বর্তমানে মাস্কুলোস্কেলেটাল সমস্যাগুলোর মধ্যে হাঁটু ব্যথায় ভুগছেন, এমন রোগীর সংখ্যা অনেক। হাঁটুর অস্থিসন্ধিতে ব্যথা অনুভব করার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। কার্যকারণজনিত( মেকানিক্যাল কারণ), কোন ধরনের আঘাত বা ট্রমা, প্যাথোলজি, বয়সজনিতসহ নানাবিধ কারণ হাঁটুব্যথার পেছনে ভূমিকা রাখতে পারে।

কোন কোন কারণে হাঁটুব্যথা হতে পারে?

* ট্রমা বা আঘাত

এটি হাঁটু ব্যথার সবচেয়ে সাধারণ কারণ। হাঁটুর সামনে অবস্থিত একটি অস্থির নাম প্যাটেলা। প্যাটেলার আশেপাশে অবস্থিত টেন্ডন বা রগে আঘাত পেলে, প্যাটেলার ফ্রাকচার, কালশিরা, সংযোগকারী তরুণাস্থির ক্ষয়সহ নানাবিধ কারণে হাঁটুসন্ধিতে প্রদাহ, ফুলে যাওয়া, চলাচলে সীমাবদ্ধতা এবং ব্যথা হতে পারে। সিঁড়িতে উঠানামার সময় এবং স্কোয়াটিং এর উপর ব্যথার তীব্রতা নির্ভর করতে পারে।

* টেন্ডোনাইটিস

টেন্ডন বা রগে প্রদাহ হলে তাকে মেডিকেলীয় ভাষায় টেন্ডোনাইটিস বলে। প্যাটেলা বা কোয়াড্রিসেপস টেন্ডনে প্রদাহ হলে তাকে “জাম্পার্স নী” নামেও ডাকা হয়। ধারাবাহিক লাফ দেওয়ার মতো কাজে যুক্ত থাকলে এই কন্ডিশনের আর্বিভাব হতে পারে। দৌড়বিদ, স্কি খেলোয়াড়, সাইক্লিস্ট এবং যারা লাফ দেওয়ার মতো স্পোর্টস এ যুক্ত আছেন, তাদের জাম্পার্স নী ডেভেলপ হবার সম্ভাবনা আছে। এই কন্ডিশনে ভুক্তভোগীর প্যাটেলা ( নীক্যাপ) এবং টিবিয়ার (শিনবোন) মাঝামাঝি জায়গায় ব্যথা অনুভূত হয়।

*প্রিপ্যাটেলার বার্সাইটিস

আমাদের হাঁটুর সামনে থলির মতো একটি অংশ আছে, যার নাম প্রিপ্যাটেলার বার্সা। এর কাজ হচ্ছে অস্থি এবং পেশি, টেন্ডন বা রগ, লিগামেন্টের মাঝে ঘর্ষন পরিহার করা। দীর্ঘসময় হাঁটু গেড়ে বসে কাজ করলে বা হাঁটুতে সামান্য তীব্রতায় ক্রমাগত আঘাত পেতে থাকলে এই বার্সায় প্রদাহ হয়ে সৃষ্ট কন্ডিশনের নাম প্রিপ্যাটেলার বার্সাইটিস, যা “হাউজমেইড’স নী” নামে পরিচিত। এর লক্ষণ ও উপসর্গের মধ্যে আছে হাঁটুর সামনে ফুলে যাওয়া, ব্যথা, লালচে ভাব, হাঁটুর অস্থিসন্ধি নড়াচড়ায় সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি।

*এসিএল ইঞ্জুরি

যারা বাস্কেটবল, সকার, ফুটবলের মতো খেলায় যুক্ত আছেন, তাদের জন্য এন্টেরিয়োর ক্রুশিয়েট লিগামেন্ট ছিঁড়ে যাওয়াটা খুবই সাধারণ একটি ঘটনা। এর লক্ষণ ও উপসর্গের মধ্যে আছে পায়ে তীব্র ব্যথা, ফুলে যাওয়া, হাটাচলায় অসুবিধা ইত্যাদি।

*ইলিওটিবিয়াল ব্যান্ড ফ্রিকশন সিন্ড্রোম

হাঁটুর সামনে ব্যথার পেছনে এই কন্ডিশনটির ও ভূমিকা আছে। ম্যারাথন দৌড়বিদ এবং সাইক্লিস্টদের এ কন্ডিশনে ভোগার সম্ভাবনা বেশি। এই সিনড্রোমে পায়ে অবস্থিত ইলিওটিবিয়াল ব্যান্ড খুবই শক্ত হয়ে আমাদের শরীরের সবচেয়ে মজবুত অস্থি ফিমারের গায়ে লেগে ক্রমাগত ঘষা খেতে থাকে, যার কারণে ভুক্তভোগী ব্যথা অনুভব করেন।

*আর্থ্রাইটিস.

