরিচর্যা ছাড়া, স্ট্রোক রোগীরা পঙ্গুত্ব বা মৃত্যুর মুখোমুখি হতে পারেন। স্ট্রোকের ঝুঁকিতে কারা আছেন ?

স্ট্রোক কি?

স্ট্রোক হলো মস্তিষ্কের এক ধরণের রোগ যা মস্তিষ্কের রক্তপ্রবাহের আকস্মিক বাধাগ্রস্ত হওয়ার ফলে ঘটে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, মস্তিষ্কের রক্ত সঞ্চালনের বিঘ্ন ঘটার ফলে স্ট্রোক হয় এবং এর ফলে মস্তিষ্কের স্নায়বিক ঘাটতি দেখা দেয়, যা ২৪ ঘন্টার অধিক সময় ধরে স্থায়ী হয় এমনকি ২৪ ঘন্টার মধ্যে রোগীকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। যদি এই লক্ষণসমূহ ২৪ ঘন্টার মধ্যে উন্নতি লাভ করে, তবে তা ট্রান্সিয়েন্ট ইসকিমিক অ্যাটাক (TIA) হিসাবে বিবেচিত হয়।

স্ট্রোক মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশে রক্ত প্রবাহের হ্রাস বা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে ঘটে, যা মস্তিষ্কের কোষগুলির মৃত্যু ঘটাতে পারে। এর প্রধান দুই ধরন হলো ইস্কিমিক স্ট্রোক এবং হেমোরেজিক স্ট্রোক। ইস্কিমিক স্ট্রোক তখন ঘটে যখন মস্তিষ্কের একটি ধমনী ব্লক হয়ে যায়, এবং হেমোরেজিক স্ট্রোক হয় মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক রক্তপাতের ফলে।

শ্রেণিবিন্যাস

স্ট্রোককে দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়: ইস্কিমিক বা রক্তসংরোধজনিত স্ট্রোক এবং হেমোরেজিক বা রক্তক্ষরণজনিত স্ট্রোক।

ইস্কিমিক বা রক্তসংরোধজনিত স্ট্রোক:

ইস্কিমিক স্ট্রোকের ক্ষেত্রে, মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট একটি অংশে রক্তের প্রবাহ হ্রাস পায় অথবা বন্ধ হয়ে যায়, যার ফলে মস্তিষ্কের ওই অংশের টিস্যু স্বাভাবিকভাবে কার্যকর হতে পারে না। শতকরা প্রায় ৮৭% রোগীদের ইস্কিমিক স্ট্রোক হয়ে থাকে।

এই প্রকারের স্ট্রোকে, মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীণ বা বহিরাগত ধমনীতে একটি রক্ত জমাট বাঁধার কারণে রক্তপ্রবাহ ব্যাহত হয়, যা মস্তিষ্কের কোষগুলোতে অক্সিজেন ও পুষ্টির অভাব ঘটায়। এই অভাবের ফলে মস্তিষ্কের কোষগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং তাদের কার্যকারিতা হারাতে থাকে।

ইস্কিমিক বা রক্তসংরোধজনিত স্ট্রোকের কারণ সমূহ:-

  • থ্রম্বোসিস: এই অবস্থায় রক্তনালীর ভেতরে রক্তপিণ্ড গঠিত হয়, যা রক্তের প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে। এটি মূলত রক্তনালীর দেয়ালে প্লাক গঠনের ফলে হয়।
  • এম্বোলিজম: এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে শরীরের অন্য কোনো অংশ থেকে রক্তপিণ্ড ভেঙে রক্তনালীর মাধ্যমে চলে আসে এবং মস্তিষ্কের সরু রক্তনালীকে আটকে দেয়, ফলে রক্তচলাচল ব্যাহত হয়।
  • রক্ত সরবরাহের হ্রাস: বিভিন্ন কারণে শরীরে রক্ত সরবরাহ কমে গিয়ে শকের মতো অবস্থা সৃষ্টি হয়, যা মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ হ্রাস করতে পারে।
  • সেরিব্রাল ভিনাস সাইনাস থ্রম্বোসিস: মস্তিষ্কের ভেনাস সিস্টেমে থ্রম্বোসিস ঘটলে রক্ত প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়, যা স্ট্রোক ঘটাতে পারে।
  • ক্রিপ্টোজেনিক স্ট্রোক: অনেক ক্ষেত্রে স্ট্রোকের সুনির্দিষ্ট কারণ সনাক্ত করা যায় না। এই ধরণের স্ট্রোককে ক্রিপ্টোজেনিক স্ট্রোক বলা হয়, যা অজানা কারণে ঘটে।

