পিঠের মাঝখানের ব্যথা বলতে বোঝানো হয় থোরাসিক স্পাইনের (T1 থেকে T12 কশেরুকা) আশেপাশে হওয়া ব্যথা, যা সাধারণত ঘাড়ের নিচ থেকে শুরু হয়ে পাঁজরের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকতে পারে। এই ব্যথা কখনো তীব্র, কখনো হালকা অথবা মাঝেমাঝে আসা-যাওয়া করতে পারে। সাধারণত বেশি কাজ, দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা, ভুল ভঙ্গিতে কাজ করা বা হঠাৎ ভঙ্গি পরিবর্তনের কারণে এই ব্যথা অনুভূত হয়। আমাদের শরীরের এই অংশটি পাঁজরের সাহায্যে মজবুতভাবে সুরক্ষিত থাকায়, এখানে ব্যথা তুলনামূলকভাবে কম দেখা যায়। তবে যখন দেখা দেয়, তখন এটি মাংসপেশি, হাড়, স্নায়ু অথবা অভ্যন্তরীণ অঙ্গের সমস্যার কারণে হতে পারে।

পিঠের মাঝের ব্যথা কোমর বা ঘাড়ের ব্যথার তুলনায় সাধারণত কম হয়, কারণ এই অংশের মেরুদণ্ড অপেক্ষাকৃত কম নড়াচড়া করে। তবুও এই ব্যথা যদি হয়, তাহলে এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে বেশ সমস্যায় ফেলতে পারে— যেমন কাজের সক্ষমতা কমে যাওয়া, ঘুমে অসুবিধা, কিংবা সাধারণ কাজকর্মে ব্যাঘাত সৃষ্টি হওয়া। এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ১০০ জন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে প্রায় ১৫ থেকে ২০ জন জীবনে কোনো না কোনো সময় এই ধরনের ব্যথার মুখোমুখি হন, যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটি স্বল্পমেয়াদি হয়ে থাকে (Fouquet et al. 2016, European Spine Journal)। তবে সংক্রমণ, টিউমার বা অভ্যন্তরীণ অঙ্গের কোনো সমস্যার কারণে যদি ব্যথা হয় এবং সঠিক সময়ে তা নির্ণয় না হয়, তাহলে বড় ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকির আশঙ্কা থাকে।

বাংলাদেশে এই ধরনের পিঠের ব্যথার সমস্যা দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে যারা দীর্ঘক্ষণ অফিসে বসে কাজ করেন বা কৃষি ও নির্মাণসহ বিভিন্ন কায়িক শ্রমের কাজে নিয়োজিত, তাদের মধ্যে এটি বেশি দেখা যায়।

Table of Contents hide

পিঠের গঠন

পিঠের মাঝখানে যে অংশে ব্যথা অনুভূত হয়, সেটিই মূলত থোরাসিক মেরুদণ্ড। এটি আমাদের মেরুদণ্ডের মাঝামাঝি অংশ এবং এতে মোট ১২টি কশেরুকা (T1 থেকে T12) থাকে। প্রতিটি কশেরুকা পাঁজরের হাড়ের সাথে যুক্ত থাকে, যা মিলে তৈরি করে রিব কেজ বা পাঁজরের খাঁচা। এই খাঁচা আমাদের শরীরের উপরের অংশকে সহায়তা করে এবং হৃৎপিণ্ড, ফুসফুসের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোকে রক্ষা করে।

থোরাসিক মেরুদণ্ড তুলনামূলকভাবে ঘাড় (সার্ভাইক্যাল) বা কোমরের (লাম্বার) মেরুদণ্ডের চেয়ে কম নড়াচড়া করে। কারণ, এটি পাঁজরের সাথে সংযুক্ত এবং এর মধ্যে থাকা “ফ্যাসেট জয়েন্ট” বা ছোট জয়েন্টগুলোও এর গতিশীলতাকে সীমিত রাখে। এই কারণেই থোরাসিক অংশ অনেক বেশি স্থিতিশীল এবং শরীরের ভারসাম্য ও ভঙ্গিমা বজায় রাখতে বড় ভূমিকা রাখে।

ব্যথার সাথে থোরাসিক অংশের সম্পর্ক

পিঠের মাঝখানে ব্যথা হলে সেটি কেবল পেশির কারণে নয়, বরং বিভিন্ন কারণে হতে পারে। যেমন:

