প্যাটেলোফেমোরাল পেইন সিন্ড্রোম কি এবং প্রতিকার

প্যাটেলোফেমোরাল পেইন সিন্ড্রোম কি. হাঁটু ব্যথা বর্তমান সময় একটি সাধারণ বিষয়, আগে ধারণা করা হতো শুধুমাত্র বয়স্ক ব্যক্তিদের হাঁটু ব্যথা হয়ে থাকে কিন্তু এখন হাঁটু ব্যথার প্রবণতা সকল বয়সের মানুষের মধ্যেই লক্ষ্য করা যায়। গঠনগত এবং কার্যক্ষমতা দিক দিয়ে হাঁটু শরীরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি জয়েন্ট। শরীরের সমস্ত ভর বহনসহ আমাদের দৈনন্দিন চলাফেরা সকল কাজকর্মে হাঁটুর গুরুত্ব অপরিসীম।

সকল ধরনের মাস্কুলো-স্কেলেটাল সমস্যার মধ্যে হাঁটু ব্যথা দ্বিতীয় অবস্থানে আছে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর ৩০ মিলিয়ন মানুষ হাঁটু ব্যথায় ভুগে থাকেন। বিভিন্ন কারণে আমাদের হাঁটুতে ব্যথা হতে পারে, প্যাটেলোফেমোরাল পেইন সিন্ড্রোম তার মধ্যে অন্যতম। ২০ থেকে ৩০ শতাংশ হাঁটু ব্যথা আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্যাটেলোফেমোরাল পেইন সিন্ড্রোম এর জন্য হাটু ব্যথায় ভুগে থাকেন। সাধারণত ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা দুই থেকে তিনগুণ বেশি প্যাটেলোফেমোরাল পেইন সিন্ড্রোম জনিত হাঁটু ব্যথায় ভুগে থাকেন।

প্যাটেলোফেমোরাল পেইন সিন্ড্রোম কি?

প্যাটেলোফেমোরাল পেইন সিনড্রোম (পিএফপিএস) একটি বৃহৎ শব্দ  যা সাধারণত হাঁটুর সামনের অংশে, প্যাটেলা বা বার্টির চারপাশের নরম টিস্যুগুলিতে ব্যথা অনুভব হওয়া জনিত সমস্যাকে বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী হাঁটুর সমস্যা যা স্কোয়াটিং, অতিরিক্ত উঠবস করা, সিঁড়িরে ব্যবহার এবং দৌড়ানোর মতো কার্যকলাপের দিন দিন আরও খারাপ হতে থাকে।এ সমস্যায় হাঁটুর সামনের অংশের পাশাপাশি অনেক সময় হাঁটুর পিছনে এবং পপলাইটাল ফোসা সহ সম্পূর্ণ হাঁটুতেই ব্যথা অনুভব হতে পারে।

আরও পড়ুনঃ ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি

প্যাটেলোফেমোরাল পেইন সেন্ড্রোমের কারণ সমূহ

চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা সঠিক কারণ সম্বন্ধে এখনো নিশ্চিত নয়, তবে কিছু কিছু কারণে প্যাটেলোফেমোরাল পেইন সিস্টেমে আক্রান্তের পরিমাণ পরিমাণ অধিকতর লক্ষ্য করা যায়।

হাঁটু অতিরিক্ত ব্যবহার করা: সাধারণ মানুষের তুলনায় ক্রিয়াবীদের মধ্যে প্যাটেলের সিনড্রোম অধিক লক্ষ্য করা যায়। যেমন দৌড়, দীর্ঘ লাফ, ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, বাস্কেটবল, ভলিবল এবং টেনিস এর মত খেলায় হাঁটতে অধিক চাপ পড়ে এত করে প্যাটালার নিচে ব্যথা ও জ্বালাতন সৃষ্টি হতে পারে।

