হাঁটু ব্যথার জন্য কার্যকারী ব্যায়াম
হাঁটু ব্যথার জন্য কার্যকারী ব্যায়াম. হাঁটু ব্যথার জন্য ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক এর নির্দেশনায় যদি আপনি নিয়মিত ব্যায়াম করেন, তাহলে খুব দ্রুতই ব্যথা থেকে মুক্তি লাভ করবেন। ব্যায়ামের মাধ্যমে অস্থিসন্ধির নমনীয়তা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। পাশাপাশি হাঁটুর নানা ব্যায়াম অস্থিসন্ধির চারপাশে অবস্থিত পেশিকে শক্তিশালী করে, যা ভবিষ্যৎ ইনজুরি বা আঘাতের ঝুঁকি কমিয়ে দেয়।
আপনার হাঁটু ব্যথার কারণের উপর নির্ভর করে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক নানা ধরণের ব্যায়াম প্রেসক্রাইব করতে পারেন। এ প্রবন্ধে আমরা এরকম কয়েকটি ব্যায়াম নিয়ে আলোচনা করবো।
হ্যামস্ট্রিং স্ট্রেচ
হাঁটু ব্যথার জন্য কার্যকারী ব্যায়াম. আমাদের থাই বা উরুর পিছনে অবস্থিত মাসল গ্রুপের নাম হ্যামস্ট্রিং। হ্যামস্ট্রিং মাসল কমপ্লেক্স তিনটি আলাদা পেশির সমন্বয়ে গঠিত। যথা: সেমিটেন্ডিনোসাস, সেমিমেমব্রেনোসাস এবং বাইসেপস ফিমোরিস। কোমর এবং পায়ের নানা মুভমেন্টে হ্যামস্ট্রিং মাসলের সরাসরি ভূমিকা আছে।হ্যামস্ট্রিং মাসল স্ট্রেচ করার নানা পদ্ধতি আছে। তার মধ্যে কয়েকটি হলো
স্ট্যান্ডিং টো টাচ – দাঁড়ানো অবস্থা থেকে নুয়ে পায়ের বুড়ো আঙ্গুল ধরা
স্টেপ ১ – সমতল ভূমি বা মেঝেতে সোজা হয়ে দাঁড়ান। সামনের দিকে ধীরে ধীরে ঝুঁকে দুই হাত দিয়ে পায়ের বুড়ো আঙ্গুল ধরার চেষ্টা করুন। যদি আপনি মেঝের কাছাকাছি যেতে না পারেন, সমস্যা নেই। যতক্ষণ না পর্যন্ত উরুর পেছনে টান অনুভব করছেন, ততক্ষন পর্যন্ত যেতে থাকুন।
স্টেপ ২ – স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস বজায় রেখে ১৫ থেকে ৩০ সেকেন্ড এই অবস্থায় থাকুন। এরপর শুরুর পজিশনে আসুন এবং পুনরায় করুন।
রোটেটিং টো টাচ
স্টেপ ১ – দুই পায়ের পাতার মাঝে কিছুটা ফাঁকা রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ান। দুই হাত মেঝের সমান্তরালে কাধ বরাবর উঠিয়ে আনুন।
স্টেপ ২ – আপনার পা সোজা রাখা অবস্থায় ঝুঁকে ডান হাত দিয়ে বাম পায়ের গোড়ালির দিকে যান। হাঁটু ভাজ করা যাবে না। এই অবস্থায় আপনি আপনার বাম পায়ের পিছনে তীব্র টান অনুভব করবেন।
স্টেপ ৩ – স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস বজায় রেখে ১৫ থেকে ৩০ সেকেন্ড পজিশনটি ধরে রাখুন। এরপর শুরুর পজিশনে ফিরে আসুন এবং বিপরীত পাশে একই স্টেপগুলো অনুসরণ করুন।
শোয়াবস্থায় হ্যামস্ট্রিং স্ট্রেচ
স্টেপ ১ – সমতল মেঝে বা বিছানায় শুয়ে পড়ুন। আপনার ডান পায়ে রেজিস্টেন্স ব্যান্ড বা তোয়ালে পেঁচিয়ে নিন।
স্টেপ ২ – ধীরে ধীরে আপনার ডান পা উপরে তুলুন, বিপরীত পা মেঝেতে অবস্থান করবে এবং উভয় হাঁটু সোজা থাকতে হবে।
