লাম্বার স্পন্ডাইলোসিস কমানোর উপায়, লাম্বার স্পন্ডাইলোসিস কেন হয়, লাম্বার স্পন্ডাইলোসিস কি, স্পন্ডাইলোসিস হলে কি ব্যায়াম করা যায়। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ তার জীবনের কোন না কোন সময় কোমর ব্যথায় ভোগেন কিন্তু তারা মনে করেন এই ব্যথা এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। কোমর ব্যথা দীর্ঘদিন ধরে থাকার ফলে অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় ব্যথা আর শুধু কোমরের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে এক পায়ে বা দুই পায়ে চলে আসে। এর পাশাপাশি অনেকের আবার ঝিনঝিন ভার ভার অবস মনে হয়। যত দিন যায় পা আস্তে আস্তে দুর্বল হতে শুরু করে। এই ধরনের কোমর ব্যথা কে মেডিকেল সাইন্সের ভাষায় লাম্বার স্পন্ডিলোসিস বলে।

লাম্বার স্পন্ডাইলোসিস কি/লাম্বার স্পন্ডিলাইটিস কি?

লাম্বার স্পন্ডাইলোসিস হলো কোমরের মেরুদন্ডের এক ধরনের ক্ষয় জনিত সমস্যা, যা মূলত বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মেরুদণ্ডের ডিস্ক এবং জয়েন্টগুলোর ক্ষয়ের ফলে হয় এবং এর পাশাপাশি পায়ে ঝিনঝিনে অনুভূতি বা চলাফেরায় অসুবিধার মতো লক্ষণ দেখা দেয়। লাম্বার স্পন্ডাইলোসিস কি, কেন হয় এবং এর চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা

লাম্বার স্পন্ডাইলোসিস কেন হয়?

লাম্বার স্পন্ডাইলোসিস প্রধানত মেরুদণ্ডের বয়স জনিত ক্ষয় প্রক্রিয়া, যা সময়ের সাথে সাথে স্বাভাবিক ভাবেই ঘটে। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে মেরুদণ্ডের ডিস্কগুলো পাতলা হয়ে যায় এবং জয়েন্টগুলোর উপর অতিরিক্ত চাপ পড়তে থাকে। তবে কিছু অন্যান্য কারণেও লাম্বার স্পন্ডিলোসিস হতে পারে যেমনঃ

অতিরিক্ত পরিশ্রম: আমদের মধ্যে অনেকই নিয়মিত ভারী ওজন তোলার কাজ করেন আবার অনেকই দীর্ঘ সময় ধরে শারীরিক পরিশ্রম করেন যার ফলে আমাদের মেরুদণ্ডের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে। এই চাপের কারণে মেরুদণ্ডের ডিস্ক ও জয়েন্টগুলো দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং অনেক ক্ষেত্রেই স্থায়ী ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ডিস্কগুলো মূলত আমাদের মেরুদণ্ডের হাড়গুলো কে একে অপরের সাথে ঘর্ষণ থেকে রক্ষা করে এবং আমাদের শরীরের ভার বহন করে। দীর্ঘদিন ধরে ভারী পরিশ্রমের ফলে কোমরের পেশি গুলো দুর্বল হয়ে পরার পাশাপাশি কোমরে ব্যথা হয় (1)।

কোমরে স্পন্ডিলাইটিস

ভুল শারীরিক ভঙ্গি: আমাদের মধ্যে একটি প্রবানতা বেশী কাজ করে যেমন আমরা যখন কোন কাজ করি সামনের দিকে ঝুঁকে বসে কাজ করি, যখন কোন ওজন তুলি নিঁচু হয়ে ঝুঁকে তুলতে বেশী পছন্দ এছাড়াও আমরা যখন দীর্ঘ সময় ধরে বসে থাকি তখন পেট ভাঁজ করে কুঁজো হয়ে বসি বা ভুল শারীরিক ভঙ্গিতে বসতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি যার ফলে মেরুদণ্ডে অতিরিক্ত চাপ পড়ে এবং স্পাইনাল ডিস্ক ও জয়েন্টগুলোর ক্ষতি করে। এই ক্রমাগত চাপের ফলে ডিস্কে ডিজেনারেশন বা ক্ষয় হয় এবং ব্যথা হয় (2)।

