হাঁটুর জয়েন্টে আর্থ্রাইটিস এ করণীয়. আর্থ্রাইটিস’ একটি বিস্তৃত এবং জটিল টপিক, যার অনেক ধরণ ও প্রকরন আছে। অস্থিসন্ধির তাৎক্ষনিক বা দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ, যার সাথে ব্যথা এবং কাঠামোগত ক্ষতি সম্পর্কিত, তাকেই আর্থ্রাইটিস বলে। যেকোন বয়সের মানুষই আর্থ্রাইটিস এ আক্রান্ত হতে পারেন।
হাঁটুর জয়েন্টে আর্থ্রাইটিস এ করণীয়
কোন ধরণের আঘাতের অনুপস্থিতিতে হাঁটু ব্যথার কারণ প্রায়ই আর্থ্রাইটিস দায়ী হয়ে থাকে। এই প্রবন্ধে আমরা কয়েক ধরণের আর্থ্রাইটিস নিয়ে আলোকপাত করবো, যার কারণে হয়তোবা আপনিও হাঁটুব্যথায় ভুগছেন।
অস্টিওআর্থ্রাইটিস
হাঁটুর অস্টিওআর্থ্রাইটিস সাধারনত ডিজেনারেটিভ জয়েন্ট ডিজিজ হিসেবে পরিচিত, যার মানে হচ্ছে যে রোগে অস্থিসন্ধি ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাবে। বয়স্ক মানুষদের মধ্যে হাঁটুর অস্টিওআর্থ্রাইটিস হবার প্রবণতা বেশি আর পুরুষদের তুলনায় মহিলারা এই রোগে বেশি ভুগে থাকেন। হাঁটু ব্যথার চিকিৎসা
হাঁটুর অস্টিওআর্থ্রাইটিসকে দুইভাগে ভাগ করা যেতে পারে।
প্রাইমারি অস্টিওআর্থ্রাইটিস: কোন সুনির্দিষ্ট কারণ নেই। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ক্ষয়জনিত কারণে হতে পারে।
সেকেন্ডারি অস্টিওআর্থ্রাইটিস: স্থূলতা, পারিবারিক ইতিহাস, জন্মগত ত্রুটি, হাঁটুর অস্থিসন্ধিতে পূর্বের কোন আঘাত যা সঠিকভাবে চিকিৎসা করা হয়নি, হাঁটুর অস্থিসন্ধির অতিরিক্ত ব্যবহার (জয়েন্ট হাইপারমবিলিটি), দীর্ঘসময় গতিশীল না থাকা (ইমমোবিলাইজেশন), মেটাবলিক বা বিপাকীয় কোন কারণ যেমন: রিকেটস, অস্থিসন্ধির গাঠনিক কোন সমস্যা যেমন হাঁটুর ভালগাস বা ভ্যারাস পোশ্চার ইত্যাদি নানা কারণেই সেকেন্ডারি অস্টিওআর্থ্রাইটিস হতে পারে।
হাঁটুর অস্থিসন্ধির অস্টিওআর্থ্রাইটিস এর সাধারণ লক্ষণ ও উপসর্গের মধ্যে আছে –
- চলাচলে ব্যথা অনুভূত হওয়া
- হাঁটুতে জড়তা অনুভব করা, বিশেষ করে সকাল বেলা
- দীর্ঘসময় বসে থাকার পর উঠতে গেলে হাঁটুতে ব্যথা
- হাঁটুতে ফুলে যাওয়া
- চলাচলের সময় কোন কিছু ফেটে গেলে যেমন শব্দ শুনি আমরা, সেরকম কাছাকাছি কোন শব্দ শুনা। মেডিকেলীয় ভাষায় একে ক্রেপিটাস বা ক্র্যাকিং শব্দ বলে।
- হাঁটুতে চাপ দিলে ব্যথা পাওয়া
- ক্ষেত্রবিশেষে অস্থিসন্ধির বৃদ্ধি ইত্যাদি
রক্তপরীক্ষা, এক্সরে, এমআরআই প্রভৃতির মাধ্যমে হাঁটুর অস্টিওআর্থ্রাইটিস পরীক্ষা করা যায়। এই অবস্থার প্রাথমিক এবং গবেষনাভিত্তিক চিকিৎসা হচ্ছে ফিজিওথেরাপি। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার মাধ্যমে হাঁটুর ব্যথা ও প্রদাহ কমানো, হাঁটু ও এর আশেপাশের অঞ্চলের পেশির শক্তি বাড়ানো, চলাচলের ভারসাম্য সঠিক করা, কার্ডিওভাস্কুলার রোগের ঝুঁকি কমানো প্রভৃতি দিক সামলানো হয়। বিভিন্ন থেরাপিউটিক ব্যায়াম, ম্যানুয়াল থেরাপি, হাইড্রোথেরাপি, ট্যাপিং, ম্যাসাজ, ব্রেসিং, ইলেকট্রোথেরাপি প্রভৃতি নানা পদ্ধতি ব্যবহার করে একজন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক হাঁটুর অস্টিওআর্থ্রাইটিস এর যাবতীয় জটিলতা দূর করতে পারেন।