স্টেপ ৩ – আপনার পক্ষে যতদূর সম্ভব, পা স্ট্রেচ বা প্রসারিত করতে থাকুন। যদি ডান পায়ের পিছনে টান অনুভব করেন, তাহলে সেই অবস্থানে থামুন।
স্টেপ ৪ – পনেরো থেকে ত্রিশ সেকেন্ড এই পজিশনে থাকুন। এরপর শুরুর অবস্থানে ফিরে অন্য পায়ে একই পদ্ধতি অনুসরণ করুন।
ডাউনওয়ার্ড ফেসিং ডগ পোজ বা ইয়োগার ভাষায় – অধোমুখী শবাসনা
স্টেপ ১ – চার হাত পার সাহায্যে প্রথমে টেবিল এর মতো পজিশনে আসুন। সমতল ভূমিতে আপনার হাতের আঙ্গুলগুলো ছড়িয়ে দিন। পায়ের পাতা পরস্পরের সাথে লেগে থাকবে।
স্টেপ ২ – ধীরে ধীরে হাঁটু শক্ত করুন এবং নিতম্বকে উপরের দিকে উঠান।
স্টেপ ৩ – আপনার মাথা, ঘাড় এবং মেরুদণ্ডকে একই সারিতে রাখুন। হাঁটু ভাজ করা যাবে না, পায়ের পাতা সমতল ভুমির সাথে লেগে থাকবে, আঙ্গুলগুলো সামনে থাকবে। স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস বজায় রেখে ২০-৩০ সেকেন্ড থাকুন। এরপর বিশ্রাম নিন। এ পদ্ধতিতে হ্যামস্ট্রিং এর পাশাপাশি পায়ের কাফ মাসল ও কোমরের মাংশপেশির স্ট্রেচিং ও সম্পন্ন হয়।
কাফ মাসল স্ট্রেচিং
গ্যাস্ট্রোকনেমিয়াস এবং সোলিয়াস – এ দুটি মাসলের সমন্বয়ে কাফ মাসল গঠিত। পায়ের চলাচলে এ দুটি পেশির সরাসরি ভুমিকা আছে। দ্রুতগতিতে হাঁটা, দৌড়ানো, সিঁড়িপথে উঠানামা করা – প্রত্যেকটিই কাফ মাসল শক্তিশালী করতে সহায়ক।
কাফ মাসল স্ট্রেচিং এর কয়েকটি পদ্ধতি হলো –
সমতল ভুমিতে বসে কাফ মাসল স্ট্রেচ
স্টেপ ১ – সমতল ভূমিতে পা সোজা রেখে বসুন। পায়ের পাতায় একটি তোয়ালে বা বেল্ট পেঁচিয়ে হাত দিয়ে ধরুন।
স্টেপ ২ – তোয়ালে বা বেল্টের সাহায্যে আপনার পায়ের পাতা ও আঙ্গুলগুলো আপনার দিকে টানুন যতক্ষণ না পর্যন্ত আপনি আপনার পায়ের পিছনে যেখানে কাফ মাসল গুলো আছে সেখানে টান অনুভব করছেন।
স্টেপ ৩ – ৩০ সেকেন্ড ধরে রেখে ছেড়ে দিন। এরপর অন্য পায়েও একই পদ্ধতিতে স্ট্রেচিং করুন।
এ পদ্ধতিতে কাফ মাসলগুলোকে আলাদাভাবে স্ট্রেচ করতে চাইলে:
- গ্যাস্ট্রোকনেমিয়াস – হাঁটু সোজা রাখতে হবে
- সোলিয়াস – সামান্য পরিমাণে হাঁটু বেন্ড বা বাঁকা করে নিন।
চেয়ারে বসে কাফ স্ট্রেচ
স্টেপ ১- চেয়ারে লম্বা হয়ে বসুন। কুজো হওয়া যাবে না। আপনার পায়ের পাতায় একটি তোয়ালে বা বেল্ট পেচিয়ে হাত দিয়ে ধরুন।
স্টেপ ২- তোয়ালে বা বেল্টের মাধ্যমে পায়ের গোড়ালি টানুন, ধীরে ধীরে কাফ মাসল এরিয়াতে স্ট্রেচ বাড়ান।
স্টেপ ৩- ৩০ সেকেন্ড ধরে রেখে ছেড়ে। অন্য পায়ে একই পদ্ধতিতে স্ট্রেচ করুন।
দাঁড়িয়ে দেয়ালের সাহায্যে কাফ মাসল স্ট্রেচ
স্টেপ ১ – একটি দেয়ালের মুখোমুখি দাঁড়ান। আপনার পিছনে পা প্রসারিত করুন। পায়ের আঙ্গুলগুলো সামনে দেয়ালের দিকে থাকতে হবে।
স্টেপ ২ – গ্যাস্ট্রোকনেমিয়াস মাসলের জন্য : পিছনের হাঁটু এবং কোমর সোজা রেখে সামনের পায়ের দিকে ঝুঁকুন (লাঞ্জ) যতক্ষণ না পর্যন্ত আপনি পায়ের পিছনে টান অনুভব করছেন।
