মানব শরীরের জটিলতম অঙ্গের মধ্যে পা এবং পায়ের পাতা অন্যতম। এই অংশটি ২৬ টা হাঁড়, ৩৩ টা জয়েন্ট এবং ১০০ ও বেশি মাংসপেশি দিয়ে গঠিত। আমাদের শরীরের সমস্ত ভার পা এবং পায়ের পাতার মাধ্যমে মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে। আর এই ভর পায়ের পাতায় সমান ভাবে বন্টনের এর কাজ করে আর্চ অব ফুট। আর্চ অব ফুট হচ্ছে পায়ের পাতার নিচের অংশে একটু কারভি বা ঢেউ খালানো অংশ। আর্চ অব ফুট স্বাভাবিকের তুলনায় কমে গেলে অথবা কম থাকলে তাকে ফ্ল্যাট ফুট বলে।চিকিৎসা বিজ্ঞানে ফ্ল্যাট ফুট কে প্লেছ প্লেনার্স বা ফলেন আর্চ নামেও পরিচিত। ফ্ল্যাট ফুট জনিত সমস্যার জন্য হাঁটাচলা করার সময় ভারসাম্যহীনতা এবং পায়ের গোড়ালি ও পাতায় ব্যথা হতে পারে।

ফ্ল্যাট ফুট কী?

পায়ের পাতার নিচের অংশটি যদি আমরা ভালোভাবে লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পারব মাঝখানটা একটু কারদি বা ঢেউ খেলা কিন্তু যাদের পায়ের পাতা নিচের অংশ একদম সমান, দাঁড়ালে বা পায়ের পাতার উপর ভর ফেললে পায়ের পাতা মাটির সাথে লেগে থাকে এই ধরনের পায়ের পাতাকে ফ্ল্যাট ফুট বলে। স্বাভাবিকভাবে একটি শিশু জন্মের সময় তার পায়ের পাতা সমান থাকে অর্থাৎ তাদের পায়ে কোন আর্চ বা ঢেউ খেলানোর অংশ থাকে না। আস্তে আস্তে বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে পায়ের পাতার আজ অফ ফুট তৈরি হতে থাকে এবং পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যে সম্পন্ন রূপে আর্চ অব ফুট গঠিত হয়ে যায়। তবে কারো কারো আর্চ অব ফুট গঠিত হয় না তাদেরই ফ্ল্যাট ফুটের সমস্যা হয়। প্রতি ১০০জন বাচ্চার মধ্যে ২০ জন বাচ্চা আর্চ অব ফুট গঠিত না হওয়ার ফলে প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় ফ্ল্যাট ফুট সমস্যায় ভুগে থাকে।

আসুন জেনে নেই ফ্ল্যাট ফুট কত প্রকার এবং কি কি

ফ্ল্যাট ফুট কত প্রকার এবং কি কি:

সাধারণত ফ্ল্যাট ফুট চার ধরনের হয়ে থাকে। যথাক্রমে:-

রিজিড ফ্ল্যাট ফুট: খুব কম সংখ্যক ফ্ল্যাট ফুট রিজিড ও ব্যথা যুক্ত হয়ে থাকে। এই ক্ষেত্রে পায়ের আর্চ সর্বদা অনুপস্থিত থাকে।অর্থাৎ দাঁড়িয়ে পায়ের উপর ভর বহন করা কিংবা ভর হীন অবস্থায় বসে বা শুয়ে থাকলেও পায়ের আর্চ কোন পরিবর্তন ঘটে না।

ফ্লেক্সিবল ফ্ল্যাট ফুট: সাধারণত এই প্রকারের ফ্ল্যাট ফুট সর্বাধিক লক্ষ করা যায়। সাধারণত বড়হীন অবস্থায় পায়ের পাতার আর্চ স্বাভাবিক থাকে কিন্তু দাঁড়ালে অথবা পায়ের পাতায় ভর দিলে পায়ের পাতার আর্চ সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত থাকে।ফ্লেক্সিবল ফ্ল্যাট ফুট দুই পায়েই হতে পারে এবং সময়ের সাথে সাথে পায়ের টেন্ডন এবং লিগামেন্টের উপর চাপ বাড়ে একই সাথে পা ফুলে যেতে পারে।

ফলেন আর্চেস: প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর ফুট ড্রপ অথবা ফুট কুলাপসের কারণে ফরেন আর্চেস দেখা যায়। এক ক্ষেত্রের সাধারণত পা বাইরের দিকে ঘুরে যায় । সাধারণত পায়ের পুস্টারিয়র টিভিয়াল টেন্ডনে প্রদাহ অথবা ট্যান্ডন ছিঁড়ে গেলে এই ধরনের ফ্ল্যাট ফুট হয়ে থাকে ।

