সায়াটিক নার্ভের ব্যথা কেন হয় এবং কাদের বেশি হয়? এই প্রশ্নটি অনেক রোগীর মনে জাগে, বিশেষ করে যারা কোমর থেকে পায়ে ব্যথা অনুভব করেন। সায়াটিক ব্যথা (Sciatica) হলো একধরনের স্নায়বিক ব্যথা, যা সাধারণত কোমর থেকে শুরু হয়ে নিতম্ব হয়ে পায়ের পিছনের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই ব্যথা তখনই হয়, যখন সায়াটিক নার্ভে চাপ পড়ে, জ্বালা হয় বা প্রদাহ সৃষ্টি হয়। এটি শুধু সাধারণ কোমর ব্যথা নয়, বরং একটি স্নায়ুবিষয়ক সমস্যা (neuropathic condition), যা দীর্ঘদিন স্থায়ী হলে ব্যথা বাড়ে, চলাফেরা সীমিত হয় এবং জীবনযাত্রার মান অনেকটাই কমে যায়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সায়াটিকার ব্যাপকতা এবং এর কারণে কাজের অক্ষমতা নিয়ে আলোচনা অনেক বেড়েছে।
এই ব্যথা শুধু শরীরের কষ্টই বাড়ায় না, এর অর্থনৈতিক প্রভাবও বেশ গুরুতর। এটি কর্মজীবী মানুষের জন্য ছুটি নেওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ এবং এর ফলে কর্মক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায় (Hartvigsen J, et al., 2018)। এ কারণে আমেরিকান কলেজ অব ফিজিশিয়ানস (ACP) এবং নর্থ আমেরিকান স্পাইন সোসাইটি (NASS) বারবার এই রোগের সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে (Qaseem A, et al., 2017)।
সায়াটিক ব্যথা সাধারণত বেশি দেখা যায় তাঁদের মধ্যে যাঁরা প্রতিদিন দীর্ঘ সময় ধরে বসে থাকেন বা শারীরিকভাবে ভারী কাজ করেন। যেমন অফিস কর্মী, নির্মাণ শ্রমিক, গাড়িচালক কিংবা গৃহিণীরা—সবার মধ্যেই এই সমস্যা বেশ দেখা যায়।
সব মিলিয়ে, সায়াটিকা শুধু একটি স্নায়বিক সমস্যা নয়, বরং এটি আমাদের সামাজিক, পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবনযাত্রার ওপর একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তাই এর সঠিক কারণ নির্ণয় করে সঠিক চিকিৎসা নেওয়া এবং সচেতনতা তৈরি করাটা এখন আগের চেয়েও অনেক বেশি জরুরি।
সায়াটিক নার্ভ কী?
সায়াটিক নার্ভ হলো মানবদেহের সবচেয়ে লম্বা ও প্রশস্ত স্নায়ু। এটি কোমরের নিচ দিক থেকে শুরু হয়ে নিতম্বের পাশ দিয়ে পায়ের পিছন বরাবর চলে যায় এবং পায়ের পাতার নিচ পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। এই নার্ভটি মূলত পাঁচটি স্নায়ুর শাখা—L4, L5, S1, S2 এবং S3—মিলে তৈরি হয়, যা লাম্বার ও স্যাক্রাল স্পাইন থেকে বের হয় (Standring S, 2020)।
সায়াটিক নার্ভ মূলত লাম্বার প্লেক্সাসের একটি অংশ। এটি গ্লুটিয়াস ম্যাক্সিমাস নামক পেশির নিচ দিয়ে এবং পাইরিফর্মিস মাংসপেশির পাশ ঘেঁষে চলে যায়। এরপর উরুর পিছন দিয়ে হাঁটু পর্যন্ত গিয়ে দুটি প্রধান শাখায় বিভক্ত হয়—একটি হলো টিবিয়াল নার্ভ এবং অন্যটি কমন পেরোনিয়াল নার্ভ (Moore KL et al., 2018)।
এই নার্ভ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ পেশি ও ত্বকে স্নায়বিক সংকেত পাঠিয়ে চলাফেরা ও অনুভূতির নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এর মাধ্যমে উরু, হাঁটু, পায়ের পেছনের অংশ, পায়ের পাতার নিচ এবং আঙুল পর্যন্ত স্নায়বিক বার্তা পৌঁছায়।
