হাঁটু ব্যথায় ফিজিওথেরাপি একটি গবেষণাভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতি। আপনি হাঁটু ব্যথা নিয়ে একজন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক এর কাছে আসলে তিনি আপনার কোমর থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত পরীক্ষা করে আপনার হাঁটু ব্যথার কারণ খুঁজে বের করবেন এবং সঠিক চিকিৎসা নির্ধারণ করবেন।
আপনি কোন ধরণের হাঁটু ব্যথায় ভুগছেন?
হাঁটু ব্যথায় আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা প্রদানের আগে তিনি কোন ধরণের হাঁটু ব্যথায় ভুগছেন, তা জানা জরুরি। হাঁটুর ব্যথা তিন ধরণের হয়ে থাকে:
১. অ্যাকিউট পেইন বা তাৎক্ষণিক যে ব্যথা অনুভূত হয়ঃ আঘাত পাওয়ার ১ থেকে ৭ দিনের মধ্যে যে ব্যথা অনুভূত হয়। এই সময়ে আপনাকে বিশ্রামে থাকতে হবে।
২. সাব-অ্যাকিউট পেইনঃ আঘাত পাওয়ার ২ থেকে ৬ সপ্তাহ পরে যে ব্যথা অনুভুত হয়।
৩. ক্রনিক পেইন বা দীর্ঘমেয়াদী ব্যথাঃ আঘাত পাওয়ার পর ৮ থেকে ১২ সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে ব্যথা থাকে।
হাঁটু ব্যথার অবস্থান অনুযায়ী লক্ষণ ও উপসর্গ
যদি ব্যথার তীব্রতা বেশি হয় বা ব্যথা কয়েক সপ্তাহ ধরে থাকে, তাহলে অবশ্যই আপনাকে একজন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক এর শরণাপন্ন হতে হবে। হাঁটুর কোথায় আপনি ব্যথা অনুভব করছেন, সেটা সঠিকভাবে আপনার ফিজিওথেরাপিস্টকে জানান। তিনি এই তথ্যের ভিত্তিকে হাঁটুর কোন কাঠামোগত ত্রুটির কারণে আপনি ব্যথায় ভুগছেন, তা বের করে আপনার জন্য সঠিক চিকিৎসা নির্ধারন করবেন।
১। হাঁটুর সামনে ব্যথা – যদি আপনি হাঁটুর সামনে ব্যথা অনুভব করেন, তাহলে প্যাটেলা বা নীক্যাপের অবস্থানগত সমস্যা থাকতে পারে। মেডিকেলীয় ভাষায় একে প্যাটেলোফিমোরাল স্ট্রেস সিন্ড্রোম বা সংক্ষেপে পিএফএসএস বলে। এক্ষেত্রে হাঁটুর আশেপাশের কাঠামোতে প্রদাহ হয়ে ব্যথার সৃষ্টি করে। হাঁটুর সামনের ব্যথার কারণে রোগী স্বাভাবিকভাবে হাঁটু গেড়ে বসতে, সিড়ি বেয়ে উঠা নামা করতে, লাফ দিতে বা দৌড়াতে পারেন না।

২। হাঁটুর ভিতরেব্যথা – যদি আপনি হাঁটুর ভিতরে ব্যথা অনুভব করেন, তাহলে সম্ভাবনা আছে যে আপনার রগে টান পড়েছে বা লিগামেন্ট আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। হাঁটুর ভিতরে মিডিয়াল মেনিসক্যাস বা মিডিয়াল কোল্যাটারাল লিগামেন্ট আছে। সাধারণত ক্রীড়াবিদদের এই কাঠামোতে আঘাত বা ইঞ্জুরির সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে। হাঁটুর ভিতরে অবস্থিত মিডিয়াল মেনিসক্যাস ঘাতশোষক বা শক এবসরবার হিসেবে ভূমিকা পালন করে। কখনো কখনো আর্থ্রাইটিস এর কারণে কোন আঘাত না পেলেও এই লিগামেন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