মাংসপেশীর ভারসাম্যহীনতা বা দুর্বলতা: হাঁটু এবং কোমরের মাংসপেশি দুর্বলতার ফলে প্যাটালা বা হাঁটুর বাটি সঠিক অবস্থান থেকে সরে গিয়ে পেট্রলের ফেমাস হতে পারে।

আঘাত: হাটুতে আঘাত, ডিসলোকেসন, ভেঙে যাওয়া এবং পায়ের লিগামেন্ট ছিড়ে গেলে প্যাটেলোফেমোরাল পেইন সেন্ড্রোম  লক্ষ্য করা যায়।

অস্ত্রোপচার: যেকোনো ধরনের হাঁটুর অস্ত্রোপচার, এন্টেরিয়র কুশিয়েট লিগামেন্ট (এস সি এল) ইনজুরিতে লিগামেন্ট প্রতিস্থাপনের জন্য পেটেলার টেন্ডন ব্যবহারের ফলে প্যাটেলোফেমোরাল পেইন সেন্ড্রোমের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।

যে সকল কারণে প্যাটেলোফেমোরাল পেইন সেন্ড্রোমের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়

  • হঠাৎ করে  শারীরিক কার্যকলাপের মাত্রা বৃদ্ধি করা।
  • বয়স:সাধারণত কিশোর এবং তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে অধিক লক্ষ্য করা যায়। বয়স্কদের মধ্যে হাঁটুর ব্যথা সাধারণত আর্থ্রাইটিসজনিত সমস্যা ফলে হয়ে থাকে।
  • লিঙ্গ: পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে পেট্রলের ফিমেল পেইন্ট সিমটমে হওয়ার সম্ভাবনা দ্বিগুণেরও  বেশি হয়ে থাকে। কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেন ছেলেদের তুলনা মেয়েদের কোমর অনেক বেশি চওড়া হয় যার ফলে হাঁটুতে সংযুক্ত হওয়ার সময় ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের বক্রতা বেশি থাকে।
  • খেলাধুলা: দৌড়ানো, দীর্ঘ লাফ, ফুটবল, ভলিবল, ক্রিকেট, বাস্কেটবল, এবং জিমনেস্টিকে মত খেলাতে খেলোয়াড়দের পায়ে অধিক চাপ পড়ে থাকে, বিশেষ করে যখন ট্রেনিং সেশন বৃদ্ধি করা হয়।
  • যেন ভালগান ডিফরর্মিটি পেট্রলের ফিমেল পেইন্ট সিমটমের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
  • ফুট প্রোনেশন।

প্যাটেলোফেমোরাল পেইন সেন্ড্রোমের উপসর্গগুলি

  • হাটু বাটির নিচে এবং তার চারপাশে ব্যথা অনুভব হওয়া
  • হাটুতে ক্রিপিটাস বা অস্বাভাবিক শব্দ হাওয়া।
  • হাঁটু চারপাশ ফুলে যাওয়া।
  • হাটু এবং কোমরের চারপাশের মাংস গুলিতে দুর্বলতা অনুভব হওয়া।
  • উঠবস করতে অসুবিধা হয়।
  • সিঁড়িতে উঠালামা করতে অসুবিধা হয়
  • দীর্ঘ সময় বসে থাকার পর হাটুতে ব্যথা অনুভব হয়
  • দৈনন্দিন কাজকর্মের সাথে ব্যথা বৃদ্ধি পায়া
  • হাঁটু ভাঁজ করতে অসুবিধা হওয়া

আরও পড়ুনঃ স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি কী, এর প্রকারভেদ এবং ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা

যেভাবে প্রতিরোধ করতে পারি প্যাটেলোফেমোরাল পেইন সেন্ড্রোম

হাঁটু ব্যথার শুরু হওয়ার সাথে সাথে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে প্যাটেলোফেমোরাল পেইন সেন্ড্রোমপ্রতিরোধ করা সম্ভব

