কাঁধের জয়েন্টে ব্যাথা। বর্তমানে খুবই সাধারণ সমস্যা, যা বিভিন্ন কারণে সৃষ্টি হতে পারে যেমনঃ রোটেটর কাফ ইনজুরি, ফ্রোজেন শোল্ডার, টেন্ডোনাইটিস, আরথ্রাইটিস বা কাঁধের ডিসলোকেশন ইত্যাদি। রোটেটর কাফের পেশী ও টেন্ডন ক্ষতিগ্রস্ত হলে কাঁধে ব্যাথা শুরু হতে পারে, যা নড়াচড়ার সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। এছাড়া ফ্রোজেন শোল্ডার বা অ্যাডহেসিভ ক্যাপসুলাইটিসের ক্ষেত্রে কাঁধের জয়েন্ট শক্ত হয়ে যায় এবং ব্যাথা বাড়ে। টেন্ডোনাইটিসে অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে টেন্ডনে প্রদাহ সৃষ্টি হয়, যার ফলে কাঁধের জয়েন্টে ব্যাথা হতে পারে।
কাঁধের জয়েন্টে ব্যাথা
কাঁধে ব্যাথা বা কাঁধ জমে যাওয়া, যা সাধারণত ফ্রোজেন শোল্ডার নামে পরিচিত, একটি জটিল এবং কষ্টকর অবস্থা। এতে কাঁধের জয়েন্ট ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে যায় এবং নড়াচড়ার সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এই সমস্যা টি সাধারণত ধাপে ধাপে হয়—প্রথমে কাঁধের নড়াচড়ায় ব্যথা শুরু হয়, পরে কাঁধ শক্ত হয়ে যায় এবং শেষে কাঁধের নড়াচড়া খুবই সীমিত হয়ে পড়ে। মূলত রোটেটর কাফ ইনজুরি, টেন্ডোনাইটিস অথবা কোনো আঘাতের কারণে কাঁধ জমে যেতে পারে। ফ্রোজেন শোল্ডারের ঝুঁকি বেশি দেখা যায় ৪০ থেকে ৬০ বছর বয়সের মানুষদের মধ্যে এবং ডায়াবেটিস বা দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে এই সমস্যার হার আরও বেশি প্রায় ১০% থেকে ২০% (1)।
কাঁধের ব্যথার কারণ
কাঁধের ব্যাথার কারণ বিভিন্ন হতে পারে, যা কাঁধের গঠন, পেশী, হাড়, এবং টেন্ডনের সমস্যার উপর নির্ভর করে। নিচে কাঁধের ব্যাথার কয়েকটি সাধারণ কারণ উল্লেখ করা হলো:
রোটেটর কাফ ইনজুরি: রোটেটর কাফ হলো কাঁধের চারটি পেশী ও টেন্ডন, যা কাঁধ কে স্থিতিশীল রাখে এবং বিভিন্ন দিকের নড়াচড়ায় সহায়তা করে। কোনো আঘাত, অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে এই পেশী বা টেন্ডন ক্ষতিগ্রস্ত হলে রোটেটর কাফ ইনজুরি ঘটে। এই ইনজুরির ফলে কাঁধে ব্যাথা, দুর্বলতা এবং নড়াচড়ার সীমাবদ্ধতা দেখা দেয়, যা সাধারণত হাত উঁচু করে কাজ করার সময় বেশি অনুভূত হয়।
ডান কাঁধে ব্যথার কারণ
ফ্রোজেন শোল্ডার: কাঁধের ব্যাথার একটি সাধারণ কারণ হলো ফ্রোজেন শোল্ডার, যা অ্যাডহেসিভ ক্যাপসুলাইটিস নামে পরিচিত। এটি এমন একটি অবস্থা যেখানে কাঁধের জয়েন্ট ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে যায় এবং নড়াচড়ার সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। ফ্রোজেন শোল্ডারের প্রধান লক্ষণ হলো কাঁধে ব্যাথা এবং কাঁধের নড়াচড়ায় বাধা। এই সমস্যা সাধারণত ধাপে ধাপে শুরু হয় প্রথমে ব্যথা অনুভূত হয়, তারপর কাঁধের নড়াচড়া সীমিত হয়ে পড়ে, এবং শেষে কাঁধ সম্পূর্ণ ভাবে জমে যায়।
টেন্ডোনাইটিস: সাধারণত অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে হয়, বিশেষত খেলাধুলায় অংশগ্রহণকারী বা যাদের হাত দিয়ে বেশি কাজ করতে হয়, তাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। কাঁধের টেন্ডন গুলোতে অতিরিক্ত চাপ বা দীর্ঘ মেয়াদি ব্যবহারের ফলে প্রদাহ সৃষ্টি হয়, যা ব্যাথা এবং অস্বস্তি তৈরি করে। এই অবস্থায় হাত উঁচু করে কাজ করা বা ঘুরানো বেশ কষ্টকর হয়ে পড়ে।
আপনার কি কাঁধের জয়েন্টে ব্যথা
আরথ্রাইটিস: কাঁধের আরথ্রাইটিস সাধারণত বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে দেখা যায় এবং এটি ধীরে ধীরে শুরু হয়। এই অবস্থায় কাঁধের জয়েন্টের কার্টিলেজ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, ফলে জয়েন্টের হাড় গুলো একে অপরের সঙ্গে ঘষা খায়, যা ব্যাথা এবং অস্বস্তি তৈরি করে। কাঁধের আরথ্রাইটিসের কারণে ব্যাথা ছাড়াও কাঁধের নড়াচড়া সীমিত হয়ে যায়, এবং জয়েন্টে শক্ত ভাব অনুভূত হয়।
