স্ট্রোক মস্তিষ্কের একটি জরুরি অবস্থা, যা সাধারণত মস্তিষ্কের রক্তপ্রবাহ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারনে হয়। এর ফলে মস্তিষ্কের কোষগুলো অক্সিজেন ও প্রয়োজনীয় পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হয় এবং কয়েক মিনিটের মধ্যেই কোষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা মারা যেতে পারে।

স্ট্রোকের লক্ষণ দ্রুত চিনতে পারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ প্রথম ৩ থেকে ৬ ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসা শুরু করতে পারলে অনেক সময় মৃত্যুর ঝুঁকি কমানো যায় এবং অক্ষমতা হ্রাস করা সম্ভব হয় (Saver, J.L., 2006. Time is Brain)। স্ট্রোকের সাধারণ লক্ষণগুলোর মধ্যে হঠাৎ করে মুখ, হাত বা পায়ে দুর্বলতা, কথা জড়িয়ে যাওয়া, চোখে ঝাপসা দেখা বা দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলা, হঠাৎ মাথাব্যথা বা ভারসাম্য হারানো অন্যতম।

মস্তিষ্কের স্ট্রোক কী?

মস্তিষ্কের স্ট্রোক কী
মস্তিষ্কের স্ট্রোক কী

স্ট্রোক মূলত দুই প্রকারের হয়: ইস্কেমিক স্ট্রোক এবং হেমোরেজিক স্ট্রোক

  • ইস্কেমিক স্ট্রোক হলে মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহকারী কোনো ধমনী রক্তজমাট বা প্ল্যাক জমে আটকে যায়। প্রায় ৮৭% ক্ষেত্রেই এই সব স্ট্রোক হতে দেখা যায় (Benjamin et al., 2019. Heart Disease and Stroke Statistics)।
  • হেমোরেজিক স্ট্রোক হলে মস্তিষ্কের কোনো রক্তনালী ফেটে গিয়ে রক্তক্ষরণ হয়, যার ফলে মস্তিষ্কে চাপ বেড়ে যায় এবং কোষের ক্ষতি হয়। এটি তুলনামূলকভাবে কম হলেও অনেক ক্ষেত্রে মারাত্মক হতে পারে (Feigin et al., 2009. The Lancet Neurology)।

বাংলাদেশের মতো দেশে স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধির পেছনে কিছু নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে—যেমন:

  • উচ্চ রক্তচাপ (স্ট্রোকের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি),
  • ডায়াবেটিস,
  • ধূমপান,
  • দীর্ঘ সময় বসে থাকা বা অলস জীবনযাপন

বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া দরকার প্রথম ৪ থেকে ৬ ঘণ্টা, যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে “গোল্ডেন আওয়ার” বলা হয়। এই সময়ের মধ্যে চিকিৎসা শুরু করতে পারলে স্ট্রোকজনিত অক্ষমতা ও মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো যায় (Emberson et al., 2014. The Lancet)।

স্ট্রোক শনাক্তে FAST পদ্ধতি: সহজ, কার্যকর ও জীবনরক্ষাকারী

স্ট্রোক শনাক্তে FAST পদ্ধতি সহজ কার্যকর ও জীবনরক্ষাকারী
স্ট্রোক শনাক্তে FAST পদ্ধতি সহজ কার্যকর ও জীবনরক্ষাকারী

স্ট্রোক দ্রুত শনাক্ত করার একটি সহজ, কার্যকর এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি হলো FAST। এই পদ্ধতিটি বিশেষভাবে সধারন মানুষের জন্য তৈরি, যাতে কোনো চিকিৎসা জ্ঞান ছাড়াই কেউ একজন স্ট্রোকের প্রাথমিক লক্ষণ বুঝতে পারেন এবং জরুরি পদক্ষেপ নিতে পারেন।

F – Face (মুখ): ব্যক্তিকে হাসতে বলুন। যদি মুখের একপাশ ঝুলে পড়ে বা বেঁকে যায়, তাহলে সেটি স্ট্রোকের লক্ষণ হতে পারে। এটি ফেসিয়াল নার্ভের দুর্বলতার লক্ষণ।

A – Arm (হাত): ব্যক্তিকে দুই হাত উপরে তুলতে বলুন। যদি একটি হাত পড়ে যায় বা তুলতে না পারে, তাহলে সেটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত। এটি শরীরের একপাশ প্যারালাইসিসের ইঙ্গিত দেয়।