হেমোরেজিক বা রক্তক্ষরণজনিত স্ট্রোক:

হেমোরেজিক স্ট্রোক ঘটে যখন মস্তিষ্কের কোনো রক্তনালী ফেটে যায় এবং রক্ত মস্তিষ্কের আশপাশের টিস্যুতে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে মস্তিষ্কের কোষগুলি ঠিকমতো কাজ করতে পারে না এবং ক্ষতি হয়। এ ধরনের স্ট্রোক শতকরা প্রায় ১৩% হয়ে থাকে, তবে এর মৃত্যুর হার ইস্কিমিক স্ট্রোকের তুলনায় বেশি। হেমোরেজিক স্ট্রোক অধিক মারাত্মক হয় কারণ এতে রক্তপাতের ফলে মস্তিষ্কের কোষগুলি চাপের মুখে পড়ে এবং স্বাভাবিক ফাংশন ব্যাহত হয়। এর ফলে মস্তিষ্কের অংশবিশেষ অক্সিজেন ও পুষ্টি সাপ্লাই পায় না, যা মস্তিষ্কের ক্ষতি হয় এবং জটিল লক্ষণগুলো দেখা দেয়। স্ট্রোক রোগীর ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা

হেমোরেজিক বা রক্তক্ষরণজনিত স্ট্রোকের কারণ সমূহ:-

  1. ইন্ট্রাসেরিব্রাল হেমোরেজ হচ্ছে মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে রক্তপাত, যা ঘটে মস্তিষ্কের কোনো ধমনি ফেটে যাওয়ার ফলে। এই ধরনের রক্তপাত মস্তিষ্কের কোষগুলিকে রক্তে ভিজিয়ে দেয়। এটি দুই ধরনের হয়ে থাকে, ইন্ট্রাপ্যারেনকিমাল হেমোরেজ (যেখানে মস্তিষ্কের টিসুর ভিতরে রক্তপাত হয়) এবং ইন্ট্রাভেন্ট্রিকুলার হেমোরেজ (যেখানে মস্তিষ্কের ভেন্ট্রিকুলার সিস্টেমে রক্তপাত ঘটে)।
  2. সাব-অ্যারাকনয়েড হেমোরেজ হলো মস্তিষ্কের বাইরে কিন্তু করোটির ভিতরে ঘটে এমন এক ধরনের রক্তপাত, যা বিশেষ করে অ্যারাকনয়েড মেটার এবং পায়া মেটার (মস্তিষ্কের মেনিনজেসের তিনটি স্তরের মাঝের সূক্ষ্ম স্তর) এর মাঝে ঘটে থাকে।

চলুন জেনে নেই স্ট্রোকের লক্ষণ সমূহ:

স্ট্রোক বা মস্তিষ্ক আঘাত হচ্ছে এমন এক রোগ যেখানে মস্তিষ্কের এক বা একাধিক অঞ্চলের রক্তপ্রবাহে বিঘ্ন ঘটে, ফলে মস্তিষ্কের টিস্যুগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা মারা যায়। এর প্রভাব কতটা গভীর হবে তা নির্ভর করে মস্তিষ্কের কোন অঞ্চলে আঘাতটি হয়েছে এবং কতটা ব্যাপক তার ওপর। স্ট্রোকের লক্ষণগুলি ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়। নিম্নে স্ট্রোকের সাধারণ লক্ষণগুলি উল্লেখ করা হলঃ

  • অঙ্গ অবশ বা দুর্বলতা: হাত, পা অথবা শরীরের এক পাশ অবশ হয়ে যাওয়া, বিশেষ করে হাত ওপরে তুলতে অক্ষমতা।
  • দৃষ্টি সমস্যা: ঝাপসা দৃষ্টি, অন্ধকার দেখা বা ডাবল দেখা।
  • কথা বলা ও বোঝার সমস্যা: কথা বলতে বা বোঝার সমস্যা, বাক্য জড়িয়ে যাওয়া।
  • গিলতে অসুবিধা: খাবার বা পানি গিলতে কষ্ট হওয়া।
  • মুখ বেঁকে যাওয়া: মুখের এক পাশ অসাড় বা বেঁকে যাওয়া।
  • ভারসাম্য হারানো: শরীরের ভারসাম্য হারানো, পড়ে যাওয়া বা হঠাৎ জ্ঞান হারানো।
  • তীব্র মাথাব্যথা: অকস্মাৎ মাথাব্যথা যা খুব তীব্র এবং সাধারণত বাজ পড়ার মত অনুভূতি দেখা দেয়।
  • বমি বা বমি ভাব: অস্বাভাবিক বমি বমি ভাব বা খিঁচুনি হওয়া।
  • অস্থিরতা ও মাথা ঘোরানো: হাঁটাচলা করতে গিয়ে অস্থিরতা বা মাথা ঘোরানোর অনুভূতি।