  • পেশিতে টান লাগা
  • লিগামেন্টে টান পড়া বা আঘাত
  • ছোট ছোট জয়েন্টে প্রদাহ (যেমন: ফ্যাসেট জয়েন্ট)
  • ডিস্কে সমস্যা (যেমন ডিস্ক হার্নিয়া বা ক্ষয়)
  • এমনকি হৃদপিণ্ড বা ফুসফুস থেকেও ব্যথা ছড়িয়ে পড়তে পারে

ভঙ্গি (Posture) ও নড়াচড়ার প্রভাব

অনেক সময় ভুল ভঙ্গিতে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা বা সামনে ঝুঁকে কাজ করা পিঠের মাঝখানে অস্বস্তি বা ব্যথা সৃষ্টি করে। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে ডিস্ক বা জয়েন্ট ক্ষয় হতে পারে, যা ব্যথা বাড়িয়ে তোলে। থোরাসিক কাইফোসিস (অর্থাৎ পিঠ বাঁকা হয়ে যাওয়া) এবং এই অংশের নড়াচড়ার সীমাবদ্ধতা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যথা বাড়ার পেছনে দায়ী হতে পারে।

পিঠের মাঝখানে ব্যথার সাধারণ কারণ

পিঠের মাঝখানে ব্যথার সাধারণ কারণ
পিঠের মাঝখানে ব্যথার সাধারণ কারণ

পিঠের মাঝখানে ব্যথা অনেক সময় আমাদের দৈনন্দিন অভ্যাস, কাজের ধরন বা শারীরিক ভঙ্গির কারণে হয়ে থাকে। সাধারণত এই ব্যথা মাংসপেশীর চাপ, ভুল ভঙ্গি বা আঘাতের ফলাফল। নিচে এই সাধারণ কারণগুলো সহজভাবে ব্যাখ্যা করা হলো।

মাংসপেশী ও ভঙ্গিজনিত কারণ

. মাংসপেশীর টান বা মচকানো: পিঠের মাঝখানে ব্যথার সবচেয়ে সাধারণ কারণ হলো পেশিতে টান বা লিগামেন্টে টান পড়া। অনেক সময় ভারী কিছু তুলতে গিয়ে, দীর্ঘক্ষণ একই ভঙ্গিতে কাজ করলে এই ব্যথা শুরু হয়। বিশেষ করে যারা বসে কাজ করেন বা ভাড়ী কাজকর্ম করেন, তাদের মধ্যে এটি বেশি দেখা যায়।

এক গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রায় ৪০–৫০% ক্ষেত্রেই মাংসপেশীর টান লাগা হচ্ছে পিঠের মাঝখানে ব্যথার কারণ (Haldeman et al., 2010, ‘Spine’)।

. ভঙ্গির ভুল:সারাদিন ভুল ভঙ্গিতে বসে থাকা, যেমন মাথা সামনে ঝুঁকিয়ে রাখা বা কাঁধ গোল করে বসা— এগুলো পিঠের মাঝখানে অস্বাভাবিক চাপ সৃষ্টি করে। ঘন্টার পর ঘন্টা স্মার্টফোন বা ল্যাপটপের ব্যবহার এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে দেয়।

. থোরাসিক ডিস্ক হার্নিয়া: যখন পিঠের মাঝখানে থাকা ডিস্ক নিজের অবস্থান থেকে সরে গিয়ে নার্ভে চাপ দেয়, তখন ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে বা ঝিনঝিন করে। এই সমস্যাটি তুলনামূলকভাবে কম হলেও, একবার হয়ে গেলে তা গুরুতর হতে পারে।

Wood et al. (2011) জানিয়েছেন, এই ধরনের ডিস্ক হার্নিয়া পিঠের ব্যথার মাত্র ১–২% হলেও, স্নায়বিক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।

. ফ্যাসেট জয়েন্টের সমস্যা:পিঠের মেরুদন্ডের হাড়ের সংযোগস্থলে (ফ্যাসেট জয়েন্ট) প্রদাহ বা ক্ষয় হলে সেখান থেকেও ব্যথা হতে পারে। বয়সজনিত আর্থ্রাইটিস বা পুরনো আঘাতের কারণে এসব জয়েন্ট দুর্বল হয়ে পড়ে।

