আপনার ঘাড় ও কাঁধে ব্যাথা। ঘাড় ও কাঁধে ব্যথা একটি শারীরিক সমস্যা যা বিভিন্ন কারণে হতে পারে। অধিকাংশ সময় এটি পেশির টান, দীর্ঘ সময় ধরে একই অবস্থানে বসে থাকা, ভারী ওজন উত্তোলন বা অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে শোওয়ার কারণে ঘটে। ঘাড়ের ব্যথা সাধারণত কাঁধে ছড়িয়ে পড়ে এবং কখনো কখনো হাতেও পৌঁছাতে পারে।
ঘাড়ের কারণে কাঁধে ব্যাথা
ঘাড়ের সমস্যা থেকে কাঁধে ব্যাথা হতে পারে। ঘাড়ের পেশি, নার্ভ বা হাড়ের কোনো ক্ষতি বা চাপের কারণে এই ব্যথা কাঁধ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিশেষ করে সার্ভাইকাল স্পন্ডাইলোসিস বা ডিস্কের সমস্যার কারণে ঘাড়ের নার্ভে চাপ পড়লে সেই ব্যাথা কাঁধে অনুভূত হয়। ঘাড়ের সঠিক সাপোর্ট না থাকা, দীর্ঘ সময় ধরে মোবাইল বা কম্পিউটার ব্যবহার করা অথবা ঘুমানোর সময় ভুল ভঙ্গি এই সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায়। কাঁধে ব্যাথা হলে হাত উঠানো বা নড়াচড়া করাও কষ্টকর হয়ে যায় এবং কখনো কখনো এটি হাতের নিচের অংশ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে। (1)
ঘাড় থেকে হাতে ব্যাথা
ঘাড় থেকে হাতে ব্যাথা সাধারণত সার্ভাইকাল রেডিকুলোপ্যাথি নামে পরিচিত। এই সমস্যায় ঘাড়ের হাড়, ডিস্ক বা নার্ভে চাপ পড়ার কারণে ব্যথা ঘাড় থেকে কাঁধ হয়ে হাতে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে, ঘাড়ের ডিস্ক বা হাড়ের পরিবর্তনের ফলে নার্ভে চাপ সৃষ্টি হলে ব্যথা, ঝিঁঝিঁ ধরা বা অসাড়তার অনুভূতি হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে, সার্ভাইকাল স্পন্ডাইলোসিস বা ডিস্ক হার্নিয়েশনের কারণে এই ব্যাথা হতে পারে। (2)
ঘাড়ের ডান পাশে ব্যাথা
ঘাড়ের ডান পাশে ব্যাথা সাধারণত পেশির টান, দীর্ঘক্ষণ একই ভঙ্গিতে বসে থাকা বা ঘাড়ে আঘাতের কারণে হয়ে থাকে। ঘাড়ের ডান পাশে পেশির অস্বস্তি বা ব্যাথা অনেক সময় তীব্র হতে পারে, যা মাথা ঘোরানো বা দৈনন্দিন কাজ করার সময় আরও বেড়ে যায়। এছাড়া সার্ভাইকাল স্পন্ডাইলোসিস, সার্ভাইকাল ডিস্ক হার্নিয়েশন বা নার্ভে চাপ পড়ার মতো সমস্যাগুলিও ঘাড়ের ডান পাশে ব্যাথার একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে।
ঘাড়ের বাম পাশে ব্যাথার কারণ
ঘাড়ের বাম পাশে ব্যথার বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ রয়েছে। সাধারণত পেশির টান, পেশির ওপর অতিরিক্ত চাপ বা দীর্ঘক্ষণ একই ভঙ্গিতে বসে থাকার ফলে এই ব্যথা হতে পারে। এছাড়া, নিম্নলিখিত কারণগুলোও বাম পাশের ঘাড়ে ব্যথার জন্য দায়ী হতে পারে
আপনার ঘাড় ও কাঁধে ব্যাথা
পেশির টান বা স্ট্রেন: সাধারণত অতিরিক্ত চাপ, ভুল ভঙ্গিতে ঘুমানো অথবা দীর্ঘ সময় ধরে একদিকে বসে থাকার ফলে ঘটে। মোবাইল বা কম্পিউটার ব্যবহার করার সময় ঘাড়কে একই অবস্থানে ধরে রাখলে পেশিগুলোতে চাপ পড়ে, যা পেশির টান সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়াও ভারী ব্যাগ বহন করা বা হঠাৎ কোনো তীব্র নড়াচড়া করার ফলেও পেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। পেশির টানের কারণে ঘাড়ের বাম পাশে ব্যথা তীব্র হতে পারে এবং তা অনেক সময় মাথা ও কাঁধেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
হঠাৎ ঘাড় ব্যাথার কারণ