সায়াটিক নার্ভের ব্যথা কেন হয় এবং কাদের বেশি হয়? — অনেক সময় কোমরের হাড়ের গঠনগত ত্রুটির কারণেও এই ব্যথা হতে পারে। সায়াটিক নার্ভ যেহেতু শরীরের এতটা দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে, তাই এর যেকোনো অংশে চাপ, প্রদাহ বা ইনজুরি হলে সায়াটিক ব্যথা শুরু হতে পারে। এতে শুধু ব্যথা নয়, পায়ে অবশভাব, দুর্বলতা কিংবা চলাফেরার অসুবিধাও দেখা দিতে পারে। ফলে এই নার্ভের গঠন ও পথ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকাটা চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সায়াটিক ব্যথা কীভাবে সৃষ্টি হয়: প্রধান কারণসমূহ

সায়াটিক নার্ভের ব্যথা কেন হয় এবং কাদের বেশি হয়? — এর উত্তরে বলা যায়, এটি একটি স্নায়ুব্যাধি হলেও দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ও অভ্যাসের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। সায়াটিক ব্যথা সাধারণত তখনই হয়, যখন সায়াটিক নার্ভের ওপর কোনোভাবে চাপ পড়ে, প্রদাহ তৈরি হয়, অথবা আমাদের জীবনযাত্রার কিছু অনিয়ম সেই নার্ভকে প্রভাবিত করে। মূলত এই ব্যথার কারণগুলোকে তিনটি ভাগে ভাগ করে দেখা যায়:
মেকানিক্যাল বা গঠনগত কারণ
সায়াটিক নার্ভের ব্যথা কেন হয় এবং কাদের বেশি হয়? — এর উত্তর খুঁজতে হলে অবশ্যই কর্মজীবনের ধরণ ও দৈহিক অভ্যাস বিশ্লেষণ করতে হবে।
সবচেয়ে সাধারণ কারণ হলো “হার্নিয়েটেড ডিস্ক”, যেখানে মেরুদণ্ডের মাঝে থাকা ডিস্কের নরম জেলির মতো অংশটি ফেটে গিয়ে সায়াটিক নার্ভে চাপ দেয়। এর ফলে কোমর থেকে শুরু করে পায়ের পেছন পর্যন্ত ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে (Deyo RA & Mirza SK, 2016)।
আরেকটি কারণ হলো “স্পাইনাল স্টেনোসিস”, অর্থাৎ মেরুদণ্ডের নার্ভ চলাচলের জায়গা সংকুচিত হয়ে যাওয়া। এতে নার্ভে চাপ পড়ে ব্যথা হয়।
“স্পন্ডাইলোলিসথেসিস” নামক সমস্যায় একটি কশেরুকা (vertebra) অপরটির উপর পিছলে গেলে সায়াটিক নার্ভে টান পড়ে।
এছাড়া, কম পরিচিত হলেও “পাইরিফর্মিস সিনড্রোম” একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। এটি তখন হয়, যখন নিতম্বের গভীরে থাকা পিরিফর্মিস পেশিটি নার্ভের উপর চাপ সৃষ্টি করে (Fishman LM, et al., 2002)।
প্রদাহজনিত বা মেটাবলিক কারণ
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত অনেকেই “ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি” তে ভোগেন, যা সায়াটিক নার্ভকেও প্রভাবিত করতে পারে। এতে ব্যথার পাশাপাশি ঝিঁঝিঁ ভাব, অবশ বা জ্বালাভাব দেখা দিতে পারে (Callaghan BC, et al., 2012)।
এছাড়া, শরীরের প্রদাহজনিত কিছু রাসায়নিক উপাদান যেমন “TNF-α এবং IL-1β”, স্নায়ুকে অতিরিক্ত সংবেদনশীল করে তোলে। ফলে ব্যথা আরও তীব্র হয়।
জীবনযাত্রাজনিত কারণ
আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অভ্যাসগুলোর মধ্যেও সায়াটিক ব্যথা তৈরি হওয়ার ঝুঁকি লুকিয়ে থাকে। যেমন—
- ঘন্টার পর ঘন্টা চেয়ারে বসে থাকা
- নিয়মিত এক্সারসাইজের অভাব
- ভুল ভঙ্গিতে ভারী জিনিস তোলা
- অতিরিক্ত ওজন বহন করা
এসব কারণেই অফিস কর্মী, চালক, নির্মাণ শ্রমিক এমনকি গৃহিণীদের মধ্যেও এই ব্যথা দেখা যায় (Hartvigsen J, et al., 2018)।
এছাড়া, যদি শরীরের “কোর পেশিগুলো দুর্বল” হয় বা মাংসপেশির ভারসাম্য ঠিক না থাকে, তাহলে মেরুদণ্ড ঠিকভাবে সাপোর্ট পায় না। এতে সায়াটিক নার্ভে অপ্রয়োজনীয় চাপ সৃষ্টি হয়।
কারা বেশি ঝুঁকিতে আছেন?
