কোমর ব্যথায় ভুগছেন?

মেরুদন্ডের পেছনের দিকের শেষ অংশে ব্যথা হলে সাধারণত তাকে কোমর ব্যথা বলে। অনেক সময় আমরা একে কিডনির কারনে ব্যথা বলে ভুল করি। যদি আপনার কোমর ব্যথা বসা, দাঁড়ানো, হাটা কিংবা কাজে কর্মের সাথে বাড়ে ও বিশ্রামে কমে তবে এটিকে ম্যাকানিক্যাল কোমর ব্যথা বলে।

কোমর ব্যথার কারণ কি?

মেকানিক্যাল কোমর ব্যথা শরীরের মাংসপেশির ফিটনেস কমে যাওয়া, শারিরিকভাবে কর্মক্ষম না হওয়া, বয়স বেড়ে যাওয়া, ও ওজনের সাথে সম্পর্কযুক্ত। তবে সাধারণত দেখা যায় মেরুদন্ডের মাংসপেশি বা লিগামেন্ট স্ট্রেচ, মচকানো বা আংশিক ছিড়ে যাওয়া, দুই কশেরুকার মধ্যবর্তী ডিস্কে সমস্যা, ডিস্ক ফেটে জেলি বের হয়ে স্নায়ু না নার্ভকে চাপ দেয়া, এবং মেরুদন্ডের কশেরুকার অবস্থা পরিবর্তনের কারণে কোমর ব্যথা হয়ে থাকে।

কত মানুষের কোমর ব্যথা হয়?

বিশ্বব্যপী কোমর ব্যথা চিকিৎসকদের দেখানোর পঞ্চম সাধারণ কারণ। প্রায় ৬০ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষের জীবনকালে কোন না কোন সময় কোমর ব্যথা হয়। কিছু গবেষণায় দেখা গিয়েছে বিশ্বের প্রাপ্ত বয়স্কদের ২৩ শতাংশ দীর্ঘস্থায়ী কোমরের ব্যথায় ভোগেন। এই জনসংখ্যার ২৪ শতাংশ থেকে ৮০শতাংশ মানুষের একবছরে কোমর ব্যথার পুনরাবৃত্তি হারও দেখা গেছে।

কোমর ব্যথা কেন হয়?

অনেকে আঘাত, পোশ্চারাল সমস্যা, এক অবস্থানে বেশি সময় থাকা এবং কোমরে বিভিন্ন রোগে ভুগে কোমর ব্যথা হয়। নিচে কয়েকটি কারন উল্লেখ করা হলো-

১. স্ট্রেইন এবং মোচঃ

কোমর ব্যথার সবচেয়ে সাধারণ কারণ হল মেরুদন্ডের স্ট্রেন এবং মোচ। আপনি খুব ভারী কিছু উত্তোলন করে বা নিরাপদে উত্তোলন না করে পেশী, টেন্ডন বা লিগামেন্টকে আঘাত করতে পারেন। এছাড়া আপনার ফিটনেসের অবনতি হলে, কিছু লোক হাঁচি, কাশি, মোচড়ানো বা নিচু হলেই করে তাদের পিঠে চাপ পড়ে ও কোমর ব্যথা হতে পারে। আমরা অফিসে যারা দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে বা বসে কাজ করি, কম্পিউটার ব্যবহার করি, যাদের শরীরের ওজন কিছুটা বেশি এবং যারা অবসর জীবন যাপন বেশি করি তাঁদের এ সমস্যা হবার সম্ভাবনা বেশি।

২. ফ্র্যাকচারঃ

মেরুদণ্ডের হাড়গুলি দুর্ঘটনার সময় ভেঙে যেতে পারে, যেমন গাড়ি দুর্ঘটনা বা পড়ে যাওয়ার পর। এর ফলে মেরুদন্ডের কশেরুকা পিছলে সামনে বা পিছনে চলে যেতে পারে। এছাড়া কশেরুকা ভেঙ্গে যেতে পারে। এর বাইরে কখনো কশেরুকার সংযোগস্থলে বা আর্চে ফ্র্যাকচার হতে পারে।

৩. ডিস্ক সমস্যাঃ

এটি কোমর ব্যথার একটি অন্যতম কারণ। ডিস্ক হল আমাদের মেরুদন্ডের কুশন। এটি মেরুদন্ডকে যে কোন অবস্থায় শক- নেয়া বা চাপ নেয়ায় সহায়তা করে। ডিস্কগুলি মেরুদণ্ডে তাদের অবস্থান থেকে স্ফীত হয়ে জেলি বের হয়ে যায় ফলে মেরুদন্ডের স্নায়ুতে চাপ পড়তে পারে। তারা সরে যেতে পারে বা ছিঁড়ে জেল বের হয়ে যেতে পারে যা হার্নিয়েটেড ডিস্ক নামে পরিচিত। হার্নিয়েটেড ডিস্ক কোমরে পিএলআইডি নামে পরিচিত।