Manchikanti et al. (2016) জানিয়েছেন, শতকরা ১৫–২০% পিঠে ব্যথা ফ্যসেট জয়েন্টের সমস্যার কারণে হয়।

আঘাতজনিত কারণ

. কশেরুকায় ফ্র্যাকচার: বয়স্কদের মধ্যে অস্টিওপোরোসিসের কারণে অনেক সময় হাড় দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সামান্য চাপেও হাড় ভেঙে যেতে পারে। আবার দুর্ঘটনা বা পড়ে যাওয়ার কারণে যেকোনো বয়সেই এই ফ্র্যাকচার হতে পারে।

. সফট টিস্যুর ইঞ্জুরি:খেলাধুলা, দুর্ঘটনা, বা দৈনন্দিন অনিয়ন্ত্রিত শরীরচর্চার ফলে মাংসপেশি, টেন্ডন বা লিগামেন্টে আঘাত লাগতে পারে, যাকে বলা হয় সফট টিস্যুর ইঞ্জুরি।

পিঠের মাঝখানে ব্যথার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ

পিঠের মাঝখানে ব্যথার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ
পিঠের মাঝখানে ব্যথার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ

পিঠের মাঝখানের ব্যথা সাধারণত মাংসপেশি বা ভঙ্গিজনিত কারণে হয়, তবে কিছু গুরুতর কারণও রয়েছে যেগুলো অবহেলা করলে জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন—মেরুদণ্ডের জন্মগত বা বয়সজনিত পরিবর্তন, সংক্রমণ, টিউমার, কিংবা অভ্যন্তরীণ অঙ্গ বা নার্ভের সমস্যা থেকেও এই ব্যথা আসতে পারে। নিচে এসব কারণ সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করা হলো:

মেরুদণ্ডসংক্রান্ত গুরুতর কারণ

স্কোলিওসিস ও কাইফোসিস: যখন মেরুদণ্ড স্বাভাবিক সোজা অবস্থার পরিবর্তে এক পাশে বাঁকা হয়ে যায় তাকে “স্কোলিওসিস” বলে, আর যখন বেশি কুঁজো হয়ে সামনে ঝুঁকে যায় তাকে “কাইফোসিস” বলে। এই ধরনের অস্বাভাবিক বক্রতা পিঠের মাঝখানে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে, ফলে পেশি, জয়েন্ট কিংবা স্নায়ুতে ব্যথা হতে পারে।বিশেষ করে কিশোরদের মধ্যে স্কোলিওসিস আর বয়স্কদের মধ্যে কাইফোসিস বেশি দেখা যায়।গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৫–১০% ক্ষেত্রে পিঠের মাঝখানে ব্যথার জন্য মেরুদন্ডের এই ধরনের বক্রতা দায়ী (Weinstein et al., 2003, ‘The Lancet’)।

মেরুদণ্ডের সংক্রমণ: মেরুদণ্ডে বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ হতে পারে যেমন—”অস্টিওমাইলাইটিস” (হাড়ের সংক্রমণ) বা “ডিস্কাইটিস” (ডিস্কে সংক্রমণ)।

এই সংক্রমণ ধীরে ধীরে ব্যথা তৈরি করে, সঙ্গে থাকতে পারে জ্বর, দুর্বলতা ও রাতে ব্যথা।

বাংলাদেশে “টিউবারকুলোসিস (টিবি)” থেকে পট’স ডিজিজ নামে পরিচিত এই সংক্রমণ বেশ পরিচিত।

Zimmerli (2010) দেখিয়েছেন, মেরুদণ্ডের সংক্রমণজনিত পিঠে ব্যথা প্রায় ১% ক্ষেত্রে হলেও তা জীবনঘাতী হতে পারে (‘New England Journal of Medicine’)।

রক্ত পরীক্ষা ও এমআরআই এর মাধ্যমে এটি নির্ণয় করা যায় এবং সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক বা অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধেই চিকিৎসা করা যায় (Berbari et al., 2015, ‘Clinical Infectious Diseases’)।

মেরুদণ্ডের টিউমার: মেরুদণ্ডে ক্যান্সার হতে পারে, যেটি কেবল মেরুদণ্ডেই হতে পারে কিংবা শরীরের অন্য অঙ্গ (যেমন ফুসফুস, স্তন) থেকে ছড়িয়ে আসতে পারে।

