থাইরয়েড কি, থাইরয়েড রোগ ও কারণ – লক্ষণ এবং নিরাময়ের উপায়। থাইরয়েড হলে কি বাচ্চা হয় না. থাইরয়েড একটি ছোট গ্রন্থি যা গলার সামনের অংশে অবস্থিত এবং এটি থলের মতো দেখতে হয়। এটি শরীরের বিভিন্ন প্রকারের গুরুত্ব পূর্ণ হরমোন উৎপাদন করে, যার মধ্যে প্রধানত থাইরয়েড হরমোন থাকে। থাইরয়েড হরমোনের মধ্যে প্রধান দুটি হল ট্রাইয়োডোথাইরোনিন (T3) এবং থাইরোক্সিন (T4)।
থাইরয়েড কি
এই হরমোন গুলো শরীরের মেটাবলিজম নিয়ন্ত্রণ করে, অর্থাৎ কীভাবে শরীর শক্তি ব্যবহার করে, শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এবং হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি বা অতিরিক্ত উৎপাদন শরীরের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, যেমন হাইপোথাইরয়েডিজম (থাইরয়েড হরমোনের অভাব) এবং হাইপারথাইরয়েডিজম (থাইরয়েড হরমোনের অতিরিক্ত নিঃসরণ)।
থাইরয়েড এর লক্ষণ
থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যার লক্ষণ গুলি প্রধানত হাইপোথাইরয়েডিজম (থাইরয়েড হরমোনের অভাব) এবং হাইপারথাইরয়েডিজম (থাইরয়েড হরমোনের অতিরিক্ত উৎপাদন) এ বিভক্ত। এই দুটি অবস্থার লক্ষণ গুলি নিচে দেওয়া হলো
হাইপো থাইরয়েডিজমের লক্ষণ সমূহ
শরীরের ওজন বৃদ্ধি হাইপোথাইরয়েডিজম তখনই হয় যখন থাইরয়েড গ্রন্থি পর্যাপ্ত পরিমাণে হরমোন উৎপাদন করতে ব্যর্থ হয়, যা শরীরের মেটাবলিজম কে ধীর করে ফেলে। মেটাবলিজম ধীর হয়ে গেলে শরীরের ক্যালোরি খরচ কম হয়, ফলে খাদ্য গ্রহণের মাত্রা অপরিবর্তিত থাকলেও ওজন বাড়তে থাকে। তাছাড়া, হাইপোথাইরয়েডিজমের ফলে শরীরে পানি ও লবণের সঞ্চয় বেড়ে যায়, যার ফলে শরীরের ওজন বৃদ্ধি পায়।
অবসাদগ্রস্ততা থাইরয়েড গ্রন্থি পর্যাপ্ত পরিমাণে হরমোন উৎপাদন করতে ব্যর্থ হলে শরীরের মেটাবলিজম ধীর হয়ে যায়, যা শরীরের প্রতিটি কোষের কার্যকারিতা কে প্রভাবিত করে। এ কারণে শরীরের শক্তি কমে যায় এবং সব সময় ক্লান্তি অনুভূত হয়। হরমোনের এই অভাব শরীরের পাশাপাশি মস্তিষ্ককেও প্রভাবিত করে, ফলে মনোযোগের অভাব, হতাশা এবং মানসিক অবসাদ গ্রস্ততার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। প্রতিদিনের কাজকর্মে আগ্রহ হারানো এবং দৈনন্দিন জীবনে উদ্যমের অভাবও অবসাদ গ্রস্ততার লক্ষণ হিসেবে প্রকাশ পেতে পারে।
থাইরয়েড হলে কি কি সমস্যা হয়
শুষ্ক ত্বক এবং চুল পড়া থাইরয়েড হরমোনের অভাব শরীরের মেটাবলিজম কে ধীর করে দেয়, যা ত্বক এবং চুলের স্বাভাবিক কোষ পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া কে প্রভাবিত করে। ফলে ত্বক শুষ্ক, খসখসে, এবং পাতলা হয়ে যায়, যা অনেক সময় খোসা ওঠার মতো সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। একই ভাবে, চুলের বৃদ্ধির হারও কমে যায়, এবং চুল পাতলা হয়ে পড়তে শুরু করে। চুলের রঙ মলিন হতে পারে এবং শুষ্কতা বাড়ার কারণে চুল ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