আঘাত: আঘাত বা দুর্ঘটনা লাম্বার স্পন্ডাইলোসিসের অন্যতম কারণ হতে পারে। কোমরের মেরুদণ্ডে সরাসরি আঘাত পেলে বা দুর্ঘটনার ফলে ডিস্ক, জয়েন্ট বা আশেপাশের টিস্যুগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে, আঘাতের কারণে মেরুদণ্ডের ডিস্কে ফাটল, ফোলা ভাব বা জয়েন্টের গঠনে পরিবর্তন হলে মেরুদণ্ডের স্থিতিশীলতা নষ্ট হয় এবং ডিস্ক ডিজেনারেশন বা ক্ষয়প্রক্রিয়া শুরু হয় (3)।

অতিরিক্ত ওজন: শরীরের অতিরিক্ত ওজনের কারণে মেরুদণ্ডের নিচের অংশ, বিশেষ করে কোমরের ডিস্ক ও জয়েন্টগুলোর উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়। মেরুদণ্ডের প্রধান কাজ হলো শরীরের ভার বহন করা, কিন্তু অতিরিক্ত ওজন এই ভার বহনের ক্ষমতা ছাড়িয়ে যায়, যার ফলে মেরুদণ্ডের ডিস্ক ও জয়েন্ট গুলো দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। বিশেষত, ওজন বৃদ্ধির কারণে মেরুদণ্ডের ডিস্কের মধ্যে থাকা প্রাকৃতিক কুশন বা শক-অ্যাবসর্বিং ক্ষমতা কমে যায়, যা ডিস্ক ডেজেনারেশন বা ক্ষয় প্রক্রিয়াকে বাড়িয়ে দেয় (4)।

লাম্বার স্পন্ডাইলোসিস কমানোর উপায়?

লাম্বার স্পন্ডাইলোসিস কমানোর জন্য বেশ কয়েকটি কার্যকর পদ্ধতি রয়েছে, যা প্রতিদিনের অভ্যাসে যোগ করা গেলে কোমর ও মেরুদণ্ডের স্বাস্থ্য রক্ষা করা সম্ভব। জীবন যাত্রা ও শারীরিক ফিটনেসের উপর ভিত্তি করে এই পদ্ধতি গুলো নির্ধারণ করা হয়। নিম্নে লাম্বার স্পন্ডাইলোসিস কমানোর কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপায় গবেষণার আলোকে বিশদ বর্ণনা দেওয়া হলো:

ব্যথা নিয়ন্ত্রণের জন্য ওষুধ: প্রাথমিক ভাবে আপনি ব্যথা কমানোর জন্য একজন অর্থোপেডিক চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ খেতে পারেন। ওষুধ খাওয়ার পাশাপাশি আপনাকে প্রতিদিন কমপক্ষে ৩.৭ লিটার পানি পান করতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে তাহলে আপনি এই ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে পারেন।

স্পন্ডিলাইটিস হলে কি করতে হয়

ফিজিওথেরাপি: ব্যথানাশক ওষুধ সেবনের পরেও যদি আপনার ব্যথা না কমে তাহলে একজন ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। ফিজিওথেরাপি, বিশেষ করে ম্যানুয়াল থেরাপি, লাম্বার স্পন্ডাইলোসিস নিরাময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একজন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক আপনার শারীরিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে যথাযথ চিকিৎসা সেবা প্রদান করবেন। আপনি আপনার নিকটস্থ কোনো প্রতিষ্ঠানে এই চিকিৎসা সেবাটি পেতে পারেন (5)।

