ডিস্ক প্রলাপ্স কী? ডিস্ক প্রলাপ্সের লক্ষণ ও চিকিৎসা | কীভাবে বুঝবেন আপনার ডিস্ক প্রলাপ্স হয়েছে?. ডিস্ক হচ্ছে মেরুদন্ডের দুটি কশেরুকার মধ্যবর্তী একটি বিশেষ পদার্থ একটি মেরুদন্ডের হাড় কে উপর একটি মেরুদন্ডের হাড় থেকে বিভক্ত রাখে যাতে একটি আরেক টির সাথে ঘর্ষণ না লাগে। এটি এক ধরনের চাকতির মত পদার্থ যার দুটি অংশ থাকে।
ডিস্ক প্রলাপ্স কী?
একটি হচ্ছে ‘অ্যানিউলাস ফাইব্রোসাস’ বাইরের আবরণ এবং অপরটি হচ্ছে নিউক্লিয়াস পালপোসাস ভেতরের অংশ এবং ইহা জেলির মত পদার্থ। এই জেলির মত পদার্থ যাতে বাইরে আসতে না পারে এর জন্য রয়েছে ‘আনিউলাস ফাইব্রোসাস’ যেটি বিশেষ ধরনের ফাইব্রাস টিস্যু (যাকে বলে কোলাজেন ফাইবার) দ্বারা তৈরি কয়টি স্তর থাকে। ভেতরের জেলির মত অংশটি যখন বাইরের অংশ কে চাপ দেয় এবং এই চাপ যখন নার্ভ বা স্নায়ুর উপর করে তখন তাকে ডিস্ক প্রলাপ্স বলে। পিএলআইডি/ডিস্ক হার্নিয়েশনের সর্বোত্তম চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে
স্লিপ ডিস্ক বা ডিস্ক প্রলাপ্স কেন হয়
ডিস্কের দুটি অংশ, বাইরের দিকে আনিউলাস ফাইব্রোসাস এবং ভিতরের দিকে নিউক্লিয়াস পালপোসাস যদি সঠিক স্থানে থাকে তাহলে তার চলাফেরা সহ্য মত হয়। ওজন তোলা বা বহন করা, সামনে ঝোঁকা বা বসা ইত্যাদি কোন অসুবিধা বা সমস্যা দেখা দেয় না।
ডিস্কের ভেতরের অংশটি শক্ত অথচ ইলাস্টিকের মত। মেরুদন্ডে যদি চাপ পড়ে তাহলে এটি উহা কে বাধা দিয়ে স্বাভাবিক অবস্থা রাখার চেষ্টা করে। কেউ যদি দীর্ঘ সময় সামনে ঝুঁকে কাজ করে যেভাবে বসা দরকার সেভাবে না বসে তাহলে ডিস্কের ভেতরের অংশের দেয়াল পাতলা হয়ে যায় এবং এক সময় যদি সে হঠাৎ সামনে ঝুঁকে বেশি ভারী জিনিস তোলে বা হাচি বা কাশি দেয় তাহলে ডিস্কের মধ্যে অতিরিক্ত চাপ পড়ে।
তখন বাইরের অংশ টি আর ভেতরের অংশ কে মধ্যবর্তী জায়গায় ধরে রাখতে পারে না। যে কোনো এক দিকে চাপ বেশি পড়ে এবং এটি যদি কোমর থেকে বের হয়ে নার্ভ বাঁ স্নায়ুর উপর চাপ দেয় তাহলে ব্যথা পায়ের নিচ পর্যন্ত চলে যায়, একেই ডিস্ক প্রলাপ্স বলে।
কিভাবে বুঝবেন আপনার ডিস্ক প্রলাপস বা স্লিপ ডিস্ক হয়েছে
- রোগীর সমস্যার বর্ণনা শুনতে গেলে প্রথমেই বলে ভারী জিনিস উঠাবার সময় বা হাঁচি অথবা কাশি দিতে গিয়ে কোমরে একটা শব্দ হয়েছে বা টান লাগছে।
