লাম্বার স্পন্ডাইলোসিস হলো মেরুদণ্ডের নিচের অংশের (কোমরের) অস্টিওআর্থ্রাইটিস (হাড় ক্ষয়), যা মেরুদণ্ডের ডিস্ক এবং জয়েন্ট গুলির ক্ষয় জনিত পরিবর্তনের কারণে হয়। সাধারণত এটি বয়স্কদের মধ্যে দেখা যায় এবং কোমর ব্যথা ও অন্যান্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

স্পন্ডাইলোসিস এর লক্ষণ গুলো কি কি?/ লাম্বার স্পন্ডাইলোসিস কতটা ক্ষতিকর?

এটি বিভিন্ন স্থানে হতে পারে, যেমন সারভাইক্যাল (ঘাড়ে), থোরাসিক (মধ্য পিঠে) এবং লাম্বার (কোমরে)। এই রোগ টি বিভিন্ন উপসর্গের মাধ্যমে রোগীর জীবনে উল্লেখ যোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে। এর ক্ষতিকর প্রভাব গুলো নিম্নে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা হলো:

১. কোমর ব্যথা কোমরে দীর্ঘদিন ধরে ব্যথা হয়, যা বসা, দাঁড়ানো বা হাঁটার সময় বেড়ে যায়। মাঝে মাঝে হঠাৎ তীব্র ব্যথা হতে পারে, যা কোনো কিছু কিছু কাজের ক্ষেত্রে বৃদ্ধি পায়।

২. স্নায়বিক উপসর্গ কোমর থেকে পা পর্যন্ত অবশ ভাব বা ঝিঁঝিঁ ভাব হতে পারে, যা সাধারণত সায়াটিকা নামে পরিচিত। পেশী গুলো দূর্বল লাগতে পারে, বিশেষ করে পায়ের পেশী।

৩. জয়েন্টের কার্য কারিতা হ্রাসামনের দিকে ঝোকা বা ডানে বামে ঘোরার শক্তি কমে যেতে পারে। কোমরের মেরুদন্ড স্থিরতা এবং শক্ত ভাব থাকতে পারে।

৪. মাংস পেশি টাইট কোমরের পেশী সমূহ টাইট হয়ে যায়, যা ব্যথা ও অস্বস্তি বা যন্ত্রণা বাড়ায়। পিঠের পেশী গুলো শক্ত হয়ে যেতে পারে এবং ধরলে ব্যথা হতে পারে।

৫. অন্যান্য উপসর্গ হাঁটা চলার সময় ব্যথা বৃদ্ধি পেতে পারে, যার ফলে হাঁটা চলায় অসুবিধা হতে পারে। দীর্ঘ সময় বসা বা দাঁড়ানো তে ব্যথা বাড়তে পারে, যা প্রতিদিনের কাজে অসুবিধা সৃষ্টি করে। সামনে ঝুকে কাজ করতে বা ভারী ওজন তুলতে তীব্র ব্যথা অনুভূত হতে পারে।

লাম্বার স্পন্ডাইলোসিস চিকিৎসা ও প্রতিকার

স্পন্ডালোসিস এর জন্য বিভিন্ন চিকিৎসা এবং প্রতিকার পদ্ধতি আছে, যা রোগীর অবস্থার উপর নির্ভর করে নির্ধারণ করা হয়। যেমন – ওষুধের চিকিৎসা, ফিজিওথেরাপী বা কারেকশন থেরাপী চিকিৎসা ও অপারেশন। এখানে স্পন্ডাইলোসিস এর চিকিতসা পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-

ঔষধ

ব্যথা কমাতে সাধারণ ব্যথা নাশক ঔষধ ব্যবহার করা যেতে পারে, যেমন- আইবুপ্রোফেন বা এসিটামিনোফেন। বিশেষ প্রয়োজনে প্রদাহ কমাতে এবং ব্যথা নিয়ন্ত্রণে স্টেরয়েড ইনজেকশন দেওয়া যেতে পারে।

ফিজিওথেরাপি

শারীরিক ব্যায়াম: পেশী শক্তি ও নমনীয়তা বাড়াতে এবং ব্যথা কমাতে শারীরিক ব্যায়াম কার্যকর হতে পারে।