নার্ভ কম্প্রেশন (সার্ভাইকাল রেডিকুলোপ্যাথি): ঘাড়ের হাড় বা ডিস্কের পরিবর্তনের কারণে নার্ভে চাপ পড়ে, যার ফলে ব্যথা ঘাড়ের বাম পাশে অনুভূত হয় এবং তা কাঁধ ও হাতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সার্ভাইকাল ডিস্ক হার্নিয়েশন বা স্পন্ডাইলোসিসের মতো সমস্যাগুলিও এই চাপের কারণ হতে পারে। নার্ভ কম্প্রেশন হলে ব্যথার পাশাপাশি ঝিঁঝিঁ ধরা, অসাড়তা, বা পেশিতে দুর্বলতার অনুভূতি হতে পারে।
আঘাত বা আঘাতজনিত সমস্যাগুলি: গাড়ি দুর্ঘটনা বা কোনো ভারী বস্তু দ্বারা আঘাত লাগার কারণে ঘাড়ের পেশি, লিগামেন্ট, বা হাড় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বিশেষ করে ‘হুইপল্যাশ’ ধরনের আঘাত, যেখানে ঘাড় দ্রুত সামনে-পেছনে চলে যায়, এটি পেশি এবং নার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি করে, যার ফলে বাম পাশে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। এছাড়াও, খেলাধুলা বা শারীরিক কার্যকলাপের সময় ঘাড়ে আঘাত লাগলে পেশি ফেটে যেতে পারে বা স্নায়ুতে ক্ষতি হতে পারে। আপনার মাথা ব্যাথা হলে করণীয়
অস্টিওআর্থ্রাইটিস বা সার্ভাইকাল স্পন্ডাইলোসিস: বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে ঘাড়ের হাড় ও সংলগ্ন ডিস্কগুলিতে ক্ষয় হতে থাকে, যা সার্ভাইকাল স্পন্ডাইলোসিস নামে পরিচিত। এই অবস্থায় হাড়ের প্রান্তে অতিরিক্ত হাড় গজাতে পারে, যা নার্ভে চাপ সৃষ্টি করে ব্যথার কারণ হয়। অস্টিওআর্থ্রাইটিসের কারণে ঘাড়ের জয়েন্টগুলিতে ইনফ্লেমেশন বা প্রদাহ দেখা দেয়, যা ঘাড়ের বাম পাশে তীব্র ব্যথার সৃষ্টি করতে পারে। এই ব্যথা কাঁধ ও হাতে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং মাথা ঘোরানো বা দৈনন্দিন কাজ করতে অসুবিধা হতে পারে।
ঘাড় ব্যাথা কিসের লক্ষণ
পেশির শক্ত হওয়া (Muscle Spasm): ঘাড়ের পেশি অতিরিক্ত পরিশ্রম বা অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে দীর্ঘ সময় ধরে থাকলে পেশি শক্ত হয়ে যায়। দীর্ঘক্ষণ মোবাইল বা কম্পিউটার ব্যবহার, সঠিক ভঙ্গি না মেনে বসা, অথবা ঘুমানোর সময় ঘাড়ের সঠিক সমর্থন না থাকার ফলে এই সমস্যাটি দেখা দিতে পারে। পেশির শক্ত হয়ে যাওয়ার কারণে ঘাড়ের বাম পাশে ব্যথা তীব্র হতে পারে, এবং কখনও কখনও মাথা, কাঁধ বা উপরের পিঠেও ব্যথা ছড়িয়ে পড়তে পারে।
ঘাড় ব্যাথার প্রতিকার
ঘাড়ের ব্যথা উপশমের জন্য বিভিন্ন প্রতিকার এবং ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। ব্যথার তীব্রতা এবং কারণ অনুযায়ী প্রতিকারগুলো ভিন্ন হতে পারে। নিচে ঘাড়ের ব্যথার কিছু সাধারণ প্রতিকার উল্লেখ করা হলো:
বিশ্রাম: ঘাড়ের পেশি বা নার্ভে অতিরিক্ত চাপ পড়ে, তখন পেশিগুলোকে আরাম দিতে এবং শরীরকে সেরে ওঠার সুযোগ দিতে বিশ্রাম অপরিহার্য। ঘাড়ের ব্যথা হলে কিছু সময়ের জন্য শারীরিক কাজকর্ম থেকে বিরতি নেওয়া উচিত, বিশেষত এমন কাজ যা ঘাড়ের ওপর চাপ ফেলে। বিশ্রাম নেয়ার সময় আরামদায়ক বালিশ ব্যবহার করা উচিত যাতে করে ঘাড়ের উপর অতিরিক্ত চাপ না পরে।
গরম বা ঠান্ডা সেঁক: ঠান্ডা সেঁক প্রদাহ বা ইনফ্লেমেশন কমাতে সাহায্য করে, বিশেষত আঘাতের পর বা তীব্র ব্যথার ক্ষেত্রে। ঠান্ডা সেঁক ব্যথার অনুভূতি কমিয়ে পেশিগুলোর শিথিলতা বাড়ায়। এটি সাধারণত ব্যথা শুরু হওয়ার ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কার্যকর। অন্যদিকে, গরম সেঁক পেশি শিথিল করতে, রক্ত সঞ্চালন বাড়াতে এবং কঠিন পেশিগুলোকে নরম করতে সহায়ক হয়। গরম সেঁক দীর্ঘমেয়াদী ব্যথা বা পেশির টান কমাতে সাহায্য করে।