এই টিউমার স্নায়ু বা হাড়ে চাপ দিয়ে দীর্ঘস্থায়ী বা রাতে ব্যথা তৈরি করতে পারে। সঙ্গে থাকতে পারে ওজন কমে যাওয়া, দুর্বলতা বা অবশভাব।

এমআরআই ও বায়োপসি পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করে রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি বা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে এর চিকিৎসা করা হয় (Cole & Patchell, 2008, ‘The Lancet Oncology’)।

অন্যান্য অঙ্গ থেকে ছড়ানো ব্যথা

হৃদরোগ: হৃদপিণ্ডের সমস্যাও পিঠের মাঝখানে ব্যথা তৈরি করতে পারে, বিশেষ করে “অ্যাঞ্জাইনা” বা “অ্যাওর্টিক অ্যানিউরিজম” হলে।

এই ব্যথা অনেক সময় বুকে শুরু হয়ে পিঠে ছড়িয়ে পড়ে। পাশাপাশি থাকতে পারে শ্বাসকষ্ট, ঘাম ও মাথা ঘোরানো।

Cayley (2005) বলছেন, এমন ব্যথা শতকরা ২–৫% ক্ষেত্রে হৃৎপিন্ডের ব্যথার কারণে পিঠের ব্যথা হতে পারে (‘American Family Physician’)

সঠিকভাবে ইসিজি, ইকো, বা সিটি অ্যাঞ্জিওগ্রাম করে চিকিৎসা করা জরুরি (Amsterdam et al., 2014, ‘Journal of the American College of Cardiology’)।

পরিপাকতন্ত্রের রোগ: “পিত্তথলির পাথর”, “অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ” বা “খাদ্যনালীর জ্বালাপোড়া” থেকেও পিঠের মাঝখানে ব্যথা হতে পারে।খাওয়ার পর ব্যথা বাড়ে, সঙ্গে পেটে অস্বস্তি, বমি বা হজমের সমস্যা থাকতে পারে।

চিকিৎসার জন্য আল্ট্রাসাউন্ড, এন্ডোস্কোপি ও প্রয়োজনে অস্ত্রোপচার করা লাগতে পারে (Everhart & Ruhl, 2009, ‘Gastroenterology’)।

ফুসফুসের রোগ: “নিউমোনিয়া”, “প্লুরাইটিস” বা “পালমোনারি এম্বোলিজম” থেকেও পিঠের মাঝখানে ব্যথা হতে পারে।এই ব্যথার সঙ্গে জ্বর, কাশি বা শ্বাসকষ্ট দেখা যায়।

স্নায়বিক কারণ

নার্ভের চাপ: “ডিস্ক হার্নিয়া” বা “অস্টিওফাইট” (হাড়ের অতিরিক্ত বৃদ্ধি) যদি নার্ভের উপর চাপ দেয়, তাহলে তা ব্যথা, অবশ বা ঝিনঝিনের কারণ হতে পারে।এই ব্যথা প্রায়ই বুক বা পাঁজর পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়।

এমআরআই ও ইএমজি দিয়ে এটি নির্ণয় করা যায়, এবং প্রয়োজনে ফিজিওথেরাপি বা অপারেশন করা হয় (Wilbourn & Aminoff, 1998, ‘Muscle & Nerve’)।

শিঙ্গলস (Herpes Zoster): শিঙ্গলস ভাইরাসজনিত একটি সংক্রমণ, যা পিঠের নার্ভকে আক্রান্ত করে। এতে পাঁজরের একপাশে তীক্ষ্ণ ব্যথা ও ফুসকুড়ি হয়।বাংলাদেশে বয়স্কদের মধ্যে এই রোগ বেশি দেখা যায়।

Gilden et al. (2013) বলেন, শতকরা ২–৩% ক্ষেত্রে শিঙ্গলস এর কারণে পিঠে ব্যথা হয় (The Lancet Neurology’)।

অ্যান্টিভাইরাল ও ব্যথার ওষুধে এটি ভালো হয় এবং প্রতিরোধে ভ্যাকসিন কার্যকর (Oxman et al., 2005, ‘New England Journal of Medicine’)।