  • মাংসপেশি শক্তি বৃদ্ধি: আমাদের উড়ুর  (কয়াডিসেপ্স) এবং কোমরের (হিপ অ্যাবডাক্টর) মাংসপেশীর শক্তি বৃদ্ধির করা যা হাঁটুর ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে।
  • মাংসপেশী নমনীয়তা বৃদ্ধি করা।
  • শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমানো।
  • প্রতিযোগিতামূলক ক্রিয়ার পূর্বে ওয়াম আপএক্সেসাইজ করা। এত করে প্যাটেলোফেমোরাল পেইন সেন্ড্রোম বহু অংশে কমানো সম্ভব।
  • সঠিক মাপের জুতা পরিধান করা এবং ক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত জোতাই ব্যবহার করা।
  • ব্যথা পুনরাবৃত্তি হলে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক অথবা ফিটনেস ট্রেইনারের পরামর্শে ক্রিয়ার টেকনিক পরিবর্তন করা।
  • এক্সারসাইজ, ওয়া মাপ এবং ট্রেনিং এর সময় ধীরে ধীরে বৃদ্ধি করা।
  • ব্যথার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে নিকেপ, বাহ হাটুর এংলেট ব্যবহার করা।

সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ না করলে প্যাটেলোফেমোরাল পেইন সেন্ড্রোমের ফলে জটিলতা লক্ষ্য করা যায়

  • প্যাটেলোফেমোরাল আর্থ্রাইটিস বা অস্টিওআর্থ্রাইটিস।
  • প্যাটেলা ডিসলোকেশন অর্থাৎ দৈনন্দিক ক্রিয়াকলাপ এর সময় হাঁটুর বাটি ভিতরে অথবা বাহিরের দিকে সরে যাওয়া।
  • হাটু শক্ত হয়ে যাওয়া।
  • হাঁটুর নড়াচড়ায় তীব্র ব্যথা অনুভব হওয়া।

যে সকল পরীক্ষার মাধ্যমে প্যাটেলোফেমোরাল পেইন সেন্ড্রোম নির্ণয় করা হয়

যেকোনো ধরনের মাসকুলস্কেকলেটাল সমস্যায় রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে রোগীর হিস্ট্রি বা ইতিহাস সম্পর্কে জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন ধরনের ইমেজিং পরীক্ষার তুলনায় রোগ বিস্তারের ইতিহাস সঠিক রোগ নির্ণয়ের সাহায্য করে। প্যাটেলোফেমোরাল পেইন সিনড্রোমের নির্ণয় ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে যত দ্রুত সম্ভব একজন অভিজ্ঞ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক অথবা অর্থোপেডিকস সার্জন এর শরণাপন্ন হওয়া।

শারীরিক পরীক্ষা: একজন অভিজ্ঞ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক বিভিন্ন ধরনের শারীরিক পরীক্ষা (যেমন-ম্যাকমুরেস টেস্ট, অ্যাপলির টেস্ট)  মাধ্যমে প্যাটেলোফেমোরাল পেইন সেন্ড্রোম নির্ণয় করে থাকেন।

  • ইন্সপেকশন: যেকোনো ধরনের মাসকুলস্কেকলেটাল ইন্সপেকশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এক্ষেত্রে একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক হাঁটু ফুলে যাওয়া, হাঁটুর চারপাশ লাল হয়ে যাওয়া, হাটুর স্বাভাবিক অবস্থান পরিবর্তন হওয়া এবং প্যাটেলার ডিসলকেসন  ইত্যাদি দেখে থাকেন।
  • পালপেশন: সাধারণত এক্ষেত্রে একজন চিকিৎসক তার হাত দিয়ে রোগীর হাটু বিভিন্ন অংশে চাপ দিয়ে হাঁটুর বর্তমান অবস্থা নির্ণয় করে থাকেন।
  • মুভমেন্ট: বিভিন্ন পজিশনে হাটু ভাঁজ করা এবং সোজা করা, হাঁটুতে ভর বহন করার মাধ্যমে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকগণ ব্যথার নির্দিষ্ট অবস্থান নির্ণয় করে থাকেন।
  • স্পেশাল টেস্ট: প্যাটেলার গ্রাইন্ড টেস্ট একে ক্লার্কের চিহ্ন, ক্লার্কের পরীক্ষা এবং জোহলেন চিহ্নও বলা হয়, এটি সাধারণত ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকগণ হাঁটু ব্যথা নির্ণয় করতে ব্যবহার করেন।