ঠান্ডা সহ্য করতে না পারা থাইরয়েড হরমোন শরীরের মেটাবলিজম এবং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের একটি গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যখন থাইরয়েড হরমোনের অভাব হয়, তখন মেটাবলিজম ধীর হয়ে যায় এবং শরীর পর্যাপ্ত পরিমাণে তাপ উৎপাদন করতে অক্ষম হয়। এর ফলে, শরীর ঠান্ডা আবহাওয়ার সাথে খাপ খাওয়া তে পারে না এবং অস্বাভাবিক ভাবে ঠান্ডা অনুভব করতে শুরু করে। এমন কি গরম পরিবেশেও ঠান্ডা লাগা, হাত-পায়ে শীতলতা, এবং শীতল আবহাওয়ায় শরীর কাঁপতে থাকা এ ধরনের লক্ষণ দেখা দিতে পারে। ঠান্ডা সহ্য করতে না পারা রোগীদের দৈনন্দিন জীবন কে বাধাগ্রস্ত করে এবং শারীরিক অস্বস্তি বাড়িয়ে তোলে।
স্মৃতিভ্রংশ হাইপোথাইরয়েডিজমের লক্ষণ গুলির মধ্যে একটি হলো মেমরি সমস্যা বা স্মৃতিভ্রংশ। থাইরয়েড হরমোনের অভাব মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়, যার ফলে মস্তিষ্কের কার্য ক্ষমতা হ্রাস পায়। এর ফলে রোগীরা প্রায়শই ভুলে যাওয়া, মনোযোগের অভাব, এবং তথ্য সংরক্ষণ বা পুনরুদ্ধারে সমস্যা অনুভব করতে পারেন। এমন কি দৈনন্দিন কাজের কথা মনে রাখতে না পারা বা কথা বলার সময় সঠিক শব্দ খুঁজে না পাওয়ার মতো সমস্যা ও দেখা দিতে পারে। মেমরি সমস্যা রোগীর আত্মবিশ্বাস ও কর্ম ক্ষমতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং মানসিক চাপ বাড়িয়ে তুলে।
কোষ্ঠকাঠিন্য থাইরয়েড হরমোনের অভাবে শরীরের মেটাবলিজমের গতি ধীর হয়ে যায়, যা পেটের পেশী গুলোর কাজ কে প্রভাবিত করে। এর ফলে হজম প্রক্রিয়া ধীর হয়ে যায় এবং খাদ্য অন্ত্রের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়। অন্ত্রের এই ধীরগতি পায়খানা কঠিন এবং শুষ্ক করে তোলে, যা কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
মাসিক চক্রের সমস্যা হাইপোথাইরয়েডিজমের লক্ষণ গুলোর মধ্যে একটি গুরুত্ব পূর্ণ লক্ষণ হলো মাসিক চক্রের সমস্যা। থাইরয়েড হরমোনের অভাব শরীরের হরমোনের সামগ্রিক ভারসাম্য কে প্রভাবিত করে, যা সরাসরি মহিলাদের প্রজনন ক্ষমতার ওপর প্রভাব ফেলে। এই কারণে মাসিক চক্র অনিয়মিত হয়ে যেতে পারে এবং মাসিকের সময় সীমা বেড়ে যেতে পারে অথবা রক্তপাতের পরিমাণ বেশি হতে পারে, যাকে মেনোরেজিয়া বলা হয়। আবার কখনো কখনো মাসিকের ফ্রিকোয়েন্সি কমে যেতে পারে বা মাসিক অনিয়মিত ভাবে আসতে পারে, যা ওলিগোমেনোরিয়া নামে পরিচিত।