যারা পিঠের মাঝখানে ব্যথা হবার ঝুঁকিতে আছেন

যারা পিঠের মাঝখানে ব্যথা হবার ঝুঁকিতে আছেন
যারা পিঠের মাঝখানে ব্যথা হবার ঝুঁকিতে আছেন

পিঠের মাঝখানের ব্যথা অনেক সময় আমাদের বয়স, দৈনন্দিন জীবনযাত্রা বা অন্যান্য রোগের প্রভাবে দেখা দেয়। এসব ঝুঁকি সম্পর্কে জানা থাকলে আমরা আগেভাগেই সতর্ক হতে পারি এবং ব্যথা প্রতিরোধ ও সঠিক সময়ে চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারি।

জনসংখ্যাগত কারণ

বয়স: বয়স যত বাড়ে, শরীরে নানা রকম অবক্ষয়জনিত পরিবর্তন দেখা যায়। বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে অস্টিওআর্থ্রাইটিস, অস্টিওপোরোসিস, কিংবা ফ্যাসেট জয়েন্টের ক্ষয়জনিত সমস্যা বেশি দেখা যায়। এসব কারণে পিঠের মাঝখানে ব্যথা হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
বাংলাদেশে অনেক বয়স্ক মানুষ এই সমস্যায় ভোগেন, কিন্তু সচেতনতার অভাবে তা প্রায়ই শনাক্ত হয় না। অন্যদিকে, তরুণদের মধ্যে খেলাধুলা বা সড়ক দুর্ঘটনার কারণে পেশিতে টান বা হাড়ে চোট বেশি দেখা যায়। ১৫–৩০ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে শতকরা ২০–৩০% ক্ষেত্রে আঘাতজনিত কারণে পিঠের মাঝখানে ব্যথা হয় (Haldeman et al., 2010, Spine)।

লিঙ্গ: নারীদের মধ্যে হরমোনগত পরিবর্তনের কারণে মেনোপজের পর হাড় দুর্বল হয়ে যায়, ফলে অস্টিওপোরোসিস-সম্পর্কিত কশেরুকা ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। বাংলাদেশের অনেক নারী পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম বা ভিটামিন ডি পান না, যার ফলে তারা আরও বেশি ঝুঁকিতে থাকেন।

জীবনযাত্রা সম্পর্কিত কারণ

অলস জীবনধারা ও স্থূলতা: দীর্ঘক্ষণ বসে কাজ করা, এক্সারসাইজের অভাব এবং অতিরিক্ত ওজন—সবগুলোই পিঠের উপর চাপ সৃষ্টি করে।
এতে পেশি দুর্বল হয়ে পড়ে, চলাফেরার ভঙ্গি খারাপ হয় এবং ব্যথা হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।
Shiri et al. (2010) এর গবেষণায় দেখা গেছে, এসব কারণে প্রায় ৩০% ক্ষেত্রে পিঠে ব্যথা হয়ে থাকে (American Journal of Epidemiology)।
বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে এই সমস্যা দ্রুত বাড়ছে, কারণ অনেকেই অফিসে বা পড়াশোনায় দীর্ঘ সময় বসে থাকেন।

পেশাগত ঝুঁকি: যারা ভারী শ্রম করেন—যেমন কৃষক, নির্মাণ শ্রমিক বা রিকশাচালক—তাদের পিঠে চাপে বেশি পড়ে। অন্যদিকে অফিস কর্মীরা দীর্ঘক্ষণ বসে কাজ করেন, যেখানে সঠিক চেয়ার বা ডেস্ক না থাকলে পোশ্চারে সমস্যা হয়।
Punnett et al. (2005) দেখিয়েছেন, এই পেশাগত ঝুঁকি পিঠের ব্যথার ২৫–৩৫% ক্ষেত্রে দায়ী (Journal of Occupational and Environmental Medicine)।

অন্যান্য রোগের কারণে পিঠে ব্যথা

যাদের ডায়াবেটিস, বাত (arthritis), বা অটোইমিউন রোগ (যেমন অ্যাঙ্কাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস) আছে, তাদের পিঠের মাঝখানে ব্যথা হওয়ার ঝুঁকি স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি।
বাত হলে জয়েন্টগুলোতে প্রদাহ তৈরি হয়, যা ব্যথা সৃষ্টি করে। ডায়াবেটিস থাকলে স্নায়ুর ক্ষতি হয় এবং সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