তবে চিকিৎসা শুরু করার আগে আপনার শারীরিক অবস্থার পর্যালোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে, ASPC ম্যানুপুলেশন থেরাপি সেন্টার (House #U64, Noorjahan Road Mohammadpur, Dhaka-1207) উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করছে, যেখানে Structural Diagnosis & Management (SDM) টেকনিক প্রয়োগ করা হয়। SDM টেকনিকের মাধ্যমে রোগীর গঠনগত পরিবর্তন এবং সংশ্লিষ্ট মাংসপেশি গুলো এসেসমেন্ট করে কারেকশন থেরাপির মাধ্যমে মাংসপেশির শক্তি বৃদ্ধি করা হয়, যা রোগীদের দ্রুত আরোগ্য লাভে সহায়ক।

স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা: অতিরিক্ত ওজন কোমরে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে, যা ডিস্কের ক্ষয় প্রক্রিয়াকে বাড়িয়ে দেয়। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং ব্যায়ামের মাধ্যমে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা মেরুদণ্ডের উপর চাপ কমায় এবং ডিস্ক ডেজেনারেশনের ঝুঁকি কমিয়ে দেয়।

জীবন যাত্রার পরিবর্তন: ধূমপান মেরুদণ্ডের ডিস্কগুলোর রক্ত সঞ্চালন কমায়, যার ফলে ডিস্ক দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয় তাই আমাদের ধূমপানের অভ্যাস পরিত্যাগ করা উচিত। এছাড়া, পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং সঠিক ভঙ্গিতে শোয়ার মাধ্যমে মেরুদণ্ডের উপর চাপ কমাতে পারেন। জীবন যাত্রার মান উন্ননের মাধ্যমে স্পন্ডাইলোসিস থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

স্পন্ডাইলোসিস হলে কি ব্যায়াম করা যায়

স্পন্ডাইলোসিস হলে ব্যায়াম করতে পারেন, যা মেরুদণ্ডের শক্তি এবং স্থিতিশীলতা বাড়াতে সাহায্য করে এবং ব্যথা কমায়। সাধারণত, একজন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের পরামর্শে স্ট্রেচিং, কোর স্ট্যাবিলিটি এবং লো ইম্প্যাক্ট অ্যারোবিক ব্যায়াম করতে পারেন। স্ট্রেচিং ব্যায়াম, যেমন হ্যামস্ট্রিং স্ট্রেচ ও, পিঠ ও কোমরের পেশিগুলো কে নমনীয় রাখতে সাহায্য করে। কোর স্ট্যাবিলিটি ব্যায়াম (যেমন ব্রিজিং এবং বার্ড-ডগ) মেরুদণ্ডের আশেপাশের পেশিগুলো কে শক্তিশালী করে, যা ডিস্কের উপর চাপ কমায়।

লো ইম্প্যাক্ট অ্যারোবিক ব্যায়াম, যেমন হাঁটা, সাঁতার কাটা এবং সাইক্লিং, মেরুদণ্ডের উপর কম চাপ সৃষ্টি করে এবং রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়, যা মেরুদণ্ড কে ঠিক রাখে। গবেষণায় দেখা গেছে যে নিয়মিত এসব ব্যায়াম মেরুদণ্ডের স্থিতিশীলতা বজায় রাখে এবং স্পন্ডিলোসিসের উপসর্গ গুলি নিয়ন্ত্রণে রাখে (6)। তবে, ভারী ওজন বা হাই ইম্প্যাক্ট এক্সারসাইজ এড়ানো এবং একজন ফিজিওথেরাপিস্টের তত্ত্বাবধানে ব্যায়াম করা গুরুত্বপূর্ণ, যাতে মেরুদণ্ডের কোনো অতিরিক্ত ক্ষতি না হয়।

ব্যায়াম করলে কি লাম্বার স্পন্ডাইলোসিস ভালো হয়?

