পিএলআইডি জনিত কোমর ব্যথা। পিএলআইডি বা প্রোল্যাপসড লাম্বার ইন্টারভার্টেব্রাল ডিস্ক একটি সাধারণ কিন্তু অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক রোগ, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেরুদণ্ডের কোমরের অংশে ঘটে থাকে। এই অবস্থায় মেরুদণ্ডের ডিস্কের নরম জেলির মতো উপাদান তার স্বাভাবিক স্থান থেকে বেরিয়ে আসে এবং স্নায়ুর উপর চাপ সৃষ্টি করে।
পিএলআইডি জনিত কোমর ব্যথা
ফলস্বরূপ, তীব্র কোমর ব্যথা দেখা দেয়, যা অনেক সময় কোমর থেকে পায়ের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। পিএলআইডি জনিত কোমর ব্যথা সাধারণত হঠাৎ করে শুরু হয় এবং তা নড়াচড়া বা দৈনন্দিন কাজকর্মে বিঘ্ন ঘটায়। এই ব্যথা হাঁটাচলা, সোজা হয়ে দাঁড়ানো, এমনকি কাশির সময়ও বেড়ে যেতে পারে। অনেক সময় এই ব্যথার সাথে পায়ের দিকে ঝিনঝিন অনুভূতি, অসাড়তা, বা দুর্বলতা দেখা দিতে পারে।
কোমর থেকে পায়ে ব্যথা
কোমর থেকে পায়ে ব্যথা সাধারণত সায়াটিকা (Sciatica) নামে পরিচিত, যা কোমরে সায়াটিক নার্ভে চাপ পড়ার কারণে হয়। সায়াটিক নার্ভ হল শরীরের দীর্ঘতম নার্ভ, যা কোমর থেকে শুরু করে পায়ের নিচ পর্যন্ত বিস্তৃত। সায়াটিকার ব্যথা কোমর থেকে শুরু হয়ে নিতম্ব, উরু, পায়ের পেছন দিক দিয়ে গোড়ালি পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে পারে।
ডিস্ক হের্নিয়েশন বা PLID: ডিস্ক হের্নিয়েশন, যা PLID (Prolapsed Lumbar Intervertebral Disc) নামেও পরিচিত, হলো মেরুদণ্ডের একটি সাধারণ সমস্যা যেখানে মেরুদণ্ডের ডিস্কের নরম কেন্দ্রীয় বস্তু তার বাইরের শক্ত আবরণ ভেদ করে বেরিয়ে আসে এবং স্নায়ুর উপর চাপ সৃষ্টি করে। এই সমস্যাটি মূলত কোমরে ঘটে এবং এটি সাধারণত কোমর থেকে পায়ে ব্যথা, ঝিনঝিন অনুভূতি, অসাড়তা, এবং মাংসপেশির দুর্বলতা সৃষ্টি করে।
মেরুদণ্ডের ক্ষয় (স্পন্ডাইলোসিস): কোমর থেকে পায়ে ব্যথার একটি সাধারণ কারণ হলো মেরুদণ্ডের ক্ষয় বা স্পন্ডাইলোসিস। এটি একটি বয়সজনিত রোগ, যেখানে মেরুদণ্ডের হাড়, ডিস্ক, এবং জয়েন্টগুলির স্বাভাবিক ক্ষয় হয়। এই ক্ষয়প্রক্রিয়ার ফলে মেরুদণ্ডের মধ্যবর্তী ডিস্কগুলি সংকুচিত হয়ে যায় এবং মেরুদণ্ডের হাড়ের প্রান্তে অস্থি বৃদ্ধির (বোন স্পার) সৃষ্টি হতে পারে। এই অস্থি বৃদ্ধি বা ক্ষয়প্রক্রিয়া মেরুদণ্ডের স্নায়ুগুলির ওপর চাপ সৃষ্টি করে, যা কোমর থেকে পায়ে ব্যথার কারণ হয়। বিশেষ করে, যখন লাম্বার (কোমরের) মেরুদণ্ডের ক্ষয় ঘটে, তখন এই ব্যথা পায়ের পেছনের দিকে ছড়িয়ে পড়ে, যা অনেক সময় সায়াটিকার মতো লক্ষণ তৈরি করে।