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস হলে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা আমাদের বিরুদ্ধে কাজ করা শুরু করে অস্থিসন্ধির টিস্যুকে আক্রমণ করে। জেনেটিক কারণ ছাড়া এখন পর্যন্ত বের করা যায়নি যে অন্যান্য কি কি কারণে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস হতে পারে। পুরুষদের তুলনায় মহিলারাই এতে বেশি আক্রান্ত হন।
হাঁটুতে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস হলে হাঁটুতে ব্যথা, হাঁটুর অস্থিসন্ধির আশেপাশে ধরতে গেলে ব্যথা অনুভব করা, যাকে ইংরেজিতে টেন্ডারনেস বলে অথবা দাঁড়ানো, হাটাচলা ও ব্যায়ামের সময় হাঁটুতে অস্বস্তি বোধ করা প্রধান উপসর্গ হিসেবে উপস্থাপিত হয়। এছাড়াও অস্থিসন্ধির আশেপাশে গরম হয়ে যাওয়া, অস্থিসন্ধির মাঝে জড়তা বা কাঠিন্য অনুভব করা – বিশেষ করে শীতকালে অথবা সকালে ঘুম থেকে উঠার পর, পায়ের আঙ্গুলে চুলকানি বা অবশ ভাব প্রভৃতি লক্ষণ ও উপসর্গের উপস্থিতিও লক্ষণীয়।
শারীরিক পরীক্ষা, রক্তপরীক্ষা, এক্সরে, এমআরআই, আলট্রাসাউন্ড প্রভৃতির মাধ্যমে হাঁটুর রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস নির্ণয় করা হয়। অন্যান্য চিকিৎসার পাশাপাশি ফিজিওথেরাপি নিলে নানা জটিলতা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। হাঁটুতে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস হয়েছে এমন একজন রোগীর চিকিৎসার জন্য ফিজিওথেরাপিস্ট যে যে লক্ষ্য নির্ধারন করেন –
- রোগটিকে সামলানোর জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান রোগী ও তার পরিবারকে দেওয়া
- ব্যথা নিয়ন্ত্রণ
- অস্থিসন্ধির কাঠিন্য কমিয়ে যতটুকু সম্ভব, স্বাভাবিকে আনা
- অস্থিসন্ধির গাঠনিক ক্ষতি প্রতিরোধ করা, যতটুকু ক্ষতি হয়ে গেছে তা যাতে বাড়তে না পারে, তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া
- পেশির শক্তি বাড়ানো
- ক্লান্তিভাব কাটানো
- ভারসাম্য ও সমন্বয়ের উন্নয়ন ইত্যাদি।
এক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক বিভিন্ন থেরাপিউটিক ব্যায়াম, টেনস – ট্রান্সকিউটেনিয়াস ইলেক্ট্রিকাল নার্ভ স্টিমুলেশন , জয়েন্ট প্রোটেকশন, কোন্ড/হট এপ্লিকেশন, ম্যাসাজ থেরাপি, হাইড্রোথেরাপি প্রভৃতি টেকনিক অবলম্বন করে থাকেন।
সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস
সোরিয়াসিস হলো এক ধরণের চর্মরোগ। এই চর্মরোগের সাথে সম্পর্কিত দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহী অস্থিসন্ধির রোগ হলো সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস। পুরুষ মহিলা উভয়েই সমানভাবে এতে আক্রান্ত হতে পারেন। সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস যেকোন বয়সেই হতে পারে কিন্তু ৩০-৫০ বয়সী মানুষের এতে বেশি আক্রান্ত হতে দেখা যায়।
