গর্ভাবস্থায় একজন নারীর শরীরে নানাবিধ মেটাবলিক/ বিপাকীয়, জৈব রাসায়নিক ও শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তনগুলো এমন একটি পরিবেশ তৈরী করে, যা গর্ভকালীন ও প্রসবোত্তর সময়ের জন্য সুবিধাজনক।

  গর্ভকালীন সময়ে আপনি যত বেশি সক্রিয় জীবনযাপন করবেন, আপনার জন্য শারীরিক পরিবর্তনগুলোর সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া তত বেশি সহজ হবে। গর্ভকালীন সময়ে ব্যায়াম করাটা আপনার গর্ভের শিশুর জন্য মোটেই বিপদজনক নয়। গবেষনায় দেখা গেছে, শারীরিকভাবে সক্রিয় নারীদের প্রসবকালীন ও প্রসবোত্তর জটিলতায় ভোগার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে কম। এই প্রবন্ধে আমরা গর্ভকালীন সময়ে আপনি কি কি ব্যায়াম করতে পারেন, তা সম্পর্কে একদম বেসিক কিছু ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করবো। পাশাপাশি গাইনি এন্ড অবস ফিল্ডে কর্মরত একজন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক এর পরামর্শ নিয়ে নিরাপদভাবে আপনার শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী ‘প্রেগন্যান্সি ফিটনেস গাইডলাইন’ অনুসরণ করতে পারেন।

নিম্নলিখিত এক্সারসাইজ প্রোটোকল গুলো বিগিনার, ইন্টারমিডিয়েট এবং এডভান্স লেভেল অনুযায়ী প্রস্তুত করা হয়েছে।

১. বিগিনার লেভেলে তারা আছেন যারা আগে কখনো এক্সারসাইজ করেন নি বা ফিটনেস ও এক্সারসাইজ প্রোগ্রাম নিয়ে তেমন জানেন না। এনাদের নিয়মিত নির্দেশনার প্রয়োজন হয়ে থাকে।

২. যারা সপ্তাহে ২-৩ বার নিয়মিত এক্সারসাইজ করেন এবং যাদের ফিটনেস নিয়ে সাধারণ ধারণা আছে, তারা ইন্টারমিডিয়েট লেভেলে অবস্থান করেন।

৩. এডভান্স লেভেলে তারাই আছেন, যারা সপ্তাহে ৪-৫ বার এক্সারসাইজ করেন এবং যাদের ফিটনেস নিয়ে খুবই ভালো জানা আছে।

প্রথম ত্রৈমাসিক সপ্তাহ ১ থেকে ১২ তম সপ্তাহের শেষ দিন পর্যন্ত। দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক সপ্তাহ ১৩ – ২৬ পর্যন্ত। তৃতীয় ত্রৈমাসিক ২৭ তম সপ্তাহ থেকে প্রসবকাল পর্যন্ত।

প্রথম ত্রৈমাসিকের ব্যায়াম:

প্রথম ত্রৈমাসিকে গর্ভবতী নারীর শরীরে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়ে থাকে। যেমন:

* রক্তের পরিমাণ বৃদ্ধি

* রিলাক্সিন হরমোনের উৎপাদন

* অস্থিরতা

* ক্লান্তি

* বমি বমি ভাব ইত্যাদি

      এই সময়ে ব্যায়ামের মাধ্যমে সক্রিয় জীবনযাপন করলে শারীরিক পরিবর্তনের কারণে অস্থিরতা কমানো যেতে পারে। আপনি যদি নিয়মিত ব্যায়াম করেও থাকেন, তবুও প্রথম ত্রৈমাসিকে এনার্জি লেভেল কম থাকা ও বমি বমি ভাবের কারণে সময়টি আপনার জন্য মারাত্নক চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। এটা মনে রাখবেন, একদমই অলস জীবনযাপনের চেয়ে কিছু এক্সারসাইজের মাধ্যমে কর্মঠ থাকা তুলনামূলক ভাবে আপনার জন্য ভালো। কখনো কখনো শুধুমাত্র অল্প কিছুক্ষণ হাঁটলেও তা আপনার শারীরিক শক্তি ও প্রফুল্লতা বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।

বিগিনার লেভেল এক্সারসাইজ

১. কার্ডিও – যদি হাঁটাই আপনার একমাত্র কার্ডিও এক্সারসাইজ হয়, তাহলে প্রতি সপ্তাহে তিন থেকে চারদিন ২০ মিনিটের মতো করে হাঁটুন। প্রথম ত্রৈমাসিকের দিকে আপনি গর্ভাবস্থায় থাকাকালীন একটি নতুন অভ্যাস তৈরী করছেন, আর গবেষণায় পাওয়া গেছে, হাঁটা অন্যতম সেরা ব্যায়ামগুলোর একটি। তাই আপনার সহ্যক্ষমতার বিচারে নিয়মিতভাবে হাঁটুন। শুধু এদিকে খেয়াল রাখবেন, যাতে খুব বেশি ঘেমে অস্থির হয়ে না যান।

