আপনার মাথা ব্যথা? কি করবেন? মাথা ব্যথা (Headache) মাথার যে কোনো অংশে ব্যথার ফলে হতে পারে এবং এটি হবার পেছনে একাধিক কারণে থাকতে পারে। সাধারণত, এটি দুই ভাগে বিভক্ত। প্রাথমিক ভাবে মাথা ব্যথা কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই ঘটে, যেমন টেনশন টাইপ হেডেক, এটির ক্ষেত্রে মানসিক চাপ বা স্ট্রেসের কারণে মাথায় চাপ বা টান অনুভূত হয়।
মাইগ্রেনও একটি প্রাইমারি মাথা ব্যথা, যেখানে মাথার এক পাশে তীব্র ব্যথা হয় এবং এর সাথে বমি ভাব বা আলো ও শব্দের প্রতি সংবেদনশীলতা থাকতে পারে। আরেকটি তীব্র ধরনের মাথা ব্যথা হয়ে যেটি ক্লাস্টার হেডেক নামে পরিচিত। এটির ক্ষেত্রে মাথার এক পাশে এবং চোখের চারপাশে ব্যথা অনুভূত হয়। এছাড়াও মাথা ব্যথা সাধারণত অন্য কোনো শারীরিক সমস্যা, যেমন সাইনাস ইনফেকশন, দাঁতের সমস্যা, মস্তিষ্কে আঘাত বা টিউমারের কারণেও ঘটে।
ঘন ঘন মাথা ব্যথার কারন কি?
ঘন ঘন মাথা ব্যথা বিভিন্ন কারণে হতে পারে, এবং এর পেছনে শারীরিক ও মানসিক উভয় কারণই জড়িত থাকতে পারে। নিচে ঘন ঘন মাথা ব্যথার কিছু সাধারণ কারণ উল্লেখ করা হলো
মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ: দৈনন্দিন জীবনের অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, কাজের চাপ, আর ব্যক্তিগত জীবনের বিভিন্ন সমস্যা মানসিক চাপের সৃষ্টি করে, যা সরাসরি মাথা ব্যথার কারণ হতে পারে। যখন কেউ দীর্ঘ সময় ধরে মানসিক চাপে থাকে বা উদ্বিগ্ন থাকে, তখন শরীরে কর্টিসল নামক স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়, যা মাথার পেশিতে টান সৃষ্টি করে এবং মাথায় ব্যথা অনুভব হয়। সাইনাসের মাথা ব্যাথা এর কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা
মাইগ্রেন: মাইগ্রেন একটি স্নায়বিক সমস্যা, যা সাধারণত মাথার একপাশে তীব্র ব্যথার সৃষ্টি করে এবং এটি বারংবার হয়ে থাকে। মাইগ্রেনের ব্যথা সাধারণ মাথা ব্যথার চেয়ে অনেক বেশি তীব্র হয় এবং এর সঙ্গে অন্যান্য উপসর্গও থাকতে পারে, যেমন বমি বমি ভাব, বমি হওয়া, আলো ও শব্দের প্রতি অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা। অনেক সময় মাইগ্রেনের আগে কিছু সতর্কতা মূলক লক্ষণ দেখা যায়, যেমন চোখে ঝাপসা দেখা বা আলোর ঝলকানি। মাইগ্রেনের সঠিক কারণ এখনও সম্পূর্ণ ভাবে জানা যায়নি, তবে এটি সাধারণত জিনগত বা পরিবেশগত কারণে ঘটে বলে মনে করা হয়।
ঘুমের সমস্যা: পর্যাপ্ত এবং ভালো ঘুম না হলে শরীর এবং মস্তিষ্ক পুরোপুরি বিশ্রাম পায় না, যার ফলে মাথা ব্যথার ঝুঁকি বাড়ে। অনিদ্রা বা ঘুমের ব্যাঘাতের কারণে মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রের উপর চাপ পড়ে, যা মাথায় টান বা ব্যথার অনুভূতি তৈরি করে। বিশেষ করে, যারা দীর্ঘ মেয়াদি ঘুমের সমস্যা, যেমন অনিদ্রা, স্লিপ অ্যাপনিয়াতে ভুগেন, বা অনিয়মিত ঘুমের অভ্যাস, তাদের মধ্যে ঘন ঘন মাথা ব্যথার প্রবণতা দেখা যায়।