স্পাইনাল স্টেনোসিস: স্পাইনাল ক্যানেল সংকোচন হলে সায়াটিক নার্ভে চাপ পড়ে এবং সেই চাপের কারণে কোমর থেকে পায়ে ব্যথা, অসাড়তা, এবং দুর্বলতা সৃষ্টি হতে পারে। স্পাইনাল স্টেনোসিস সাধারণত বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে ঘটে, যখন মেরুদণ্ডের ডিস্ক, হাড়, বা লিগামেন্টগুলি প্রাকৃতিকভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে সংকুচিত হয়ে যায় এবং স্পাইনাল ক্যানেল সংকীর্ণ হয়ে যায়। এছাড়া, ক্যালসিয়ামের অভাবজনিত কারণে হাড়ের বৃদ্ধি (বোন স্পার) বা হাড়ের শক্ত অংশের বৃদ্ধি এবং লিগামেন্টের পুরুত্বও এই সংকোচনের কারণ হতে পারে (1)।
পিরিফরমিস সিন্ড্রোম: কোমর থেকে পায়ে ব্যথার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো পিরিফরমিস সিন্ড্রোম, যেখানে নিতম্বের গভীরে অবস্থিত পিরিফরমিস পেশি সায়াটিক নার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। এই পেশিটি নিতম্ব থেকে উরুর হাড় পর্যন্ত বিস্তৃত এবং যখন এটি অতিরিক্ত সংকুচিত হয় বা প্রদাহজনিত কারণে স্নায়ুতে চাপ দেয়, তখন কোমর থেকে পায়ের পেছনের দিকে ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণত, এই ব্যথা সায়াটিকার মতোই অনুভূত হয়, তবে এটি নিতম্ব থেকে শুরু হয় এবং পায়ের পেছন দিক দিয়ে পায়ের পাতায় পৌঁছাতে পারে।
ইনজুরি বা আঘাত: মেরুদণ্ডে হঠাৎ আঘাত লাগলে বা দুর্ঘটনার ফলে ডিস্ক, লিগামেন্ট, অথবা পেশিতে ক্ষতি হতে পারে, যা নার্ভে চাপ সৃষ্টি করে। বিশেষ করে লাম্বার স্পাইন বা কোমরের নিচের অংশে আঘাত পাওয়ার ফলে ডিস্ক স্থানচ্যুত হয়ে (ডিস্ক হের্নিয়েশন) স্নায়ুর শিকড়ে চাপ দেয়, যা কোমর থেকে পায়ে ব্যথা, ঝিনঝিন অনুভূতি বা পায়ে দুর্বলতার সৃষ্টি করতে পারে।
ভারী বস্তু তোলার সময় ভুল ভঙ্গিতে উঠানো, পড়ে যাওয়া, বা খেলাধুলার সময় সরাসরি কোমরে আঘাত লাগা এসব কারণে এই ধরনের ব্যথা দেখা দিতে পারে। আঘাতজনিত কারণে মেরুদণ্ডের অস্থিসন্ধি বা পেশিতে টান পড়লে তা সায়াটিক নার্ভকে উত্তেজিত করে এবং সেই উত্তেজনা পায়ের পেছন দিক থেকে গোড়ালি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।
কোমর থেকে পায়ে ঝি ঝি ধরা
কোমর থেকে পায়ে ঝি ঝি ধরা বা ঝিনঝিন অনুভূতি সাধারণত সায়াটিকা নামক সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত, যেখানে কোমরের নিচের অংশ থেকে পায়ের দিকে যাওয়া সায়াটিক নার্ভে চাপ পড়ে। এই চাপের কারণ হতে পারে ডিস্ক হের্নিয়েশন বা PLID, যেখানে মেরুদণ্ডের ডিস্কের নরম কেন্দ্র স্থানচ্যুত হয়ে স্নায়ুর ওপর চাপ সৃষ্টি করে। এছাড়া, স্পাইনাল স্টেনোসিস বা মেরুদণ্ডের খালের সংকোচন, পিরিফরমিস সিন্ড্রোম, অথবা আঘাতজনিত কারণে স্নায়ুর উত্তেজনা তৈরি হলে এই ঝিনঝিন অনুভূতি দেখা দিতে পারে।
এটি সাধারণত কোমরের নিচের অংশ থেকে শুরু হয়ে নিতম্ব, উরু এবং পায়ের পেছনের দিক দিয়ে পায়ের পাতায় পর্যন্ত প্রসারিত হয়। এই অবস্থায় পায়ে অসাড়তা, দুর্বলতা, পিন চুলকানোর মতো অনুভূতি, কিংবা মাংসপেশির শক্তি কমে যাওয়ার মতো উপসর্গও দেখা দিতে পারে। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা, ভারী ওজন তোলা, বা ভুল ভঙ্গিতে শোয়া বা বসার কারণে এই ঝিনঝিন অনুভূতি তীব্র হতে পারে (2)।