ম্যানুয়াল থেরাপি বা কারেকশন থেরাপি- লাম্বার স্পন্ডাইলোসিসের চিকিৎসার ক্ষেত্রে কারেকশন থেরাপি গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ম্যানুয়াল থেরাপি পেশী ও জয়েন্টের ব্যথা কমাতে ও কার্য কারিতা উন্নত করতে সহায়ক। বিশ্বে্র উন্নত দেশ গুলো তে কারেকশন থেরাপির বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে লাম্বার স্পন্ডাইলোসিসের চিকিৎসা করে থাকে। উন্নত বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশে এএসপিসি ম্যানিপুলেশন থেরাপি সেন্টারে এস ডি এম (স্ট্রাকচারাল ডায়াগনো্সিস এন্ড ম্যানেজমেন্ট) টেকনিকে সম্পূর্ন ম্যানুয়াল থেরাপির মাধ্যমে লাম্বার স্পন্ডাইলোসিসের চিকিৎসা করা হয়। এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে অল্প দিনের মধ্যেই দ্রুত রোগীর ব্যথা কমে যায় এবং পুনরায় ব্যথা ফিরে আসার ঝুকি অনেকংশেই কম থাকে। স্ট্রোকের ঝুঁকিতে কারা আছেন?

জীবনযাত্রার পরিবর্তন

স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা মেরুদণ্ডের উপর চাপ কমাতে সহায়ক। সঠিক ভংগিতে বসা এবং মেরুদণ্ডের উপর অতিরিক্ত চাপ এড়িয়ে চলা উচিৎ।

শল্য চিকিৎসা

গুরুতর ক্ষেত্রে এবং অন্যান্য চিকিৎসায় রোগীর ব্যথা যদি না কমে তাহলে অপারেশন করা লাগতে পারে। সাধারণত লাম্বার স্পন্ডাইলোসিসের রোগীর শরীরে চার টি লক্ষণ  থাকলে ডাক্তার অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দিতে পারেন। যেমন

  • পায়ের গোড়ালীতে ভর দিয়ে হাঁটতে না পারা।
  • পায়ের পাতায় ভর দিয়ে হাঁটতে না পারা।
  • প্রস্রাব ধরে না রাখতে পারা।
  • পায়খানা ধরে রাখতে না পারা।

সর্বাধিক সঞ্চালিত কিছু সার্জারির মধ্যে রয়েছে:

ল্যামিনেক্টমি এ পদ্ধতি তে আপনার মেরুদণ্ড কে চাপ মুক্ত করার জন্য ল্যামিনা নামক ভার্টিব্রার একটি অংশ অপসারণ করা হয়।

মেরুদণ্ডের অস্টিওটমি মেরুদণ্ডের অস্টিওটমি এমন একটি প্রক্রিয়া যা আপনার মেরুদণ্ডের কাঠামোগত অস্বাভাবিকতা গুলি সংশোধন করতে ব্যবহৃত হয়।

মেরুদণ্ডের ফিউশন মেরুদণ্ডের ফিউশন এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে আপনার দুই বা ততোধিক কশেরুকা স্থায়ী ভাবে একসাথে জোড়া দেয়া হয়।

লাম্বার স্পন্ডিলোসিস হলে কি করা উচিত নয়?

লাম্বার স্পন্ডাইলোসিস কোমড়ের মেরুদণ্ডের একটি সাধারণ সমস্যা, যা প্রায়ই কোমর ব্যথা এবং অন্যান্য সমস্যার কারণে হয়। এই অবস্থায় কিছু নির্দিষ্ট কাজ এবং অভ্যাস এড়িয়ে চলা গুরুত্ব পূর্ণ, যাতে ব্যথা ও অস্বস্তি কমাতে সাহায্য করে এবং মেরুদণ্ড যাতে আর খারাপ না হয় সে ক্ষেত্রে সাহায্য করে। এখানে লাম্বার স্পন্ডাইলোসিস হলে কি করা উচিত নয় তা বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা হলো-

১। ভারী বস্তু উত্তোলন করা উচিত নয় ভারী বস্তু উত্তোলন করার সময় মেরুদণ্ডে মাত্রাতিরিক্ত চাপ পড়ে, যা কোমরের ব্যথা বাড়াতে পারে এবং মেরুদণ্ডের সমস্যা আরও গুরুতর হতে পারে। ভারী বস্তু উত্তোলন থেকে বিরত থাকুন জরুরী প্রয়োজনে সঠিক পদ্ধতি তে উঠান, যেমন- হাঁটু ভাঁজ করে বসে ভারী বস্তু উঠানো।