হার্টরেট কমে যাওয়া থাইরয়েড হরমোন শরীরের মেটাবলিজমের গতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি হৃদযন্ত্রের কার্যক্রমেও গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা পালন করে। থাইরয়েড হরমোনের অভাব হলে হৃদযন্ত্রের পেশী গুলোর সংকোচন ও প্রসারণের গতি ধীর হয়ে যায়, ফলে হৃদস্পন্দনের হার স্বাভাবিকের তুলনায় কমে যেতে পারে। এই অবস্থায় রোগীরা দুর্বলতা, মাথা ঘোরা, শ্বাসকষ্ট এবং ক্লান্তির অনুভূতি নিয়ে ভুগতে পারেন। হৃদযন্ত্রের হার কমে গেলে রক্ত প্রবাহের মাত্রাও হ্রাস পায়, যা মস্তিষ্ক এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কার্যকারিতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
মুখ, পা, এবং হাত ফোলাভাব থাইরয়েড হরমোনের অভাব হলে শরীরের মেটাবলিজম ধীর হয়ে যায়, যা শরীরের বিভিন্ন কোষ ও টিস্যু তে পানি জেমে থাকার প্রবণতা বাড়ায়। ফলে, মুখ মণ্ডল বিশেষ করে চোখের চারপাশে, পায়ের গোড়ালি এবং হাতের আঙুলে ফোলা ভাব দেখা দিতে পারে। এই ফোলা অংশ গুলো প্রায়ই নরম হয় এবং স্পর্শ করলে গর্তের মতো দাগ পড়তে পারে, যা “পিটিং এডিমা” নামে পরিচিত।
হাইপার থাইরয়েডিজমের লক্ষণ সমূহ
ওজন কমে যাওয়া হাইপারথাইরয়েডিজমের একটি সাধারণ এবং গুরুত্ব পূর্ণ লক্ষণ হলো অপ্রত্যাশিত ভাবে ওজন কমে যাওয়া। এই অবস্থায় থাইরয়েড গ্রন্থি অতিরিক্ত পরিমাণে হরমোন উৎপাদন করে, যা শরীরের মেটাবলিজম কে স্বাভাবিকের তুলনায় দ্রুততর করে তোলে। ফলে শরীর বেশি ক্যালোরি ব্যবহার করে এবং খাদ্যের মাধ্যমে প্রাপ্ত শক্তির তুলনায় শক্তি ব্যয় বেশি হয়। এমন কি যখন খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ অপরিবর্তিত বা বেশি থাকে, তখনও ওজন দ্রুত কমে যেতে থাকে। হাইপারথাইরয়েডিজমের কারণে শরীরে ফ্যাট এবং পেশির টিস্যু দ্রুত ভেঙে যায়, যা শরীরের সামগ্রিক ওজন কমিয়ে দেয়।
বর্ধিত হৃদস্পন্দন হাইপারথাইরয়েডিজমের একটি প্রধান লক্ষণ হলো হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া বা ট্যাকি কার্ডিয়া। এই অবস্থায় থাইরয়েড গ্রন্থি অতিরিক্ত হরমোন উৎপাদন করে, যা শরীরের বিভিন্ন সিস্টেম, বিশেষ করে হৃদযন্ত্রের কার্যক্রম কে অতি মাত্রায় সক্রিয় করে তোলে। ফলে হৃদযন্ত্র দ্রুত ও জোরে স্পন্দিত হয়, এমনকি বিশ্রামের সময়ও হৃদস্পন্দনের গতি স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি থাকে। এই বর্ধিত হৃদস্পন্দন রোগীর জন্য অস্বস্তিকর হতে পারে এবং বুক ধড়ফড়, শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরা, এবং কখনো কখনো বুকে ব্যথার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
ঘাম বেশি হওয়া এবং গরম সহ্য করতে না পারা থাইরয়েড গ্রন্থি অতিরিক্ত হরমোন উৎপাদন করে, যা শরীরের মেটাবলিজমের গতি বৃদ্ধি করে দেয়। মেটাবলিজমের গতি বেড়ে যাওয়ার ফলে শরীরের প্রাকৃতিক ভাবে তাপ মাত্রা নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হয়, এবং শরীর অতিরিক্ত তাপ উৎপাদন করতে শুরু করে। এর প্রতিক্রিয়ায়, শরীর অতিরিক্ত ঘাম তৈরি করে তাপ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। রোগীরা প্রায়ই অল্প পরিশ্রমেই ঘেমে যান এবং স্বাভাবিক তাপমাত্রায়ও অস্বাভাবিক গরম অনুভব করেন। তারা গরম আবহাওয়ায় অস্বস্তি বোধ করেন এবং অতিরিক্ত গরমে শারীরিক ও মানসিক চাপ অনুভব করতে পারেন।
