কোমরের দুই পাশে ব্যথা আজকাল একটি খুবই সাধারণ শারীরিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা নারী-পুরুষ বা যেকোনো বয়সের মানুষের মধ্যে দেখা দিতে পারে। এই ব্যথা কখনো অল্প হয়, আবার কখনো এতটাই তীব্র হয় যে দৈনন্দিন কাজে বড় ধরনের বাধা সৃষ্টি করে। ব্যথা শুধু কোমরের দুই পাশে সীমাবদ্ধ নাও থাকতে পারে; এটি পিঠের মাঝখানে, নিচের দিকে বা এমনকি পা পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে পারে, যাকে আমরা রেফারড পেইন বলি। এই ব্যথা বাড়ে যখন কেউ দীর্ঘক্ষণ বসে থাকে, ভারী জিনিস তুলতে যায় বা ভুলভাবে চলাফেরা করে। সঠিক সময়ে সঠিক কারণ খুঁজে বের না করলে এই ব্যথা দীর্ঘমেয়াদি সমস্যায় রূপ নিতে পারে। এটি মেরুদণ্ডের স্থায়ী ক্ষতি, ডিস্কের সমস্যা বা পেশি ও জয়েন্টের দুর্বলতার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। গবেষণা বলছে, প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রায় ৬০-৮০ শতাংশ মানুষ জীবনের কোনো না কোনো সময় কোমর ব্যথায় ভুগেন, যার বড় একটি অংশ কোমরের দুই পাশের ব্যথার সঙ্গে জড়িত (Balagué et al., 2012)।

কোমরের দুই পাশে ব্যথার সম্ভাব্য কারণসমূহ:

কোমরের দুই পাশে ব্যথার সম্ভাব্য কারণসমূহ
কোমরের দুই পাশে ব্যথার সম্ভাব্য কারণসমূহ

মেরুদণ্ড-সংক্রান্ত কারণ (Spinal-Origin Causes)

কোমরের দুই পাশে ব্যথার অন্যতম প্রধান কারনে হচ্ছে মেরুদন্ডের সমস্যা।

লাম্বার স্পন্ডাইলোসিস: লাম্বার স্পন্ডাইলোসিস হলো মেরুদণ্ডের বয়সজনিত পরিবর্তনের ফল, যেখানে ডিস্কের পানি কমে গিয়ে ফাঁকা জায়গা সংকুচিত হয় এবং হাড়ের বৃদ্ধির (osteophytes) ফলে নার্ভে চাপ পড়ে ব্যথা হয় (Frymoyer, 1988)।

ডিস্ক হার্নিয়েশন বা প্রোল্যাপ্স: যখন ডিস্কের ভিতরের জেলির মতো অংশ বাইরের আবরণ ছিঁড়ে বাইরে চলে আসে, যা কাছাকাছি নার্ভে চাপ সৃষ্টি করে ব্যথা ও ঝিনঝিন অনুভূতির কারণ হতে পারে।
ফ্যাসেট জয়েন্ট আর্থ্রাইটিস: মেরুদণ্ডের ছোট জয়েন্টগুলোর প্রদাহ, যা দীর্ঘদিনের ব্যবহারে ক্ষয় হয়ে ব্যথা সৃষ্টি করে, বিশেষত ঘাড় বাঁকানো বা পেছনে ঝোঁকার সময় বেশি অনুভূত হয় (Kalichman et al., 2008)।

স্যাক্রোইলিয়াক জয়েন্ট ডিসফাংশন (SI Joint Dysfunction): পেলভিস ও কোমরের সংযোগস্থলে যে জয়েন্ট থাকে তা ঠিকভাবে কাজ না করলে তীব্র ব্যথা সৃষ্টি করে, যা প্রায়ই একপাশে বেশি হয়।
অ্যাঙ্কাইলোজিং স্পন্ডাইলাইটিস: এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ, যা সাধারণত তরুণ বয়সে শুরু হয়। সময়ের সঙ্গে মেরুদণ্ড শক্ত হয়ে যায় এবং সকালে কোমরের পাশে বা নিচে ব্যথা বাড়ে (Braun & Sieper, 2007)।

পেশি ও লিগামেন্ট সংক্রান্ত কারণ (Muscular and Ligamentous Causes)