সোলিয়াস মাসলের জন্য : কোমর সোজা রেখে পিছনের হাঁটু সামান্য বাকিয়ে রেখে দেয়ালের সাথে ঝুঁকুন যতক্ষণ না আপনি পায়ের পিছনে টান অনুভব করছেন।
স্টেপ ৩ – ৩০ সেকেন্ড ধরে রাখুন। তারপর অন্য পায়ে একই পদ্ধতিতে স্ট্রেচ করুন।
কোয়াড্রিসেপস মাসলের ব্যায়াম
হাঁটুর উপরে উরুর সামনে অবস্থিত কোয়াড্রিসেপস মাসল গ্রুপ আমাদের শরীরের অন্যতম শক্তিশালী পেশিগুলোর মধ্যে অন্যতম। রেকটাস ফিমোরিস, ভাসটাস মিডিয়ালিস, ভাসটাস ল্যাটেরালিস, ভাসটাস ইন্টারমিডিয়ালিস – এই পৃথক চারটি পেশির সমন্বয়ে কোয়াড্রিসেপস ফিমোরিস গঠিত।
আমাদের চলাচলের জন্য এই পেশিগুলোর সুস্থতা অপরিহার্য। পেশিগুলোকে সচল রাখার জন্য অনেক ধরণের ব্যায়াম আছে। তার মধ্যে কয়েকটি হলো –
দাঁড়িয়ে কোয়াড স্ট্রেচ
স্টেপ ১ – টেবিল বা চেয়ালে ধরে ভারসাম্য বজায় রেখে এক পায়ে দাঁড়ান। অন্য পা ভাজ করে কোমরের কাছাকাছি বা নিতম্ব পর্যন্ত নিয়ে এসে একই পাশের হাত দিয়ে গোড়ালিকে ধরুন।
স্টেপ ২ – মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াবেন। সামনের দিকে ঝুঁকবেন না।
স্টেপ ৩ – পায়ের গোড়ালিকে হাত দিয়ে নিতম্বের দিকে চেপে ধরুন যতক্ষণ না পর্যন্ত উরুর সামনে টান অনুভব করছেন।
স্টেপ ৪ – ৩০ সেকেন্ড ধরে রাখুন। ছেড়ে দিন। এরপর অপর পায়েও একই পদ্ধতিতে স্ট্রেচিং করুন।
সাইড লায়িং বা এক পাশে শুয়ে কোয়াড মাসলের স্ট্রেচ
স্টেপ ১ – সমতল ভূমিতে শুয়ে কাঁধ, নিতম্ব এবং হাঁটু সোজা লাইন বরাবর রেখে এক পাশে আনুন। এক হাত মাথার নিচে থাকবে। অন্য হাত মুক্ত থাকবে।
স্টেপ ২ – গোড়ালি ভাঁজ করে নিতম্ব পর্যন্ত আনার চেষ্টা করুন। এরপর হাত দিয়ে গোড়ালি ধরে চাপ প্রয়োগ করতে থাকুন যতক্ষণ না পর্যন্ত উরুর সামনে আপনি স্ট্রেচ বা টান অনুভব করেন। এক্ষেত্রে হাঁটু যেন শুরুতে যেমন কাঁধ বরাবর অবস্থানে ছিল, তেমনই থাকে – হাঁটু সামনে চলে আসলে প্রসারণ মাত্রা কমে যাবে। হাঁটু ব্যথার চিকিৎসা
স্টেপ ৩ – ৩০ সেকেন্ড ধরে রেখে ছেড়ে দিন। পাশ পরিবর্তন করে অপর পায়ের জন্যও একই পদ্ধতিতে স্ট্রেচিং করুন।
উপুড় হয়ে শুয়ে কোয়াড মাসলের স্ট্রেচ
স্টেপ ১ – সমতল জায়গায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ুন। হাঁটুর নিচে বালিশ বা তোয়ালে পেঁচিয়ে রাখতে পারেন।
স্টেপ ২ – হাঁটু ভাজ করে নিতম্বের কাছে এনে গোড়ালিকে হাত দিয়ে ধরে নিতম্বের সাথে চেপে ধরুন। উরুর সামনে একটা টান অনুভব করবেন। যদি আপনি হাত দিয়ে গোড়ালি পর্যন্ত পৌঁছাতে না পারেন, তাহলে বেল্টের সাহায্য নিয়েও করতে পারেন। সেক্ষেত্রে গোড়ালির চারপাশে বেল্ট বেধে সেটি ধরে টান দিতে থাকবেন যতক্ষণ না পর্যন্ত উরুর সামনে টান অনুভব করেন।
স্টেপ ৩ – ৩০ সেকেন্ড ধরে রাখুন। ধীরে ধীরে পা আগের অবস্থায় আনুন। এরপর অপর পায়ে একই পদ্ধতি অনুসরণ করে স্ট্রেচিং করুন।