প্রাদুর্ভাব (Epidemiology)

সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও পিঠের মাঝখানে ব্যথা হওয়ার প্রবণতা ধীরে ধীরে বাড়ছে।
Fouquet et al. (2016) এর গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ১৫–২০% প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ জীবনের কোনো না কোনো সময়ে এই ধরনের ব্যথায় ভোগেন (European Spine Journal)
বাংলাদেশে শহরায়ন, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, অপুষ্টি এবং বয়সজনিত রোগ এই ব্যথার হারকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
তরুণদের মধ্যে দুর্ঘটনা ও খেলাধুলার আঘাত পাওয়া অন্যতম কারণ, আর বয়স্কদের মধ্যে হাড় ক্ষয় ও ডায়াবেটিস-সম্পর্কিত জটিলতা প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

পিঠের মাঝখানে ব্যথার রোগ নির্ণয়

পিঠের মাঝখানে ব্যথা আমাদের অনেকেরই পরিচিত এক সমস্যা। এটি সাধারণত মাংসপেশির টান লাগা , ভুল ভঙ্গি, আঘাত, বা এমনকি অন্যান্য অঙ্গের সমস্যার কারণেও হতে পারে। তাই শুধু ব্যথা কমানো নয়, এর আসল কারণ খুঁজে বের করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করতে হলে কিছু ধাপ অনুসরণ করতে হয়—কখন চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে, কীভাবে পরীক্ষা করা হয়, এবং কোন রোগ কোনটার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা দরকার তা জানাও জরুরি।

কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি?

সব ব্যথার জন্য চিকিৎসকের কাছে দৌড়াতে হয় না। তবে কিছু সতর্কতা সংকেত (red flags) আছে, যেগুলো দেখা গেলে দেরি না করে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে:

  • যদি ব্যথা কয়েক সপ্তাহেও না কমে এবং বিশেষ করে রাতে বা বিশ্রামের সময় বাড়ে, তাহলে তা হতে পারে টিউমার বা সংক্রমণের ইঙ্গিত (Finucane et al., 2020)।
  • পা বা হাত ঝিনঝিন করা, দুর্বলতা বা অবশভাব থাকলে বুঝতে হবে নার্ভে চাপ পড়ছে, যা হতে পারে ডিস্কের সমস্যা বা স্পাইনাল স্টেনোসিস।
  • জ্বরের সঙ্গে পিঠব্যথা থাকলে, তা হতে পারে মেরুদণ্ডে সংক্রমণ—যেমন অস্টিওমাইলাইটিস (Zimmerli, 2010)।
  • হঠাৎ ওজন কমে যাওয়া, বিশেষত যদি এর কোনও কারণ না থাকে, তাহলে তা হতে পারে ক্যান্সার বা সিস্টেমিক রোগের লক্ষণ (Finucane et al., 2020)।
  • মূত্র বা মল নিয়ন্ত্রণ এ সমস্যা হলে তা হতে পারে মারাত্মক একটি অবস্থা—কডা ইকুইনা সিনড্রোম, যা জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে টিবি ও ডায়াবেটিস খুবই সাধারণ ব্যাপার, এসব লক্ষণ উপেক্ষা না করাই ভালো।

রোগ নির্ণয়ের ধাপ ও পদ্ধতি

পিঠের ব্যথার সঠিক কারণ খুঁজে বের করতে চিকিৎসক নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করেন:

. শারীরিক পরীক্ষা: প্রথমেই চিকিৎসক আপনার ব্যথার ধরন, কবে থেকে হচ্ছে, কোন ভঙ্গিতে বাড়ে বা কমে—এইসব প্রশ্ন করবেন। এরপর ভঙ্গি, পেশি শক্তি, রিফ্লেক্স এবং চলাচলের ক্ষমতা পরীক্ষা করবেন।
এর মাধ্যমে চিকিৎসক ধারনা করতে পারেন যে ব্যথাটা কোথা থেকে আসছে।