ডিসলোকেশন: কাঁধের ব্যাথার একটি গুরুতর কারণ হলো কাঁধের ডিসলোকেশন, যেখানে কাঁধের জয়েন্টের হাড় স্বাভাবিক অবস্থান থেকে সরে যায়। কাঁধের জয়েন্ট টি শরীরের অন্যান্য জয়েন্টের তুলনায় বেশি চলন ক্ষম, ফলে এটি সহজেই আঘাত বা অতিরিক্ত চাপের কারণে স্থানচ্যুত হতে পারে। ডিসলোকেশন ঘটলে কাঁধে তীব্র ব্যথা, ফুলে যাওয়া, এবং নড়াচড়া সম্পূর্ণ ভাবে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। সাধারণত কোনো আঘাত, হঠাৎ টান, বা দুর্ঘটনার ফলে কাঁধের ডিসলোকেশন ঘটে।
বাম কাঁধে ব্যথার কারণ
বারসাইটিস: বারসা হলো ছোট একটি থলি, যা হাড়, পেশী, টেন্ডন এবং ত্বকের মাঝে থাকে এবং ঘর্ষণ ও চাপ কমাতে সাহায্য করে। যখন বারসায় অতিরিক্ত চাপ পড়ে বা দীর্ঘ মেয়াদে পুনরাবৃত্তি মূলক নড়াচড়া হয়, তখন বারসায় প্রদাহ সৃষ্টি হতে পারে, যা বারসাইটিস নামে পরিচিত। বারসাইটিসের ফলে কাঁধে ব্যাথা, ফুলে যাওয়া এবং নড়াচড়ার সীমাবদ্ধতা দেখা দেয়। বিশেষ করে হাত উঁচু করে কাজ করার সময় ব্যাথা তীব্র হতে পারে। আপনার মাথা ব্যথা? কি করবেন?
আঘাত বা আঘাত জনিত ক্ষতি: আঘাতের কারণে কাঁধের জয়েন্ট, পেশী, টেন্ডন বা লিগামেন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যা ব্যথা, ফোলা ভাব, এবং নড়াচড়ার সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। বিশেষত, কাঁধের মচকানো, পেশী ছিঁড়ে যাওয়া বা জয়েন্টের স্থানচ্যুতি (ডিসলোকেশন) আঘাত জনিত ক্ষতির সাধারণ রূপ। এর ফলে কাঁধের কার্য ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং দৈনন্দিন কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটে।
কাঁধের ব্যাথার প্রতিকার ও চিকিৎসা
কাঁধের ব্যাথার প্রতিকার ও চিকিৎসা নির্ভর করে ব্যাথার প্রকৃতি, কারণ, এবং এর তীব্রতার উপর। সাধারণত, প্রাথমিক অবস্থায় ব্যথা নিয়ন্ত্রণে নেওয়া পদক্ষেপ গুলো এবং চিকিৎসার মাধ্যম গুলো হলো
বিশ্রাম: ব্যাথা শুরু হলে কাঁধের উপর অতিরিক্ত চাপ বা কার্যকলাপ এড়িয়ে চলা উচিত, যা ব্যাথাকে আরও তীব্র করতে পারে। বিশ্রাম কাঁধের টিস্যু এবং পেশীকে পুনরুদ্ধার করার সুযোগ দেয়, এবং প্রদাহ কমাতে সহায়তা করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কাঁধের ব্যাথা হলে ভারী কাজ, খেলাধুলা বা হাত উঁচু করে কোনো কার্যকলাপ বন্ধ রাখা প্রয়োজন, কারণ এগুলো রোটেটর কাফ বা টেন্ডনের উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে (2)।
ঠান্ডা ও গরম প্রয়োগ: ব্যাথা বা আঘাতের পর প্রথম ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ঠান্ডা প্রয়োগ (আইস প্যাক) প্রদাহ এবং ফোলা ভাব কমাতে সহায়তা করে। এটি টিস্যু তে রক্তপ্রবাহ হ্রাস করে এবং ব্যাথা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখে। প্রতি ১৫-২০ মিনিট ধরে দিনে কয়েক বার ঠান্ডা প্রয়োগ করা যেতে পারে (3)। অন্য দিকে, দীর্ঘ মেয়াদি ব্যাথা বা পেশীর কঠোরতার ক্ষেত্রে গরম প্রয়োগ (হট প্যাক) ব্যবহৃত হয়, যা রক্ত প্রবাহ বৃদ্ধি করে এবং পেশী কে শিথিল করতে সাহায্য করে।