৩। হাঁটুর বাইরে ব্যথা – যদি আপনি হাঁটুর বাইরে ব্যথা অনুভব করেন, তাহলে হয়তোবা অনেকগুলো কাঠামো আঘাতপ্রাপ্ত অবস্থায় আছে। ক্রীড়াবিদদের কার্যকলাপে সেখানে অবস্থিত লিগামেন্টে ইঞ্জুরি হতে পারে। হাঁটুর বাইরে ব্যথা ইলিওটিবিয়াল ব্যান্ড স্ট্রেসের কারণেও হতে পারে। ইলিওটিবিয়াল ব্যান্ড হচ্ছে টিস্যুর পুরু ব্যান্ড যা কোমর থেকে হাঁটুতে এসেছে। হাঁটুর অস্থিসন্ধিকে অতিক্রম করার সময় এই ইলিওটিবিয়াল ব্যান্ড অস্বাভাবিকভাবে হাঁটুতে ঘষা লাগতে পারে। এর কারণে হাঁটুতে ব্যথার সাথে জলুনিও অনুভুত হতে পারে। আবার, হাঁটুর বাইরেই তিনটি হ্যামস্ট্রিং টেন্ডনের একটি থাকে। এই টেন্ডনে চাপ পড়লে বা টান খেলেও তা হাঁটু ব্যথার কারণ হতে পারে।
৪। হাঁটুর পেছনেব্যথা – হাঁটুর পেছন দিকে ব্যথা সাধারণত হয় না। হ্যামস্ট্রিং টেন্ডনে অত্যধিক চাপ পড়লে ব্যথা হতে পারে। আরেকটি কারণ হচ্ছে ব্যাকার‘স সিস্ট। এই কন্ডিশনে হাঁটুর অস্থিসন্ধি অস্বাভাবিকভাবে ফুলে যায়। যার কারণে হাঁটুর পেছনের জায়গা সংকুলান হয়ে হাঁটুর নড়াচড়ায় ব্যথার সৃষ্টি করে।

ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক কিভাবে চিকিৎসা শুরু করেন?
চিকিৎসার সর্বপ্রথম ধাপ হচ্ছে হিস্ট্রি নেওয়া। এর মানে হচ্ছে ফিজিওথেরাপিস্ট আপনার সমস্যার ইতিহাস নিয়ে আপনার কাছে জানতে চাইবেন, কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যথা বাড়ছে এবং কমছে, আগে অন্য কোন রোগ ছিল কিনা যা হয়তোবা পুরো সমস্যাটির একটি কারণ হিসেবে অবদান রাখছে ইত্যাদি। হিস্ট্রি থেকে নেওয়া সব তথ্যের ভিত্তিতে, ফিজিওথেরাপিস্ট একটি শারীরিক পরীক্ষা বা ফিজিক্যাল এক্সামিনেশন করবেন, যার ধাপগুলোর মধ্যে আছে –
- গেইট ইভালুয়েশন : আপনি কীভাবে হাঁটছেন, তা পরীক্ষা করা। হাঁটার বিভিন্ন পর্যায়ে হাঁটুর চারপাশে গতির কোন সূক্ষ্ম পরিবর্তন হলেও ফিজিওথেরাপিস্ট সেটি ধরতে পারেন।
- পালপেশন : এই ধাপে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক হাঁটুর চারপাশের কাঠামো স্পর্শ করে দেখেন,কোন গাঠনিক অস্বাভাবিকতা আছে কিনা বা হাত দিয়ে স্পর্শে রোগী ব্যথা অনুভব করছে কিনা।
- রেঞ্জ অবমোশন মেজারমেন্ট : রেঞ্জ অব মোশন বলতে বোঝায় হাঁটু বাকালে বা সোজা করলে তা কতদূর যায় ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক গোনিওমিটার নামক একটি বিশেষ যন্ত্র ব্যবহার করে তা পরিমাপ করতে পারেন।