দৃষ্টি জনিত সমস্যা: যখন চোখের দৃষ্টি দুর্বল হয়ে যায় বা দীর্ঘ সময় ধরে চোখের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে, তখন এটি মাথায় ব্যথার সৃষ্টি করতে পারে। মায়োপিয়া (নিকটদৃষ্টি), হাইপারমেট্রোপিয়া (দূরদৃষ্টি), বা অ্যাস্টিগমাটিজম (বিকৃত দৃষ্টি) থাকার কারণে চোখের মাংসপেশি অতিরিক্ত কাজ করতে বাধ্য হয়, যা মাথায় চাপের মতো ব্যথা সৃষ্টি করে। এছাড়াও, দীর্ঘ সময় ধরে কম্পিউটার স্ক্রিন বা মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকার ফলে কম্পিউটার ভিশন সিন্ড্রোম বা চোখের ক্লান্তি দেখা দিতে পারে, যা ঘন ঘন মাথা ব্যথার অন্যতম কারণ। আপনার ঘাড় ও কাঁধে ব্যাথা
হরমোনের পরিবর্তন: মহিলাদের ক্ষেত্রে হরমোনের পরিবর্তন ঘন ঘন মাথা ব্যথার একটি সাধারণ কারণ হতে পারে। মাসিক চক্র, গর্ভাবস্থা, মেনোপজ, বা জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল ব্যবহারের ফলে শরীরে হরমোনের মাত্রা ওঠানামা করে, যা মাথা ব্যথার কারণ হতে পারে। বিশেষ করে এস্ট্রোজেন হরমোনের মাত্রার পরিবর্তন মাথা ব্যথার সঙ্গে সম্পর্কিত। মাসিকের সময় এস্ট্রোজেনের মাত্রা হ্রাস পায়, যা মাইগ্রেনের প্রকোপ বাড়াতে পারে। গর্ভাবস্থায় বা মেনোপজের সময় হরমোনের ওঠা নামার কারণে অনেক মহিলার ঘন ঘন মাথা ব্যথা দেখা দেয়।
খাদ্যাভ্যাস ও পানিশূন্যতা: সঠিক এবং পুষ্টিকর খাবার না খাওয়া, দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকা, অথবা অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাত খাবার খাওয়ার ফলে মাথা ব্যথার ঝুঁকি বেড়ে যায়। অনেক সময় শরীরে প্রোটিন, ভিটামিন বা মিনারেলের অভাব তৈরি হলে তা মাথা ব্যথার কারণ হতে পারে। বিশেষত, কফি বা চা বেশি পান করা, অ্যালকোহল সেবন, অথবা অতিরিক্ত মসলা যুক্ত খাবার খাওয়ার ফলে মাইগ্রেন বা মাথা ব্যথা হতে পারে। একই সঙ্গে, পানির অভাব বা দেহের পানি শূন্যতা মাথা ব্যথার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যখন শরীর পর্যাপ্ত পানি পায় না, তখন মস্তিষ্কের কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটে এবং রক্তনালী সংকুচিত হয়, যা মাথা ব্যথার সৃষ্টি করে।
উচ্চ রক্তচাপ: যখন রক্তচাপ অত্যন্ত বেড়ে যায়, তখন রক্তনালী গুলোর ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে, যা মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে রক্ত সঞ্চালনে ব্যাঘাত ঘটায় এবং মাথা ব্যথার সৃষ্টি করে। উচ্চ রক্তচাপের কারণে হওয়া মাথা ব্যথা সাধারণত মাথার পেছনের দিকে বেশি অনুভূত হয় এবং এটি চাপ বা মাথায় ধাক্কা লাগার মত অনুভূতি তৈরী হতে পারে। বিশেষত, সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর এই ধরনের মাথা ব্যথা বেশ তীব্র হয়।
মস্তিষ্কে আঘাত বা সংক্রমণ: যখন মস্তিষ্কে কোনো আঘাত লাগে, তখন মস্তিষ্কের টিস্যু বা রক্তনালী গুলোর ক্ষতি হতে পারে, যা থেকে ক্রমাগত মাথা ব্যথা দেখা দিতে পারে। এই ধরনের ব্যথা সাধারণত আঘাত লাগার পরে শুরু হয় এবং তীব্র থেকে মৃদু পর্যায়ের হতে পারে। পোস্ট-ট্রমাটিক হেডেক নামক এই ব্যথা দীর্ঘ সময় ধরে থাকতে পারে এবং এর সঙ্গে মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব, ও দৃষ্টিশক্তির সমস্যা দেখা দিতে পারে। এছাড়াও, মস্তিষ্কের সংক্রমণ, যেমন মেনিনজাইটিস বা এনসেফালাইটিস, মস্তিষ্কের ঝিল্লি বা টিস্যুর প্রদাহ সৃষ্টি করে, যা তীব্র মাথা ব্যথার কারণ হয়।
মাথা ব্যথা কোন রোগের লক্ষন