- কোমর অসহ্য ব্যথা হয়, এই ব্যথা পা পর্যন্ত ছড়িয়ে যায় এবং বিদ্যুৎ তরঙ্গের মতো প্রচন্ড আকারে কাল কাল করে নেয়। অনেক সময় শুধু পায়ের দিকে ব্যথার অনুভূতি বেশি হয়, কোমরে ব্যথা নাও হতে পারে।
- ব্যথা এতই প্রচন্ড হতে পারে যে, রোগীর পূর্ণ বিশ্রামে যেতে হতে পারে।
- পাশ ফিরতে বা সোজা হয়ে দাঁড়াতে বেশ কষ্ট হয়।
- হাঁটলে বা কাজ করলে ব্যথা বেশ বেড়ে যায়। রাতে ঘুমের মধ্যেও ব্যথা হতে পারে।
- অনেক সময় রোগী পায়ে ঝিনঝিন, অবশ ভাব ও দুর্বলতা অনুভব করেন।
- কিছু কিছু রোগীর কোমর এক দিকে বেঁকে যায় ফলে সে বাঁকা হয়ে হাটে।
- চিৎ হয়ে এক পা এক পা উঁচু করতে গেলে কোমর ও পায়ের ব্যথা ও টান অনুভব হয়।
- সাধারনত এক্সরে করে ডিস্ক প্রলাপস ধরা পরে না। এর জন্য এম.আর.আই করতে হয় ।
- এম.আর.আই করলে সুন্দর ভাবে বুঝা যায় যে কোন অংশের কোন নার্ভ বা স্নায়ু তে কত টুকু চাপ পড়েছে।
- ডিস্ক প্রলাপস স্লিপড বেশি হলে প্রসাব পায়খানা স্বাভাবিক ভাবে ধরে রাখতে কষ্ট হবে। এক্ষেত্রে অপারেশন করা অত্যন্ত বাঞ্ছনীয়।
ডিস্ক প্রলাপ্সের লক্ষণ
ডিস্ক প্রলাপ্স বা হার্নিয়েটেড ডিস্ক সাধারণত পিঠের বা ঘাড়ের ব্যথার একটি সাধারণ কারণ। এই অবস্থায়, মেরুদণ্ডের ডিস্কের মধ্যে থাকা জেলি-সদৃশ নরম অংশটি ফেটে গিয়ে বাহিরে বেরিয়ে আসে এবং স্নায়ুর ওপর চাপ সৃষ্টি করে। এর ফলে নানা রকম উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
পিঠের বা ঘাড়ের ব্যথা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পিঠের নিচের অংশে বা ঘাড়ে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। ব্যথা সাধারণত একপাশে বা নির্দিষ্ট একটি জায়গায় বেশি হয়। পায়ে বা হাতে ব্যথা (সায়াটিকা) যদি প্রলাপ্স লাম্বার ডিস্কে ঘটে, তাহলে পায়ে ব্যথা হতে পারে। এটি পিঠ থেকে শুরু করে পায়ের নিচ পর্যন্ত নেমে যেতে পারে। ঘাড়ের ডিস্ক প্রলাপ্স হলে ব্যথা হাতে ছড়াতে পারে।
অসাড়তা বা ঝিনঝিন ভাব ক্ষতিগ্রস্ত স্নায়ু অনুযায়ী হাত বা পায়ের নির্দিষ্ট অংশে অসাড়তা, ঝিনঝিন ভাব বা পিন-প্রিকলিং এর অনুভূতি হতে পারে। পেশীর দুর্বলতা ক্ষতিগ্রস্ত স্নায়ুর সাথে যুক্ত পেশী দুর্বল হয়ে পড়তে পারে, যা হাঁটা, দাঁড়ানো বা জিনিস পত্র ধরার সময় অসুবিধা সৃষ্টি করে। ডিস্ক প্রলাপ্স বা স্লিপ ডিস্ক হলে কি করবেন?