কোমর ব্যথা ও পায়ে ঝিনঝিন ভাব কেন হয়
কোমর ব্যথা ও পায়ে ঝিনঝিন ভাব সাধারণত মেরুদণ্ডের নিচের অংশে (লাম্বার স্পাইন) স্নায়ুর ওপর চাপ পড়ার কারণে হয়। এই অবস্থার পিছনে বেশ কয়েকটি সাধারণ কারণ রয়েছে:
ডিস্ক হের্নিয়েশন বা PLID: মেরুদণ্ডের ডিস্কের নরম কেন্দ্র তার বাইরের শক্ত স্তর ভেদ করে বেরিয়ে আসে এবং স্নায়ুর শিকড়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। এর ফলে কোমরে তীব্র ব্যথা এবং সেই ব্যথা সায়াটিক নার্ভের মাধ্যমে পায়ের পেছন দিক দিয়ে নিচ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে, যা ঝিনঝিন বা অসাড়তার অনুভূতি তৈরি করে।
স্পাইনাল স্টেনোসিস: মেরুদণ্ডের খাল সংকুচিত হলে, স্নায়ুতে চাপ পড়ে এবং স্নায়ুর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। এই চাপের কারণে কোমরে ব্যথা এবং পায়ে ঝিনঝিন ভাব, দুর্বলতা বা অসাড়তা অনুভূত হতে পারে। বিশেষ করে হাঁটাচলার সময় ব্যথা ও ঝিনঝিন ভাব বেড়ে যেতে পারে।
পিরিফরমিস সিন্ড্রোম: নিতম্বের গভীরে অবস্থিত পিরিফরমিস পেশি যদি সায়াটিক নার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি করে, তাহলে কোমর থেকে পায়ে ব্যথা ও ঝিনঝিন ভাব হতে পারে। এটি সাধারণত নিতম্ব থেকে শুরু হয়ে উরু ও পায়ের নিচ পর্যন্ত প্রসারিত হয়।
সায়াটিকা: কোমরের নিচের অংশ থেকে পায়ের দিকে যাওয়া সায়াটিক নার্ভে কোনো কারণে চাপ পড়লে, কোমরে ব্যথা এবং পায়ে ঝিনঝিন অনুভূতি বা অসাড়তা দেখা দেয়। এটি ডিস্ক হার্নিয়েশন, আঘাত লাগা, বা মেরুদণ্ডের অন্যান্য সমস্যার কারণে হতে পারে।
নার্ভ ইনজুরি বা প্রদাহ: কোনো ধরনের আঘাত লাগলে, প্রদাহ বা নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হলে স্নায়ুতে সঠিকভাবে সংকেত প্রেরণ ব্যাহত হয়, যার ফলে ঝিনঝিন ভাব বা পায়ের মাংসপেশিতে দুর্বলতা দেখা দেয়।
ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি: দীর্ঘমেয়াদি ডায়াবেটিসের কারণে স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হলে, কোমর ব্যথার পাশাপাশি পায়ে ঝিনঝিন ভাব, পা অসাড় হয়ে যাওয়া বা পায়ে পিন চুলকানোর মতো অনুভূতি হতে পারে।
হাটতে গিয়ে কোমর ব্যথা
হাঁটতে গিয়ে কোমর ব্যথা সাধারণত মেরুদণ্ড, পেশি, বা নার্ভের বিভিন্ন সমস্যার কারণে হয়ে থাকে। কোমরে বা লাম্বার স্পাইনে অতিরিক্ত চাপ পড়লে বা ভারসাম্যহীনতার কারণে হাঁটার সময় ব্যথা অনুভূত হতে পারে। এর অন্যতম কারণ হলো ডিস্ক হের্নিয়েশন বা PLID, যেখানে মেরুদণ্ডের ডিস্ক স্থানচ্যুত হয়ে স্নায়ুর ওপর চাপ সৃষ্টি করে, যা হাঁটার সময় তীব্র কোমর ব্যথা এবং পায়ে ঝিনঝিন ভাব তৈরি করতে পারে। এছাড়াও, স্পাইনাল স্টেনোসিস, অর্থাৎ মেরুদণ্ডের ক্যানেল সংকীর্ণ হয়ে গেলে, স্নায়ুতে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় হাঁটার সময় ব্যথা বৃদ্ধি পায় এবং পায়ে দুর্বলতা ও ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়।