২। দীর্ঘ সময় বসে থাকা উচিত নয় যারা ঘণ্টার পর ঘন্টা বসে কাজ করেন তাদের ক্ষেত্রে মেরুদণ্ডের ডিস্ক গুলি তে চাপ বাড়ে, যার ফলে কোমর ব্যথা এবং অস্বস্তি বাড়তে পারে। সেক্ষেত্রে প্রতি ৩০-৬০ মিনিট অন্তর উঠে দাঁড়ান, হাঁটাচলা করুন এবং মেরুদণ্ডের স্ট্রেচিং এক্সারসাইজ করুন।

৩। ভুল ভঙ্গিতে বসা বা দাড়ানো ভুল ভঙ্গিতে বসা বা দাঁড়ানোর ফলে মেরুদণ্ডে অতিরিক্ত চাপ পড়ে এবং ব্যথা বাড়তে পারে। সঠিক ভঙ্গি বজায় রেখে বসা এবং দাঁড়ানোর অভ্যাস গড়ে তুলুন। মেরুদণ্ড সোজা রেখে চেয়ারে বসুন এবং পায়ের পাতা মাটি তে রাখুন।

৪। অত্যধিক শরীর চর্চা বা শক্তি শালী ব্যায়াম করা উচিত নয় অত্যধিক শরীর চর্চা বা শক্তিশালী ব্যায়াম মেরুদণ্ডের পেশী এবং জয়েন্ট গুলি তে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে পারে। হালকা এবং নিয়ন্ত্রিত এক্সারসাইজ, যেমন হাঁটা, স্ট্রেচিং, এবং হালকা এক্সাইর সাইজ করুন। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী এক্সাইর সাইজ করুন।

৫। এলো মেলো ভাবে ঘুমানো উচিত নয় ভুল ভঙ্গিতে ঘুমানোর ফলে মেরুদণ্ডের ব্যথা এবং অস্বস্তি বাড়তে পারে। সঠিক ভঙ্গিতে ঘুমান, যেমন পাশ ফিরে বা সোজা হয়ে ঘুমান। মেরুদণ্ডের স্বাভাবিক কার্ভ বজায় রাখতে সহায়ক বালিশ ব্যবহার করুন।

৬। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ব্যথানাশক ঔষধ ব্যবহার করা উচিত নয় চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ব্যথা নাশক ঔষধ দীর্ঘ মেয়াদী সেবন করলে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হতে পারে এমন কি আসল সমস্যার সমাধান নাও হতে পারে। ব্যথানাশক ঔষধ ব্যবহারের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং চিকিৎসকের নির্দেশনা মেনে ঔষধ গ্রহণ করুন।

৭। স্ট্রেস বা মানসিক চাপ বাড়ানো উচিত নয় স্ট্রেস এবং মানসিক চাপ পেশী সংকোচন এবং কোমর ব্যথা বাড়াতে পারে। মানসিক চাপ কমাতে মেডিটেশন, যোগব্যায়াম, এবং অন্যান্য রিল্যাক্সেশন টেকনিক ব্যবহার করুন।

লাম্বার স্পন্ডিলোসিস হলে কি হাঁটা উচিত?

লাম্বার স্পন্ডিলোসিসের ক্ষেত্রে নিয়মিত হাঁটা একটি গুরুত্ব পূর্ণ ব্যায়াম হতে পারে, যা পেশী শক্তি বৃদ্ধি, ব্যথা কমানো এবং মেরুদণ্ডের কার্যকারিতা উন্নত করতে সহায়ক। তবে, হাঁটার সময় কিছু বিষয় মনে রাখা জরুরি, যাতে মেরুদণ্ডে অতিরিক্ত চাপ না পড়ে। এখানে লাম্বার স্পন্ডাইলোসিস হলে কেন এবং কিভাবে হাঁটা উচিত তা বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা হলো

১. পেশীর শক্তি এবং স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি হাঁটার মাধ্যমে কোমরের এবং পায়ের পেশীগুলি শক্তিশালী হয়, যা মেরুদণ্ড কে সাহায্য করে। হাঁটা পেশী গুলির স্থিতিস্থাপকতা বাড়ায়, যা মেরুদণ্ডের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে।