গবেষকবৃন্দ সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস এ আক্রান্ত হবার পেছনে বংশগত এবং পরিবেশগত কারণ এর সমন্বয় খুঁজে পেয়েছেন। দি নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে ২০১৭ সালে একটি রিভিউ অনুসারে – স্থুলতা, নখের রোগ, আঘাতজনিত কারণ, ধূমপান প্রভৃতিও সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস ডেভেলপমেন্টে ভুমিকা রাখে।
হাঁটুর অস্থিসন্ধি সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস এ আক্রান্ত হলে সেখানে ব্যথা, বিশ্রাম নেবার পর বা ঘুম থেকে উঠার পর হাঁটুর অস্থিসন্ধি শক্ত হয়ে যাওয়া, গরম হওয়া ও ফুলে যাওয়া প্রভৃতি সমস্যা দেখা দেয়। পাশাপাশি হাঁটুর অস্থিসন্ধির আশেপাশে অবস্থিত অস্থিসমূহ, টেন্ডন, লিগামেন্ট বা রগ, তরুণাস্থি, চামড়া এবং পায়ের নখও আক্রান্ত হতে পারে। পাশাপাশি ক্লান্তিভাব, কোমর ব্যথা, পায়ের পাতা বা রগে (আকিলিস টেন্ডন) ব্যথার কারণে হাটতে অসুবিধা প্রভৃতিও দেখা যেতে পারে। এ রোগে আক্রান্ত রোগীর জীবনমান উন্নয়নে ফিজিওথেরাপি মুখ্য ভূমিকা পালন করে। সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস এ ফিজিওথেরাপি ম্যানেজমেন্টের মধ্যে আছে থেরাপিউটিক ব্যায়াম, ক্রায়োথেরাপি, ইউভি থেরাপি, প্যারাফিন বাথ, হাইড্রোথেরাপি ইত্যাদি।
গেঁটেবাত ও সিপিপিডি
গেঁটেবাত (গাউট) ও সিপিপিডি (সিউডোগাউট) বিপাকীয় ডিজঅর্ডার হলেও এদের লক্ষণ ও উপসর্গের উপস্থাপন আর্থ্রাইটিস এর সাথে নিবিড়ভাবে মিলে যায়।
গেঁটেবাত এবং সিপিপিডি উভয়েই ক্ষুদ্র স্ফটিক দিয়ে হয় কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই স্ফটিকের ভিন্নতা আছে। গাউট বা গেঁটেবাত হয় যখন শরীরে উচ্চমাত্রায় ইউরিক এসিডের কারণে অস্থিসন্ধির চারপাশে মনোসোডিয়াম ইউরেট স্ফটিক গঠিত হয় এবং ফলস্বরূপ ব্যথা হয়। অন্যদিকে সিপিপিডির পূর্ণরূপ ইংরেজিতে ‘ক্যালসিয়াম পাইরোফসফেট ডাইহাইড্রেট স্ক্রিস্টাল ডিপোজিশন’। সিউডোগাউট বা সিপিপিডি তে অস্থিসন্ধির চারপাশে পাইরোফসফেট ডাইহাইড্রেট প্রকারের স্ফটিক গঠিত হয়। যার কারণে সেখানে ব্যথা অনুভূত হয়।
হাঁটুর গেঁটেবাত এবং সিউডোগাউট হবার পেছনে বয়স, পারিবারিক ইতিহাস, আঘাতজনিত কারণ রিস্ক ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। মেয়েদের চেয়ে ছেলেরাই গেঁটেবাত এ বেশি আক্রান্ত হয়। হাঁটুর গেঁটেবাত এ আক্রান্ত রোগীরা সাধারণত ৩০-৫০ বয়সী হয়ে থাকেন। অন্যদিকে সিউডোগাউট ৬০ বছর বয়সী নারী পুরুষ যে কারো হতে পারে।
উভয় কন্ডিশনেই ফিজিওথেরাপি একটি গবেষণা ভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতি। রোগ দুটির পুনর্বাসনে থেরাপিউটিক ব্যায়াম এর পাশাপাশি অস্থিসন্ধির জন্য স্প্লিন্ট, অর্থোটিক্স ও অন্যান্য সহায়ক যন্ত্রের ব্যবহার, ক্রায়োথেরাপি, ইলেকট্রোআকুপাংচার প্রভৃতি টেকনিক করা হয়ে থাকে।