ব্যায়াম লাম্বার স্পন্ডিলোসিসের ব্যথা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিয়মিত ব্যায়াম, যেমন স্ট্রেচিং, কোর স্ট্যাবিলিটি এবং লো ইম্প্যাক্ট অ্যারোবিক এক্সারসাইজ, মেরুদণ্ডের আশেপাশের পেশিগুলোর শক্তি ও স্থিতিস্থাপকতা বাড়াতে সাহায্য করে, যা মেরুদণ্ডের উপর চাপ কমায় এবং স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করে। এসব ব্যায়াম মেরুদণ্ডের ডিস্কের উপর সরাসরি চাপ কমিয়ে ব্যথা হ্রাস করতে সহায়ক।

গবেষণায় দেখা গেছে যে নিয়মিত এসব ব্যায়াম মেরুদণ্ডের স্থায়িত্ব রক্ষা করে এবং স্পন্ডিলোসিসের উপসর্গ নিয়ন্ত্রণে রাখে (7)। এছাড়া, লো ইম্প্যাক্ট অ্যারোবিক ব্যায়াম, যেমন হাঁটা এবং সাঁতার কাটা, রক্ত সঞ্চালন বাড়িয়ে ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যুগুলোর পুনরুদ্ধারে সহায়ক হয়। তবে, ব্যায়াম শুরু করার আগে একজন ফিজিওথেরাপিস্টের পরামর্শ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ভুল ব্যায়াম কোমড়ের ক্ষতি করতে পারে।

তথ্যসূত্র

  1. Adams, M.A. and Roughley, P.J., 2006. What is intervertebral disc degeneration, and what causes it?. Spine, 31(18), pp.2151-2161. https://journals.lww.com/spinejournal/fulltext/2006/08150/What_is_Intervertebral_Disc_Degeneration,_and_What.24.aspx
  2. Callaghan, J.P. and McGill, S.M., 2001. Low back joint loading and kinematics during standing and unsupported sitting. Ergonomics, 44(3), pp.280-294. https://www.tandfonline.com/doi/abs/10.1080/00140130118276
  3. Urban, J.P. and Roberts, S., 2003. Degeneration of the intervertebral disc. Arthritis Res Ther, 5, pp.1-11. https://link.springer.com/article/10.1186/AR629
  4. Videman, T., Battié, M.C., Gibbons, L.E., Maravilla, K., Manninen, H. and Kaprio, J., 2003. Associations between back pain history and lumbar MRI findings. Spine, 28(6), pp.582-588. https://journals.lww.com/spinejournal/fulltext/2003/03150/The_Value_of_Lumbar_Spine_Magnetic_Resonance.00013.aspx
  5. Hayden, J., Van Tulder, M.W., Malmivaara, A. and Koes, B.W., 2005. Exercise therapy for treatment of non‐specific low back pain. Cochrane database of systematic reviews, (3). https://www.cochranelibrary.com/cdsr/doi/10.1002/14651858.CD000335.pub2/abstract
  6. Hayden, J., Van Tulder, M.W., Malmivaara, A. and Koes, B.W., 2005. Exercise therapy for treatment of non‐specific low back pain. Cochrane database of systematic reviews, (3). https://www.cochranelibrary.com/cdsr/doi/10.1002/14651858.CD000335.pub2/abstract
  7. Koes, B.W., Van Tulder, M. and Thomas, S., 2006. Diagnosis and treatment of low back pain. Bmj, 332(7555), pp.1430-1434. https://www.bmj.com/content/332/7555/1430.short
Dr. M Shahadat Hossain
Follow me

Physiotherapist, Pain, Paralysis & Manipulative Therapy Specialist, Assistant Professor Dhaka College of Physiotherapy, Secretary-General(BPA), Secretary(CARD), Chief Consultant(ASPC), Conceptual Inventor(SDM), Faculty Member(CRP), Member-Bangladesh Rehabilitation Council

পরামর্শ নিতে 01877733322