এছাড়াও প্যাটেলোফেমোরাল পেইন সেন্ড্রোম নির্ণয়ের ক্ষেত্রে চিকিৎসকগণ ইমেজিং টেকনোলজি সাহায্য নিয়ে থাকেন। ব্যথার যথাযথ কারণ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ইমেজিং টেকনোলজি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত চিকিৎসকগণ মাসকুলাস্কেলেটাল আলটাসনোগ্রাফি, সিটি স্ক্যান, এম আর আই এবং এক্স-রে সাহায্য নিয়ে থাকেন।

আরও পড়ুনঃ লাম্বার স্পন্ডাইলোসিস কি, কেন হয় এবং এর চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা

প্যাটেলোফেমোরাল পেইন সেন্ড্রোমের চিকিৎসা পদ্ধতি

প্যাটেলোফেমোরাল পেইন সেন্ড্রোমের প্রাথমিক চিকিৎসা: প্যাটেলোফেমোরাল পেইন সেন্ড্রোমের পর যত দ্রুত সম্ভব একজন অভিজ্ঞ  চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

ঔষধ: যদি তীব্র ব্যথা হয় সেক্ষেত্রে ব্যথা নাশক ওষধ সেবন করা যায় যেমন- অ্যাসিটামিনোফেন (টাইলেনল, অন্যান্য), আইবুপ্রোফেন (অ্যাডভিল, মট্রিন আইবি, অন্যান্য) বা নেপ্রোক্সেন সোডিয়াম (আলেভ)।

বিশ্রাম: সকল প্রকার কাজকর্ম থেকে বিরত থাকতে হবে বিশেষ করে ওই সকল কাজ যেখানে হাঁটু জড়িত যেমন সিঁড়ি বেয়ে ওঠা, হাঁটু গেড়ে বসে থাকা বা বসে থাকা। আঘাতপ্রাপ্ত হাঁটু যেন পুনরায় আঘাতপ্রাপ্ত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

বরফ সেক: ব্যথা ও ফোলা কমানোর জন্য প্রতিদিন চার থেকে ছয় ঘন্টা অন্তর অন্তর ১৫ মিনিট করে বরফ সেক দিতে হবে।

ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা: প্যাটেলোফেমোরাল পেইন সেন্ড্রোম চিকিৎসায় ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন অভিজ্ঞ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের পরামর্শে হাঁটুর জয়েন্টের চারপাশের মাংসপেশী গুলি শক্তি বৃদ্ধি, হাটুর স্থিতিশীলতা, হাটুর কর্ম ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সর্বোপরি পুনরায় ইনজুরি প্রতিরোধে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

সহায়ক বেস এবং টেপিং: প্যাটেলোফেমোরাল পেইন সেন্ড্রোমের চিকিৎসায় ব্যথা কমাতে এবং বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপে পুনরায় ব্যথা প্রতিরোধে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকগণ সহায়ক বেস ও টেপিং ব্যবহার করে থাকেন।

অস্ত্রোপ্চার: যদি রোগীর মেডিসিন এবং ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা নেওয়ার পরেও প্যাটেলোফেমোরাল পেইন সেন্ড্রোমের উপসর্গগুলি বহাল থাকে এবং দৈনন্দিন চলাফেরায় অসুবিধা সৃষ্টি হয়, সেক্ষেত্রে একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ অস্ত্রোপ্চারের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত তরুণাস্থির টুকরো অপসারণ এবং পুনর্গঠন করতে হয়।

তথ্যসূত্র

Dr. Sapia Akter
পরামর্শ নিতে 01877733322