এর ফলে কোমর ব্যথা, বা ব্যথা এক পা বা দুই পায়ে ছড়িয়ে যেতে পারে। এছাড়া ঝি ঝি, ভার ভার বা অবশ অবশ বোধ হতে পারে। কখনো কখনো এ রোগে রোগী বিছানায় পড়ে যান, পা জ্বালাপোড়া করতে পারে, পশ্রাব পায়খানায় নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে। এছাড়া এর ফলে কোমর শরীরের এক দিকে বেকে যেতে পারে।

৪) কাঠামোগত সমস্যাঃ

বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে বয়সের সাথে, ডিস্কগুলি শুকিয়ে যেতে থাকে, ডিস্কের স্পেস কমে যায় এবং তারা মেরুদন্ডকে কম সুরক্ষা দিতে পারে, যাকে ডিজেনারেটিভ ডিস্ক রোগ বলে। মেরুদণ্ডের স্টেনোসিস নামক একটি অবস্থা তখন ঘটে যখন মেরুদণ্ডের কলামটি মেরুদণ্ডের জন্য খুব সংকীর্ণ হয়। মেরুদণ্ডে চাপ পড়ার ফলে সায়্যাটিক স্নায়ুর তীব্র ব্যথা এবং পিঠের নিচের দিকে ব্যথা হতে পারে। ফলে স্কোলিওসিস, মেরুদন্ডের ক্ষয়, মেরুদণ্ডের বক্রতায় সমস্যা, ব্যথা, এবং চলতে অসুবিধা হতে পারে।

৫) বাতঃ

মেরুদন্ডে অস্টিওআর্থারাইটিস হল পিঠের নিচের দিকে ব্যথা হওয়ার সবচেয়ে সাধারণ ধরনের বাত। এটি বয়সের সাথে সম্পর্কিত। আর অল্প বয়সে বা মধ্য বয়সে অ্যানকাইলোসিং স্পন্ডিলাইটিস এর ফলে পিঠের নিচের অংশে ব্যথা, সেক্রো ইলিকাক জয়েন্টে ব্যথা, চলাফেরায় অসুবিধা হতে পারে।

৬) অন্যান্য রোগঃ

মেরুদন্ডে টিউমার, ক্যন্সার ইত্যাদি কারনেও পিঠে ব্যথা হতে পারে। অন্যান্য অবস্থার কারণেও পিঠে ব্যথা হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে কিডনিতে পাথর এবং পেটের এওর্টিক অ্যানিউরিজম।

কোমর ব্যথার চিকিৎসা কি?

কোমর ব্যথার কারণ নির্নয় খুব বেশি জরুরি। ম্যাকানিক্যাল ক্ষেত্রে প্রথম দিকে বেশিরভাগ চিকিৎসকের পরামর্শে বিশ্রামে বা পরামর্শ অনুযায়ী ঘরোয়া চিকিৎসায় এক মাসের মধ্যে ভাল হয়ে যায়। তবে যদি ভুল কারণ নির্নয়, ভুল চিকিৎসা, আংশিক চিকিৎসা, শুধু ব্যথার ঔষদের উপর ভর করে চিকিৎসা ও কারন অনুযায়ী ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা, এক্সারসাইজ ও ফিটিনেসের দিকে নজর না দেয়া হয় তবে এ ব্যথা দীর্ঘমেয়াদী ব্যথায় রুপ নেয় ও খারাপ হতে পারে।

১) ঘরোয়া চিকিৎসাঃ

প্রথম দিকে সর্বোচ্চ ৭ দিন ব্যথা উপশমকারী এবং বরফ বা তাপের ব্যবহার আপনার প্রয়োজন হতে পারে। সম্পুর্ণ বিছানা বিশ্রাম বাঞ্ছনীয় নয়, ফিজিওথেরাপিস্ট আপনাকে ফাংশনাল রেস্টের উপদেশ দিতে পারেন। আপনি যতটা সহ্য করতে পারেন ততই আপনার কার্যক্রম চালিয়ে যান। হালকা ক্রিয়াকলাপ চেষ্টা করুন, কিন্তু চিকিৎসকের পরামর্শে। ধীরে ধীরে পুরা কাজে ফিরে আসা আপনার জন্য উপকারী। বুকের নিচে একটি বা দুইটি বালিশ দিয়ে ১০ মিনিট করে দিনে দুইবার উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে পারেন, এক সপ্তাহ পর্যন্ত।