মেরুদণ্ডের ক্ষয় (স্পন্ডাইলোসিস) বা অস্থিসন্ধির ক্ষয়জনিত কারণে স্নায়ু উত্তেজিত হলে, হাঁটার সময় কোমরে ব্যথা ও অস্বস্তি অনুভূত হতে পারে। দীর্ঘ সময় বসে থাকা, শারীরিক পরিশ্রম, বা ভুল ভঙ্গিতে বসা বা দাঁড়ানোর কারণে কোমরের পেশিগুলো দুর্বল হয়ে গেলে, সেগুলোর ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে এবং পেশির স্প্যাজম সৃষ্টি হয়, যা হাঁটার সময় কোমরে ব্যথার কারণ হতে পারে। এছাড়াও, পিরিফরমিস সিন্ড্রোমের মতো রোগের ক্ষেত্রে, নিতম্বের গভীরে অবস্থিত পেশি সায়াটিক নার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি করে, যার ফলে কোমর থেকে পায়ে ব্যথা ছড়ায় এবং হাঁটার সময় ব্যথা তীব্র হয়। কোমরের মাংসপেশির ভারসাম্যহীনতা, শিরদাঁড়ার বক্রতা বা ইনজুরি থেকেও এই সমস্যা দেখা দিতে পারে (3)।
হাঁটার সময় পিঠ ও কোমরে ব্যথা হওয়ার কারণ
হাঁটার সময় পিঠ ও কোমরে ব্যথা হওয়ার বেশ কয়েকটি কারণ থাকতে পারে, যা মেরুদণ্ড, পেশি, অস্থিসন্ধি কিংবা স্নায়ুর সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত। এই ব্যথা সাধারণত মেরুদণ্ডের লাম্বার (কোমর) এবং থোরাসিক (পিঠের উপরের অংশ) অংশে অনুভূত হয় এবং হাঁটার সময় ব্যথার তীব্রতা বাড়তে পারে।
ডিস্ক হের্নিয়েশন বা PLID মেরুদণ্ডের কশেরুকাগুলির মধ্যে অবস্থিত ডিস্কের নরম কেন্দ্র যদি তার বাইরের শক্ত স্তর ভেদ করে বেরিয়ে আসে এবং স্নায়ুর ওপর চাপ সৃষ্টি করে, তখন এটি ডিস্ক হের্নিয়েশন বা PLID নামে পরিচিত হয়। এর মেরুদণ্ডের মধ্যবর্তী খাল সংকুচিত হয়ে যাওয়া, যা স্নায়ুর ওপর চাপ সৃষ্টি করে। হাঁটার সময় এই চাপ বেড়ে যাওয়ায় কোমর ও পিঠে ব্যথা বৃদ্ধি পায় এবং পায়ে দুর্বলতা ও ঝিনঝিন ভাব হতে পারে।
মাসল স্প্যাজম বা পেশির টান দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা, শারীরিক পরিশ্রম বা ভুল ভঙ্গিতে শোয়া বা দাঁড়ানোর কারণে পিঠ ও কোমরের পেশিতে অতিরিক্ত চাপ পড়লে পেশি শক্ত হয়ে যায় এবং স্প্যাজম সৃষ্টি হয়। হাঁটার সময় এই পেশির সংকোচন আরও বাড়তে পারে, যা ব্যথার কারণ হয়।
স্পন্ডাইলোসিস বা মেরুদণ্ডের ক্ষয় বয়সজনিত কারণে মেরুদণ্ডের অস্থিসন্ধি, ডিস্ক এবং লিগামেন্ট ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে গেলে, মেরুদণ্ডের গঠনগত পরিবর্তন ঘটে এবং স্নায়ুতে চাপ সৃষ্টি হয়। যা হাঁটার সময় কোমর ও পিঠে ব্যথার তীব্রতর বাড়িয়ে দেয়।
পিরিফরমিস সিন্ড্রোম নিতম্বের গভীরে অবস্থিত পিরিফরমিস পেশি, যা নিতম্বের পেছনের অংশ থেকে উরুর উপরের অংশ পর্যন্ত বিস্তৃত, সায়াটিক নার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। সায়াটিক নার্ভ শরীরের দীর্ঘতম স্নায়ু, যা কোমর থেকে শুরু হয়ে পায়ের নিচ পর্যন্ত যায়। পিরিফরমিস পেশির অতিরিক্ত সংকোচন বা প্রদাহের কারণে যখন এই নার্ভে চাপ পড়ে, তখন কোমরের নিচ থেকে শুরু করে নিতম্ব, পিঠ এমনকি পায়ের পেছন দিক পর্যন্ত ব্যথা অনুভূত হয়।