২. ব্যথা কমানো এবং অস্বস্তি হ্রাহাঁটা রক্ত সঞ্চালন বাড়িয়ে দেয়, যা ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যু গুলি তে অক্সিজেন এবং পুষ্টি সরবরাহ করতে সহায়ক, ফলে ব্যথা কমে। নিয়মিত হাঁটার মাধ্যমে শরীরের প্রদাহ হ্রাস করা সম্ভব, যা ব্যথা এবং অস্বস্তি কমায়।

৩. মেরুদণ্ডের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা হাঁটা কোমরের পেশী গুলি কে শক্তিশালী করে, যা মেরুদণ্ডের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়ক। হাঁটা কোমরের এবং পায়ের জয়েন্ট গুলির কার্যকারিতা উন্নত করে, যার ফলে মেরুদণ্ডের স্বাভাবিক গতিশীলতা বজায় থাকে।

৪. মানসিক উপকারিতা হাঁটা মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ কমায়। নিয়মিত হাঁটার ফলে এন্ডোরফিন হরমোন নিঃসৃত হয়, যা মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করতে সহায়ক।

কিভাবে হাঁটা উচিত?

১. সঠিক ভঙ্গি বজায় রাখা হাঁটার সময় মেরুদণ্ড সোজা রেখে হাঁটুন এবং কাঁধের উপর চাপ না পড়ে এমন ভাবে চলাফেরা করুন। কোমর সোজা রেখে হাঁটুন এবং পা সমান ভাবে ফেলুন।

২. নিয়মিত বিরতি নেওয়া দীর্ঘ সময় ধরে হাঁটার পরিবর্তে মাঝে মাঝে বিরতি নিন এবং শরীর কে বিশ্রাম দিন। হাঁটার বিরতি তে হালকা স্ট্রেচিং ব্যায়াম করুন, যা পেশী শিথিল করতে সহায়ক।

৩. ধীরে ধীরে সময় এবং দূরত্ব বৃদ্ধি করা প্রথমে অল্প হাঁটুন এবং ধীরে ধীরে সময় ও দূরত্ব বৃদ্ধি করুন। আপনার শরীরের প্রতিক্রিয়া দেখুন এবং ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভব করলে তাত ক্ষণাৎ হাঁটা বন্ধ করুন।

৪. আরামদায়ক জুতা পরা হাঁটার সময় আরাম দায়ক এবং সাপোর্টিভ জুতা পরুন, যা পায়ের আরাম নিশ্চিত করে।

৫. হাঁটার পৃষ্ঠ সমতল এবং নরম পৃষ্ঠে হাঁটার চেষ্টা করুন, যেমন ঘাস বা ট্রেডমিলে হাঁটা।

তথ্যসূত্র

  1. Kalichman, L. and Hunter, D.J., 2007, October. Lumbar facet joint osteoarthritis: a review. In Seminars in arthritis and rheumatism (Vol. 37, No. 2, pp. 69-80). WB Saunders. https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S0049017207000224
  2. Chou, R. and Huffman, L.H., 2007. Nonpharmacologic therapies for acute and chronic low back pain: a review of the evidence for an American Pain Society/American College of Physicians clinical practice guideline. Annals of internal medicine, 147(7), pp.492-504. https://www.acpjournals.org/doi/abs/10.7326/0003-4819-147-7-200710020-00007
  3. Koes, B.W., Van Tulder, M. and Thomas, S., 2006. Diagnosis and treatment of low back pain. Bmj, 332(7555), pp.1430-1434. https://www.bmj.com/content/332/7555/1430.short
  4. Hayden, J., Van Tulder, M.W., Malmivaara, A. and Koes, B.W., 2005. Exercise therapy for treatment of non‐specific low back pain. Cochrane database of systematic reviews, (3). https://www.cochranelibrary.com/cdsr/doi/10.1002/14651858.CD000335.pub2/abstract
Dr. M Shahadat Hossain
Follow me

Physiotherapist, Pain, Paralysis & Manipulative Therapy Specialist, Assistant Professor Dhaka College of Physiotherapy, Secretary-General(BPA), Secretary(CARD), Chief Consultant(ASPC), Conceptual Inventor(SDM), Faculty Member(CRP), Member-Bangladesh Rehabilitation Council

পরামর্শ নিতে 01877733322