অস্থিরতা ও হাত কাঁপা থাইরয়েড গ্রন্থি অতিরিক্ত পরিমাণে হরমোন উৎপাদন করে, যা স্নায়ুতন্ত্র কে অতি মাত্রায় উত্তেজিত করে তোলে। ফল স্বরূপ, রোগীরা প্রায়ই শারীরিক এবং মানসিক অস্থিরতা অনুভব করেন, যা তাদের মনের মধ্যে উদ্বেগ, তাড়া হুড়ো, এবং অতিরিক্ত চিন্তার সৃষ্টি করে। এই স্নায়বিক উত্তেজনা হাতের মাংসপেশী গুলি কে প্রভাবিত করে, যার ফলে হাত কাঁপা বা “ট্রেমর” দেখা দেয়। বিশেষ করে, রোগীরা যখন হাতের ছোট ছোট কাজ, যেমন কাগজে লেখা বা চামচ ধরে খাওয়ার চেষ্টা করেন, তখন হাত কাঁপা সমস্যা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
মাসিক চক্রের পরিবর্তন থাইরয়েড হরমোন উৎপাদনের ফলে শরীরের হরমোনের সামগ্রিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়, যা মহিলাদের প্রজনন ক্ষমতার উপর প্রভাব ফেলে। এই অবস্থায় মাসিক চক্রের ফ্রিকোয়েন্সি কমে যেতে পারে এবং রক্তপাতের পরিমাণ হ্রাস পেতে পারে, যাকে “হাইপোমেনোরিয়া” বলা হয়। কখনো কখনো মাসিক চক্র অনিয়মিত হয়ে পড়ে এবং মাসিকের সময় সীমা কম হতে পারে। এমন কি কিছু ক্ষেত্রে, মাসিক চক্র সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে, যা অ্যামেনোরিয়া নামে পরিচিত। মাসিকের এই ধরনের পরিবর্তন প্রজনন ক্ষমতা কে প্রভাবিত করতে পারে এবং গর্ভধারণের ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি করতে পারে।
আচরণগত পরিবর্তন হাইপারথাইরয়েডিজম এ আক্রান্ত রোগীরা প্রায়ই উদ্বেগ, উত্তেজনা, এবং মেজাজ দেখানোর মতো উপসর্গে ভুগতে পারেন। আচরণের এই পরিবর্তনগুলি তাদের দৈনন্দিন জীবনে স্পষ্ট ভাবে প্রতি ফলিত হয়; যেমন, তারা স্বাভাবিকের তুলনায় অতিরিক্ত রেগে যেতে পারেন, মনো যোগের অভাব দেখা দিতে পারে, এবং সহজেই হতাশ বা বিষণ্ণ হতে পারেন। ঘুমের সমস্যা, যেমন ইনসোমনিয়া বা ঘুম কম হওয়া, এই অবস্থার সাথে সম্পর্কিত একটি সাধারণ সমস্যা, যা মানসিক চাপ এবং মানসিক অস্থিরতা বাড়িয়ে তোলে।
চোখের সমস্যা থাইরয়েড গ্রন্থি অতিরিক্ত হরমোন উৎপাদন করার পাশাপাশি চোখের চার পাশের টিস্যু কে প্রভাবিত করে, যার ফলে চোখ ফুলে যাওয়া, চোখের পলক উঁচু হওয়া, এবং চোখের পেছনের অংশে চাপ বৃদ্ধি পাওয়ার মতো লক্ষণ দেখা দেয়। রোগীরা প্রায়ই চোখে অস্বস্তি, জ্বালা পোড়া, বা চোখ শুষ্কতার মতো উপসর্গ অনুভব করেন। এছাড়া, আলোতে সংবেদনশীলতা বাড়তে পারে এবং চোখের পলক কম পড়ার কারণে চোখের সাদা অংশ বেশি দৃশ্যমান হতে পারে, যা ‘এক্সোফথ্যালমোস’ নামে পরিচিত।