পেশি দুর্বলতা ও মাংসপেশির ভারসাম্যহীনতা মেরুদণ্ডের চারপাশের পেশিগুলো যাকে কোর মাংসপেশি (কোমরের নিচের অংশের পেশি, পেটের পেশি) বলা হয়, শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং শিরদাঁড়াকে সঠিকভাবে সাপোর্ট দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদি এই পেশিগুলো দুর্বল হয়ে যায় বা সঠিকভাবে কাজ না করে, তাহলে মেরুদণ্ডে অতিরিক্ত চাপ পড়ে এবং হাঁটার সময় পিঠ ও কোমরে ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
শিরদাঁড়ার বক্রতা বা স্কোলিওসিস শিরদাঁড়া স্বাভাবিক সোজা অবস্থার পরিবর্তে একপাশে বেঁকে যায়, ইংরেজি “S” বা “C” আকৃতির মতো দেখতে হয়। এই বক্রতা সাধারণত বয়ঃসন্ধিকালে (adolescence) বিকাশ লাভ করে, তবে এটি যে কোনো বয়সে হতে পারে। শিরদাঁড়ার এই অস্বাভাবিক বক্রতার কারণে শরীরের ভারসাম্য ব্যাহত হয়, ফলে হাঁটার সময় কোমর এবং পিঠের পেশিগুলোর ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে, যার ফলে ব্যথা বেড়ে যায়।
ইনজুরি বা আঘাত আঘাতজনিত কারণে পিঠ ও কোমরের ব্যথা সাধারণত তীব্র এবং তাৎক্ষণিকভাবে শুরু হয়, তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করতে পারে। আঘাতের ফলে মেরুদণ্ডের ডিস্ক স্থানচ্যুত হতে পারে, যা স্নায়ুর ওপর চাপ সৃষ্টি করে এবং কোমর থেকে পায়ের দিকে ব্যথা ও ঝিনঝিন ভাব সৃষ্টি করে। এছাড়া, মেরুদণ্ডের হাড় বা লিগামেন্টে ফ্র্যাকচার বা টান পড়লে, পিঠ ও কোমরের মাংসপেশিতে অতিরিক্ত চাপ পড়ে, যার ফলে হাঁটার সময় ব্যথা অনুভব হয়।
পিএলআইডি সংক্রান্ত কোমর ব্যথায় করণীয়/ কোমর ব্যথা হলে করণীয়
PLID (Prolapsed Lumbar Intervertebral Disc) বা ডিস্ক হের্নিয়েশন সংক্রান্ত কোমর ব্যথায় সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। PLID সংক্রান্ত কোমর ব্যথা উপশমে নিচে কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ দেওয়া হলো
বিশ্রাম PLID-এর প্রাথমিক পর্যায়ে কয়েকদিন বিশ্রাম নেওয়া খুবই জরুরী। অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম বা ভারী ওজন তোলার কাজ বন্ধ রাখতে হবে। তবে পুরোপুরি শুয়ে না থেকে হালকা কাজকর্ম করা উচিত, কারণ দীর্ঘ সময় শুয়ে থাকলে পেশি দুর্বল হয়ে যেতে পারে (4)।
গরম বা ঠান্ডা সেঁক আঘাতজনিত ব্যথা বা প্রদাহ হলে প্রথম ৪৮-৭২ ঘণ্টা ঠান্ডা সেঁক ব্যবহার করা উচিত। এটি ব্যথাযুক্ত স্থানে প্রদাহ কমায়, স্নায়ুর কার্যকলাপ হ্রাস করে এবং রক্ত সঞ্চালন কমিয়ে ব্যথা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। ঠান্ডা সেঁক দেওয়ার জন্য আইস প্যাক ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে এটি সরাসরি ত্বকে প্রয়োগ না করে একটি পাতলা কাপড় দিয়ে মুড়ে ১৫-২০ মিনিট ধরে দিনে কয়েকবার প্রয়োগ করা উচিত। অন্যদিকে, পুরনো ব্যথা, পেশির টান বা ক্রনিক ব্যথার ক্ষেত্রে গরম সেঁক ব্যবহার করা কার্যকর।