আরও পড়ুনঃ গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা

২. ফুল বডি স্ট্রেনদেনিং এক্সারসাইজ প্রোটোকল

প্রতি সপ্তাহে এক থেকে দুইদিন স্ট্রেনদেনিং এক্সারসাইজ গুলো করুন, প্রতি সেটে চার থেকে বারো বার পুনরাবৃত্তিসহ এক থেকে দুই সেট এক্সারসাইজ করুন। প্রদত্ত দুটি ওয়ার্কআউটের ( ক বা খ) মধ্যে একটি বেছে নিন অথবা আরো স্বতন্ত্র পদ্ধতির জন্য প্রতিটি ক্যাটাগরি থেকে একটি বেছে নিয়ে নিজস্ব ওয়ার্কআউট রুটিন তৈরী করতে পারেন। এক্ষেত্রে, পা, বুক, পিঠ, বাহু এবং কোর পেশিগুলোর ব্যায়াম যাতে হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। একজন অভিজ্ঞ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক এক্ষেত্রে আপনাকে সাহায্য করতে পারেন।

ক….

* স্ট্যাবিলিটি বল স্কোয়াট

* ডেডলিফট

* ক্লাম শেল

* বারবেল বাইসেপস কার্ল

 * ব্রিজিং

* ক্যাট এন্ড কাউ

খ…..

* স্ট্যাবিলিটি বল লাঞ্জ

* স্ট্যাবিলিটি বলের সাহায্যে স্ট্যান্ডিং হ্যামস্ট্রিং কার্ল

* ওয়াল পুশ আপ

* কনসেন্ট্রেশন কার্ল

* ট্রাইসেপস কিকব্যাক

* ল্যাটারাল রেইজ

* ব্যান্ডের সাহায্যে চেস্ট প্রেস

* কোর ব্রেদ

৩. ফাংশনাল মুভমেন্ট

এই ধরণের কাজগুলো প্রাত্যহিক কার্যক্ষমতা বজায় রাখতে এবং বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। এর মধ্যে আছে হাঁটা, সিঁড়ি চড়া, স্কোয়াটিং, লিফটিং (ডেডলিফট), প্রতি সেটে আট থেকে বারো বার পুনরাবৃত্তি সহ সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার এক থেকে তিন সেটে লাঞ্জ ইত্যাদি।

৪. রিলিজ ওয়ার্ক

 * কাফ স্ট্রেচিং

* স্ট্রাপের সাহায্যে হ্যামস্ট্রিং স্ট্রেচ

* স্ট্যাবিলিটি বলের সাথে বসে চেস্ট স্ট্রেচ

ইন্টারমিডিয়েট লেভেলের এক্সারসাইজ

কার্ডিও – বিগিনার লেভের মতোই। সাথে হাইকিং, সাতার, জিম যোগ করা যেতে পারে।

ফুল বডি স্ট্রেনদেনিং এক্সারসাইজ

* ডেডলিফট এবং ব্যাক রো

* স্ট্যাবিলিটি বলের সাহায্যে কাফ রেইজ

* পুশ আপ

*সাইড নী প্লাংক

* নিলিং বল স্কুইজ

* ক্রাউচিং টাইগার

 ফাংশনাল মুভমেন্ট ও রিলিজ ওয়ার্ক- বিগিনার লেভেল এর গুলোই অনুসরণ করতে পারেন

এডভান্স লেভেলের এক্সারসাইজ

কার্ডিও – প্রতিদিন হাঁটুন

ফুল বডি স্ট্রেনদেনিং এক্সারসাইজ :

* স্ট্যাবিলিটি বলের সাহায্যে স্ট্রেইট লেগ ব্রিজিং

* এক পায়ে ডেডলিফট

* প্রিচার কার্ল

* স্ট্যাবিলিটি বলে সিটেড মার্চ

* ফ্রন্ট লোডেড প্লাংক

* প্যালোফ প্রেস

* বার্ড ডগ

ফাংশনাল মুভমেন্ট ও রিলিজ ওয়ার্ক– বিগিনার লেভেল এর গুলোই অনুসরণ করতে পারেন

দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের ব্যায়াম

 দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে এনার্জি লেভেল আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে এবং বমি বমি ভাব একদমই থাকে না বলা যায়। প্রথম ত্রৈমাসিকের এক্সারসাইজ প্রোটোকলগুলোই আপনি ব্যায়ামের তীব্রতা আর সময় বাড়িয়ে করতে পারেন।