এই সাধারণ ব্যায়ামগুলো সুস্থ, যেকোন বয়সী মানুষেরাই করতে পারেন। তবে সঠিক পশ্চার বা অঙ্গভঙ্গি বজায় রাখা জরুরি। একই সাথে স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস বজায় রাখতে হবে। শারীরিক কাঠামো এবং মেডিকেল হিস্ট্রি অনুযায়ী ব্যায়াম কতক্ষণ করবেন, দিনে কতবার করবেন – এসবে ভিন্নতা আসতে পারে। নিজেকে সুস্থ এবং কর্মঠ রাখতে নিয়মিত ব্যায়ামের কোন বিকল্প নেই। একজন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক এক্ষেত্রে আপনাকে সঠিকভাবে দিকনির্দেশনা দিতে পারেন।
তথ্যসূত্র
O’Sullivan, K., Murray, E. and Sainsbury, D., 2009. The effect of warm-up, static stretching and dynamic stretching on hamstring flexibility in previously injured subjects. BMC musculoskeletal disorders, 10, pp.1-9. https://link.springer.com/article/10.1186/1471-2474-10-37
Yuktasir, B. and Kaya, F., 2009. Investigation into the long-term effects of static and PNF stretching exercises on range of motion and jump performance. Journal of bodywork and movement therapies, 13(1), pp.11-21. https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S1360859207001118
Manske, R.C. and Prohaska, D., 2017. Rehabilitation following medial patellofemoral ligament reconstruction for patellar instability. International journal of sports physical therapy, 12(3), p.494. https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC5455199/
Paterno, M.V., Schmitt, L.C., Ford, K.R., Rauh, M.J., Myer, G.D., Huang, B. and Hewett, T.E., 2010. Biomechanical measures during landing and postural stability predict second anterior cruciate ligament injury after anterior cruciate ligament reconstruction and return to sport. The American journal of sports medicine, 38(10), pp.1968-1978. https://journals.sagepub.com/doi/abs/10.1177/0363546510376053
Radford, J.A., Burns, J., Buchbinder, R., Landorf, K.B. and Cook, C., 2006. Does stretching increase ankle dorsiflexion range of motion? A systematic review. British journal of sports medicine, 40(10), pp.870-875. https://bjsm.bmj.com/content/40/10/870.short
- ডেঙ্গু জ্বরের ৭টি সতর্কীকরণ লক্ষণ ২০২৪ | ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার - November 28, 2024
- হাঁটু ব্যথার জন্য কার্যকারী ব্যায়াম গুলো জেনে নিন - November 28, 2024
- লাম্বার স্পন্ডাইলোসিস কমানোর উপায়? ও স্পন্ডাইলোসিস কি? - November 5, 2024