. ইমেজিং টেস্ট

  • এক্সরে: হাড়ের সমস্যা যেমন ফ্র্যাকচার, অস্টিওআর্থ্রাইটিস বা কুঁজো হওয়া দেখতে সাহায্য করে। তবে এটি সফট টিস্যু (যেমন ডিস্ক বা স্নায়ু) দেখাতে যায় না।
  • এমআরআই: এটি নার্ভ, ডিস্ক, সংক্রমণ বা টিউমার পর্যন্ত সবকিছু স্পষ্টভাবে দেখতে সাহায্য করে। এটি অনেক বেশি কার্যকর (Wood et al., 2011)।
  • সিটি স্ক্যান: এক্স-রে’র চেয়েও বেশি স্পষ্ট ছবি ধারণ করা যায় এবং হাড়ে ফাটল বা টিউমার দেখা যায়।

. রক্ত পরীক্ষা: যদি চিকিৎসক সন্দেহ করেন যে ব্যথা সংক্রমণ বা প্রদাহজনিত, তাহলে ESR বা CRP পরীক্ষা করতে পারেন। এ ছাড়া পস্রাব পরীক্ষার মাধ্যমে কিডনির সমস্যা বোঝা যায়।

পিঠের মাঝখানে ব্যথা প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনা

পিঠের মাঝখানে ব্যথা, যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে “থোরাসিক ব্যথা” বলা হয়, এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে একটি সাধারণ সমস্যা হয়ে উঠেছে। কিন্তু এটি শুধু চিকিৎসার মাধ্যমে নয়, বরং সচেতন জীবনযাপন, সঠিক ভঙ্গি এবং নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে অনেকাংশেই প্রতিরোধযোগ্য। এই ব্যথা হলে আমরা কীভাবে প্রতিরোধ করতে পারি এবং কোন কোন চিকিৎসা পদ্ধতি আমাদের জন্য উপযোগী, তা নিয়েই নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

প্রতিরোধই প্রথম পদক্ষেপ

কাজের পরিবেশ ঠিক রাখা (আর্গোনমিক ব্যবস্থা): সঠিক চেয়ার, টেবিল, এবং বসার ধরন—এই ছোট ছোট বিষয়গুলো পিঠের ব্যথা প্রতিরোধে বড় ভূমিকা রাখে। অফিসে কাজ করার সময় এমন চেয়ার ব্যবহার করা উচিত যা পিঠে ভালোভাবে সাপোর্ট দেয়। কম্পিউটার স্ক্রিন যেন চোখের সমান্তরালে থাকে এবং দীর্ঘ সময় বসে না থেকে প্রতি ৩০-৪৫ মিনিট পরপর একটু হাঁটাহাঁটি করা উচিত।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, এরকম কাজের পরিবেশগত পরিবর্তন পিঠের ব্যথা প্রায় ৩০–৫০% পর্যন্ত কমাতে পারে (Robertson et al., 2013)।

নিয়মিত ব্যায়াম ও শরীর সচল রাখা: পিঠের পেশি এবং কোর মাংসপেশি শক্তিশালী করতে কিছু সহজ এক্সারসাইজ যেমন প্ল্যাঙ্ক, ব্রিজ, ক্যাট-কাউ স্ট্রেচ খুবই উপকারী। নিয়মিত ১৫–২০ মিনিট এক্সারসাইজ করলে কেবল ব্যথাই কমে না, বরং শরীরও সচল থাকে।
Lahad et al. (1994)-এর মতে, নিয়মিত এক্সারসাইজ পিঠের ব্যথা প্রতিরোধ ও পুনরায় ব্যথা ফিরে আসা কমাতে কার্যকর।

ভঙ্গি ঠিক রাখা: বসা, দাঁড়ানো বা ভারী কিছু তোলার সময় পিঠ সোজা রাখা অত্যন্ত জরুরি। অনেক ক্ষেত্রেই কৃষক বা নির্মাণ শ্রমিকরা ভুলভাবে ভারী জিনিস তোলার ফলে পিঠে আঘাত পান। হাঁটু ভেঙে এবং পিঠ সোজা রেখে ওজন তোলা উচিত। গবেষণা বলছে, এই ধরনের সচেতনতা ব্যথার ঝুঁকি অনেকটাই কমিয়ে দেয় (Punnett et al., 2005)।