সায়াটিক ব্যথা যেকোনো মানুষের হতে পারে, তবে কিছু নির্দিষ্ট পেশা ও জীবন ধরণে থাকা মানুষদের মধ্যে এই সমস্যার আশঙ্কা অনেক বেশি।
যারা ডেস্কে বসে কাজ করেন: যাঁরা দীর্ঘ সময় ধরে চেয়ারে বসে কম্পিউটারে কাজ করেন—যেমন ফ্রিল্যান্সার, ব্যাংকার, কল সেন্টার কর্মী বা অফিস এক্সিকিউটিভ—তাঁদের কোমরের স্বাভাবিক নড়াচড়া কমে যায়। এতে ডিস্কের ওপর চাপ পড়ে, যা সায়াটিক নার্ভে প্রভাব ফেলতে পারে।
শারীরিক পরিশ্রম করেন যাঁরা: সায়াটিক নার্ভের ব্যথা কেন হয় এবং কাদের বেশি হয়? — এই ব্যথা এমনকি যুবকদের মাঝেও দেখা যেতে পারে যারা অতিরিক্ত ভার উত্তোলন করেন। নির্মাণ শ্রমিক, ইলেকট্রিশিয়ান বা যাঁরা নিয়মিত ভারী জিনিস তোলেন, তাঁদের মধ্যে ডিস্কে চোট বা নার্ভে চাপ পড়ার ঝুঁকি বেশি থাকে (Waddell G, et al., 2004)।
বয়সের প্রভাব: সাধারণভাবে ৩০ থেকে ৫০ বছর বয়সীদের মধ্যে সায়াটিক ব্যথা বেশি দেখা যায়। এই বয়সে মেরুদণ্ডের ডিস্ক স্বাভাবিকভাবে ক্ষয় হতে শুরু করে, ডিস্কের তরলতা ও নমনীয়তা কমে যায়, ফলে নার্ভে সহজেই চাপ পড়ে (Battie MC, et al., 2009)।
যাঁদের মধ্যে আগে থেকেই “ডিস্ক ডিজেনারেশন” বা “স্পাইনাল আর্থ্রাইটিস” রয়েছে, তাঁদের ক্ষেত্রে এই ব্যথা আরও সহজেই হতে পারে।
নারী–পুরুষের মধ্যে পার্থক্য: গবেষণায় দেখা গেছে, “পুরুষদের মধ্যে হার্নিয়েটেড ডিস্ক” থেকে সায়াটিকার সমস্যা তুলনামূলকভাবে বেশি দেখা যায়। অন্যদিকে, “নারীদের মধ্যে পিরিফর্মিস সিনড্রোম” বেশি হয়, বিশেষ করে গর্ভাবস্থার পরে যখন পিরিফর্মিস পেশিতে চাপ পড়ে বা পেশী দুর্বল হয়ে যায় (Boyajian-O’Neill LA, et al., 2008)।
অতিরিক্ত ওজন এবং ব্যায়ামের অভাব: স্থূলতা (অতিরিক্ত ওজন) মেরুদণ্ডের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করে, যা ডিস্ক ও নার্ভকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
আর যদি শরীরের কোর পেশিগুলো দুর্বল থাকে, তাহলে দেহের ভঙ্গি ঠিক থাকে না, ফলে মেরুদণ্ডে অস্বাভাবিক চাপ পড়ে। এটি সরাসরি সায়াটিক নার্ভকে প্রভাবিত করে (Shiri R, et al., 2010)।
সায়াটিক ব্যথার উপসর্গ কীভাবে বুঝবেন?