নড়া চড়ার সীমাবদ্ধতা মেরুদণ্ডে নড়াচড়া করার সময় ব্যথা তীব্র হয়ে ওঠে, বিশেষত যদি স্নায়ুর ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়। তীব্র ক্ষেত্রে ব্লাডার বা বোয়েল নিয়ন্ত্রণের সমস্যা, খুব কম ক্ষেত্রে, ডিস্ক প্রলাপ্স কডা ইকুইনা সিন্ড্রোম সৃষ্টি করতে পারে, যেখানে ব্লাডার বা বোয়েল নিয়ন্ত্রণের সমস্যা হয়, যা একটি জরুরি চিকিৎসা অবস্থা। এই লক্ষণ গুলোর যে কোনো টি দেখা দিলে দ্রুত একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে উপসর্গ গুলি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।
ডিস্ক প্রলাপ্স নির্ণয়
ডিস্ক প্রলাপ্স নির্ণয়ের জন্য রোগীর উপসর্গ এবং শারীরিক পরীক্ষার পাশাপাশি কিছু নির্দিষ্ট ইমেজিং পরীক্ষা এবং অন্যান্য ডায়াগনস্টিক পদ্ধতি প্রয়োজন হতে পারে। নিচে ডিস্ক প্রলাপ্স নির্ণয়ের জন্য ব্যবহৃত প্রধান পদ্ধতি গুলো উল্লেখ করা হলো। প্রাথমিক ভাবে উপসর্গের উপর ভিত্তি করে চিকিৎসক MRI বা CT স্ক্যানের পরামর্শ দিতে পারেন, কারণ এগুলো ডিস্ক প্রলাপ্সের সঠিক অবস্থান এবং স্নায়ুর ওপর এর প্রভাব সঠিক ভাবে নির্ধারণ করতে সক্ষম। এরপর প্রাপ্ত ফলাফলের উপর ভিত্তি করে যথাযথ চিকিৎসা নির্ধারণ করা হয়।
রোগীর ইতিহাস এবং শারীরিক পরীক্ষা- প্রথমে চিকিৎসক রোগীর উপসর্গ, ব্যথার ধরন এবং ব্যথার স্থান সম্পর্কে বিস্তারিত জিজ্ঞাসা করবেন। শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে স্নায়ুর কার্যকারিতা, পেশীর শক্তি এবং ব্যথার উৎস নির্ধারণের চেষ্টা করা হয়।
ইমেজিং টেস্ট- MRI ডিস্ক প্রলাপ্স নির্ণয়ের সবচেয়ে নির্ভর যোগ্য এবং প্রচলিত পদ্ধতি। এটি মেরুদণ্ডের ডিস্ক এবং স্নায়ুর উপর চাপ সৃষ্টি করছে কিনা তা স্পষ্ট ভাবে দেখাতে পারে। CT Scan এটি একটি আরও বিশদ ইমেজ প্রদান করে, যা ডিস্ক এবং আশে পাশের অস্থি গঠন মূল্যায়ন করতে সাহায্য করে। X-ray যদিও এটি ডিস্ক প্রলাপ্স সঠিক ভাবে দেখাতে পারে না, তবে এটি অন্যান্য কারণ যেমন অস্টিওআর্থ্রাইটিস বা হাড়ের সমস্যা নির্ধারণে সহায়ক হতে পারে।
নিউরোলজিক্যাল টেস্ট EMG এই পরীক্ষা গুলো স্নায়ুর কার্যকারিতা পরীক্ষা করে এবং স্নায়ুর ওপর ডিস্ক প্রলাপ্সের প্রভাব নির্ধারণে সাহায্য করে। মাইলোগ্রাফি যদি MRI বা CT স্ক্যান যথেষ্ট না হয়, তবে মাইলোগ্রাফি করা হয় যেখানে একটি কন্ট্রাস্ট ডাইঞ্জেক্ট করে এক্স-রে বা CT স্ক্যান করা হয়। এটি স্নায়ু বা মেরুদণ্ডে যে কোনো অস্বাভাবিক চাপের প্রমাণ পেতে সাহায্য করে।
ডিস্ক প্রলাপ্স চিকিৎসা
ডিস্ক প্রলাপ্সের চিকিৎসা নির্ভর করে রোগীর উপসর্গের তীব্রতা, ডিস্কের প্রলাপ্সের অবস্থান, এবং স্নায়ুর ওপর চাপের পরিমাণের ওপর। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, অস্ত্রোপচার ছাড়াই চিকিৎসা পদ্ধতি প্রথমে প্রয়োগ করা হয়। নিচে ডিস্ক প্রলাপ্সের বিভিন্ন চিকিৎসা উল্লেখ করা হলো।