মাথা ব্যথা বিভিন্ন রোগ বা শারীরিক সমস্যার একটি সাধারণ লক্ষণ হতে পারে। এটি একাধিক সমস্যার কারণে হতে পারে, যেগুলো কখনও কখনও গুরুতর, আবার কখনও স্বল্প মেয়াদি ও কম গুরুতর হতে পারে। নিচে মাথা ব্যথা সম্পর্কিত কিছু সাধারণ রোগ বা সমস্যার তালিকা দেওয়া হলো:
মাইগ্রেন: মাইগ্রেন একটি জটিল স্নায়বিক রোগ, যা সাধারণত মাথা ব্যথার প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি মূলত মাথার একপাশে তীব্র ব্যথার সৃষ্টি করে, যা সাধারণ ব্যথার চেয়ে অনেক বেশি তীব্র হতে পারে। মাইগ্রেনের সাথে প্রায়ই বমি ভাব, বমি এবং আলো ও শব্দের প্রতি অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা দেখা যায়। অনেক সময় মাইগ্রেন পেইন শুরু হওয়ার আগে কিছু সতর্কতা মূলক লক্ষণ যেমন চোখে ঝাপসা দেখা বা আলো ঝলকানি দেখা দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, মাইগ্রেন মূলত স্নায়বিক কার্যকলাপের পরিবর্তনের কারণে ঘটে, যা মস্তিষ্কের রক্তনালী এবং রাসায়নিক কার্যকলাপ কে প্রভাবিত করে (১)।
মাথা ব্যথা ও বমি কোন রোগের লক্ষন
সাইনাস ইনফেকশন (সাইনুসাইটিস): সাইনাস হলো মাথার হাড়ের ভেতরে বায়ু পূর্ণ ফাঁপা স্থান, যা সংক্রমণের কারণে ফুলে ওঠে এবং ব্যথা সৃষ্টি করে। সাইনাস ইনফেকশনের ফলে সাধারণত মাথার সামনের অংশে বা চোখের চারপাশে তীব্র চাপ অনুভূত হয়। এর সাথে নাক বন্ধ থাকা, ঘন শ্লেষ্মা, মুখের ব্যথা, এবং কখনও কখনও জ্বর দেখা দিতে পারে। মাথা ব্যথার পাশাপাশি সাইনাস ইনফেকশনের সময় মুখের হাড়েও ব্যথা অনুভূত হতে পারে, বিশেষ করে মাথা নিচু করার সময় ব্যথা বাড়ে।
সাইনাস ইনফেকশনের কারণে সৃষ্ট মাথা ব্যথা অনেক সময় ঠান্ডা লাগার কারণে হয় এবং সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, সাইনাস ইনফেকশন দীর্ঘ মেয়াদি হলে তা মাথা ব্যথার পাশাপাশি শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যাও তৈরি করতে পারে (২)।
টেনশন টাইপ হেডেক: টেনশন টাইপ হেডেক হলো মাথা ব্যথার সবচেয়ে সাধারণ ধরন, যা মূলত মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা বা অতিরিক্ত মানসিক ও শারীরিক পরিশ্রমের কারণে হয়। এই ধরনের মাথা ব্যথা সাধারণত মাথার চারপাশে ব্যান্ডের মতো চাপ অনুভব করায়, এবং ব্যথা টি হালকা থেকে মাঝারি তীব্রতার হয়। অনেক সময় ঘাড় ও কাঁধের পেশি গুলো শক্ত হয়ে যায়, যা ব্যথা কে আরো বাড়িয়ে তোলে। টেনশন টাইপ হেডেক দীর্ঘ সময় ধরে একটানা কাজ করা, কম ঘুমানো, বা শারীরিক ক্লান্তির কারণে হতে পারে।
এই ব্যথা সাধারণত দুই থেকে তিন ঘণ্টার মধ্যে চলে যায়, তবে কখনও কখনও দীর্ঘস্থায়ীও হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, টেনশন টাইপ হেডেক মানসিক চাপের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত, যা জীবনের প্রতিদিনের চাপ বা উত্তেজনার ফলে বেড়ে যায় (৩)। যদিও এটি মাইগ্রেনের মতো এত তীব্র না, তবে নিয়মিত ব্যথা হলে জীবন যাত্রার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
উচ্চ রক্তচাপ (হাইপারটেনশন): সাধারণত, উচ্চ রক্তচাপের কারণে মাথার পেছনের দিকে বা ঘাড়ের উপরের অংশে ব্যথা অনুভূত হয়, যা মাথায় চাপ লাগার মতো অনুভূত হতে পারে। এই ধরনের মাথা ব্যথা প্রায়শই সকালে শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে রক্তনালী গুলোর ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়, যা মাথার ব্যথার কারণ হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ জনিত মাথা ব্যথার পাশাপাশি অন্যান্য উপসর্গ ও দেখা দিতে পারে, যেমন মাথা ঘোরা, দৃষ্টিশক্তির পরিবর্তন, বুকে ব্যথা হওয়া, বা শ্বাসকষ্ট হওয়া।