সায়াটিক ব্যথার কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ আছে, যা সাধারণ কোমর ব্যথার থেকে বেশ আলাদা। এই ব্যথা সায়াটিক নার্ভ যেখান দিয়ে শরীরের মধ্যে দিয়ে গেছে—সেই পথ ধরে ছড়িয়ে পড়ে। অনেক সময় এই উপসর্গগুলো নিউরোলজিক্যাল সমস্যার দিকেও ইঙ্গিত দেয়।
সবচেয়ে সাধারণ উপসর্গসমূহ
এই ব্যথা সাধারণত কোমরের নিচ থেকে শুরু হয়ে নিতম্ব, উরুর পেছন দিক, হাঁটু ছুঁয়ে পায়ের পাতার নিচ পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। এটি সাধারণত শরীরের এক পাশেই হয়। ব্যথাটি অনেক সময় খুব তীব্র ও ধারালো অনুভূতি দেয়—যেমন:
- শার্প পেইন (চিরে যাওয়ার মতো ব্যথা)
- বার্নিং সেনসেশন (জ্বালাপোড়া ভাব)
- স্ট্যাবিং ফিলিং (চাকু দিয়ে খোঁচা দেওয়ার মতো ব্যথা)
অন্যান্য সাধারণ উপসর্গ
- পা বা পায়ের আঙুলে “অবশভাব বা অসাড়তা (numbness)”
- ঝিঁঝিঁ ভাব বা বিড়বিড় অনুভূতি (tingling)
- পায়ে দুর্বলতা বা শক্তি কমে যাওয়া
এই উপসর্গগুলো কতটা তীব্র হবে তা নির্ভর করে নার্ভের ওপর চাপ কতটা বেশি, রক্ত চলাচলে বাধা হচ্ছে কিনা এবং স্নায়ু ঠিকভাবে সংকেত পাঠাতে পারছে কি না তার ওপর।
ব্যথা কোন অবস্থায় বাড়ে?
- হাঁচি বা কাশি দিলে
- অনেকক্ষণ একটানা বসে থাকলে
- বসা থেকে হঠাৎ দাঁড়ালে বা সিঁড়ি বেয়ে উঠলে
এসব অবস্থায় কোমরের ডিস্কে চাপ বেড়ে যায়, ফলে নার্ভের ওপর চাপ আরও বেশি পড়ে এবং ব্যথা বাড়ে।
(Konstantinou K & Dunn KM, 2008)
কখন সতর্ক হবেন?
যদি কোমর থেকে শুরু হয়ে এক পাশে পায়ের দিকে ব্যথা ছড়ায়, সাথে ঝিঁঝিঁ ভাব, অবশ বা দুর্বলতাও থাকে—তবে এটি সাধারণ কোমর ব্যথা নয়। বরং এটি স্নায়ুবিষয়ক সমস্যা হতে পারে, এবং সঠিক ডায়াগনোসিস ও চিকিৎসা জরুরি।
উপসর্গ | ব্যাখ্যা |
কোমর থেকে পা পর্যন্ত ব্যথা | এক পাশেই বেশি হয়, তীব্র বা জ্বালাময় ব্যথা |
অবশ ও ঝিঁঝিঁ ভাব | নার্ভে চাপ লাগার কারণে |
পায়ে দুর্বলতা | নার্ভ সিগন্যাল ঠিকমতো না পৌঁছালে |
হাঁচি/কাশি/বসলে ব্যথা | ব্যথা বাড়ে কারণ চাপ বাড়ে |
সঠিকভাবে উপসর্গ চিহ্নিত করা গেলে চিকিৎসাও দ্রুত শুরু করা যায়, এবং দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা এড়ানো সম্ভব।
কখন চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি?

