স্ট্রোক হলো মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ ব্যাহত হওয়ার ফলে সৃষ্ট একটি গুরুতর স্বাস্থ্যগত সমস্যা, যা মস্তিষ্কের কোষের ক্ষতি করে এবং শারীরিক ও মানসিক অক্ষমতার কারণ হতে পারে। বাংলাদেশে স্ট্রোক মৃত্যু এবং দীর্ঘমেয়াদী অক্ষমতার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর প্রায় ১৫ মিলিয়ন মানুষ স্ট্রোকের শিকার হয়, যার মধ্যে ৫ মিলিয়ন মারা যায় এবং আরও ৫ মিলিয়ন স্থায়ীভাবে অক্ষম হয়ে পড়ে (World Health Organization, 2023)।
স্ট্রোকের প্রাথমিক চিকিৎসা
স্ট্রোকের প্রাথমিক চিকিৎসার প্রধান লক্ষ্য হলো মস্তিষ্কের ক্ষতি কমিয়ে আনা এবং রোগীর জীবন রক্ষা করা। চিকিৎসার পদ্ধতি স্ট্রোকের ধরনের উপর নির্ভর করে, যেমন ইস্কেমিক স্ট্রোক বা হেমোরেজিক স্ট্রোক। ইস্কেমিক স্ট্রোক, যা মোট স্ট্রোকের প্রায় ৮৭% ক্ষেত্রে ঘটে, রক্তের থকথকে (ক্লট) দ্বারা মস্তিষ্কের রক্তনালী বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে এই ধরনের স্ট্রোক হয়।
ইস্কেমিক স্ট্রোকের চিকিৎসা

ইস্কেমিক স্ট্রোক ঘটে যখন মস্তিষ্কের কোনো রক্তনালীতে রক্ত জমাট বেঁধে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়, ফলে মস্তিষ্কের কোষগুলো অক্সিজেন এবং পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হয় (American Stroke Association, 2023)। নিম্নে এই ধরনের স্ট্রোকের প্রধান চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো বর্ণনা করা হলো:
থ্রোমবোলাইসিস (Thrombolysis):
থ্রোমবোলাইসিস হলো এমন একটি চিকিৎসা পদ্ধতি যেখানে ক্লট-বাস্টিং ওষুধ ব্যবহার করে রক্তের জমাট বাধা কমিয়ে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করা হয়। সাধারণত আলটিপ্লাজ (alteplase), যা একটি টিস্যু প্লাসমিনোজেন অ্যাক্টিভেটর (tPA), এই কাজে ব্যবহৃত হয়। এই ওষুধটি স্ট্রোকের লক্ষণ শুরু হওয়ার ৪.৫ ঘণ্টার মধ্যে (তথাকথিত ‘গোল্ডেন আওয়ার’) শিরায় প্রয়োগ করা উচিত, কারণ এর পরে মস্তিষ্কের ক্ষতি কমতে পারে। তবে, এটি দেওয়ার আগে সিটি স্ক্যানের মাধ্যমে অবশ্যই দেখা নেয়া উচিৎ যে এটি হেমোরেজিক স্ট্রোক কিনা। হেমোরেজিক স্ট্রোক হলে এই ওষুধ দেয়া যাবে না। কারণ হেমোরেজিক স্ট্রোকে tPA প্রয়োগ মারাত্মক রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়ায় (National Institute of Neurological Disorders and Stroke, 2023)। বাংলাদেশে, ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটাল (NINS) এবং অন্যান্য বড় হাসপাতালে এই চিকিৎসা সুবিধা পাওয়া যায়।
থ্রোমবেক্টমি (Thrombectomy):
থ্রোমবেক্টমি হলো একটি যান্ত্রিক পদ্ধতি, যেখানে একটি ক্যাথেটার ব্যবহার করে মস্তিষ্কের বড় রক্তনালী থেকে জমাট বাঁধা রক্ত অপসারণ করা হয়। এই পদ্ধতি সাধারণত স্ট্রোকের লক্ষণ শুরু হওয়ার ৬ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রয়োগ করা যায়, তবে উন্নত ধরনের ইমেজিং প্রযুক্তি (যেমন পারফিউশন সিটি বা এমআরআই) দ্বারা নির্ধারিত হয় যে মস্তিষ্কের কোন অংশ এখনও বাঁচানো সম্ভব। এটি বিশেষত বড় ধমনী ব্লকেজের ক্ষেত্রে কার্যকর এবং উল্লেখযোগ্যভাবে অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারে (Powers et al., 2019)।
ওষুধ:
ইস্কেমিক স্ট্রোকের চিকিৎসায় এবং ভবিষ্যৎ স্ট্রোক প্রতিরোধে বিভিন্ন ওষুধ ব্যবহৃত হয়:
- অ্যান্টিপ্লাটিলেট ওষুধ: রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধ করতে অ্যাসপিরিন বা ক্লোপিডোগ্রেল স্ট্রোকের পরপরই দেওয়া হয়। এটি সাধারণত প্রথম ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই শুরু করা হয় (Sandercock et al., 2014)।
- অ্যান্টিকোঅ্যাগুল্যান্ট: অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশন বা অন্যান্য হৃদরোগের কারণে স্ট্রোক হলে ওয়ারফারিন, ডাবিগাট্রান বা অ্যাপিক্সাবানের মতো ওষুধ ব্যবহৃত হয় (Hart et al., 2018)।
- অ্যান্টিহাইপারটেনসিভ ওষুধ: উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এই ওষুধগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ উচ্চ রক্তচাপ স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। উদাহরণস্বরূপ, এম্লোডিপিন বা লিসিনোপ্রিল ব্যবহৃত হয় (Lawes et al., 2004)।
- স্ট্যাটিন: অ্যাট্রভাস্ট্যাটিন বা রোজুভাস্ট্যাটিনের মতো স্ট্যাটিন কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায় এবং রক্তনালীর দেয়ালে প্ল্যাক জমায়, যা ভবিষ্যৎ স্ট্রোক প্রতিরোধে সহায়ক।
হেমোরেজিক স্ট্রোকের চিকিৎসা

হেমোরেজিক স্ট্রোক মস্তিষ্কে রক্তনালী ফেটে রক্তক্ষরণের ফলে ঘটে, যা মস্তিষ্কের টিস্যুতে চাপ সৃষ্টি করে এবং কোষের গুরুতর ক্ষতি করে। হেমোরেজিক স্ট্রোক প্রধানত দুই ধরনের: ইন্ট্রাসেরিব্রাল হেমোরেজ (মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে রক্তক্ষরণ) এবং সাবঅ্যারাকনয়েড হেমোরেজ (মস্তিষ্কের পৃষ্ঠে রক্তক্ষরণ)। এর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে উচ্চ রক্তচাপ, অ্যানিউরিজম (রক্তনালীর দুর্বল দেয়াল ফেটে যাওয়া), অ্যার্টেরিভেনাস ম্যালফরমেশন (AVM, রক্তনালীর অস্বাভাবিক গঠন), এবং কখনো কখনো অ্যান্টিকোঅ্যাগুল্যান্ট ওষুধের ব্যবহার।
সার্জারি
সার্জারি হেমোরেজিক স্ট্রোকের চিকিৎসায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, বিশেষত যখন রক্তক্ষরণ মস্তিষ্কে উল্লেখযোগ্য চাপ সৃষ্টি করে বা জীবনের জন্য হুমকি হয়ে ওঠে। সার্জারির প্রধান উদ্দেশ্যগুলো হলো:
- রক্ত অপসারণ এবং মস্তিষ্কের চাপ কমানো: ইন্ট্রাসেরিব্রাল হেমোরেজের ক্ষেত্রে, যদি রক্ত জমাট বেঁধে হেমাটোমা তৈরি করে এবং তা মস্তিষ্কের উপর চাপ সৃষ্টি করে, তবে ক্র্যানিওটমি (মাথার খুলি খুলে অস্ত্রোপচার) বা স্টেরিওট্যাকটিক অ্যাসপিরেশন (কম আক্রমণাত্মক পদ্ধতিতে রক্ত সরানো) করা হয়। এটি মস্তিষ্কের ফোলা (সেরিব্রাল এডিমা) কমায় এবং মস্তিষ্ককে আরও ক্ষতি হওয়া প্রতিরোধ করে (Hemphill et al., 2015)।
- অ্যানিউরিজম সংশোধন: সাবঅ্যারাকনয়েড হেমোরেজ প্রায়শই অ্যানিউরিজম ফেটে যাওয়ার কারণে ঘটে। এই ক্ষেত্রে, ক্লিপিং (অ্যানিউরিজমের গোড়ায় ক্লিপ লাগানো) বা এন্ডোভাসকুলার কয়েলিং (ক্যাথেটারের মাধ্যমে কয়েল স্থাপন করে অ্যানিউরিজম বন্ধ করা) করা হয়।
- অ্যার্টেরিভেনাস ম্যালফরমেশন (AVM) সংশোধন: AVM হলো রক্তনালীর অস্বাভাবিক জট, যা রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়ায়। এটি সংশোধনের জন্য মাইক্রোসার্জারি, এন্ডোভাসকুলার এম্বোলাইজেশন (রক্তনালী বন্ধ করার জন্য আঠালো পদার্থ ব্যবহার), বা স্টেরিওট্যাকটিক রেডিওসার্জারি (যেমন গামা নাইফ) ব্যবহৃত হয়।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ
উচ্চ রক্তচাপ (হাইপারটেনশন) হেমোরেজিক স্ট্রোকের প্রধান কারণ এবং রক্তক্ষরণের পরিমাণ বাড়িয়ে তুলতে পারে। তাই, রক্তচাপ দ্রুত এবং সাবধানে নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য সাধারণত শিরায় ওষুধ প্রয়োগ করা হয়, যেমন:
- ল্যাবেটালল বা নিকার্ডিপিন: এগুলো দ্রুত রক্তচাপ কমায় এবং হাসপাতালে নিবিড় পর্যবেক্ষণে দেওয়া হয়। লক্ষ্য হলো সিস্টোলিক রক্তচাপ ১৪০-১৬০ মি.মি. এইচজি-র মধ্যে রাখা, কারণ কম রক্তচাপ মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ ব্যাহত করতে পারে (Anderson et al., 2013)।
- মুখে খাওয়ার ওষুধ: রোগীর অবস্থা স্থিতিশীল হলে এম্লোডিপিন বা লিসিনোপ্রিলের মতো ওষুধ দীর্ঘমেয়াদী নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত হয় (Lawes et al., 2004)।
ডায়াগনোসিস পদ্ধতি

স্ট্রোক নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা ব্যবহৃত হয় যা মস্তিষ্কের অবস্থা, রক্তনালীর সমস্যা এবং স্ট্রোকের ধরন নির্ধারণে সাহায্য করে। এই পরীক্ষাগুলো দ্রুত করতে হয় এবং সঠিক চিকিৎসার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নে প্রতিটি পরীক্ষার উদ্দেশ্য এবং বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হলো।
পরীক্ষা | উদ্দেশ্য |
সিটি স্ক্যান | স্ট্রোকের ধরন (ইস্কেমিক বা হেমোরেজিক) নির্ধারণ এবং মস্তিষ্কের ক্ষতির পরিমাণ পরীক্ষা করা। |
এমআরআই স্ক্যান | মস্তিষ্কের বিস্তারিত চিত্র প্রদান এবং গভীর বা ছোট ক্ষয়-ক্ষতি শনাক্তকরণ। |
সিটি অ্যাঞ্জিওগ্রাম | রক্তনালীর ব্লকেজ বা অস্বাভাবিকতা (যেমন অ্যানিউরিজম) পরীক্ষা। |
ক্যারোটিড আলট্রাসাউন্ড | ক্যারোটিড ধমনীর প্ল্যাক জমা বা সরু হওয়ার মাত্রা পরীক্ষা। |
ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম (ইসিজি) | অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশন এর মতো হার্টের সমস্যাগুলো শনাক্তকরণ। |
রক্ত পরীক্ষা | শর্করা, কোলেস্টেরল, রক্ত জমাটের সমস্যা এবং অন্যান্য ঝুঁকির কারণ পরীক্ষা। |
সোয়ালো টেস্ট | গিলতে অসুবিধা শনাক্তকরণ এবং জটিলতা (যেমন নিউমোনিয়া) প্রতিরোধ। |
ফিজিওথেরাপি এবং পুনর্বাসন
স্ট্রোকের পর ফিজিওথেরাপি এবং পুনর্বাসন রোগীদের হারানো শারীরিক ক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে এবং তাদের জীবনকে আরও সহজ ও স্বাধীন করতে সাহায্য করে। স্ট্রোকের কারণে শরীরের একপাশ দুর্বল বা অবশ হয়ে যেতে পারে, যা হাঁটা, হাত চালানো বা দৈনন্দিন কাজ করা কঠিন করে দেয়। ফিজিওথেরাপি হলো এমন একটি চিকিৎসা, যেখানে বিশেষজ্ঞরা রোগীদের শরীরের কার্যকারীতা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেন। এটি শরীরের পেশি শক্তিশালী করে, ভারসাম্য উন্নত করে এবং দৈনন্দিন কাজ যেমন খাওয়া, পোশাক পরা বা হাঁটা সহজ করে। ফিজিওথেরাপি রোগীদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং তাদের নিজের কাজ নিজে করার ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়।
বাংলাদেশে স্ট্রোক রোগীর পুনর্বাসন সেবা