মস্তিষ্কের টিউমার: মস্তিষ্কের টিউমার যখন বড় হতে থাকে, তখন এটি মস্তিষ্কের ভেতরের চাপ বাড়ায়, যা মাথা ব্যথার সৃষ্টি করে। এই ধরনের মাথা ব্যথা সাধারণত সকালে তীব্র হয় এবং বেলা বাড়ার সাথে সাথে ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে পারে, তবে ব্যথা সময়ের সঙ্গে আরও তীব্র হতে থাকে। টিউমারের কারণে সৃষ্টি হওয়া মাথা ব্যথার সঙ্গে প্রায়ই বমি, দৃষ্টিশক্তির সমস্যা, ভারসাম্যহীনতা, এবং শারীরিক দুর্বলতা হয়ে থাকে।
দাঁতের সমস্যা: দাঁতের স্নায়ু বা গাম ইনফেকশনের কারণে মুখ ও মাথায় ব্যথা ছড়িয়ে পড়তে পারে। যেমন, ডেন্টাল অ্যাবসেস বা দাঁতের শিকড়ের সংক্রমণ হলে ব্যথা শুধু দাঁতেই সীমাবদ্ধ থাকে না, এটি গাল, কান ও মাথায়ও ছড়াতে পারে। দাঁতের সংক্রমণ অনেক সময় মাথার একপাশে বা সামনের অংশে তীব্র ব্যথা সৃষ্টি করে। তাছাড়া দাঁতের ম্যালঅক্লুশন বা দাঁত ঠিকমতো বসতে না পারার কারণে যখন চাপ পড়ে, তখন চোয়ালের পেশি ও মাথায় টান অনুভূত হতে পারে, যা মাথা ব্যথার কারণ হয়।
চোখের সমস্যা (যেমন, গ্লুকোমা): চোখের মাংসপেশির অতিরিক্ত কাজ বা দৃষ্টির সমস্যা (Refractive Errors) যেমন মায়োপিয়া বা হাইপারমেট্রোপিয়া থাকলে, চোখ কে একটু বেশি কাজ করতে হয়, যা মাথা ব্যথার কারণ হতে পারে। এছাড়াও, গ্লুকোমা নামে পরিচিত চোখের চাপ বেড়ে যাওয়ার মত সমস্যা মাথা ব্যথার অন্যতম কারণ হতে পারে। গ্লুকোমার কারণে চোখের অভ্যন্তরীণ চাপ বেড়ে যায়, যা মাথার সামনের দিকে ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে এবং এর সঙ্গে দৃষ্টি শক্তি হ্রাস ও চোখে ব্যথা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, চোখের সমস্যা জনিত মাথা ব্যথা সাধারণত দিন শেষে বাড়ে, যখন চোখ দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করে (৪)।
মস্তিষ্কে আঘাত (ট্রমা): মস্তিষ্কে আঘাতের ফলে মস্তিষ্কের টিস্যুতে স্ফীতি, রক্তক্ষরণ বা স্নায়বিক ক্ষতি হতে পারে, যা মাথায় তীব্র ব্যথার সৃষ্টি করে। সাধারণত আঘাতের পরপরই মাথা ব্যথা শুরু হয় এবং এটি তীব্র থেকে মৃদু পর্যায়ে হতে পারে। তাছাড়া, এই ধরনের মাথা ব্যথা দীর্ঘ সময় ধরে হতে পারে এবং এটি পোস্ট-ট্রমাটিক হেডেক (Post-Traumatic Headache) নামে পরিচিত। মাথা ব্যথার সঙ্গে ঘন ঘন বমি, বমি বমি ভাব, বমি হওয়া, মাথা ঘোরা, দৃষ্টিশক্তির সমস্যা, এবং মেমোরি বা আচরণগত পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, মস্তিষ্কে আঘাত জনিত মাথা ব্যথা সাধারণত আঘাতের পরের দিনগুলো তে সবচেয়ে বেশি তীব্র হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে এটি দীর্ঘ মেয়াদি হতে পারে (৫)।