সায়াটিক নার্ভের ব্যথা কেন হয় এবং কাদের বেশি হয়? — এই প্রশ্নের উত্তর চিকিৎসকরা রোগীর বয়স, জীবনধারা, ওষুধ গ্রহণ ইতিহাস এবং এক্স-রে বা এমআরআই রিপোর্ট দেখে নির্ধারণ করেন।
সায়াটিক ব্যথা অনেক সময় নিজে থেকেই কমে যেতে পারে, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে এটি গুরুতর স্নায়বিক সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে। তাই উপসর্গ দীর্ঘস্থায়ী হলে বা তীব্রভাবে জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেললে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া খুবই জরুরি।
ব্যথা যদি এক সপ্তাহের বেশি থাকে: যদি কোমরের ব্যথা এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে থাকে এবং দিন দিন বেড়ে যায় বা পায়ে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। বিশেষ করে যখন ব্যথা বিশ্রাম বা ওষুধেও কমে না, তখন এটি “হার্নিয়েটেড ডিস্ক” বা “নার্ভে চাপ” পড়ার লক্ষণ হতে পারে।
পায়ে দুর্বলতা বা ভারসাম্য হারানো: যদি হঠাৎ করে পায়ে দুর্বলতা অনুভব করেন, হাঁটার সময় ভারসাম্য ঠিক রাখতে কষ্ট হয়, বা “ফুট ড্রপ” (Foot drop) দেখা যায়—তাহলে দ্রুত চিকিৎসা জরুরি। ফুট ড্রপ মানে হলো রোগী তার পায়ের পাতা ঠিকভাবে উঁচু করতে পারেন না, যা সাধারণত L5 নার্ভ রুটে চাপ পড়লে হয়। এছাড়া, যদি পা শুকিয়ে যায় বা পেশিশক্তি কমে যেতে থাকে, তাহলে এটি দীর্ঘমেয়াদি নার্ভ ক্ষতির লক্ষণ।
প্রস্রাব ও পায়খানা নিয়ন্ত্রণে সমস্যা: যদি সায়াটিক ব্যথার সঙ্গে সঙ্গে “প্রস্রাব ও পায়খানা ধরে রাখতে সমস্যা হয়”, তাহলে এটি “Cauda Equina Syndrome” নামক একটি উরুতর সমস্যার ইঙ্গিত দিতে পারে।
এই অবস্থায় মেরুদণ্ডের নিচের অংশের স্নায়ুগুলো হঠাৎ করে সংকুচিত হয়ে পড়ে, যার ফলে দেখা দিতে পারে—
- নিতম্ব ও মলত্যাগের স্থানে অবশ ভাব (Saddle anesthesia)
- পায়ে তীব্র দুর্বলতা
- বাওয়েল ও ব্লাডার ফাংশন বন্ধ হয়ে যাওয়া
এই পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক অস্ত্রোপচার না করলে রোগী স্থায়ী পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হতে পারেন।
কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন?
উপসর্গ | কেন গুরুত্ব দিতে হবে |
এক সপ্তাহের বেশি ব্যথা | সাধারণ চিকিৎসায় উপশম না হলে |
পায়ে দুর্বলতা বা ভারসাম্য হারানো | নার্ভে চাপ লাগার লক্ষণ |
পায়ের পাতার হঠাৎ শক্তি কমে যাওয়া (Foot drop) | L5 নার্ভ রুটের সমস্যা |
মল ও মূত্র ধরে রাখতে না পারা | Cauda Equina Syndrome – জরুরি অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন |
পায়ের পেশি শুকিয়ে যাওয়া | দীর্ঘমেয়াদি নার্ভ ক্ষতির লক্ষণ |
সায়াটিক ব্যথা অনেক সময় সাধারণ মনে হলেও, কিছু লক্ষণ একে গুরুতর করে তোলে। তাই উপসর্গ বাড়তে থাকলে বা দৈনন্দিন কাজকর্মে বাধা সৃষ্টি করলে দেরি না করে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়াই নিরাপদ। কারণ সময়মতো সঠিক ব্যবস্থা নিলে জটিলতা এড়ানো সম্ভব।
চিকিৎসা ও প্রতিরোধের দৃষ্টিকোণ থেকে করণীয়
সায়াটিক ব্যথা নিরাময়ের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এর সঠিক কারণ শনাক্ত করা এবং সেই অনুযায়ী চিকিৎসার পরিকল্পনা নেওয়া। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ব্যথা “(conservative)” চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, যদিও কিছু জটিল ক্ষেত্রে উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে।
ফিজিওথেরাপি
চিকিৎসার প্রথম ধাপেই ফিজিওথেরাপি অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।
- কোর মাংসপেশি শক্তিশালী ও নমনীয় হলে কোমরের ওপর চাপ কমে যায়
- ব্যাক স্ট্রেংথেনিং, হ্যামস্ট্রিং স্ট্রেচিং ও পেলভিক টিল্ট-এর মতো এক্সারসাইজ দীর্ঘমেয়াদে ব্যথা কমাতে সাহায্য করে
