ডিজেনারেটিভ ডিস্ক রোগ কি. বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশ কর্মক্ষম মানুষের মধ্যে প্রায় ৫৫ শতাংশ কোনো না কোনো ধরনের কর্মে নিয়োজিত এবং এদের মধ্যে প্রায় ৪৫ শতাংশ মানুষ সেবা খাতে (অফিস, ব্যাংক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যসেবা) কাজ করেন (1)। আমাদের মেরুদণ্ডের হাড়গুলোর মধ্যে নরম ডিস্ক (জেলী জাতীয়) থাকে, যা আমাদের শরীরের চাপ শোষণ করে এবং মেরুদণ্ডের স্থিতিস্থাপকতা বজায় রাখে কিন্তু দীর্ঘক্ষণ ধরে বসে কাজ করার জন্য ডিস্কগুলোর স্থিতিস্থাপকতা কমে যায়, ফলে এই ডিস্ক চেপে যায়, সঙ্কুচিত ও শক্ত হয়ে যায় এবং ব্যথা হয়।
ডিজেনারেটিভ ডিস্ক রোগ কি
ডিজেনারেটিভ ডিস্ক হল মেরুদণ্ডের ডিস্কগুলো বা মেরুদন্ডের হাড়ের মধ্যবর্তী ফাঁকা গুলো বয়স জনিত কারনে ক্ষয় প্রাপ্ত হয় এবং মেরুদন্ডের বিভিন্ন অংশে বিশেষ করে ঘাড়ে ও কোমরে ব্যথার সৃষ্টি করে। মেরুদণ্ডের হাড়গুলোর মধ্যে থাকা ডিস্ক গুলো শক বা চাপ শোষণ করে এবং মেরুদণ্ডের নমনীয়তা বজায় রাখে। মেরুদন্ডের হাড়গুলো ক্ষয় হয়ে যাওয়ার ফলে ডিস্কগুলো স্নায়ুর উপর চাপ সৃষ্টি করে, যা পিঠে, কোমরে বা পায়ে তীব্র ব্যথার কারণ হতে পারে। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা বা দাঁড়িয়ে থাকার ফলে এই ব্যথা অনেক সময় ঘাড় থেকে হাতে ও কোমর থেকে পায়ের দিকে চলে যেতে পারে। আবার কোন কোন সময় হাত ও পায়ে ঝিনঝিন, ভাড়-ভাড় ও অবশ ও লাগে। ডিস্ক প্রল্যাপ্স কি নিজে নিজেই সেরে যায়?
ডিজেনারেটিভ রোগের কারন
ডিজেনারেটিভ রোগের বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে, যা সাধারণত বয়স বৃদ্ধির সাথে সম্পর্কিত। তবে অন্য কিছু জীবনযাত্রা গত এবং পরিবেশগত কারণেও এটি হতে পারে। ডিজেনারেটিভ রোগের প্রধান কারণগুলো নিম্নরূপ:
বয়স জনিত পরিবর্তন: বয়স বাড়ার সাথে সাথে শরীরের কোষ ও টিস্যু গুলো তাদের স্বাভাবিক স্থিতিস্থাপকতা এবং কার্যক্ষমতা হারাতে শুরু করে। বিশেষ করে মেরুদণ্ড, হাড়, এবং জয়েন্টের মতো অংশগুলো তে এই প্রক্রিয়া সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। শরীরের হাড়ের সংযোগস্থল বা ডিস্কগুলো আর্দ্রতা হারায়, ফলে এগুলো শক্ত হয়ে যায় এবং সহজেই ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। মেরুদণ্ডের ডিস্কগুলো যেহেতু স্পাইনাল কর্ডের (মেরুদণ্ডের স্নায়ু) ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে, তাই এই পরিবর্তন অনেক সময় ব্যথা ও অবশ ভাবের কারণ হয়ে দাঁড়ায় (2)।
জেনেটিক বা বংশগত কারণ: অনেক সময় এই ধরনের রোগের ঝুঁকি পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বংশ পরম্পরায় চলে আসে, অর্থাৎ কোনো ব্যক্তির পূর্বপুরুষ বা বাবা-মায়ের মধ্যে যদি ডিজেনারেটিভ রোগ থাকে, তাহলে তারও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। কিছু নির্দিষ্ট জিন আমাদের মেরুদণ্ড, হাড় এবং জয়েন্টের গঠন ও স্থিতিস্থাপকতা কে বাধাগ্রস্ত করে। যখন এই শরীরে জিনগত কোনো পরিবর্তন বা দুর্বলতা থাকে, তখন শরীরের কোষ ও টিস্যু সহজেই ক্ষয়প্রাপ্ত হতে শুরু করে (3)।
বাহ্যিক আঘাত ও অতিরিক্ত ব্যবহার: যখন শরীরের কোনো অংশে অতিরিক্ত চাপ পড়ে বা কোন ক্রমে আঘাত প্রাপ্ত হয়, তখন সেই অংশের টিস্যু এবং জয়েন্ট গুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বিশেষ করে ভারী জিনিস বহন, শারীরিক পরিশ্রম, খেলাধুলা বা পুনরাবৃত্তিমূলক কাজের ক্ষেত্রে শরীরের বিশেষ কিছু অঙ্গে ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি হয়। এ ধরনের চাপ মেরুদণ্ডের ডিস্ক, হাঁটু, কোমর, এবং অন্যান্য জয়েন্টের উপর পড়ে, যার ফলে সেগুলো দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।