মেনিনজাইটিস: মেনিনজাইটিসের ধারাবাহিক ভাবে তীব্র মাথা ব্যথা দেখা দেয়, যা অন্যান্য সাধারণ মাথা ব্যথার তুলনায় অনেক বেশি মাত্রায় তীব্র এবং সহ্য করা কঠিন হয়। এই ব্যথা প্রায়ই মাথার পুরো অংশে ছড়িয়ে পড়ে এবং সঙ্গে প্রচন্ড জ্বর, ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া, বমি বমি ভাব, বমি হওয়া এবং আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা থাকতে পারে। মেনিনজাইটিসের কারণে সৃষ্ট মাথা ব্যথা সাধারণত হঠাৎ করে শুরু হয় এবং দ্রুত অবস্থার অবনতি ঘটতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, মেনিনজাইটিসের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের ঝিল্লির প্রদাহ মস্তিষ্কের চাপ বাড়ায়, যা থেকে এই তীব্র মাথা ব্যথা দেখা দেয় (৬)।
অনিদ্রা বা ঘুমের অভাব: পর্যাপ্ত ঘুমের সময় না পাওয়ার ফলে শরীর ও মস্তিষ্কে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়, যা মাথা ব্যথার কারণ হতে পারে। দীর্ঘ সময় ধরে ঘুমের অভাবে মস্তিষ্কের স্নায়বিক কার্যকলাপ ব্যাহত হয়, যা প্রাথমিক ভাবে মাথায় ব্যথা সৃষ্টি করে। বিশেষত, টেনশন টাইপ হেডেক এবং মাইগ্রেন ঘুমের অভাবের কারণে তীব্রতর হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ঘুমের ব্যাঘাত মস্তিষ্কের ব্যথা সংবেদনশীলতা বাড়ায়, ফলে মাথা ব্যথা বাড়তে থাকে (৭)। ঘুমের অভাবে শরীরের স্ট্রেস হরমোন করটিসলের স্তর বেড়ে যায়, যা মস্তিষ্কে অতিরিক্ত উত্তেজনা সৃষ্টি করে এবং এটি মাথা ব্যথার অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করে।
মাথার তালুতে ব্যথা হলে করনীয়
মাথার তালুতে ব্যথা বিভিন্ন কারণে হতে পারে, যেমন টেনশন, সাইনাসের সমস্যা, মাইগ্রেন, ত্বকের সংক্রমণ, আঘাত বা চুলের গোড়ার প্রদাহ। ব্যথার ধরন এবং কারণ বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। মাথার তালুতে ব্যথা হলে নিচের কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে:
বিশ্রাম: দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করা, মানসিক চাপ, বা পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবের কারণে মাথার পেশিগুলো তে টান পড়ে, যা ব্যথার সৃষ্টি করে। এ ধরনের ব্যথা উপশমের জন্য সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলো বিশ্রাম নেওয়া। মাথা ব্যথার সময় কোনো কাজ থেকে বিরতি নেওয়া, নীরব ও অন্ধকার ঘরে শুয়ে বিশ্রাম করা ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। পর্যাপ্ত ঘুম নেওয়া এবং শিথিল করণ পদ্ধতি যেমন ধ্যান বা শ্বাস-প্রশ্বাসের নিয়ন্ত্রণ করা, মানসিক চাপ কমায় এবং ব্যথা থেকে মুক্তি দেয়। বিশ্রাম মস্তিষ্কের অতিরিক্ত কার্যকলাপ হ্রাস করে, যা মাথার তালুর ব্যথা কমাতে সহায়ক হয়। তাই মাথার তালুতে ব্যথা হলে দ্রুত কাজ থেকে বিরতি নিয়ে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিশ্চিত করা উচিত।
চুলের যত্ন: খুব টাইট করে চুল বাঁধা বা চুলে অতিরিক্ত স্টাইলিং পণ্য ব্যবহার করার ফলে চুলের গোড়ায় চাপ পড়ে, যা মাথার তালুতে ব্যথার কারণ হতে পারে। এই ধরনের ব্যথা কমানোর জন্য চুলকে ঢিলে করে বাঁধা উচিত এবং খুব বেশি চুলের পণ্য ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন। এছাড়া, নিয়মিত চুল পরিষ্কার রাখা এবং মৃদু শ্যাম্পু ব্যবহার করা উচিত, যাতে মাথার ত্বকে কোনো ধরনের সংক্রমণ বা প্রদাহ সৃষ্টি না হয়। মাথার তালুতে ব্যথা হলে চুলে হালকা ম্যাসাজ করা উপকারী হতে পারে, কারণ এটি রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে এবং পেশির টান কমাতে সাহায্য করে।