অস্ত্রোপচার বিহীন চিকিৎসা পদ্ধতি – বিছানায় বিশ্রাম কিছু সময়ের জন্য শারীরিক ক্রিয়া কলাপ সীমিত করা এবং সঠিক ভাবে বিশ্রাম নেওয়া ব্যথা কমাতে সাহায্য করতে পারে।
ঔষধ – ব্যথা কমানোর জন্য পেইন কিলার (যেমন প্যারাসিটামল)। স্নায়ুর ব্যথা কমাতে গ্যাবাপেন্টিন বা প্রেগাবালিন। পেশী শিথিল করণের জন্য Muscle Relaxants ব্যবহার করা হতে পারে। স্টেরয়েড ইনজেকশন সরাসরি আক্রান্ত স্থানে ব্যথা এবং প্রদাহ কমাতে প্রয়োগ করা হয়। কিভাবে বুঝবেন যে আপনি ডিস্ক প্রল্যাপ্সজনিত কোমড় ব্যথার রোগী
ফিজিওথেরাপি – সঠিক ব্যায়াম এবং স্ট্রেচিং মেরুদণ্ডের স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি করে এবং পেশীর দুর্বলতা কমাতে সাহায্য করে। হিট থেরাপি বা ঠান্ডা প্যাক, আল্ট্রাসাউন্ড থেরাপি, এবং বৈদ্যুতিক স্নায়ু উদ্দীপনা (TENS) ব্যবহার করা যেতে পারে। শরীরের অবস্থান সংশোধন সঠিক ভাবে বসা, দাঁড়ানো এবং শোয়ার পদ্ধতি মেরুদণ্ডের ওপর চাপ কমায়।
অস্ত্রোপচার- যদি উপরের পদ্ধতি গুলো কার্যকর না হয়, এবং স্নায়ুর ওপর চাপ মারাত্মক আকার ধারণ করে বা ব্লাডার এবং বোয়েল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার ঝুঁকি থাকে, তবে অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হতে পারে।মাইক্রোডিস্কেকটমি এটি একটি সাধারণ অস্ত্রোপচার পদ্ধতি যেখানে প্রলাপ্স হওয়া অংশ অপসারণ করা হয় এবং স্নায়ুর ওপর চাপ কমানো হয়। ল্যামিনেকটমি মেরুদণ্ডের একটি অংশ (ল্যামিনা) সরিয়ে স্নায়ুর ওপর চাপ কমানো হয়। আর্থ্রোডেসিস বা স্পাইনাল ফিউশন দুই বা ততোধিক ভার্টেব্রা একত্রিত করা হয়, যা মেরুদণ্ড কে স্থিতিশীল করতে সহায়ক।
লাইফ স্টাইল মডিফিকেশন– সঠিক ভাবে ওজন নিয়ন্ত্রণ করা। সঠিক ভঙ্গি মেনে চলা। ভারী ওজন তোলার সময় সতর্ক থাকা। প্রথমে অস্ত্রোপচার বিহীন পদ্ধতি গুলো প্রয়োগ করা হয় এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ গুলো কার্যকর হয়। তবে, উপসর্গ গুরুতর হলে এবং অন্যান্য পদ্ধতি তে উপশম না হলে অস্ত্রোপচারই এক মাত্র বিকল্প হয়ে দাঁড়ায়। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী উপযুক্ত চিকিৎসা গ্রহণ করাই সঠিক পদক্ষেপ।
তথ্যসূত্র
- Koes, B.W., Van Tulder, M.W. and Peul, W.C., 2007. Diagnosis and treatment of sciatica. Bmj, 334(7607), pp.1313-1317. https://www.bmj.com/content/334/7607/1313?flh=
- Jensen, M.C., Brant-Zawadzki, M.N., Obuchowski, N., Modic, M.T., Malkasian, D. and Ross, J.S., 1994. Magnetic resonance imaging of the lumbar spine in people without back pain. New England Journal of Medicine, 331(2), pp.69-73. https://www.nejm.org/doi/full/10.1056/nejm199407143310201
- সার্ভিকাল স্পন্ডাইলোসিস কি স্থায়ীভাবে নিরাময় করা যায় - August 1, 2024
- স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি কী এবং সহজ সমাধান - June 13, 2024
- Sports Physical Therapy - May 9, 2024