S – Speech (কথাবলা): একটি সহজ বাক্য বলতে বলুন, যেমন “আকাশ নীল”। যদি তার কথা জড়িয়ে যায় বা ঠিকভাবে বলতে না পারে, সেটিও মস্তিষ্কের ল্যাংগুয়েজ সেন্টারের সমস্যার লক্ষণ হতে পারে।

T – Time (সময়): উপরের যেকোনো একটি লক্ষণ দেখা গেলে অবিলম্বে ৯৯৯ বা জরুরি নম্বরে যোগাযোগ করুন। দেরি করলে মস্তিষ্কের কোষগুলো ধ্বংস হয়ে যেতে পারে—তাই প্রতিটি মিনিট গুরুত্বপূর্ণ (Saver, 2006. Stroke Journal)।

স্ট্রোক সন্দেহ হলে কী করবেন

লক্ষণবিবরণকী করবেন
ভারসাম্য হারানোহঠাৎ হাঁটতে অসুবিধা বা মাথা ঘোরাআক্রান্ত ব্যক্তিকে বসতে দিন বা শুইয়ে দিন, ৯৯৯ এ ফোন করুন
দৃষ্টি সমস্যাঝাপসা দৃষ্টি বা দৃষ্টিশক্তি হ্রাসদ্রুত চিকিৎসা নিন
মুখের দুর্বলতামুখের একপাশ ঝুলে পড়াহাসতে বলুন, জরুরি সেবায় যোগাযোগ করুন
হাতের দুর্বলতাএকটি হাত নিচে নেমে আসাদুই হাত তুলতে বলুন, ৯৯৯-এ ফোন করুন
কথার সমস্যাকথা জড়ানো বা বোঝার অসুবিধারোগীর কথা বলায় জড়তা থাকলে, জরুরি সেবায় ফোন করুন
মাথাব্যথাতীব্র মাথাব্যথা, কারণ অজানাতাৎক্ষণিক চিকিৎসা নিন

প্রাথমিক চিকিৎসার গুরুত্ব

গোল্ডেন আওয়ার এবং প্রাথমিক চিকিতসাঃ স্ট্রোকের প্রথম কয়েক ঘণ্টা, যা “গোল্ডেন আওয়ার” নামে পরিচিত, চিকিৎসার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে, রক্ত জমাট ভাঙার ওষুধ, যেমন টিস্যু প্লাজমিনোজেন অ্যাক্টিভেটর (tPA), ইস্কেমিক স্ট্রোকের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। গবেষণা দেখায় যে এই ওষুধ প্রথম 3-4.5 ঘণ্টার মধ্যে দেওয়া হলে সবচেয়ে কার্যকর (Albers et al., 2004)। এই প্রাথমিক চিকিৎসা মস্তিষ্কের ক্ষতি কমায়, অক্ষমতা হ্রাস করে এবং জীবন বাঁচাতে সাহায্য করে। এছাড়াও, প্রাথমিক পর্যায়ে রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চমাত্রার ডায়াবেটিস (>8 mmol/l) এবং শরীরের তাপমাত্রা বেশি থাকলে স্ট্রোক রোগীর সুস্থতায় বিলম্ব হতে পারে। তাই, এগুলোর দ্রুত নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন (Díez-Tejedor and Fuentes, 2004)। অক্সিজেন স্যাচুরেশন 92% এর নিচে নামলে অক্সিজেন দেওয়া উচিত। এই সবকিছু প্রাথমিক চিকিৎসার অংশ হিসেবে স্ট্রোক ইউনিটে করা হয় (Díez-Tejedor and Fuentes, 2004)।

ফিজিওথেরাপি এবং পুনর্বাসনের ভূমিকা

স্ট্রোকের পর, রোগীরা প্রায়ই শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। ফিজিওথেরাপি এই ক্ষতি পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি গতিশীলতা, শক্তি এবং স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনে। ফিজিওথেরাপি রোগীদের হাঁটা, ভারসাম্য রক্ষা এবং দৈনন্দিন কাজ অন্যার সাহায্য ছাড়া সম্পাদনে সাহায্য করে।

পুনর্বাসনের অন্যান্য উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে অকুপেশনাল থেরাপি, যা দৈনন্দিন কাজে সহায়তা করে, এবং স্পীচ এন্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপি, যা কথা বলার জড়তা নিয়ন্ত্রণ করে। আধুনিক প্রযুক্তি, যেমন রোবট-এসিস্টিভ ডিভাইস এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, পুনর্বাসনের কার্যকারিতা বাড়ায়।

অগ্রণী স্ট্রোক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার (ASRC)-এ স্ট্রোক রোগীদের সফল পুনর্বাসন সেবা