এই লক্ষণগুলি প্রত্যক্ষ করা মাত্রই অবিলম্বে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত, কারণ স্ট্রোকের ফলাফল অত্যন্ত গুরুতর এবং জীবনঘাতী হতে পারে।

যারা স্ট্রোকের ঝুঁকিতে থাকেন:

স্ট্রোক একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সমস্যা, যা বিভিন্ন কারণে ঘটতে পারে। এই রোগের বিভিন্ন ঝুঁকি উপাদানের মধ্যে রয়েছে:

. বয়স: বয়সের সাথে সাথে মানুষের ধমনী শক্ত ও সংকুচিত হয়ে যায়, যা রক্তনালীগুলোর স্বাভাবিক কার্যকারিতায় বাধা দিতে পারে এবং স্ট্রোকের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে।

. স্বাস্থ্যগত অবস্থা: নিম্নলিখিত শারীরিক রোগসমূহ স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে:

  • উচ্চ রক্তচাপ
  • অ্যাট্রিয়াল ফাইব্রিলেশন (হৃদযন্ত্রের অনিয়মিত স্পন্দন)
  • ডায়াবেটিস
  • উচ্চ কোলেস্টেরল মাত্রা

. জীবনযাত্রার ধরন: নিম্নলিখিত জীবনযাত্রার অভ্যাসগুলি স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে:

  • ধূমপান
  • অতিরিক্ত ওজন
  • অত্যধিক মদ্যপান
  • নিয়মিত শারীরিক ব্যায়ামের অভাব
  • অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস

. পারিবারিক ইতিহাস: স্ট্রোকের প্রবণতা পারিবারিক বংশগতি অনুযায়ী হতে পারে। পরিবারে যদি কারো স্ট্রোকের ইতিহাস থাকে, তবে সেই ব্যক্তির স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি।

. জাতিগত প্রবণতা: আফ্রিকান বা ক্যারিবিয়ান উত্তরাধিকারের ব্যক্তিদের এবং দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর নাগরিকদের মধ্যে স্ট্রোকের ঘটনা বেশি লক্ষ্য করা যায়।

. লিঙ্গ: পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম। বিশেষত, ৫৫ বছরের উর্ধ্বে পুরুষদের মধ্যে স্ট্রোকের ঘটনা প্রবণতা বেশি।

আসুন জেনে নেই স্ট্রোকের ঝুকি কমানোর উপায়:

  • ব্লাড প্রেশার মনিটরিং: নিয়মিত আপনার রক্তচাপ পরীক্ষা করুন এবং যদি রক্তচাপ বেশি থাকে, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে নিয়ন্ত্রণে আনুন।
  • ধূমপান বর্জন: ধূমপান ছেড়ে দিন কারণ এটি স্ট্রোকের একটি বড় কারণ।
  • স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: উচ্চ মাত্রায় কোলেস্টেরল ও চর্বি জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলুন। ফল, সবজি, এবং শস্য জাতীয় খাবারের ওপর জোর দিন।
  • রেগুলার এক্সারসাইজ: নিয়মিত ব্যায়াম যেমন হাটা, দৌড়ানো বা যোগ ব্যায়াম করুন।
  • ডায়াবেটিস ম্যানেজমেন্ট: যদি আপনার ডায়াবেটিস থাকে, তবে এটি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
  • মানসিক চাপ হ্রাস: স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট এবং মানসিক চাপ কমানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিন।
  • মাদক ও অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন: মাদক এবং মদ্যপান স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়, তাই এসব থেকে দূরে থাকুন।
  • ওজন নিয়ন্ত্রণ: স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখার জন্য খাদ্যাভ্যাস এবং ব্যায়াম কার্যক্রম মেনে চলুন।

এই উপায়গুলি অনুসরণ করে আপনি স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে পারেন এবং একটি স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করতে পারেন।

স্ট্রোক হলে কি করবেন?