ব্যথা নাশক ও প্রদাহ নাশক ওষুধ: কাঁধের ব্যাথার প্রতিকার ও চিকিৎসায় ব্যথা নাশক এবং প্রদাহ নাশক ওষুধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাধারণত, নন-স্টেরয়ডাল অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ড্রাগস (NSAIDs) যেমন আইবুপ্রোফেন বা ন্যাপ্রোক্সেন কাঁধের ব্যাথা এবং প্রদাহ কমাতে ব্যবহৃত হয়। এই ওষুধ গুলো প্রদাহ হ্রাস করে এবং ব্যথার উপশমে সাহায্য করে, বিশেষ করে যখন ব্যাথার কারণ হিসেবে টেন্ডোনাইটিস, আরথ্রাইটিস বা মচকানো সমস্যা থাকে। NSAIDs ব্যাথা দ্রুত কমাতে সাহায্য করে এবং কাঁধের কার্যক্ষমতা পুনরুদ্ধারে সহায়ক। তবে, দীর্ঘমেয়াদে ব্যবহারের ক্ষেত্রে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি থাকায় চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণ করা উচিত।
ফিজিওথেরাপি: ম্যানুয়াল থেরাপির মাধ্যমে কাঁধের পেশী ও জয়েন্ট কে শক্তিশালী করা হয়, যা ব্যথা উপশম এবং কাঁধের নড়াচড়া পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে। ম্যানুয়াল থেরাপিতে বিভিন্ন স্ট্রেচিং ও স্ট্রেংথেনিং এক্সারসাইজ ব্যবহার করা হয়, যা কাঁধের পেশী এবং টেন্ডনের উপর চাপ কমায় এবং পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া কে ত্বরান্বিত করে। বিশেষজ্ঞ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে কাঁধের ব্যথা যেমন রোটেটর কাফ ইনজুরি, ফ্রোজেন শোল্ডার বা আরথ্রাইটিসে কারেকশন থেরাপি অত্যন্ত কার্যকর ভুমিক| পালন করে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ফিজিওথেরাপি ও ম্যানুয়াল থেরাপির চিকিৎসা করা হয়। ঢাকার মোহাম্মদপুরে অবস্থিত ASPC ম্যানিপুলেশন থেরাপি সেন্টার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, যেখানে কারেকশন থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়। এখানে রোগীর শারীরিক অবস্থা মূল্যায়নের জন্য Structural Diagnosis & Management (SDM) পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় এবং সেই অনুযায়ি চিকিৎসা করা হয় যা রোগ নিরাময়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
অপারেশন: যদি ব্যাথা দীর্ঘস্থায়ী এবং অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতিতে উন্নতি না হয়, তবে আর্থ্রোস্কোপি বা অন্যান্য অপারেশন করা যেতে পারে। এটি সাধারণত ফ্রোজেন শোল্ডার, রোটেটর কাফ ইনজুরি বা জয়েন্ট ডিসলোকেশনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
তথ্যসূত্র
- Millar, N.L., Meakins, A., Struyf, F., Willmore, E., Campbell, A.L., Kirwan, P.D., Akbar, M., Moore, L., Ronquillo, J.C., Murrell, G.A. and Rodeo, S.A., 2022. Frozen shoulder. Nature reviews Disease primers, 8(1), p.59. https://www.nature.com/articles/s41572-022-00386-2
- Zernicke, R.F. and Whiting, W.C., 2000. Mechanisms of musculoskeletal injury. Biomechanics in Sport: Performance Enhancement and Injury Prevention, pp.507-522. https://onlinelibrary.wiley.com/doi/pdf/10.1002/9780470693797#page=512
- Nadler, S.F., Weingand, K. and Kruse, R.J., 2004. The physiologic basis and clinical applications of cryotherapy and thermotherapy for the pain practitioner. Pain physician, 7(3), p.395. https://www.researchgate.net/profile/Kurt-Weingand/publication/6928434_The_Physiologic_Basis_and_Clinical_Applications_of_Cryotherapy_and_Thermotherapy_for_the_Pain_Practitioner/links/5de9271e92851c8364654b91/The-Physiologic-Basis-and-Clinical-Applications-of-Cryotherapy-and-Thermotherapy-for-the-Pain-Practitioner.pdf
- ঘাড় ব্যথা কিসের লক্ষণ - February 9, 2025
- সায়াটিকা সারানোর উপায় - January 30, 2025
- ডেঙ্গু জ্বরের ৭টি সতর্কীকরণ লক্ষণ ২০২৪ | ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার - November 28, 2024