কোমরের দুই পাশে ব্যথা কখনো পেশির টান বা মচকানোর কারণে হয়। এটি সাধারণত ভারী কিছু তুলতে গিয়ে মোচড়ের কারণে হয়। এটি একটি অস্থায়ী কিন্তু খুবই  অস্বস্তিকর  অবস্থা (Andersson, 1999)।
লিগামেন্টের আঘাত বা কোমরের লিগামেন্টে টান পড়লে একপাশে বা দুই পাশে ব্যথা হয়। শরীর বাঁকালে এই ব্যথা বাড়ে এবং কোমর শক্ত হয়ে থাকে।
এছাড়াও, ট্রিগার পয়েন্ট বা মায়োফেসিয়াল ব্যথা হলো পেশিতে কিছু গিটের মতো দলা বাঁধা অংশ, যেগুলো স্পর্শ করলে ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে। এই ব্যথা প্রায়ই কোমরের পাশে তীব্রভাবে অনুভূত হয়।(Simons et al., 1999)।

অভ্যন্তরীণ অঙ্গের কারণে (Visceral Referred Pain)

কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের শরীররে বিভিন্ন অঙ্গ যেমন কিডনি, লিভার এছাড়াও বিভিন্ন রোগ যেমন ইউরিনারি ট্রাক্ট ইনফেকশন, গাইনোকোলজিকাল সমস্যার কারনেও এই ব্যথা হতে পারে।
কিডনির পাথর বা সংক্রমণ: কোমরের পাশে তীব্র ব্যথা তৈরি করে, যা অনেক সময় সামনের দিকে ছড়িয়ে যায় এবং প্রস্রাবের সময় জ্বালাপোড়া থাকতে পারে।
জেনিটো-ইউরিনারি ইনফেকশন:, বিশেষ করে মহিলাদের মধ্যে ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বা ওভারিয়ান সিস্ট থাকলে কোমরের পাশে ব্যথা হতে পারে, যা নিচের দিকে ও তলপেটে ছড়িয়ে পড়ে।
গাইনোকোলজিক সমস্যা: যেমন: এন্ডোমেট্রিওসিস বা পেলভিক ইনফ্ল্যামেটরি ডিজিজ (PID), নারীদের কোমরের পাশে দীর্ঘমেয়াদী ব্যথার কারণ হতে পারে, যা মাসিকচক্রের সময় বাড়তে পারে।

অন্যান্য কারণ

মানসিক চাপ ও স্ট্রেসশরীরের বিভিন্ন পেশিকে অনিচ্ছাকৃতভাবে শক্ত করে তোলে, যা কোমরের পেশিতে চাপ তৈরি করে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা সৃষ্টি করে।
ভিটামিন D ও ক্যালসিয়ামের ঘাটতি: ভিটামিন D ও ক্যালসিয়ামের ঘাটতির ফলে হাড় ও পেশির দুর্বলতা সৃষ্টি করে, যার ফলে সাধারণ কাজেও ব্যথা হয়।
ওবেসিটি ও সেডেন্টারি লাইফস্টাইল: অলস জীবন-যাপন অর্থাৎ অতিরিক্ত ওজন ও কম নড়াচড়ার অভ্যাস মেরুদণ্ডে চাপ বাড়িয়ে কোমরের দুই পাশে ক্রমাগত ব্যথা সৃষ্টি করে (Shiri et al., 2010)।

রোগ নির্ণয়: (Diagnostic Approach)

রোগ নির্ণয় (Diagnostic Approach)
রোগ নির্ণয় (Diagnostic Approach)

রোগীর ইতিহাস ও উপসর্গ পর্যবেক্ষণ: কোমরের দুই পাশে ব্যথা নির্ণয়ের প্রাথমিক ধাপ হলো রোগীর ব্যথার ইতিহাস সম্পর্কে জানা। এতে ব্যথার ধরন (তীব্র, মৃদু, জ্বালাপোড়া), সময়কাল (হঠাৎ ব্যথা নাকি দীর্ঘদিনের পুরনো ব্যথা), অবস্থান (একপাশে নাকি দুই পাশে), এবং ব্যথার সঙ্গে অন্য কোনো উপসর্গ যেমন ঝিনঝিন ভাব, জ্বর, ওজন কমে যাওয়া ইত্যাদি রয়েছে কি না—তা জানা গুরুত্বপূর্ণ। রোগীর পেশাগত ইতিহাস, এক্সারসাইজ বা কাজের ধরন, পুরনো ইনজুরি কিংবা পূর্ববর্তী সার্জারি সম্পর্কেও বিস্তারিত জিজ্ঞাসা করা হয়, যা চিকিৎসার দিক নির্দেশনা দেয়।