সেপটিক আর্থ্রাইটিস
এ ধরণের আর্থ্রাইটিস এ বিভিন্ন ধরণের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হয়ে অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, ফুলে যাওয়া, দুর্বলতা, জ্বর আসা প্রভৃতি দেখা যায়। হাঁটুতে সেপটিক আর্থ্রাইটিস হলে অন্যান্য চিকিৎসার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা এড়াতে ফিজিওথেরাপি একটি কার্যকরী চিকিৎসা পদ্ধতি। হাঁটুতে সেপটিক আর্থ্রাইটিস এ আক্রান্ত রোগীর পুনর্বাসনের লক্ষ্য থাকে –
- হাঁটুর চারপাশের পেশিগুলোর শক্তি বাড়ানো
- ব্যথা কমানো
- জড়তা কমানো
- চলাচলের পরিসীমার (রেঞ্জ অব মুভমেন্ট) উন্নয়ন
- রোগীর দৈনিক কার্যক্রম গতিশীল করতে সহায়তা করা ইত্যাদি।
এক্ষেত্রে একজন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক থেরাপিউটিক ব্যায়াম, জয়েন্ট মোবিলাইজেশন, ক্রায়োথেরাপি, হাইড্রোথেরাপি, জয়েন্ট স্প্লিন্ট, অবস্থার তীব্রতা অনুযায়ী পেইন ম্যানেজমেন্ট মডালিটিস প্রভৃতি ব্যবহার করে থাকেন।
রিয়েক্টিভ আর্থ্রাইটিস
রেইটার সিনড্রোম নামে পরিচিত এ আর্থ্রাইটিস কোন গ্যাস্ট্রোইনটেসটিনাল বা জেনিটোইউরিনারি সংক্রমণ এর কয়েক দিন বা সপ্তাহ পরে প্রকাশিত হয়। রিয়েক্টিভ আর্থ্রাইটিস বয়স্ক পুরুষদের বেশি হয়।
হাঁটুর অস্থিসন্ধি এতে আক্রান্ত হলে অন্যান্য চিকিৎসার পাশাপাশি ফিজিওথেরাপি খুবই উপকারী ভূমিকা পালন করে থাকে।
তথ্যসূত্র
Felson, D.T., Lawrence, R.C., Dieppe, P.A., Hirsch, R., Helmick, C.G., Jordan, J.M., Kington, R.S., Lane, N.E., Nevitt, M.C., Zhang, Y. and Sowers, M., 2000. Osteoarthritis: new insights. Part 1: the disease and its risk factors. Annals of internal medicine, 133(8), pp.635-646. https://www.acpjournals.org/doi/abs/10.7326/0003-4819-133-8-200010170-00016
Mease, P.J., 2011. Psoriatic arthritis: update on pathophysiology, assessment and management. Annals of the Rheumatic Diseases, 70(Suppl 1), pp.i77-i84. https://ard.bmj.com/content/70/Suppl_1/i77.short
Dalbeth, N. and Haskard, D.O., 2005. Mechanisms of inflammation in gout. Rheumatology, 44(9), pp.1090-1096. https://academic.oup.com/rheumatology/article-abstract/44/9/1090/1784320
Shirtliff, M.E. and Mader, J.T., 2002. Acute septic arthritis. Clinical microbiology reviews, 15(4), pp.527-544. https://journals.asm.org/doi/abs/10.1128/cmr.15.4.527-544.2002
- ডেঙ্গু জ্বরের ৭টি সতর্কীকরণ লক্ষণ ২০২৪ | ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার - November 28, 2024
- হাঁটু ব্যথার জন্য কার্যকারী ব্যায়াম গুলো জেনে নিন - November 28, 2024
- লাম্বার স্পন্ডাইলোসিস কমানোর উপায়? ও স্পন্ডাইলোসিস কি? - November 5, 2024