ধূমপান ও অস্বাস্থ্যকর জীবন ধারা: ধূমপান শরীরের টিস্যুতে রক্তসঞ্চালন হ্রাস করে এবং শরীরে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের অভাব ঘটায়, যার ফলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিশেষত মেরুদণ্ডের ডিস্ক গুলো দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে। ধূমপানের কারণে ডিস্কের ভেতরের আর্দ্রতা এবং স্থিতিস্থাপকতা কমে যায়, যা ডিস্কের কার্যকরিতা কমিয়ে দেয় এবং ব্যথার ঝুঁকি বাড়ায়। এ কারণে, ধূমপায়ীদের মধ্যে ডিজেনারেটিভ ডিস্ক রোগের প্রবণতা অনেক বেশি (4)।
অস্বাস্থ্যকর ওজন এবং স্থূলতা: যখন শরীরের ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হয়, তখন হাড়, জয়েন্ট এবং বিশেষত মেরুদণ্ডের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে। এই চাপ দীর্ঘ মেয়াদে শরীরের টিস্যু এবং জয়েন্টের ক্ষয় প্রাপ্তি ঘটায় এবং ডিজেনারেটিভ ডিস্ক রোগ সহ অন্যান্য আর্থ্রাইটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। স্থূল ব্যক্তিদের মধ্যে হাঁটু, কোমর এবং পিঠে ব্যথা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি, কারণ এই সকল স্থানে শরীরের ওজন সবচেয়ে বেশি পড়ে।
পরিবেশগত কারণ: দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং কাজের পরিবেশের মতো বিভিন্ন পরিবেশগত কারণ শরীরের কোষ এবং টিস্যুর উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা দীর্ঘ মেয়াদে ডিজেনারেটিভ রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। বায়ুদূষণ, বিশেষত তামাকের ধোঁয়া এবং শিল্প দূষণ, শরীরে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস বৃদ্ধি করে, যা কোষের প্রাকৃতিক পুনর্গঠন প্রক্রিয়া কে বাধাগ্রস্ত করে। এর ফলে মেরুদণ্ডের ডিস্ক এবং হাড়ের স্থিতিস্থাপকতা কমে যায় এবং দ্রুত ক্ষয় হতে থাকে (5)।
ডিজেনারেটিভ ডিস্ক চিকিৎসা
ডিজেনারেটিভ ডিস্ক রোগের (Degenerative Disc Disease) চিকিৎসা প্রধানত লক্ষণ গুলো কমিয়ে আনা অর্থাৎ ব্যথা কমানো এবং রোগের অগ্রগতি কে ধীর করার উপর ভিত্তি করে করা হয়। এ রোগের চিকিৎসায় বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়, যা রোগীর ব্যথার মাত্রা, জীবনধারা, এবং রোগের অগ্রগতির উপর নির্ভর করে। সাধারণ চিকিৎসা পদ্ধতি গুলোর মধ্যে রয়েছে:
ঔষধ: প্রাথমিক ভাবে আপনি একজন রিউমাটোলজিষ্ট চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ব্যথা নিয়ন্ত্রণে সাধারণত ব্যথানাশক ওষুধ এবং অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ওষুধ, মাংসপেশির শিথিল কারক ওষুধ খাওয়ার পাশাপাশি বিশ্রাম নিলে এই ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
ফিজিওথেরাপি: ফিজিওথেরাপি বিশেষ করে ম্যানুয়ালথেরাপি চিকিৎসা ডিজেনারেটিভ ডিস্ক রোগ নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে। আপনার যদি ঔষধ খাওয়ার পরেও ব্যথা না কমে তাহলে আপনার উচিৎ একজন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া যিনি আপনার শারীরিক অবস্থা পর্যালোচনা করে চিকিৎসা সেবা প্রদান করবেন। আপনার আশে পাশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থাকে আপনি এ চিকিৎসা সেবা টি নিতে পারেন।