ভার্টিকাল টেলার্স বা রকার বুটুম ফুট: জন্মগতভাবে কিছু কিছু বাচ্চাদের পায়ের আর্চ তৈরি হয় না কারণ পায়ের টেলাস নামক হাড় সঠিক অবস্থানে থেকে না। এক্ষেত্রে পায়ের নিচের অংশ রকিং চেয়ারে নিচের অংশের মতো বাঁকা থাকে। তাই একে রকার বাটন ফুটো বলে।

ফ্লাট ফুটের কারণসমূহ:

ফ্লাট ফুটের কারণসমূহ:

বংশগত ভাবেও ফ্ল্যাট ফুট হতে পারে। সাধারণত ৫ থেকে ৮ বছরের মধ্যে আর্চ তৈরি হয় কিন্তু কারো কারো এ আর্চ অনেক বেশি থাকে অথবা স্বাভাবিকের তুলনায় কম থাকে বা আর্চ নাও থাকতে পারে। কারো কারো প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় ফ্ল্যাট ফুট হয়ে থাকে। ফ্ল্যাট ফুট এর সঠিক কোন কারণ এখনো জানা যায়নি তবে নিন্মুক্তকারণে ফ্ল্যাট ফুট এর ঝুঁকি বেড়ে যায়।

  • একেলিস টেন্ডন ইনজুরি
  • সেরিব্রাল পালসি
  • ডায়াবেটিস
  • ডাউন সিনড্রোম
  • উচ্চ রক্তচাপ
  • স্থূলস্বাস্থ্য
  • টিভিয়ালিস পোস্টেরিয়ার ট্যান্ডন ছিড়ে যাওয়া অথবা অকার্যকর হওয়া।
  • স্পাইনা ভাইফিডা
  • মাসকুলার ডিস্টফি
  • মাসকুলা
  • পেরুনিয়াল স্পাজম
  • গর্ভকালীন সময় পায়ে অতিরিক্ত পানি আসা
  • রিমাটয়েড আর্থসাইটিস
  • পোস্ট ফ্র্যাকচারাল কম্প্লিকেশন
  • জিবিএস
  • ফুড ড্রপ
  • লিগামেন্টাল লেক্সিটি
  • পেরিফেরাল নার্ভ ইনজুরি

ফ্ল্যাট ফুট বুঝার উপায়:

বেশিরভাগ সময় ফ্ল্যাট ফুটের সমস্যায় কোনরকম উপসর্গ থাকে না। তবে দীর্ঘদিনের ফ্ল্যাট ফুট সমস্যা থাকলে নিম্নোক্ত লক্ষণ গুলি দেখা দিতে পারে।

  • পায়ের পাতার উপর ভর দিয়ে দাঁড়ালে পায়ের পাতা সম্পূর্ণরূপ মেঝের সাথে লেগে গেলে।
  • পায়ের পাতা ফেলতে অসুবিধা হয় অর্থাৎ পায়ের পাতা ফেললে পায়ের নিচের অংশ ব্যথা লাগে।
  • পা ফেলতে গেলে মাঝেমাঝেই পা স্লিপ করে।
  • হাঁটা চলাফেরা করার সময় বা দাঁড়িয়ে থাকতে শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে অসুবিধা হলে।
  • পায়ের পাতার নিচের অংশে ক্রিস বা কড়া পরলে।
  • পায়ে সবসময় ব্যথা অনুভব হলে।
  • পা ফেলতে গেলে মাঝেমাঝে স্লিপ করে।
ফ্ল্যাট ফুট এর জন্য পায়ে অন্যান্য যে সকল সমস্যা হতে পারে:

ফ্ল্যাট ফুট এর জন্য পায়ে অন্যান্য যে সকল সমস্যা হতে পারে:

ফ্ল্যাট ফুটে সাধারণত কোন উপসর্গ না থাকলেও এর ফলে পায়ে অন্যান্য মাসকুলোস্কেলেটাল সমস্যা হতে পারে বা এদের উপসর্গগুলি বৃদ্ধি পেতে পারে।

  • ট্যান্ডন অ্যাকেলিসে প্রদাহ
  • পায়ের গোড়ালিতে আর্থ্রাইটিস
  • পায়ের পাতা ও আঙ্গুলের জয়েন্ট গুলোতে আর্থ্রাইটিস
  • বাউনিয়ান্স
  • হেমার টু
  • প্লান্টার ফাসাইলিটিস
  • হিল স্পার
  • টিভিয়ালিস পোস্টেরিওর টেনডনের পদাহ
  • শিন স্প্লিন্ট