ওজন নিয়ন্ত্রণ ও হাড়ের যত্ন: অতিরিক্ত ওজন পিঠের হাড় ও জয়েন্টে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে। এজন্য নিয়মিত হালকা এক্সারসাইজ, কম চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া, ও প্রচুর পানি পান করা উচিত।
একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, স্থূলতা পিঠের ব্যথার সম্ভাবনা ১.৫–২ গুণ বাড়ায় (Shiri et al., 2010)।
তাছাড়া, হাড় মজবুত রাখতে দুধ, ডিম, শাকসবজি, এবং সূর্যের আলো থেকেও ভিটামিন D পাওয়া যায়। বিশেষ করে মহিলাদের জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

পিঠের ব্যথার চিকিৎসার ধরন

কঞ্জার্ভেটিভ চিকিৎসা

প্রাথমিক অবস্থায় ব্যথা হলে চিকিৎসক সাধারণত এক্সারসাইজ, ভঙ্গি সংশোধন, এবং জীবনযাত্রায় পরিবর্তনের পরামর্শ দেন।

  • ফিজিওথেরাপি: পেশি শক্তিশালী করা, সঠিক ভঙ্গি গঠন, ও ব্যথা নিয়ন্ত্রণে এক্সারসাইজ ও থেরাপি গুরুত্বপূর্ণ।
  • ব্যথানাশক ওষুধ: আইবুপ্রোফেন বা ন্যাপ্রোক্সেনের মতো NSAIDs ব্যথা সাময়িকভাবে উপশম করলেও, দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে (Deyo et al., 2015)। তাই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া না খাওয়াই ভালো।
  • জীবনযাত্রার পরিবর্তন: ধূমপান বন্ধ, ওজন কমানো ও নিয়মইত এক্সারসাইজ করাই দীর্ঘমেয়াদি সমাধান (Lahad et al., 1994)।

ইন্টারভেনশনাল চিকিৎসা

  • ইনজেকশন: কর্টিকোস্টেরয়েড ইনজেকশন প্রদাহ কমাতে সহায়ক হলেও, এর সীমাবদ্ধতা আছে এবং অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে দেওয়া উচিত (Manchikanti et al., 2016)।
  • অস্ত্রোপচার: ডিস্ক হার্নিয়া, নার্ভে চাপ বা ফ্র্যাকচারের মতো জটিল ক্ষেত্রে অপারেশন করা লাগতে পারে। এটি সাধারণত তখনই করা হয় যখন অন্যান্য চিকিৎসায় কাজ হয় না (Weinstein et al., 2006)।

সিস্টেমিক সমস্যার জন্য চিকিৎসা

যদি ব্যথা হাড় ক্ষয় (অস্টিওপোরোসিস), মেরুদণ্ডে সংক্রমণ বা অটোইমিউন রোগ ইত্যাদি কারণে হয়, তাহলে সেই অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হয়। যেমন:

  • অস্টিওপোরোসিসে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন D ওষুধ দরকার।
  • জীবাণু সংক্রমণে অ্যান্টিবায়োটিক লাগে (Zimmerli, 2010)।
  • অটোইমিউন রোগে ইমিউনোমডুলেটরি ওষুধ দরকার হতে পারে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যেখানে টিবি ও অস্টিওপোরোসিস প্রচলিত, তাই এ ধরনের ব্যথাকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা উচিত।

উপসংহার

উপসংহারে বলা যায়, পিঠের মাঝখানে ব্যথা একটি বহুমাত্রিক সমস্যা যা কখনও শুধুমাত্র সাধারণ মাংসপেশীর টান থেকে শুরু করে আবার কখনও গুরুতর স্নায়বিক বা সিস্টেমিক রোগের লক্ষণও হতে পারে। এই ব্যথার প্রকৃত কারণ নির্ধারণে এর শারীরস্থান এবং সম্ভাব্য ঝুঁকিপূর্ণ অভ্যাস বা কারণগুলো বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, যথাযথভাবে এগুলো চিহ্নিত করতে পারলে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং প্রাথমিক পর্যায়ে কার্যকর হস্তক্ষেপ করা সহজ হয়।

এই প্রেক্ষাপটে, আমাদের উচিত নিজেদের উপসর্গ সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং ব্যথা যদি দীর্ঘস্থায়ী বা তীব্র হয় তবে তা অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ও দৈনন্দিন শারীরিক অবস্থান ও কার্যকলাপের প্রতি যত্নবান হওয়া ব্যথা প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে।

পরামর্শ নিতে 01877733322