স্ট্রোকের পর রোগীদের পুনর্বাসন সেবা তাদের হারানো শারীরিক ক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতালগুলো স্ট্রোক রোগীদের জন্য পুনর্বাসন সেবা দেইয়ার ব্যবস্থা রয়েছে, তবে দেশের বিশাল জনসংখ্যার তুলনায় এই সেবা খুবই সীমিত। অন্যদিকে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো, যেমন সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড (CRP) এবং অগ্রনী স্পেশালাইজড ফিজিওথেরাপি সেন্টার (ASPC) সহ বিভিন্ন সরকারি বেসরাকারি প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন যাবৎ সুনামের সঙ্গে এই ক্ষেত্রে সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
সরকারি হাসপাতালে পুনর্বাসন সেবা
বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতাল, যেমন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (BSMMU), ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটাল (NINS), ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সহ বিভিন্ন বিভাগীয়, জেলা এমনকি উপজেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালের স্ট্রোক রোগীদের জন্য পুনর্বাসন সেবা দেয়। এই হাসপাতালগুলোতে ফিজিওথেরাপি এবং অন্যান্য সেবা পাওয়া যায়, যা রোগীদের হাত-পা ব্যবহার এবং শরীরের শক্তি ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে। তবে, বাংলাদেশের বিশাল জনসংখ্যার তুলনায় এই সেবা খুবই কম। অনেক সময় রোগীদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয় বা পর্যাপ্ত চিকিৎসকের অভাবে পুরোপুরি সেবা পাওয়া যায় না। গ্রামাঞ্চলে এই সুবিধা আরও কম, যা স্ট্রোক রোগীদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অফ দ্য প্যারালাইজড (CRP), অগ্রনী স্পেশালাইসড ফিজিওথেরাপি সেন্টার (ASPC) সহ বাংলাদেশে আরও অনেক প্রতিষ্ঠান স্ট্রোক রোগীদের জন্য পুনর্বাসন সেবা প্রদান করে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো রোগীদের শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী চিকিৎসা পরিকল্পনা তৈরি করে।
বাংলাদেশে স্ট্রোকের প্রেক্ষাপট
স্ট্রোক বাংলাদেশে একটি গুরুতর স্বাস্থ্যগত সমস্যা, যা অনেক মানুষের জীবনকে কঠিন করে তোলে। এটি ঘটে যখন মস্তিষ্কে রক্ত সঠিকভাবে পৌঁছাতে পারে না, ফলে মস্তিষ্কের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উচ্চ রক্তচাপ স্ট্রোকের সবচেয়ে বড় কারণ, যা প্রায় ৮৫% রোগীর মধ্যে পাওয়া যায় (Islam et,al., 2013)। গ্রামাঞ্চলে হাসপাতাল এবং চিকিৎসার সুবিধা কম থাকায় স্ট্রোকের চিকিৎসা পাওয়া খুব কঠিন। নিচে এই বিষয়টি সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করা হলো,
স্ট্রোক প্রতিরোধ এবং সচেতনতা

স্ট্রোক হয় যখন মস্তিষ্কে রক্ত সঠিকভাবে পৌঁছায় না, যার ফলে শরীরের একপাশ দুর্বল হয়ে যায়, কথা বলতে বা হাঁটতে সমস্যা হয়। স্ট্রোক প্রতিরোধে কিছু সহজ নিয়ম মানা গুরুত্বপূর্ণ, যেমন রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা, ধূমপান বন্ধ করা, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া এবং নিয়মিত শরীরচর্চা করা। এছাড়া, রোগী এবং তাদের পরিবারকে স্ট্রোক সম্পর্কে ধারণা দেওয়া খুব জরুরি, কারণ এটি আরেকটি স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি কমায়।
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ
উচ্চ রক্তচাপ স্ট্রোকের সবচেয়ে বড় কারণ, এবং বাংলাদেশে প্রায় ৮৫% স্ট্রোক রোগীর এই সমস্যা থাকে, যা রক্তনালীতে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে এবং সেগুলো ফেটে যাওয়ার বা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। এটি নিয়ন্ত্রণের জন্য যাদের বয়স ৪০ বছরের বেশি তাদের নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করা জরুরি, এবং ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ খাওয়া ও নিয়ম মেনে চলতে হবে। এছাড়াও, লবণ কম খাওয়াও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ লবণ বেশি খাওয়া রক্তচাপ বাড়ায়, এবং মানসিক চাপ কমাতে যোগব্যায়াম বা কিছু এক্সারসাইজ করা সাহায্য করে। এই সহজ নিয়মগুলো মানলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেক কমে যায় (Islam.,et al., 2017).
ধূমপান বন্ধ করা
ধূমপান স্ট্রোকের একটি বড় ঝুঁকি, কারণ এটি রক্তনালী সংকীর্ণ করে এবং রক্ত জমাট বাঁধার সম্ভাবনা বাড়ায়, এবং বাংলাদেশে অনেক পুরুষের ধূমপানের অভ্যাস তাদের স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। ধূমপান বন্ধ করতে ধীরে ধীরে এর পরিমাণ কমিয়ে একেবারে ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করা উচিত, এবং পরিবার বা বন্ধুদের সাহায্য নিলে উৎসাহ পাওয়া যায়। এছাড়া, ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীর পরামর্শ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তারা ওষুধ বা কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে সাহায্য করতে পারেন। ধূমপান বন্ধ করলে শুধু স্ট্রোক নয়, হৃদরোগ এবং ফুসফুসের সমস্যাও অনেক কমে যায়।
স্বাস্থ্যকর খাবার এবং শরীরচর্চা
স্বাস্থ্যকর খাবার এবং নিয়মিত শরীরচর্চা স্ট্রোক প্রতিরোধে খুব গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু বাংলাদেশে অনেকে তেল-চর্বিযুক্ত খাবার খান এবং এক্সারসাইজ করেন না, যা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। এটি নিয়ন্ত্রণের জন্য শাকসবজি, ফল, মাছ এবং ডাল বেশি খাওয়া উচিত, আর ভাজা খাবার, তেল-চর্বিযুক্ত মাংস এবং মিষ্টি কম খাওয়া দরকার, কারণ এটি কোলেস্টেরল এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। এছাড়া, প্রতিদিন ৩০ মিনিট হাঁটা, সাইকেল চালানো বা হালকা এক্সারসাইজ করলে ওজন কমে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং শরীর সুস্থ থাকে। পর্যাপ্ত পানি পান করাও জরুরি, কারণ এটি শরীরের রক্ত সঞ্চালন ভালো রাখে।
উপসংহার
স্ট্রোকের প্রাথমিক চিকিৎসা মস্তিষ্কের ক্ষতি কমাতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেমন দ্রুত ওষুধ প্রয়োগ বা অস্ত্রোপচার, এবং ফিজিওথেরাপি পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় রোগীদের হারানো শারীরিক ক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে, যাতে তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে। বাংলাদেশে চিকিৎসা সুবিধা সীমিত হলেও, সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অফ দ্য প্যারালাইজড (CRP), অগ্রনী স্পেশালাইসড ফিজিওথেরাপি সেন্টার (ASPC) এবং BRAC-এর মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হাতে-কলমে ফিজিওথেরাপি, কথা বলার চিকিৎসা এবং দৈনন্দিন কাজের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে রোগীদের জীবনমান উন্নত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।