পেশী দুর্বলতা হাইপারথাইরয়েডিজম দেখা দিলে শরীরের মেটাবলিজমের গতি মাত্রাতিরিক্ত ভাবে বেড়ে যায়, ফলে পেশী গুলোর প্রোটিন দ্রুত ভেঙে যায় এবং শক্তি কমতে থাকে। এর ফলে, রোগীরা প্রায়ই শরীরের উপরের অংশের পেশী গুলোর দুর্বলতা অনুভব করেন, যেমন বাহু, উরু, এবং কাঁধের পেশী। তারা দৈনন্দিন কাজকর্ম, যেমন সিঁড়ি বেয়ে ওঠা, ভারী বস্তু তোলা, বা এমন কি হাতের কাজ করতে গিয়ে অসুবিধা অনুভব করতে পারেন। পেশীর এই দুর্বলতা তাদের স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় বিঘ্ন ঘটায় এবং শারীরিক অক্ষমতার অনুভূতি বাড়ায়।
ডায়রিয়া বা মলত্যাগের পরিবর্তন অতিরিক্ত থাইরয়েড হরমোন উৎপাদনের ফলে শরীরের মেটাবলিজম বেড়ে যায়, যা হজম প্রক্রিয়ার গতি ত্বরান্বিত করে। এর ফলে অন্ত্রের পেশী গুলোর সংকোচন বাড়ে এবং খাদ্য দ্রুত অন্ত্রের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে, যার কারণে রোগীরা প্রায়ই মল ত্যাগের প্রয়োজন অনুভব করেন। এই পরিস্থিতি তে মল নরম বা পাতলা হয়ে যেতে পারে এবং ফ্রিকোয়েন্সি বেড়ে যায়, যা ডায়রিয়ার মতো উপসর্গের সৃষ্টি করে। ডায়রিয়া রোগীর শরীরে পানিশূন্যতা, পুষ্টির অভাব, এবং ইলেক্ট্রোলাইটের ভার সাম্যহীনতা ঘটাতে পারে, যা শারীরিক দুর্বলতা এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে।
থাইরয়েড হলে কি বাচ্চা হয় না
থাইরয়েডের সমস্যা থাকলে সন্তান ধারণের ক্ষমতা প্রভাবিত হতে পারে, তবে সন্তান ধারণ ক্ষমতা পুরোপুরি ভাবে নষ্ট হয় না। বিশেষ করে, হাইপোথাইরয়েডিজম (থাইরয়েড হরমোনের অভাব) থাকলে মহিলাদের প্রজনন ক্ষমতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এই অবস্থায় থাইরয়েড হরমোনের অভাবে হরমোনের সামগ্রিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়, যা মাসিক চক্র অনিয়মিত হওয়া, ইনফার্টিলিটি, এবং অপরিপক্ব ডিম্বাণু তৈরী হওয়ার মত সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তবে সঠিক চিকিৎসা এবং থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অনেক মহিলাই সুস্থভাবে সন্তান ধারণ করতে সক্ষম হন। আপনার হরমোনের সমস্যা বোঝার উপায়
অন্যদিকে, হাইপারথাইরয়েডিজম (থাইরয়েড হরমোনের অতিরিক্ত উৎপাদন) হলে গর্ভধারণের ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দিতে পারে, যেমন গর্ভপাত, প্রি-এক্লাম্পসিয়া, এবং অপরিণত শিশু জন্মের ঝুঁকি। তবে, চিকিৎসকের পরামর্শমতো থাইরয়েডের চিকিৎসা গ্রহণ এবং হরমোনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার মাধ্যমে এই ঝুঁকিগুলি কমানো যায় এবং সফলভাবে গর্ভধারণ করা সম্ভব (১)।
থাইরয়েড কি খেলে ভালো হয়