বিগিনার লেভেল

কার্ডিও – হাঁটার সময় বাড়িয়ে নিতে পারেন

ফুল বডি স্ট্রেনদেনিং এক্সারসাইজ

* স্কোয়াট

* লাঞ্জ

* বসা অবস্থায় হিপ এডাকশন

* বেঞ্চে ইনক্লাইন চেস্ট প্রেস

*স্ট্যান্ডিং বার্ড ডগ

* স্কোয়াট এন্ড লো ব্যাক

* স্টেশোনারি লাঞ্চ উইদ ওভারহেড ট্রাইসেপস এক্সটেনশন

* রিয়ার ক্রিসেন্ট লাঞ্জ  

ফাংশনাল মুভমেন্ট – প্রথম ত্রৈমাসিকের মতোই

রিলিজ ওয়ার্জ – পুর্বের গুলো +

* বলস্টারের সাহায্যে সোয়াস রিলিজ

* স্ট্যাবিলিটি বলের উপর পেলভিক রকিং

ইন্টারমিডিয়েট লেভেলের এক্সারসাইজ

কার্ডিও – হাঁটা, সাতার, জিম

ফুল বডি স্ট্রেনদেনিং এক্সারসাইজ: বিগিনার লেভেলের সাথে –

* হিপ থ্রাস্ট

* ওয়াকিং লাঞ্জ

* বেন্ট ওভার রিভার্স ফ্লাই

* মনস্টার ওয়াক

*ফ্রেনকেনস্টেইন ওয়াক

ফাংশনাল মুভমেন্ট এবং রিলিজ ওয়ার্ক বিগিনার লেভেলের টাই অনুসরণ করতে পারেন।

এডভান্স লেভেলের এক্সারসাইজ

কার্ডিও – আগের মতো

ফুল বডি স্ট্রেনদেনিং এক্সারসাইজ – ইন্টারমিডিয়েট লেভেল +

* স্ট্যান্ডিং হ্যামার কার্ল

* ওয়ান আর্ম রিভার্স ফ্লাই

* বেন্ট আর্ম ল্যাটেরাল রেইজ

ফাংশনাল মুভমেন্ট এবং রিলিভ ওয়ার্ক আগের মতোই।

তৃতীয় ত্রৈমাসিকের ব্যায়াম

এই সময়ে গর্ভবতী নারীর ওজন প্রায় দেড় থেকে এক পাউন্ড (০.২৫-০.৫ কেজি) বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি অনেকেই ভেরিকোজ ভেইন, হাত পা ফুলে যাওয়া এবং ওজন বৃদ্ধির কারণে চলাফেরায় অসুবিধা বোধ করেন। এ সময়ে অতিরিক্ত ওজন সামলাতে কোর পেশিগুলো অত্যধিক প্রসারিত হয় এবং তাদের স্বাভাবিক কার্যকারিতার সাথে আপোস করে চলে।

  এই সময়ে আপনি নিজেকে প্রসবকালের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিবেন। ডিপ স্কোয়াট, স্ট্রেচিং এবং রিলিজ ওয়ার্ক, ব্রিদিং টেকনিকসহ আরো কিছু প্রোটোকল অনুসরণ করলে তা প্রসব কালীন ও এর পরে নানাভাবে সাহায্য করবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই একজন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক এর পরামর্শে সুনির্দিষ্ট ব্যায়াম গুলো করবেন।

বিগিনার লেভেলের এক্সারসাইজ

কার্ডিও – হাঁটার পরিমান কিছুটা কমিয়ে দিতে পারেন। সম্ভব হলে সাতার কাটতে পারেন। প্রেগন্যান্সির শেষ দিকে পানির প্লবতা মনকে উৎফুল্ল রাখতে সহায়ক।

ফুল বডি স্ট্রেনদেনিং এক্সারসাইজ

* ওয়াল পুশ আপ

* সিটেড বাইসেপস কার্ল

* বল স্কুইজ রোটেশন

* মডিফাইড কোর ব্রেদ

* আপরাইট রো

ফাংশনাল মুভমেন্ট – যতটুকু সম্ভব হয়।

রিলিজ ওয়ার্ক – দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের গুলোর সাথে-

* পোস্টেরিয়োর পেলভিক ফ্লোর রিলিজ

* স্ট্যাবিলিটি বলের উপর এডাকটর স্ট্রেচ

* স্ট্যাবিলিটি বলের উপর হিপ ফ্লেক্সর স্ট্রেচ

ইন্টারমিডিয়েট লেভেলের এক্সারসাইজ

 বিগিনার লেভেলের মতোই

এডভান্স লেভেলের এক্সারসাইজ

কার্ডিও, ফাংশনাল মুভমেন্ট, রিলিজ ওয়ার্ক বিগিনার লেভের মতোই

 ফুল বডি স্ট্রেনদেনিং এক্সারসাইজ এর মধ্যে আগের গুলো সহ

* স্ট্যাবিলিটি বলে স্কাল ক্রাশার

* ল্যাটেরাল রেইজ

* নিলিং হোভার

প্রেগন্যান্সির প্রতিটি ধাপেই নিরাপদভাবে এক্সারসাইজের জন্য একজন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।

Follow me

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This field is required.

This field is required.

পরামর্শ নিতে 01975451525