গরম সেঁক পেশি শিথিল করতে, রক্ত সঞ্চালন বাড়াতে এবং ব্যথা ও অস্বস্তি কমাতে সাহায্য করে। গরম সেঁকের জন্য হট প্যাক, গরম পানির বোতল বা ইলেকট্রিক হিটিং প্যাড ব্যবহার করা যেতে পারে, যা ১৫-২০ মিনিট ধরে দিনে ২-৩ বার প্রয়োগ করা উচিত (5)।
ব্যথানাশক ওষুধ প্রাথমিকভাবে নন-স্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগস (NSAIDs), যেমন আইবুপ্রোফেন বা ন্যাপ্রোক্সেন, কোমরের ব্যথা কমাতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এই ওষুধগুলো প্রদাহ কমিয়ে এবং স্নায়ুর উত্তেজনা হ্রাস করে ব্যথা উপশমে সহায়তা করে। তীব্র বা দীর্ঘস্থায়ী ব্যথার ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী মাংসপেশি শিথিলকারক ওষুধ (Muscle Relaxants) যেমন টিজানিডিন বা ডায়াজিপাম ব্যবহার করা যেতে পারে, যা পেশির টান কমাতে সাহায্য করে। পিএলআইডি এর আধুনিক চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে
পিএলআইডি ব্যথা
ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের পরামর্শে ফিজিওথেরাপি শুরু করা যেতে পারে। ফিজিওথেরাপি PLID জনিত কোমর ব্যথার ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকর। নির্দিষ্ট কিছু ব্যায়াম, যেমন ম্যাকেঞ্জি এক্সারসাইজ, পেলভিক টিল্ট এবং কোর স্ট্রেন্থেনিং এক্সারসাইজ পেশির শক্তি ও নমনীয়তা বাড়াতে সাহায্য করে। ফিজিওথেরাপিস্ট রোগীর অবস্থা অনুযায়ী বিশেষ ধরনের ব্যায়াম নির্ধারণ করেন, যা কোমর এবং পায়ের পেশীকে শক্তিশালী ও নমনীয় করে তোলে।
একজন গ্র্যাজুয়েট ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ফিজিক্যাল অ্যাাসেসমেন্টের মাধ্যমে রোগীর শারিরীক অবস্থা পর্যালোচনা করে কারেকশন থেরাপির গ্রহনের মাধ্যমে এই রোগ থেকে পুরোপুরি মুক্তি পাওয়া সম্ভব। কারেকশন থেরাপির মাধ্যমে কোমরের মেরুদণ্ডের হাঁড়ের কাঠামো উন্নতি সহ সংশ্লিষ্ট মাংশপেশীর শক্তিবৃদ্ধি করা যায়, যার ফলে পুনরায় এই সমস্যাটি ফিরে আসার সম্ভাবনা অনেকাংশেই কমে যায়। বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি হাসপাতাল, প্রাইভেট চেম্বার ও ক্লিনিক সহ ছোট-বড় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ফিজিওথেরাপি বা ম্যানুয়াল থেরাপি চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন।
তবে অবশ্যই একজন গ্রাজুয়েট ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের কাছে সঠিক রোগ নির্ণয়ের মাধ্যমে চিকিৎসা নেয়া উচিৎ। বর্তমানে বাংলাদেশে বিভিন্ন ফিজিওথেরাপি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একমাত্র ASPC ম্যানু্পুলেশন থেরাপি সেন্টার (House #U64, Noorjahan Road Mohammadpur, Dhaka-1207) এ শুধুই ম্যানুয়াল থেরাপির মাধ্যমে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। Structural Diagnosis & Management (SDM) টেকনিকের ভিত্তিতে রোগীর অবস্থা অনু্যায়ি কারেকশন থেরাপির চিকিৎসা প্রদান করে থাকে যার ফলে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে রোগী সর্বোচ্চ সুস্থতা পায়।