যেসব আর্থ্রাইটিস হাঁটুসন্ধিকে আক্রান্ত করে, তার মধ্যে সবচেয়ে কমন টাইপ হচ্ছে অস্টিওআর্থ্রাইটিস। অস্টিওআর্থ্রাইটিস একটি ডিজেনারেটিভ প্রক্রিয়া, যেখানে অস্থিসন্ধির তরুণাস্থি ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যায়। মধ্যবয়স্ক এবং বৃদ্ধ বয়সীদের এই কন্ডিশনটি সবচেয়ে বেশি হয়। হাঁটুতে ক্রমাগত আঘাত বা স্থূলকায় হলে অস্থিসন্ধিতে চাপ বেড়ে গিয়েও অস্টিওআর্থ্রাইটিস হতে পারে। হাঁটুর ব্যথার পেছনে আর্থ্রাইটিস এর আরেকটি টাইপ হলো রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস। এই ক্ষেত্রে হাঁটুর অস্থিসন্ধিতে প্রদাহের পাশাপাশি তরুণাস্থিগুলোর ক্ষয় হতে থাকে। কৈশোর ও সদ্য যৌবনে থাকা ছেলেমেয়েদের অস্টিওআর্থ্রাইটিস এর তুলনায় রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস হবার সম্ভাবনা বেশি।

*প্লাইকা সিনড্রোম.

দীর্ঘস্থায়ী ইরিটেশনের কারণে প্যাটেলার চারপাশে অবস্থিত টিস্যু ইলাস্টিসিটি হারিয়ে ফাইব্রোটিক ব্যান্ড এর মতো হয়ে যায়, যার কারণে হাঁটুব্যথা হয়।

*ফ্যাট প্যাড সিনড্রোম.

আঘাতজনিত কারণে হাঁটুর সামনে অবস্থিত ইনফ্রাপ্যাটেলার ফ্যাট প্যাডে ক্রমাগত ঘর্ষণ বা ইরিটেশনের কারণে এই সিনড্রোমের উদ্ভব হয়, যার কারণে হাঁটুব্যথা অনুভূত হয়।

*এপোফাইসাইটিস.

আমাদের শরীরে মাংশপেশি এবং টেন্ডন/রগের সংযোগস্থলে কিছু তরুণাস্থি পাওয়া যায়, যাকে এপোফাইসেস বলে। হাঁটু এবং কোমরে অনেকগুলো এপোফাইসেস আছে। বাচ্চা এবং কৈশোর এ আছে, এমন ছেলেমেয়েদের অস্থির গ্রোথপ্লেট এর আশেপাশে আঘাত বা প্রদাহ হলে এপোফাইসাইটিস হয়। দৌড়ানো, লাফানো, কোন কিছু ছুড়ে ফেলা, হঠাৎ করে পড়ে গেলে এপোফাইসাইটিস হতে পারে। হাঁটুর অস্থিসন্ধিকে আক্রান্ত করে, এমন দুটি এপোফাইসাইটিস হচ্ছে “অজগুড স্লাট্যার ডিজিজ” এবং “সিন্ডিং লারসেন জোহানসন সিনড্রোম”। তরুন খেলোয়াড় যারা দৌড়ানো, লাফ দেওয়া বা নিক্ষেপণ খেলাধুলার সাথে জড়িত, তাদের এপোফাইসাইটিস হবার ঝুঁকি আছে। এপোফাইসাইটিস এর লক্ষণ ও উপসর্গের উপস্থাপনার ভিন্নতা থাকতে পারে। কিছু কমন ব্যাপার হলো – খেলাধুলার সময়ে বা পরে হাঁটু ব্যথা অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাওয়া, হাঁটুর আশেপাশে ফুলে যাওয়া, ধরলে ব্যথা পাওয়া ইত্যাদি।

* অন্যান্য কিছু কন্ডিশন, যার কারনে প্যাটেলোফিমোরাল ব্যথা হতে পারে, যেমন –

১. ট্রমাটিক প্যাটেলার কন্ড্রোমেলাশিয়া

২. টাইট মিডিয়াল এন্ড ল্যাটেরাল রেটিনাকুলা বা প্যাটেলার প্রেশার সিনড্রোম

৩. সিম্পটোম্যাটিক বাইপারটাইট প্যাটেলা

৪. প্যাটেলা বা ফিমোরাল ট্রকলিউয়ার অস্টিওকন্ড্রাইটিস ডিসেকানস।

হাঁটুর নানা ধরণের ব্যথার চিকিৎসার জন্য ফিজিওথেরাপি একটি গবেষনা ভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতি। একজন স্পোর্টস ফিজিওথেরাপিস্ট অথবা মাস্কুলোস্কেলেটাল ফিল্ডে প্রাকটিসরত ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক হাঁটুব্যথার দ্রুত উপশম করতে পারেন। তাই যেকোন ধরণের হাঁটুব্যথায় ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক এর শরণাপন্ন হোন।

Follow me

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This field is required.

This field is required.

পরামর্শ নিতে 01975451525