- স্ট্রেন্থ মেজারমেন্ট: হাঁটুর চারপাশে অনেক পেশির সংযোগ আছে এবং এই পেশি গুলোর শক্তি মেপে এটা বোঝা যায় যে রোগীর পায়ের ব্যথা কি পেশি দুর্বলতার কারণে হচ্ছে নাকি ভারসাম্যহীনতার কারণে।
- ব্যালেন্স এসেসমেন্ট : যদি আপনার ভারসাম্য ত্রুটিপূর্ণ হয়, তাহলে সেটি সরাসরি আপনার হাঁটুতে অতিরিক্ত চাপ প্রদান করে। যার কারণে ব্যথা হয়।
- শোয়েলিং মেজারমেন্ট: মাঝে মাঝে, আঘাত পাওয়ার পরে হাঁটুর অস্থিসন্ধি ফুলে যেতে পারে। একজন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক কতটুকু ফুলেছে, তা পরিমাপ করে সরাসরি চিকিৎসা দিতে পারেন।
- স্পেশাল টেস্ট: কিছু বিশেষ পরীক্ষা আছে, যা গবেষণাভিত্তিক এবং যার মাধ্যমে হাঁটু ব্যথার পিছনে কোন কাঠামোগত ত্রুটি দায়ী, তা বের করা যায়।
হাঁটু ব্যথার চিকিৎসায় ফিজিওথেরাপি টেকনিক:
থেরাপিউটিক ব্যায়াম : একাধিক গবেষণায় পাওয়া গেছে, হাঁটু ব্যথার চিকিৎসায় থেরাপিউটিক ব্যায়াম অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। ফিজিওথেরাপিস্ট দ্বারা প্রেসক্রাইব করা থেরাপিউটিক ব্যায়াম ব্যথা কমিয়ে অস্থিসন্ধির নমনীয়তা ( জয়েন্ট ফেক্সিবিলিটি) পুনরুদ্ধার করে। একই সাথে অস্থিসন্ধির চারপাশে অবস্থিত পেশিগুলোকে শক্তিশালী করে, যা ভবিষ্যৎ এ আঘাতের ঝুঁকি কমিয়ে দেয়। হাঁটু ব্যথার কারণ, ধরণ এবং অবস্থান অনুযায়ী, ফিজিওথেরাপিস্ট প্রেসক্রাইব করতে পারেন –
- হ্যামস্ট্রিংস্ট্রেচ
- কাফস্ট্রেচ
- স্ট্যান্ডিংকোয়াড্রিসেপস স্ট্রেচ
- সীটেডলেগ রেইজ
- স্টেপআপ
- স্ট্রেইটলেগ লিফট
- সিংগেললেগ ডিপস
- হ্যামস্ট্রিংকার্লস
- ওয়ালস্কোয়াট
- হাফস্কোয়াট
- নীস্ট্যাবিলাইজিং সিরিজ
- স্ট্যাটিকহ্যামস্ট্রিং কনট্রাকশন
- হিলকর্ড স্টেচ
- লেগএক্সটেনশন
- হিপএবডাকশন এন্ড এডাকশন
- লেগপ্রেসেস উইদ রেজিস্টেন্স ব্যান্ড
হাঁটুতে আঘাত বা সার্জারির পর আপনার শারীরিক অবস্থার উপর নির্ভর করে তৈরী করা থেরাপিউটিক ব্যায়াম এর পরিকল্পনা আপনাকে শীঘ্রই দৈনন্দিন কাজে ফিরে আসতে সহায়তা করবে। নিরাপদে থাকতে, ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকদের নিবিড় তত্ত্বাবধানে, ব্যায়ামগুলো করুন। অন্যথায়, ব্যথা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক আপনাকে দেখিয়ে দিবেন কীভাবে হাঁটুর অস্থিসন্ধিতে অতিরিক্ত চাপ প্রদান ছাড়াই নিরাপদে ব্যায়ামগুলো করবেন।
হাঁটু ব্যথার কারণ যাই হোক না কেন, ব্যায়াম ব্যথা উপশনে সাহায্য করবেই। প্রথমত, ব্যায়াম হাঁটুর চারপাশের পেশিগুলোকে শক্তিশালী করে। দ্বিতীয়ত, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে, যা অস্থিসন্ধির উপর থেকে অতিরিক্ত চাপ পড়া থেকে বাঁচিয়ে দেয়। পেশি শক্ত থাকলে তা ইঞ্জুরির ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এইজন্য পেশির জন্য টার্গেটেড প্রেসক্রাইবড স্ট্রেনদেনিং এবং স্ট্রেচিং এক্সারসাইজ গুলো করা জরুরি।
ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকরা প্রোপিয়োসেপশন এবং ভারসাম্য ব্যায়ামও প্রেসক্রাইব করে থাকেন, বিশেষ করে, আঘাত পাওয়ার পরে। এটি আপনার ভারসাম্য উন্নয়নে সাহায্যকারী এবং একই সাথে আপনার শরীরকে শিখিয়ে দেয় কীভাবে আঘাত পাওয়া অস্থিসন্ধিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
ম্যানুয়াল থেরাপি
থেরাপিউটিক ব্যায়ামের পাশাপাশি, হাঁটু ব্যথার চিকিৎসায় মোবিলাইজেশন এবং ম্যানিপুলেশনের ব্যবহারও হয়ে যায়। এদেরকে ম্যানুয়াল থেরাপি বলা হয়, যা চলাচলের পরিসীমা বা রেঞ্জ অব মোশন বাড়ায় এবং চলাফেরাকে সহজতর করে। ম্যানুয়াল থেরাপি প্রদাহ কমিয়ে ব্যথার উপশম করে। ম্যানুয়াল থেরাপির কিছু টেকনিক হলো –
- টিবিওফিমোরালজয়েন্টে পোস্টেরিয়োর টু এন্টেরিয়োর মোবিলাইজেশন এবং দি স্কুপ টেকনিক
- টিবিওফিমোরালজয়েন্টে এন্টেরিয়োর টু পোস্টেরিয়োর মোবিলাইজেশন
- রোটেশনালমোবিলাইজেশন
- শিয়ারমোবিলাইজেশন
- প্যাটেলারমোবিলাইজেশন
- টিবিওফিমোরালডিসট্রাকশন
- এন্টেরিয়োরগ্লাইড
- পোস্টেরিয়োরগ্লাইড
- রোটেশনালগ্লাইড
- প্যাটেলোফিমোরালগ্লাইড ইত্যাদি
ইলেকট্রোথেরাপি
থেরাপিউটিক ব্যায়াম, ম্যানুয়াল থেরাপির পাশাপাশি ইলেকট্রোথেরাপির ব্যবহার হাঁটুব্যথায় আক্রান্ত রোগীর পুনর্বাসন তরান্বিত করে। হাঁটু ব্যথায় ব্যবহৃত কিছু ইলেক্ট্রোথেরাপি মডালিটিস হলো –
- ট্রান্সকিউটেনিয়াসইলেকট্রিকাল নার্ভ স্টিমুলেশন ( টেনস)
- আল্ট্রাসাউন্ড
- পালসডশর্ট ওয়েব থেরাপি
- এক্সট্রাকরপোরিয়েলশক ওয়েভ থেরাপি ( ইএসডব্লিউটি)
একজন দক্ষ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক হাঁটু ব্যথার কারণ বের করে নানা ধরণের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন, যার সবগুলোই গবেষণাভিত্তিক। হাঁটু ব্যথায় সার্জারি আপনার সর্বশেষ অবলম্বন হওয়া উচিত। ঔষধ ব্যথা কমায় কিন্ত এর ফলাফল সাময়িক। তার উপর, অধিকাংশ ঔষধের কোন না কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে, যার বিরুপ প্রভাব পুরো শরীরের উপর পড়ে। ফিজিওথেরাপিই সবচেয়ে নিরাপদ চিকিৎসা।
- Treating Rotator Cuff Tears Without Surgery - September 27, 2023
- Shoulder Pain: Could It Be Avascular Necrosis? - September 24, 2023
- Understanding Brachial Plexus Neuropathy: An Overview of Parsonage-Turner Syndrome - September 20, 2023