স্ট্রোকের প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য FAST একটি মৌলিক নির্দেশিকা। FAST হল:

  • F (Face): মুখের বিকৃতি যেমন এক পাশ বা কোণে ঝুলে পড়া।
  • A (Arms): হাতে দুর্বলতা বা এক হাত অপর হাতের তুলনায় দুর্বল হওয়া।
  • S (Speech): কথা বলার সমস্যা, কথা জড়িয়ে যাওয়া বা অস্পষ্ট বলা।
  • T (Time): এই লক্ষণগুলি দেখা দিলে সময় নষ্ট না করে দ্রুত চিকিৎসার জন্য রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।

এই লক্ষণগুলি দেখলে রোগীকে আরামদায়ক অবস্থানে শুইয়ে দিতে হবে এবং দ্রুত অ্যাম্বুলেন্স ডাকা বা নিকটবর্তী হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। রোগী যাতে শ্বাস নিতে পারে সেজন্য রোগীর কাপড় ঢিলেঢালা করে দিতে হবে এবং যদি জ্ঞান হারান, তার মুখে কিছু আটকে আছে কিনা তা যাচাই করতে হবে। রোগীকে কোনো খাবার, পানি বা ওষুধ দেওয়া উচিত নয়, কারণ গিলতে সমস্যা হতে পারে। অনেকের ধারণা যে স্ট্রোক হবার পরপর ই রোগীর কানের লতি কিংবা হাতের আঙ্গুল ফুটো করে রক্ত বের করে দিলে হয়তো ক্ষতির মাত্রা কমে যাবে, তবে এ ধরনের কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সুতরাং এসকল কাজ না করাই উত্তম। বরং অতিরিকত রক্তক্ষরণের ফলে রোগীর অন্যান্য ক্ষতি হতে পারে। স্ট্রোক কি এবং এর প্রতিকার

স্ট্রোক পরবর্তী চিকিৎসা ও পুনর্বাসন

স্ট্রোকের চিকিৎসা শুরু করার পূর্বে রোগের ধরন সনাক্ত করা জরুরি। সনাক্তকরণের জন্য বিভিন্ন মেডিকেল টেস্ট প্রয়োজন হয় যেগুলি হলো:

  • কম্পিউটেড টোমোগ্রাফি স্ক্যান (CT): মস্তিষ্কের চিত্র ধারণ করে, যা স্ট্রোকের ধরন এবং অবস্থান নির্ণয় করতে সাহায্য করে।
  • ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং স্ক্যান (MRI): মস্তিষ্কের আরও সুস্পষ্ট চিত্র প্রদান করে এবং ক্ষতির মাত্রা নির্ধারণ করে।
  • ECG (ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম): হৃদযন্ত্রের স্পন্দন পরীক্ষা করে, যা অ্যাট্রিয়াল ফাইব্রিলেশনের মতো হৃদরোগ সনাক্ত করতে সাহায্য করে।
  • ডপলার আলট্রাসাউন্ড: গলার ধমনীতে রক্তপ্রবাহের সমস্যা নির্ধারণ করে।
  • রক্ত পরীক্ষা: রক্তের জমাট বাঁধা, ব্লাড সুগার, এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা পরীক্ষা করে।

স্ট্রোকের জরুরি চিকিৎসা: স্ট্রোকের জরুরি চিকিৎসায় অবিলম্বে একজন নিউরোলজিস্ট বা নিউরোসার্জনের তত্ত্বাবধানে থাকা জরুরী। দ্রুত চিকিৎসা পেলে রোগীর সুস্থ হবার সম্ভাবনা বাড়ে এবং পরবর্তী জটিলতা অনেকাংশেই কমানো সম্ভব হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সার্জারির মাধ্যমে জমাট বাধা রক্ত অপসারণ করা হয়।

স্টোক পরবর্তী চিকিৎসা ও পুনর্বাসন:

স্ট্রোক পরবর্তী চিকিৎসা শুরু করার পূর্বে অবশ্যই কোন ধরনের স্ট্রোক তা সনাক্ত করা অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন। স্টোক সনাক্ত করতে কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন হয় যেমন:- কম্পিউটেড টোমোগ্রাফি স্ক্যান (CT), ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং স্ক্যান (MRI), ECG (ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম): হৃদস্পন্দন পরীক্ষা  করা, ডপলার আলট্রাসাউন্ড: গলার ধমনীগুলিতে অবরোধ আছে কিনা তা পরীক্ষা করা, রক্তাচপ মাপা এবং রক্ত পরীক্ষা (রক্ত জমাট বাঁধা, ব্লাড সুগার এবংকোলেস্টেরলের মাত্রা)।