২) ঔষুধঃ

আপনার কোমরের ব্যথার উপর নির্ভর করে, ডাক্তার আপনাকে নিম্নলিখিত সুপারিশ করতে পারেন। আইবুপ্রোফেন বা ন্যাপ্রক্সেন সোডিয়াম, পিঠের ব্যথা উপশম করতে সাহায্য করতে পারে। এই ওষুধগুলি শুধুমাত্র আপনার ডাক্তারের নির্দেশ অনুসারে নিন। অতিরিক্ত ব্যবহার মারাত্মক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। পেশী শিথিলকারী, যদি হালকা থেকে মাঝারি পিঠের ব্যথা ওটিসি ব্যথা উপশমকারীদের সাথে উন্নতি না করে , আপনার ডাক্তার পেশী শিথিলকারীও লিখে দিতে পারেন।

পেশী শিথিলকারী আপনাকে মাথা ঘোরাতে এবং ঘুমাতে পারে। আপনার ডাক্তারের ঘনিষ্ঠ তত্ত্বাবধানে অল্প সময়ের জন্য ওপিওডযুক্ত অক্সিকোডোন বা হাইড্রোকোডোন ব্যবহার করা যেতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী ব্যথার জন্য ওপিওডগুলি ভাল কা কিছু ধরণের এন্টিডিপ্রেসেন্টস বিশেষ করে ডুলোক্সেটিন (সিম্বাল্টা) এবং ট্রাইসাইক্লিক এন্টিডিপ্রেসেন্টস, যেমন অ্যামিট্রিপটাইলিন দীর্ঘস্থায়ী পিঠের ব্যথা উপশম করে তাদের বিষণ্নতার প্রভাব থেকে মুক্তি দেয়।

৩) ফিজিওথেরাপি চিকিৎসাঃ

কোমর ব্যথায় ফিজিওথেরাপি একটি বৈজ্ঞানিক এবং পাশ্বপ্রতিক্রিয়া বিহীন চিকিৎসা। একজন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক আপনার ব্যথায় সঠিক রোগ নির্নয় করে, চিকিৎসা পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক ম্যানুয়াল থেরাপি, ম্যানিপুলেশন থেরাপি, এক্সারসাইজ, বিভিন্ন ফিজিক্যাল এজেন্ট, টেপিং, নিডলিং, মেডিকেশন সহ আপনার ব্যথা নিরাময়, অবস্থানের উন্নতি, কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি ও ব্যথা আবার ফিরে আসা প্রতিরোধ করতে পারেন।

৪) অস্ত্রোপচার এবং অন্যান্য পদ্ধতিঃ

কর্টিসোন ইনজেকশনঃ যদি অন্য ব্যবস্থাগুলি আপনার ব্যথা উপশম না করে তবে অনেক সময় মেরুদন্ডে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে কর্তিসোন ইনজেকশন দিতে পারেন।
রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি নিউরোটমি ও রোপিত স্নায়ু উদ্দীপকঃ আপনার ত্বকের নিচে লাগানো ডিভাইসগুলি ব্যথা সংকেত ব্লক করার জন্য নির্দিষ্ট স্নায়ুতে বৈদ্যুতিক প্রেরণ সরবরাহ করতে পারে।

সার্জারিঃ আপনি সার্জারি করতে পারেন যদি-

  • ক) আপনার ব্যথা ঔষধ ও ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা নিয়ে আরো খারাপ হয় এবং দীর্ঘমেয়াদে ভালো নাহয়ে তীব্রতর হয়।
  • খ) আপনার যদি পস্রাব বা পায়খানা ধরে রাখতে না পারেন বে ধরে রাখতে কস্ট হয় এবং ফিজিওথেরাপিতে তার উন্নতি না হয়।
  • গ) আপনার যদি সমস্যাটি প্যাথলজিক্যাল সমস্যা হয় এবং আপনার জীবন বাচাতে সার্জারির প্রয়োজন হয়।

    তবে গবেষণা মতে, সার্জারির আগে ও পরে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের পরামর্শে এক্সারসাইজ ও পোস্ট-সার্জিক্যাল ফিজিওথেরাপি নিলে আপনার সার্জারির সফলতা অনেক বেশি বেড়ে যায়।
Follow me

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This field is required.

This field is required.

error: Content is protected !!
পরামর্শ নিতে 01975451525