ফ্ল্যাট ফুট জন্য কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত:

  • হঠাৎ করেই ভারসাম্যহীনতা দেখা দিলে বিশেষ করে দাঁড়ালে বা হাঁটাচলা করার সময়।
  • ব্যথার জন্য স্বাভাবিক হাঁটা চলার ব্যাহত হলে।
  • ব্যথার সাথে নমনীয় হীনতা
  • হঠাৎ করেই ফ্ল্যাট ফুট দেখা দিলে (ফলেন আর্চেস)।

ফ্ল্যাট ফুটের চিকিৎসা পদ্ধতি:

আমাদের আশেপাশে অনেকেরই ফ্ল্যাট ফুট জনিত সমস্যা থাকলেও এর জন্য উল্লেখযোগ্য তেমন কোন সমস্যা থাকেনা। যদি পায়ের ব্যথা শক্ত হয়ে যাওয়া বা অন্যান্য সমস্যা অনুভূত হয় তাহলে নন সার্জিক্যাল চিকিৎসা পদ্ধতি মাধ্যমে সুফল পাওয়া যায়। যদি উল্লেখযোগ্য হারে পায়ের হাড়ে বা টেনডনে সমস্যা দেখা দেয় অথবা নন সার্জিকাল চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যর্থ হয় তাহলে অস্ত্রোপাচারের প্রয়োজন হতে পারে।

ফিজিওথেরাপ চিকিৎসা: যথাযথ ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে দুর্বল মাংসপেশী ও টেন্ডনের শক্তি বৃদ্ধি এবং অস্বাভাবিক মাংসপেশি সংকোচন বা টাইটনেস কমিয়ে মাংসপেশী নমনীয়তা বৃদ্ধি করা যায়। এরফলে ফ্ল্যাট ফুট এর সমস্যা বহু অংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। ফ্ল্যাট ফুটের ফলে ব্যথা হলে ক্রাইওথেরাপ, আল্টাস সাউন্ড থেরাপি এবং বিভিন্ন ধরনের রিলিছ টেকনিকের মাধ্যমে ব্যথা নিরাময় করা যায়। অধিকাংশ ফ্ল্যাট ফুটের রোগীদের অস্বাভাবিক হাঁটাচলা করার ধরন লক্ষ্য করা যায়। একজন ফিজিওথেরাপিস্ট রোগীর স্বাভাবিক হাঁটাচলার জন্য সঠিক দিক নির্দেশনা ও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকেন।

আর্টস সাপোর্ট ডিভাইস (অর্থোটিকস ডিভাইস):

সাধারণত ফ্ল্যাট ফুট জনিত সমস্যার কারণে যদি প্রচন্ড ব্যথা হয় এবং দৈনন্দিন চলাফেরায় অসুবিধা সৃষ্টি হয় তাহলে আজ সাপোর্টিং অর্থটিকস ডিভাইস ব্যবহারের নির্দেশ দেয়া হয়। আর্চ সাপোর্টিং অর্থোটিকস ডিভাইস সরাসরি ফ্ল্যাট ফুটের সমস্যা সমাধান না করলেও ফ্ল্যাট ফুট জনিত উপসর্গগুলি কমাতে সাহায্য করে।

ঔষধ:

প্রাপ্তবয়স্কদের ফ্ল্যাট ফুটের জন্য তেমন কোনো ওষুধের প্রয়োজন হয় না যদি না খুবই গুরুতর উপসর্গগুলি না দেখা যায়। সেক্ষেত্রে নন স্টেরয়েডাল এন্টি ইনফ্লামেটরি ড্রাগস (এন এস এ আই টি) এবং করটিকুস্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা হয়।

ফ্ল্যাট ফুটের প্রতিকার:

  • পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রামনেওয়া।
  • যে সকল কাজে ফ্ল্যাট ফুটের সমস্যা বৃদ্ধি পায় সে সকল কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। যেমন:-জাম্পিং, দৌড়ানো, সাঁতার কাটা, অনেক বেশি হাঁটা ইত্যাদি।
  • সঠিক মাপের জুতা নির্বাচন করা বিশেষ করে যে সকল জুতার সোল পায়ের আর্চ ঠিক রাখে ।
  • শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমানো: শরীরের অতিরিক্ত ওজনের ফলে পায়ের উপরে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি চাপ পড়ে যা ফ্ল্যাট ফুট বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।

তথ্যসূত্রঃ

Follow me

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This field is required.

This field is required.

পরামর্শ নিতে 01975451525