কিন্তু চিকিৎসা নেওয়ার আগে আপনার শারীরিক অবস্থা পর্যালোচনা করা খুবই গুরুত্বপূর্ন সেক্ষেত্রে ASPC ম্যানু্পুলেশন থেরাপি সেন্টার (House #U64, Noorjahan Road Mohammadpur, Dhaka-1207) Structural Diagnosis & Management (SDM) টেকনিক অ্যাপ্লাই করে সাফল্য পাচ্ছে। যেখানে Structural Diagnosis & Management (SDM) টেকনিকের মাধ্যমে রোগীর গঠনগত পরিবর্তন সহ সংশ্লিঠ মাংশপেশী গুলো অ্যাসেসমেন্ট করে কারেকশন থেরাপির মাধ্যমে সেগুলোর শক্তি বাড়ানোর চিকিৎসা করা হয় যার ফলে রোগী খুবই অল্প সময়ে সুস্থতা লাভ করে।
লাইফ স্টাইল পরিবর্তন: ঔষধ এবং কারেকশন থেরাপি নেয়ার পাশাপাশি সুষম খাদ্য গ্রহণ, বিশেষ করে হাড় ও জয়েন্টের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাদ্য খাওয়া, চলাফেরা, সঠিক ভঙ্গিমায় বসা এবং ওজন নিয়ন্ত্রণ, ধূমপান পরিহার সহ জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের মাধ্যমে ডিজেনারেটিভ ডিস্ক রোগের লক্ষণ গুলো নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
সার্জারি: যেসব ক্ষেত্রে অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতি কার্যকর হয় না, এবং ব্যথা খুবই তীব্র ও স্থায়ী হয়, তখন চিকিৎসক সার্জারি করার পরামর্শ দিতে পারেন। ডিস্ক প্রতিস্থাপন বা ডিস্ক ফিউশন সার্জারি প্রায়ই ব্যবহৃত হয়, যা ক্ষতিগ্রস্ত ডিস্কের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনে।
তথ্যসূত্র
- https://bbs.portal.gov.bd/sites/default/files/files/bbs.portal.gov.bd/page/b2db8758_8497_412c_a9ec_6bb299f8b3ab/2023-06-26-09-19-2edf60824b00a7114d8a51ef5d8ddbce.pdf
- Zhao CQ, Wang LM, Jiang LS, Dai LY. The cell biology of intervertebral disc aging and degeneration. Ageing Res Rev. 2007 Oct;6(3):247-61. doi: 10.1016/j.arr.2007.08.001. Epub 2007 Aug 10. PMID: 17870673. https://doi.org/10.1016/j.arr.2007.08.001
- Kao, P.Y.P., Chan, D., Samartzis, D., Sham, P.C. and Song, Y.Q., 2011. Genetics of lumbar disk degeneration: technology, study designs, and risk factors.Orthopedic Clinics, 42(4), pp.479-486. https://www.orthopedic.theclinics.com/article/S0030-5898(11)00077-0/abstract
- Kirnaz, S., Capadona, C., Lintz, M., Kim, B., Yerden, R., Goldberg, J.L., Medary, B., Sommer, F., McGrath, L.B., Bonassar, L.J. and Härtl, R., 2021. Pathomechanism and biomechanics of degenerative disc disease: features of healthy and degenerated discs.International journal of spine surgery, 15(s1), pp.10-25. http://www.ijssurgery.com/content/15/s1/10.abstract
- Thompson, D.A., Lehmler, H.J., Kolpin, D.W., Hladik, M.L., Vargo, J.D., Schilling, K.E., LeFevre, G.H., Peeples, T.L., Poch, M.C., LaDuca, L.E. and Cwiertny, D.M., 2020. A critical review on the potential impacts of neonicotinoid insecticide use: current knowledge of environmental fate, toxicity, and implications for human health.Environmental Science: Processes & Impacts, 22(6), pp.1315-1346. https://pubs.rsc.org/en/content/articlehtml/2020/em/c9em00586b
- ডেঙ্গু জ্বরের ৭টি সতর্কীকরণ লক্ষণ ২০২৪ | ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার - November 28, 2024
- হাঁটু ব্যথার জন্য কার্যকারী ব্যায়াম গুলো জেনে নিন - November 28, 2024
- লাম্বার স্পন্ডাইলোসিস কমানোর উপায়? ও স্পন্ডাইলোসিস কি? - November 5, 2024