স্ট্রোকের জরুরি চিকিৎসা: একজন অভিজ্ঞ নিউরোলজিস্ট অথবা নিউরোসার্জনের সরাসরি তত্ত্বাবধানে দ্রুত চিকিৎসা নিতে পারলে স্ট্রোক পরবর্তী জটিলতা ও রুগীর জীবন রক্ষা করা সম্ভব। জমাট কৃত রক্ত বের করতে অনেক সময় সার্জারিও প্রয়োজন হতে পারে।

স্ট্রোক পরবর্তী সমস্যা সমূহ:

নড়াচড়া ও ভারসাম্যের সমস্যা

  • রোগীর শরীরের এক পাশে দুর্বলতা দেখা দিতে পারে।
  • রোগী ভারসাম্য হারাতে পারে এবং হাঁটাচলায় সমস্যা হতে পারে।
  • পা, পায়ের পাতা, বাহু, এবং হাত নাড়াচাড়া করতে কঠিনতা হতে পারে।

অন্যান্য শারীরিক সমস্যা

  • ঢোঁক গিলতে সমস্যা, যা খাওয়া-দাওয়ায় প্রভাব ফেলতে পারে।
  • মল এবং মূত্র ত্যাগের ওপরে নিয়ন্ত্রণ হারানো।
  • অত্যধিক ক্লান্তি, যা বিশ্রাম নিলেও দূর হয় না।
  • পেশী এবং জয়েন্টে ব্যথা অনুভব হওয়া।

চিন্তাভাবনা ও যোগাযোগ

  • স্মরণশক্তির সমস্যা, মনসংযোগের অভাব, এবং সমস্যা-সমাধানে অক্ষমতা।
  • কথা বলা, বোঝা, পড়া, এবং লিখতে সমস্যা হওয়া।
  • এক পাশের পরিবেশের সম্পর্কে অজ্ঞতা বা অসচেতনতা।

ইন্দ্রিয়গত সমস্যা

  • ডাবল ভিশন, আলোর প্রতি অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা, এবং দৃষ্টিক্ষেত্রের সমস্যা হওয়া।
  • ত্বকে অসাড়তা এবং টিংলিং সেনসেশন।

আচরণের পরিবর্তন

  • আচরণগত পরিবর্তন, যেমন: খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন, খিটখিটে মেজাজ, এবং বিনা ভাবনায় কাজ করা।

স্ট্রোকের পুনর্বাসন

পুনর্বাসন হলো স্ট্রোক করার পর রোগীকে তার দৈনন্দিন জীবনে ফিরিয়ে আনার একটি প্রক্রিয়া, যা তাকে পুনরায় তার স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে সাহায্য করে এবং নতুনভাবে বাস্তবতার সাথে মানিয়ে নিতে সহায়তা করে। এটি মূলত রোগীকে চলাফেরা, দৈনন্দিন কার্যকলাপ সম্পাদন, সামাজিক যোগাযোগ বজায় রাখা, এবং সম্ভব হলে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার দিকে নির্দেশ করে।

স্ট্রোকের পর রোগীর পুনর্বাসন অত্যন্ত জরুরি, এবং এই প্রক্রিয়াটি অবিলম্বে শুরু করা উচিত। এই প্রক্রিয়া হাসপাতালে শুরু করা হয়, এবং প্রয়োজন অনুযায়ী বাড়িতে এটি চালিয়ে যাওয়া জরুরি। পুনর্বাসনের অংশ হিসেবে রোগীর বিভিন্ন ধরনের থেরাপি যেমন ফিজিক্যাল থেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি, এবং স্পিচ থেরাপির মতো পরিষেবাগুলি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই থেরাপিগুলি রোগীকে শারীরিক, মানসিক, এবং যোগাযোগ সংক্রান্ত দক্ষতা পুনরুদ্ধারে সাহায্য করে।