থাইরয়েডের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং থাইরয়েড গ্রন্থির সঠিক কার্যকারিতা বজায় রাখতে কিছু নির্দিষ্ট খাবার উপকারী হতে পারে। এই খাবারগুলো হাইপোথাইরয়েডিজম এবং হাইপারথাইরয়েডিজম উভয় অবস্থার জন্যই সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে, নির্দিষ্ট কিছু খাবারের পরামর্শ থাইরয়েডের সমস্যার ধরন এবং ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যের ওপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে। সাধারণত, থাইরয়েডের জন্য উপকারী কিছু খাবার হলো:
আয়োডিন সমৃদ্ধ খাবার আয়োডিন থাইরয়েড হরমোন তৈরির জন্য অপরিহার্য। আয়োডিনের অভাব হাইপোথাইরয়েডিজমের কারণ হতে পারে। তাই, সামুদ্রিক মাছ, সামুদ্রিক শৈবাল, আয়োডিনযুক্ত লবণ, এবং দুগ্ধজাত পণ্য আয়োডিনের চমৎকার উৎস হিসেবে কাজ করতে পারে।
সেলেনিয়াম সমৃদ্ধ খাবার সেলেনিয়াম থাইরয়েড হরমোনের কার্যকারিতা বজায় রাখতে সহায়তা করে এবং থাইরয়েড গ্রন্থির কোষগুলিকে সুরক্ষিত রাখে। বাদাম, মাছ, ডিম, এবং মুরগির মাংস সেলেনিয়ামের সমৃদ্ধ উৎস।
জিঙ্ক সমৃদ্ধ খাবার জিঙ্ক থাইরয়েড হরমোনের উৎপাদন এবং রূপান্তরে সহায়তা করে। লাল মাংস, মুরগির মাংস, শস্য, বাদাম, এবং বীজ জিঙ্কের ভালো উৎস।
ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার ভিটামিন ডি থাইরয়েড হরমোনের কার্যকারিতা বাড়ায় এবং অটোইমিউন থাইরয়েড সমস্যার ঝুঁকি কমায়। সামুদ্রিক মাছ, ডিমের কুসুম, এবং সূর্যের আলো ভিটামিন ডির ভালো উৎস।
আঁশ সমৃদ্ধ খাবার আঁশ সমৃদ্ধ খাবার, যেমন সবুজ শাকসবজি, ফলমূল, শস্য, এবং শস্যজাত দ্রব্য হজম প্রক্রিয়াকে উন্নত করে এবং হাইপোথাইরয়েডিজমের ক্ষেত্রে কোষ্ঠ কাঠিন্য সমস্যা কমাতে সাহায্য করে।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার অ্যন্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার, যেমন বেরি, পালং শাক, টমেটো, এবং ব্রকলি শরীরের কোষের ক্ষতি কমায় এবং থাইরয়েড গ্রন্থিকে সুরক্ষিত রাখে।
স্বাস্থ্যকর ফ্যাট অলিভ অয়েল, বাদামের তেল, এবং অ্যাভোকাডো তে পাওয়া স্বাস্থ্যকর ফ্যাট থাইরয়েড গ্রন্থির সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে সহায়ক।
থাইরয়েড কমানোর উপায়
থাইরয়েড গ্রন্থির অতিসক্রিয়তা, বিশেষত হাইপারথাইরয়েডিজম, নিয়ন্ত্রণের জন্য কয়েক টি কার্যকরী উপায় রয়েছে। থাইরয়েড হরমোনের অতিরিক্ত উৎপাদন নিয়ন্ত্রণে রাখতে ও থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যক্রম কে সঠিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে এই পদ্ধতিগুলি সহায়ক হতে পারে:
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণ হাইপারথাইরয়েডিজম নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য এন্টি-থাইরয়েড ড্রাগ (যেমন মেথিমাজোল বা প্রোপাইলথাইউরাসিল) ব্যবহার করা হয়। এই ওষুধগুলো থাইরয়েড গ্রন্থির হরমোন উৎপাদন কমায় এবং থাইরয়েডের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। ওষুধের ডোজ এবং প্রকার নির্ধারণের জন্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