শারীরিক পরীক্ষা বা ফিজিক্যাল এক্সামিনেশন: পরবর্তী ধাপে শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে রোগীর মেরুদণ্ডের নড়াচড়ার ক্ষমতা (range of motion), পেশি ও জয়েন্টের অবস্থা এবং নার্ভ এর লক্ষণগুলো যাচাই করা হয়। যেমন, ফ্লেক্সন, এক্সটেনশন, ল্যাটারাল বেন্ডিং-এর মাধ্যমে মুভমেন্ট সীমাবদ্ধতা ধরা পড়ে। এছাড়াও, special tests যেমন Straight Leg Raise (SLR), FABER test, Gaenslen’s test বা SI joint compression test রোগের উৎস নির্ধারণে সাহায্য করে।

ইমেজিং (X-ray, MRI, CT Scan): শারীরিক পরীক্ষা ও ইতিহাস অনুযায়ী সন্দেহজনক ক্ষেত্রে ইমেজিং টেস্ট করানো হয়। X-ray মেরুদণ্ডের অস্থি-কাঠামোর পরিবর্তন (যেমন স্পন্ডাইলোসিস, স্কোলিওসিস, ফ্যাসেট জয়েন্ট ডিজেনারেশন) দেখতে ব্যবহৃত হয়। MRI হলো কোমরের ব্যথা নির্ণয়ে সবচেয়ে সংবেদনশীল পদ্ধতি, যা ডিস্ক হার্নিয়েশন, স্নায়ুর চাপ, বা সফট টিস্যুর প্রদাহ নির্দেশ করতে পারে। CT scan তুলনামূলকভাবে হাড়ের সূক্ষ্ম পরিবর্তন নির্ধারণে কার্যকরী।

রক্ত পরীক্ষা: ব্যথার পেছনে প্রদাহ বা সংক্রমণের কোনো ভূমিকা আছে কি না তা নির্ধারণে ESR (Erythrocyte Sedimentation Rate) এবং CRP (C-Reactive Protein) পরীক্ষা করা হয়। বিশেষ করে অ্যাঙ্কাইলোজিং স্পন্ডাইলাইটিস বা অটোইমিউন কোনো প্রদাহজনিত রোগ সন্দেহ হলে এই মার্কারগুলো বাড়তে দেখা যায়। পাশাপাশি, যদি কিডনি-জনিত ব্যথা সন্দেহ হয়, তবে Serum Creatinine, Urea, Urinalysis সহ কিডনি ফাংশনের পরীক্ষা করতে হয়।

চিকিৎসার ধরনসমূহ (All Kinds of Treatment Approaches)

চিকিৎসার ধরনসমূহ (All Kinds of Treatment Approaches)
চিকিৎসার ধরনসমূহ (All Kinds of Treatment Approaches)

ওষুধ: কোমরের দুই পাশে ব্যথার প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে সাধারণত ব্যথানাশক (NSAIDs) যেমন আইবুপ্রোফেন বা ন্যাপ্রোক্সেন ব্যবহার করা হয়। এগুলো প্রদাহ কমিয়ে ব্যথা কমাতে কার্যকর । মাংসপেশি শিথিলকারী (Muscle relaxants) যেমন টিজানিডিন বা মেথোকারবামল, পেশির টান বা শক্তভাব উপশমে ব্যবহৃত হয়, বিশেষত যখন পেশিতে বেশি ব্যথা হয়। নিউরোপ্যাথিক ওষুধ যেমন গ্যাবাপেন্টিন বা প্রেগাবালিন, সেই সব রোগীর জন্য কার্যকর যারা স্নায়ুবিষয়ক ব্যথা যেমন রেডিকুলোপ্যাথিতে ভোগেন।
ভিটামিন D, B12 এবং ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট ব্যথা উপশম ও হাড় ও পেশি শক্তিশালী করতে সহায়তা করে, বিশেষ করে যাদের পুষ্টির ঘাটতি রয়েছে।