পানি শূন্যতা এড়ানো: অনেক সময় শরীরে পর্যাপ্ত পানি না থাকার কারণে মাথার ত্বকের পেশিগুলো সংকুচিত হয়ে যায় এবং রক্ত সঞ্চালনে ব্যাঘাত ঘটে, যা মাথার তালুতে ব্যথার কারণ হতে পারে। দেহের আর্দ্রতা বজায় রাখতে প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করা জরুরি, কারণ পানির অভাব দেহের বিভিন্ন কার্যক্রমে সমস্যা সৃষ্টি করে এবং মাথা ব্যথার সম্ভাবনা বাড়ায়। বিশেষ করে গরম আবহাওয়ায় বা দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করার সময় শরীর থেকে অনেক বেশি পানি বেরিয়ে যায়, যা দ্রুত পূরণ করা উচিত।
পানি শূন্যতা এড়াতে সারা দিনে নিয়মিত ভাবে পানি পান করা এবং পানিযুক্ত ফলমূল খাওয়া দরকার। মাথার তালুতে ব্যথা অনুভব করলে শরীরকে হাইড্রেটেড রাখলে ব্যথা কমে যেতে পারে। পর্যাপ্ত পানি পান করার মাধ্যমে শরীরের আর্দ্রতা বজায় রাখা শুধু মাথা ব্যথা নয়, শরীরের সামগ্রিক সুস্থতার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ফিজিওথেরাপি বা ম্যানুয়াল থেরাপি: মাথার তালুতে ব্যথা হলে ফিজিওথেরাপি বা ম্যানুয়াল থেরাপি একটি কার্যকরী উপায় হতে পারে, বিশেষত যদি ব্যথার কারণ হয় পেশির টান বা মানসিক চাপ। ম্যানুয়াল থেরাপির পেশিগুলো কে শিথিল করে এবং রক্ত সঞ্চালন বাড়িয়ে ব্যথা উপশম করতে সাহায্য করে। একজন ফিজিওথেরাপিস্ট প্রথমে মাথার পেশির টান বা সংকোচন চিহ্নিত করে এবং সেই অনুযায়ী ম্যাসাজ, স্ট্রেচিং এবং শিথিলকরণ পদ্ধতি ব্যবহার করে। হালকা ম্যাসাজ এবং বিভিন্ন স্ট্রেচিং কৌশল অনুশীলন মাথার তালুর পেশিগুলো কে শিথিল করে এবং মাথার ব্যথা কমাতে সহায়তা করে।
এছাড়া, ফিজিওথেরাপি মানসিক চাপজনিত মাথা ব্যথা বা দীর্ঘ সময় ধরে বসে কাজ করার ফলে হওয়া মাথা ব্যথা নিয়ন্ত্রণে খুবই উপকারী। নিয়মিত ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার মাধ্যমে কেবল ব্যথাই উপশম হয় না, বরং এটি মাথার পেশিগুলোর স্থায়ীভাবে শিথিলতা এবং আরাম নিশ্চিত করে, যা দীর্ঘমেয়াদে ব্যথার পুনরাবৃত্তি কমাতে সাহায্য করে। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল, প্রাইভেট চেম্বার, ক্লিনিকসহ ছোট-বড় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ফিজিওথেরাপি বা ম্যানুয়াল থেরাপির চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। তবে, সঠিক রোগ নির্ণয়ের জন্য অবশ্যই একজন গ্র্যাজুয়েট ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
বর্তমানে বাংলাদেশে বিভিন্ন ফিজিওথেরাপি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ASPC ম্যানিপুলেশন থেরাপি সেন্টার (House #U64, Noorjahan Road, Mohammadpur, Dhaka-1207) একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান হিসেবে শুধুমাত্র ম্যানুয়াল থেরাপির মাধ্যমে রোগীদের সেবা প্রদান করে। তারা Structural Diagnosis & Management (SDM) টেকনিকের ভিত্তিতে রোগীর অবস্থা অনুযায়ী কারেকশন থেরাপি প্রদান করে, যার ফলে রোগীরা দ্রুত এবং সর্বোচ্চ সুস্থতা অর্জন করে থাকেন।