রেডিওএকটিভ আয়োডিন থেরাপি রেডিওএকটিভ আয়োডিন থেরাপি একটি সাধারণ চিকিৎসা পদ্ধতি, যা থাইরয়েড গ্রন্থির কোষ গুলো কে ধ্বংস করে অতিরিক্ত হরমোন উৎপাদন কমায়। এটি সাধারণত মুখে গ্রহণ করা হয় এবং সময়ের সাথে সাথে থাইরয়েডের কার্যকারিতা হ্রাস পায়। এটি কার্যকর হলেও, পরবর্তীতে হাইপোথাইরয়েডিজমের সম্ভাবনা থাকতে পারে, যার জন্য নিয়মিত মনিটরিং এবং ওষুধ প্রয়োজন (২)।
থাইরয়েড গ্রন্থির সার্জারি যদি ওষুধ বা রেডিওএকটিভ আয়োডিন থেরাপি কার্যকর না হয়, তবে সার্জারির মাধ্যমে থাইরয়েড গ্রন্থির একটি অংশ বা পুরো গ্রন্থি অপসারণ করা যেতে পারে। এই পদ্ধতি সাধারণত বড় আকারের গলগণ্ড বা ক্যান্সারের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। সার্জারির পর প্রায়ই রোগীদের হাইপোথাইরয়েডিজমের চিকিৎসার জন্য থাইরয়েড হরমোন প্রতিস্থাপন করতে হয়।
ডায়েট নিয়ন্ত্রণ খাবারে আয়োডিনের পরিমাণ কমিয়ে থাইরয়েডের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আয়োডিন সমৃদ্ধ খাবার, যেমন সামুদ্রিক খাবার, আয়োডিনযুক্ত লবণ, এবং কিছু দুগ্ধজাত পণ্য এড়িয়ে চলা উচিত। ক্যাফেইন, চিনি, এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার কম খাওয়া উপকারী হতে পারে।
স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ স্ট্রেস থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যক্রমকে প্রভাবিত করতে পারে। নিয়মিত ব্যায়াম, ধ্যান, যোগব্যায়াম, এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়ামের মাধ্যমে মানসিক চাপ কমানো যায়। স্ট্রেস কমানোর জন্য পর্যাপ্ত ঘুমও গুরুত্বপূর্ণ।
নিয়মিত মনিটরিং থাইরয়েডের কার্যক্রম নিয়মিত পরীক্ষা করে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা পরিকল্পনা পরিবর্তন করা জরুরি। নিয়মিত ব্লাড টেস্টের মাধ্যমে থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
তথ্যসূত্র
- Negro, R. and Mestman, J.H., 2011. Thyroid disease in pregnancy.Best practice & research Clinical endocrinology & metabolism, 25(6), pp.927-943. https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S1521690X11000868
- Kravets, I., 2016. Hyperthyroidism: diagnosis and treatment.American family physician, 93(5), pp.363-370. https://www.aafp.org/pubs/afp/issues/2016/0301/p363.html
- ডেঙ্গু জ্বরের ৭টি সতর্কীকরণ লক্ষণ ২০২৪ | ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার - November 28, 2024
- হাঁটু ব্যথার জন্য কার্যকারী ব্যায়াম গুলো জেনে নিন - November 28, 2024
- লাম্বার স্পন্ডাইলোসিস কমানোর উপায়? ও স্পন্ডাইলোসিস কি? - November 5, 2024