ফিজিওথেরাপি ও পুনর্বাসন: যদি কোন রোগীর ফিজিক্যাল টেস্ট, রেডিওলজিকাল বা প্যাথলজিক্যাল টেস্ট এ শরীরের ইন্টারনাল  অঙ্গের  সমস্যা না থাকে সেক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার মধ্যমে হাড় ও মাংসপেশি জনিত সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। ASPC Manipulation Therapy Centre কোমরের ব্যথা নিরাময়ে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ও বিশেষায়িত ফিজিওথেরাপি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুপরিচিত। এখানে আধুনিক ও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত ‘Structural Diagnosis and Management (SDM)’ পদ্ধতির মাধ্যমে প্রতিটি রোগীকে পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে এসেসমেন্ট করা হয়। সাধারণ ফিজিওথেরাপির মতো শুধু ব্যথা কমানোর চেষ্টা না করে, ASPC প্রথমেই ব্যথার প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করে। রোগীর শরীরের গঠন, অস্থিসন্ধি, পেশি ও নার্ভের অবস্থান ও কার্যক্ষমতা পর্যালোচনা করে সমস্যার মূল উৎস নির্ধারণ করা হয়। তারপর ম্যানুয়াল থেরাপি, মোবিলাইজেশন, স্পাইনাল ম্যানিপুলেশন, সুনির্দিষ্ট এক্সারসাইজ ও অন্যান্য ক্লিনিক্যাল কৌশলের মাধ্যমে সেই মূল সমস্যার সমাধান করা হয়।

ফলে ব্যথা শুধু সাময়িকভাবে উপশম হয় না, বরং রোগী দীর্ঘমেয়াদে আরামে থাকতে পারেন এবং ব্যথা পুনরায় ফিরে আসার সম্ভাবনা অনেকাংশে কমে যায়। রোগী-ভিত্তিক এই প্রক্রিয়াগত ও কাঠামোগত চিকিৎসাপদ্ধতি ASPC-কে বাংলাদেশের ম্যানিপুলেশন থেরাপির ক্ষেত্রে একটি বিশ্বস্ত ও ফলপ্রসূ কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

লাইফস্টাইল মডিফিকেশন (Lifestyle Modification): ওজন নিয়ন্ত্রণ করে কোমরের উপর চাপ কমানো সম্ভব, যা ব্যথা কমাতে সাহায্য করে (Shiri et al., 2010)। এই ওজন নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সঠিক ভঙ্গি বজায় রাখা জরুরি, যেমন সোজা হয়ে বসা বা ভারী জিনিস তোলার সময় হাঁটু ভেঙে ওঠা-নামা, যা মেরুদণ্ডকে সুরক্ষিত রাখে (McGill, 2007)। দীর্ঘক্ষণ বসে না থাকা এবং মাঝে মাঝে উঠে দাঁড়ানো বা হাটা রক্ত সঞ্চালন বজায় রাখে এবং পেশিকে সচল রাখে (Waersted et al., 2010)। এই সক্রিয়তা বজায় রাখতে নিয়মিত হালকা এক্সারসাইজ ও হাঁটা মেরুদণ্ড ও কোমরের পেশিকে শক্তিশালী করে, মানসিক চাপ কমায় এবং ব্যথার ঝুঁকি হ্রাস করে।

অপারেশন (Surgical Options – if required): যদি ওষুধ, ফিজিওথেরাপি ও লাইফস্টাইল পরিবর্তনের পরও উপশম না হয়, অথবা Disc Prolapse বা Severe Arthritis এর কারণে নার্ভে চাপ বা চলাচলে অসুবিধা হয়, তখন অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হতে পারে। যেমন Microdiscectomy, Laminectomy বা Spinal fusion ইত্যাদি অপারেশন করা হয়, যা উন্নততর ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকর।

উপসংহার:

কোমরের দুই পাশে ব্যথা বিভিন্ন কারণে হতে পারে, যেমন পেশি, ডিস্ক, জয়েন্ট বা অভ্যন্তরীণ অঙ্গের সমস্যা। এই ব্যথার সঠিক কারণ নির্ণয় করা গেলে উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে অধিকাংশ সময় অস্ত্রোপচার ছাড়াই সমাধান সম্ভব। তাই সঠিক রোগ নির্ণয়ের পর ASPC-এর মতো আধুনিক থেরাপি সেন্টারে চিকিৎসা নিলে রোগীর সুস্থতায় উল্লেখযোগ্য ফল পাওয়া যায়।

তথ্যসূত্র:

পরামর্শ নিতে 01877733322