চিকিৎসকের পরামর্শ: অনেক সময় মাথার তালুর ব্যথা গুরুতর কোনো শারীরিক সমস্যা বা আঘাতের ইঙ্গিত হতে পারে, যেমন স্নায়বিক সমস্যা, মাথার ত্বকের সংক্রমণ, বা মাইগ্রেন। চিকিৎসক ব্যথার সঠিক কারণ নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারেন, যেমন শারীরিক পরীক্ষা, রক্ত পরীক্ষা, বা স্ক্যানিং।
বিশেষত, যদি মাথার তালুর ব্যথার সঙ্গে অন্যান্য উপসর্গ যেমন মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব, ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া বা দৃষ্টিশক্তির সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া উচিত। চিকিৎসক সঠিক ভাবে কারণ নির্ণয় করে প্রয়োজনীয় ওষুধ বা থেরাপি দিয়ে ব্যথা উপশম করতে সাহায্য করতে পারেন। ব্যথা উপেক্ষা করা বা বাড়িতে নিজেই চিকিৎসা করার চেয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য নিরাপদ এবং কার্যকর।
তথ্যসূত্র
- Olesen, J., Gustavsson, A., Svensson, M., Wittchen, H.U., Jönsson, B., CDBE2010 Study Group and European Brain Council, 2012. The economic cost of brain disorders in Europe.European journal of neurology, 19(1), pp.155-162. https://onlinelibrary.wiley.com/doi/abs/10.1111/j.1468-1331.2011.03590.x
- Bellussi, L.M., Passali, F.M., Ralli, M., Vincentiis, M.D.E., Greco, A. and Passali, D., 2019. An overview on upper respiratory tract infections and bacteriotherapy as innovative therapeutic strategy.European Review for Medical and Pharmacological Sciences, 23(1), pp.27-38. https://iris.uniroma1.it/handle/11573/1412742
- Jensen, R. and Stovner, L.J., 2008. Epidemiology and comorbidity of headache.The Lancet Neurology, 7(4), pp.354-361. https://www.thelancet.com/article/S1474-4422(08)70062-0/abstract
- Sheedy, J.E., Hayes, J. and Engle, A.J., 2003. Is all asthenopia the same?.Optometry and vision science, 80(11), pp.732-739. https://journals.lww.com/optvissci/fulltext/2003/11000/Is_all_Asthenopia_the_Same_.8.asp
- Theeler, B.J., Mercer, R. and Erickson, J.C., 2008. Prevalence and impact of migraine among US Army soldiers deployed in support of Operation Iraqi Freedom.Headache: The Journal of Head and Face Pain, 48(6), pp.876-882. https://headachejournal.onlinelibrary.wiley.com/doi/abs/10.1111/j.1526-4610.2008.01159.x
- van de Beek, D., Cabellos, C., Dzupova, O., Esposito, S., Klein, M., Kloek, A.T., Leib, S.L., Mourvillier, B., Ostergaard, C., Pagliano, P. and Pfister, H.W., 2016. ESCMID guideline: diagnosis and treatment of acute bacterial meningitis.Clinical microbiology and infection, 22, pp.S37-S62. https://www.clinicalmicrobiologyandinfection.com/article/S1198-743X(16)00020-3/fulltext
- Rains, J. C., & Poceta, J. S. (2015). Headache and sleep disorders: review and clinical implications for headache management. Headache: The Journal of Head and Face Pain, 45(5), 598-609. https://headachejournal.onlinelibrary.wiley.com/doi/abs/10.1111/j.1526-4610.2006.00578.x