- নিয়মিত কোর এক্সারসাইজ নার্ভে চাপ হ্রাস করে এবং পুনরায় ব্যথা হওয়ার ঝুঁকি কমায়
ওজন নিয়ন্ত্রণ
স্থূলতা মেরুদণ্ডের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে, যা ডিস্ক ও নার্ভের ক্ষতির সম্ভাবনা বাড়ায়। গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁদের “BMI বেশি”, তাঁদের মধ্যে সায়াটিকা ও লো ব্যাক পেইনের প্রবণতা অনেক বেশি (Shiri R, et al., 2010)।
সঠিক দেহভঙ্গি
সঠিক ভঙ্গিতে বসা ও কাজ করা সায়াটিক ব্যথা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ।
- লাম্বার সাপোর্ট সহ চেয়ার ব্যবহার
- ডেস্ক-চেয়ারের উচ্চতা শরীর অনুযায়ী ঠিক রাখা
- প্রতি ৩০–৪০ মিনিট পরপর উঠে দাঁড়ানো বা হালকা স্ট্রেচিং করা
এভাবে দীর্ঘ সময় একই অবস্থায় বসে থাকার নেতিবাচক প্রভাব কমানো যায়।
প্রয়োজনীয় পরীক্ষা–নিরীক্ষা
যদি চিকিৎসা সত্ত্বেও ব্যথা না কমে, তখন ডাক্তার ইমেজিং পরীক্ষার পরামর্শ দিতে পারেন, যেমন:
– “MRI” – ডিস্ক হার্নিয়েশন বা নার্ভে চাপ নির্ণয়ে কার্যকর
– তবে শুধু MRI’র ফলাফল দেখে চিকিৎসা না করে রোগীর উপসর্গ ও শারীরিক নীরিক্ষণ মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি (Qaseem A, et al., 2017)
– “EMG ও NCS (নিউরোফিজিওলজিক্যাল টেস্ট)” – স্নায়ুর কার্যক্ষমতা নির্ধারণে ব্যবহৃত হয়
করণীয় | উপকারিতা |
নিয়মিত ফিজিওথেরাপি | কোমরে চাপ কমে, ব্যথা হ্রাস পায় |
ওজন নিয়ন্ত্রণ | ডিস্ক ও নার্ভে অতিরিক্ত চাপ কমে |
সঠিক বসার ভঙ্গি | ব্যথা প্রতিরোধে কার্যকর |
ইমেজিং ও টেস্ট | সঠিক কারণ চিহ্নিত করে চিকিৎসার দিক নির্ধারণ |
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা মেনে চললে সায়াটিক ব্যথার ঝুঁকি অনেকটাই কমানো যায়। অধিকাংশ রোগী অস্ত্রোপচার ছাড়াই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন, যদি তারা সময়মতো সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করেন ও সচেতনভাবে দৈনন্দিন জীবন পরিচালনা করেন। ব্যথা শুরুর পর দেরি না করে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণই সুস্থ জীবনের চাবিকাঠি।
সায়াটিক ব্যথা শুধু একটি শারীরিক সমস্যা নয়—এটি একটি বহুমাত্রিক সমস্যা, যার সঙ্গে জীববৈজ্ঞানিক, মানসিক, সামাজিক ও জীবনধারাজনিত নানা বিষয় জড়িয়ে আছে। তাই এর সমাধানও হওয়া উচিত সমন্বিতভাবে। একদিকে যেমন ডিস্ক বা নার্ভের গঠনগত সমস্যার দিকটি গুরুত্ব দিতে হবে, তেমনি মানসিক চাপ, দৈনন্দিন অভ্যাস, এবং কর্মপরিবেশের প্রভাবও বিবেচনায় নেওয়া দরকার (Hartvigsen J, et al., 2018)।
গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব রোগী শুধুমাত্র ব্যথানাশক ওষুধের উপর নির্ভর না থেকে নিজেদের জীবনযাপন পরিবর্তন করেছেন, নিয়মিত এক্সারসাইজ করেছেন, এবং ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে মেরুদণ্ড সক্রিয় রেখেছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে এই ব্যথার পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা অনেক কমে গেছে (Qaseem A, et al., 2017)।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বলেছে, নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ বা দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতাগুলোর চিকিৎসায় সচেতনতা ও সময়মতো পদক্ষেপ নেওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সায়াটিক ব্যথার ক্ষেত্রেও বিষয়টি এক রকম। যদি শুরুতেই রোগী উপসর্গগুলো গুরুত্ব দিয়ে দেখে এবং সময়মতো চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন, তাহলে বড় কোনো জটিলতা এড়ানো সম্ভব (WHO, 2020)।
- পেটের বাম পাশে ব্যথা কমানোর উপায় - June 19, 2025
- কোমরের দুই পাশে ব্যথার কারণ কী? - June 19, 2025
- মহিলাদের মধ্যে স্ট্রোক: ঝুঁকি এবং প্রতিরোধ - June 18, 2025