জীবনযাত্রার পরিবর্তন ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা এবং ধূমপান পরিহার করা উচিত, কারণ অতিরিক্ত ওজন এবং ধূমপান মেরুদণ্ডের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে এবং PLID-এর ঝুঁকি বাড়ায়। দৈনন্দিন কাজকর্মে সঠিক শারীরিক অবস্থান বজায় রাখা খুবই জরুরী। বসার সময় কোমর সোজা রেখে বসা এবং কোমরের নিচে সাপোর্ট দেওয়া উচিত। হাঁটার সময় সোজা হয়ে চলাফেরা করা এবং ভারি ওজন তোলার সময় সামনের দিকে ঝুকে তোলা উচিত নয়। শোয়ার সময় কোমরের নিচে একটি বালিশ বা কুশন দিয়ে সাপোর্ট দিতে পারেন, যাতে মেরুদণ্ড সোজা থাকে। পাশে শোয়ার সময় হাঁটুগুলো সামান্য বাঁকা রেখে একটি বালিশের সাহায্যে হাঁটুগুলোর মাঝে সাপোর্ট দেওয়া উচিত।
সার্জারি: যদি সব ধরনের চিকিৎসা ব্যর্থ হয় এবং ব্যথা এতটাই তীব্র হয় যে দৈনন্দিন কার্যক্রম ব্যাহত হয়, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সার্জারি (যেমন মাইক্রোডিসেকটমি বা লামিনেকটমি) করা যেতে পারে।
তথ্যসূত্র
- Genevay, S. and Atlas, S.J., 2010. Lumbar spinal stenosis. Best practice & research Clinical rheumatology, 24(2), pp.253-265. https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S1521694209001247
- Valat, J.P., Genevay, S., Marty, M., Rozenberg, S. and Koes, B., 2010. Sciatica. Best practice & research Clinical rheumatology, 24(2), pp.241-252. https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S1521694209001417
- Melancia, J.L., Francisco, A.F. and Antunes, J.L., 2014. Spinal stenosis. Handbook of clinical neurology, 119, pp.541-549. https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/B9780702040863000357
- Postacchini, F., 1999. Management of herniation of the lumbar disc. The Journal of Bone & Joint Surgery British Volume, 81(4), pp.567-576. https://boneandjoint.org.uk/article/10.1302/0301-620x.81b4.0810567
- Malanga, G.A., Yan, N. and Stark, J., 2015. Mechanisms and efficacy of heat and cold therapies for musculoskeletal injury. Postgraduate medicine, 127(1), pp.57-65. https://www.tandfonline.com/doi/abs/10.1080/00325481.2015.992719
- পায়ের গোড়ালি ব্যথা কিসের লক্ষণ - February 23, 2025
- পিঠে ব্যথা কিসের লক্ষণ? - February 18, 2025
- ডিস্ক প্রলাপ্স নিয়ে সাধারণ ভুল ধারণা: ডিস্ক প্রলাপ্স মানেই কি সার্জারি লাগবে? - February 15, 2025