ঘাড়ের সঠিক অবস্থান বজায় রাখা: বিশেষ করে যারা কম্পিউটার বা মোবাইল দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহার করেন, তাদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা বেশি দেখা যায়। পিঠ সোজা রেখে ঘাড় এবং মাথা নিরপেক্ষ অবস্থায় থাকতে হবে, যাতে মেরুদণ্ডে কোনো অতিরিক্ত চাপ না পড়ে। চেয়ারের উচ্চতা এমন হতে হবে যাতে ঘাড়কে সামনে বা পেছনে না ঝুঁকিয়ে চোখের সমান উচ্চতায় স্ক্রিন দেখা যায়। এছাড়া, মাঝে মাঝে বিরতি নিয়ে একটু হাঁটাচলা করা উচিত, যাতে পেশির উপর চাপ কমে এবং রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক থাকে।
ব্যথানাশক ওষুধ: বিশেষত তীব্র ব্যথা বা প্রদাহ কমাতে প্যারাসিটামল বা ইবুপ্রোফেন জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা হয়। এই ওষুধগুলো দ্রুত ব্যথা কমাতে সাহায্য করে এবং ঘাড়ের পেশি ও নার্ভে যে চাপের কারণে ব্যথা হচ্ছে, তা প্রশমিত করে। ইবুপ্রোফেন বা ন্যাপ্রোক্সেনের মতো নন-স্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ড্রাগ (NSAIDs) প্রদাহ কমিয়ে ব্যথা উপশম করে এবং অনেক ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক আরাম দেয়। ব্যথানাশক ওষুধ ব্যবহারের আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত, বিশেষ করে যদি ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হয় বা অন্যান্য উপসর্গ দেখা দেয়।
ফিজিওথেরাপি: ঘাড়ের ব্যথা উপশমে ফিজিওথেরাপি অত্যন্ত কার্যকর একটি পদ্ধতি। ফিজিওথেরাপি মূলত ব্যথা কমানো, পেশির নমনীয়তা বৃদ্ধি, এবং ঘাড়ের শক্তি পুনরুদ্ধারের জন্য বিশেষ ধরনের ব্যায়াম এবং থেরাপি ব্যবহার করে। একজন স্নাতক ডিগ্রিধারী ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞ প্রথমে রোগীর ব্যথার কারণ চিহ্নিত করে উপযুক্ত ব্যায়াম নির্ধারণ করেন। এই ব্যায়ামগুলো পেশি শিথিল করতে, নার্ভে চাপ কমাতে, এবং ঘাড়ের চলনক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক হয়।
ফিজিওথেরাপি সেশনগুলোতে হালকা স্ট্রেচিং, ঘাড়ের পেশির শক্তি বাড়ানোর ব্যায়াম, এবং ঘাড়ের অবস্থানের উন্নতি নিয়ে কাজ করা হয়। ঢাকার মোহাম্মদপুরে অবস্থিত ASPC ম্যানিপুলেশন থেরাপি সেন্টার একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান, যেখানে ম্যানুয়াল থেরাপির মাধ্যমে রোগীদের সেবা দেওয়া হয়। এখানে Structural Diagnosis & Management (SDM) পদ্ধতি ব্যবহার করে রোগীর শারীরিক অবস্থা মূল্যায়ন করা হয় এবং সংশোধনমূলক থেরাপি প্রদান করা হয়, যা দ্রুত আরাম ও নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
তথ্যসূত্র
- Binder, A.I., 2007. Cervical spondylosis and neck pain. Bmj, 334(7592), pp.527-531. https://www.bmj.com/content/334/7592/527.full-text
- Iyer, S. and Kim, H.J., 2016. Cervical radiculopathy. Current reviews in musculoskeletal medicine, 9, pp.272-280. https://link.springer.com/article/10.1007/s12178-016-9349-4
- ডিজেনারেটিভ ডিস্ক রোগ কি? - November 3, 2024
- কোমর ব্যথার কারণ | যেভাবে মহিলারা কোমর ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে পারেন - October 30, 2024
- বর্তমান সময়ে মাথা ব্যাথা কোন রোগের লক্ষণ - October 28, 2024