অগ্রণী স্ট্রোক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার(ASRC), যা ঢাকার মোহাম্মদপুরের নুরজাহান রোড, U-64-এ অবস্থিত, স্ট্রোক রোগীদের জন্য উচ্চমানের পুনর্বাসন সেবা প্রদান করে, যা তাদের হারানো শারীরিক ক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সহায়তা করে। স্ট্রোকের পর রোগীদের শরীরের একপাশ দুর্বল বা অবশ হয়ে যায়, যার ফলে হাঁটা-চলা, হাত ও পায়ের ব্যবহার বা দৈনন্দিন কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে। ASRC তাদের হাতে-কলমে ফিজিওথেরাপি সেবা, কথা বলার চিকিৎসা, দৈনন্দিন কাজের প্রশিক্ষণ এবং এসেসমেন্টের মাধ্যমে সফলভাবে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া পরিচালনা করে। এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিটি রোগীর শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত সতর্কতার সহিত পরীক্ষা করে চিকিৎসা পরিকল্পনা তৈরি করে, যা পেশির স্পাজম কমায়, নড়াচড়া সহজ করে এবং ব্যথা হ্রাস করে। ASRC-এর বিশেষজ্ঞ ফিজিওথেরাপিস্টরা রোগীদের নিয়মিত এসেসমেন্টের মাধ্যমে অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করেন এবং চিকিৎসা পরিকল্পনা আপডেট করেন, যাতে রোগীরা দ্রুত সুস্থ হয়। এছাড়া, ASRC রোগী ও তাদের পরিবারকে স্ট্রোক প্রতিরোধ এবং বাড়িতে এক্সারসাইজ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়, যা আরেকটি স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়। সাশ্রয়ী মূল্যে এবং আন্তর্জাতিক মানের সেবা প্রদানের মাধ্যমে ASRC গ্রামীণ ও শহুরে রোগীদের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুনাম অর্জন করেছে, যা তাদের জীবনমান উন্নত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

স্ট্রোক রোগী কখন ফিজিওথেরাপি নিবেন

স্ট্রোক রোগী কখন ফিজিওথেরাপি নিবেন
স্ট্রোক রোগী কখন ফিজিওথেরাপি নিবেন

গবেষণায় দেখা যায় যে পুনর্বাসন যত তাড়াতাড়ি শুরু হয়, তত ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। আদর্শভাবে, রোগী স্থিতিশীল হওয়ার পর 24-72 ঘণ্টার মধ্যে ফিজিওথেরাপি শুরু করা উচিত (Johns Hopkins Medicine, 2024)। NICE প্রটোকল অনুসারে, স্ট্রোকের পর রোগীদের প্রতিদিন কমপক্ষে 3 ঘণ্টা ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে 5 দিন প্রদান করা উচিত (NICE, 2023)।

উপসংহার

স্ট্রোকের লক্ষণ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি একটি জীবন রক্ষাকারী পদক্ষেপ যা ব্যক্তির বাইরেও প্রভাব ফেলে। পরিবার, বন্ধু এবং সম্প্রদায়ের সদস্যদের FAST এবং BE FAST সম্পর্কে শিক্ষিত করলে সবাই স্ট্রোক চিনতে এবং দ্রুত সাড়া দিতে সক্ষম হয়। জনসচেতনতা প্রচারণা দেখিয়েছে যে স্ট্রোকের সতর্কতা লক্ষণ সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞান চিকিৎসায় বিলম্ব কমায়, যা বেঁচে থাকার হার এবং পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা উন্নত করে। এই সংক্ষিপ্ত সূত্রগুলো কথোপকথন, সামাজিক মাধ্যম বা সম্প্রদায়ের কর্মশালার মাধ্যমে শেয়ার করুন, এবং জোর দিন যে এই তথ্য জানা এবং ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে যে কেউ জীবন রক্ষাকারী হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, শিশু বা সহকর্মীদের মুখের ঝুলে যাওয়া বা জড়িয়ে কথা বলার লক্ষণ চিনতে শেখানো একটি সচেতন প্রতিক্রিয়াশীল নেটওয়ার্ক তৈরি করতে পারে, যাতে কোনো স্ট্রোক অলক্ষিত না থাকে (American Stroke Association, 2024)।

স্ট্রোক হলে করনীয় এবং স্ট্রোক রোগীর ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা

স্ট্রোক হলে করনীয় এবং স্ট্রোক রোগীর ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা | স্ট্রোক রোগীর ফিজিওথেরাপি.…
পরামর্শ নিতে 01877733322