ফিজিওথেরাপি: স্ট্রোকের পরবর্তী পুনর্বাসনে, ফিজিওথেরাপি একটি অপরিহার্য পদক্ষেপ। এটি মস্তিষ্কের নিউরোপ্লাস্টিসিটির উন্নয়নে সাহায্য করে, যার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত মস্তিষ্কের কোষগুলি নিজেদের কাজ পুনরায় শিখতে বা নতুন কোষগুলি ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলির দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারে। এর ফলে রোগী ধীরে ধীরে তার হাঁটা, কথা বলা, এবং সামাজিক যোগাযোগের মতো দৈনিক কাজকর্মের দক্ষতা পুনরুদ্ধার করতে পারে। ফিজিওথেরাপি দ্বারা পেশীর শক্তি বাড়ানো, চলাফেরার ক্ষমতা উন্নত করা, ভারসাম্য এবং সমন্বয় বৃদ্ধি করা এবং সার্বিক শারীরিক কার্যক্ষমতা উন্নত করা সম্ভব। এই কারণে, স্ট্রোক হওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব ফিজিওথেরাপি শুরু করা প্রয়োজন।

অকুপেশনালথেরাপি: অকুপেশনাল থেরাপি স্ট্রোক পরবর্তী রোগীদের জীবনে রুগীর স্বাধীনভাবে কার্যক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে অপরিহার্য। এই থেরাপি মাধ্যমে রোগীরা দৈনন্দিন কার্যকলাপে আরও সক্রিয় ও স্বাধীন হয়ে উঠতে পারেন। ব্যক্তিগত যত্ন, যেমন নিজের পোশাক পরা, নিজে নিজে খাওয়া, গোসল করা, এবং টয়লেটে যাওয়ার মতো কাজগুলি পুনরায় শিখতে সাহায্য করে। এর ফলে রোগীরা তাদের দৈনন্দিন জীবনে আরও সক্রিয় ও স্বনির্ভর হতে পারেন, যা তাদের আত্মবিশ্বাস ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়।

স্পিচ এন্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপি: এই থেরাপি স্ট্রোক পরবর্তী রোগীদের কথা বলা এবং মনের ভাব প্রকাশের ক্ষমতা উন্নত করতে সাহায্য করে। এই থেরাপি মুখের পেশী এবং জিহ্বার নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণের উন্নতি আনতে কাজ করে, যা খাবার গিলতে এবং স্পষ্টভাবে কথা বলতে সাহায্য করে। এটি স্ট্রোকের ফলে যারা কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন বা যাদের ভাষা বুঝতে বা প্রকাশ করতে সমস্যা হচ্ছে, তাদের জন্য অপরিহার্য। এছাড়াও, এই থেরাপি মুখের লালা নিয়ন্ত্রণ এবং সঠিকভাবে খাদ্য গ্রহণ এবং পানি পানের ক্ষমতা উন্নত করতে সাহায্য করে, যাতে রোগী আরও স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারে এবং তাদের জীবনমান উন্নত হয়।

সাইকো থেরাপি: স্ট্রোক পরবর্তী সময়ে, অনেক রোগী হতাশা, অবসাদ ও উদ্বেগের মতো মানসিক সমস্যায় ভোগেন, যা তাদের দৈনন্দিন জীবনের গুণগত মান ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। এই সমস্যাগুলি রোগীর স্মরণশক্তি, চিন্তাশক্তি, এবং সামাজিক এবং পারিবারিক সম্পর্কে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। সাইকো থেরাপির মাধ্যমে রোগীর মনোবল ও আত্মবিশ্বাস বাড়ানো, মানসিক সমস্যাগুলি মোকাবিলা করা এবং একটি ইতিবাচক মানসিক অবস্থা তৈরি করা সম্ভব হয়।

খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ: অনিয়মিত এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে পারে। একজন অভিজ্ঞ ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ অনুসরণ করে রোগীরা তাদের খাদ্যাভ্যাসে উন্নতি ঘটাতে এবং স্ট্রোকের পুনরাবৃত্তি এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যগত জটিলতাগুলি রোধ করতে পারেন। সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীদের সুস্থতা এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে আসার পথে সহায়ক হতে পারে।

স্ট্রোক পরবর্তী পুনর্বাসনের মাধ্যমে রোগীদের শারীরিক ও মানসিক উন্নতি সাধন করে তাদের দৈনন্দিন জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এই পুনর্বাসন প্রক্রিয়া রোগীদের আত্মনির্ভরশীল ও সক্রিয় করে তুলে, যাতে তারা নিজেরা এবং তাদের পরিবার এবং সমাজের জন্য অবদান রাখতে পারে।

তথ্যসূত্র

Dr. Sapia Akter

ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি এবং কত প্রকার ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি

ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি এবং কত প্রকার ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি. ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি হল এক ধরনের…
পরামর্শ নিতে 01877733322