মাসল স্পাজমের কারণ
মাসল স্পাজম বা পেশী খিঁচুনি কীভাবে সৃষ্টি হয়, তার সঠিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত ভাবে জানা যায়নি। তবে সাধারণ ট্রিগার গুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে:
- ব্যায়াম থেকে পেশী ক্লান্তি
- পেশীর অত্যধিক ব্যবহার
- দীর্ঘ সময়ের জন্য একই অবস্থানে থাকা
- ডিহাইড্রেশন
- ইলেক্ট্রোলাইট হ্রাস
- ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম এবং সোডিয়ামের নিম্ন মাত্রা
- কিছু ওষুধ, যেমন স্ট্যাটিন, ডাই ইউরেটিক ড্রাগ
- কিছু মেডিকেল কন্ডিশন, যেমন ডায়াবেটিস, পারকিনসন ডিজিজ, কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ এবং সিরোসিস
- গর্ভাবস্থা
- মেরুদন্ডের স্নায়ুতে ক্রমাগত চাপ, লাম্বার স্টেনোসিস
- অপর্যাপ্ত রক্ত সরবরাহ, আর্টেরিওস্ক্লেরোসিস
- নার্ভের ক্ষতি
- পূর্বের আঘাত ইত্যাদি।
প্রায়শই, পেশীর খিঁচুনিকে ইডিওপ্যাথিক লেবেল করা হয় – যার অর্থ তাদের কোন চিহ্নিত কারণ নেই।
মাসল স্পাজমের চিকিৎসা
মাসল স্পাজমের চিকিৎসা। মাংসপেশীর ক্র্যাম্প বা স্পাজম এক বা একাধিক মাংসপেশীর আকস্মিক ও অনিচ্ছাকৃত সঙ্কোচন যা প্রায়ই তীব্র ব্যথা সৃষ্টি করে। এই মাংসপেশীর টান কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে এবং এটি একটি প্রতিরক্ষা মূলক বা চিকিৎসা গত প্রতিক্রিয়া হিসেবে ঘটে।
মাংসপেশীর স্পাজমের বিভিন্ন ধরনের মধ্যে রয়েছে স্কেলিটাল মাংসপেশীর স্পাজম, অ্যানজাইনা, এবং সিজার। যদিও বেশিরভাগ মাংসপেশীর স্পাজম গুরুতর ক্ষতি সৃষ্টি করে না, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে এটি মাংসপেশীর ব্যবহারকে সাময়িকভাবে প্রায় অসম্ভব করে তুলতে পারে। ফিজিওথেরাপি সহ বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি মাংসপেশীর টান হ্রাস করতে এবং ভবিষ্যতে মাংসপেশীর স্পাজম এড়াতে সহায়ক হতে পারে।
মাসল স্পাজমের ঝুঁকিতে আছেন কারা?
পেশী ক্র্যাম্পের ঝুঁকি বাড়াতে পারে এমন কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে:
* বয়স: বয়স্ক লোকেরা ধীরে ধীরে পেশীর ভর হারায়, তাই অবশিষ্ট পেশীগুলো খুব সহজে অতিরিক্ত চাপে পড়তে পারে।
* পানিস্বল্পতা: যেসব ক্রীড়াবিদ উষ্ণ আবহাওয়ায় খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করেন, তারা আবহাওয়াজনিত কারণে খুব সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়েন এবং ঘামের দরুন পানিস্বল্পতাজনিত কারণে তাদের প্রায়শই পেশীতে ক্র্যাম্প হয়।
* গর্ভাবস্থা: গর্ভাবস্থায় পেশীতে স্পাজম বা ক্র্যাম্প সাধারণ।
* মেডিকেল কন্ডিশন: আপনার যদি ডায়াবেটিস, বা স্নায়ু, লিভার বা থাইরয়েডের ব্যাধি থাকে, তবে আপনার পেশীতে স্পাজম বা ক্র্যাম্পের ঝুঁকি বেশি হতে পারে।
আরও পড়ুনঃ টেনিস এলবো চিকিৎসায় ফিজিওথেরাপি
পেশীর খিঁচুনি বা ক্র্যাম্প সাধারণত পায়ের পেশীতে বেশি ঘটতে দেখা যায়। কিন্তু পিঠ, হাত, পায়ের পাতা বা পায়ের আঙ্গুল সহ যেকোনো জায়গার পেশীতে খিঁচুনি হতে পারে। পেশীর খিঁচুনি কয়েক সেকেন্ড থেকে পনেরো মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
আপনি যদি দীর্ঘদিন ধরে মাসল ক্র্যাম্পিং অনুভব করেন তবে আপনি একজন ফিজিওথেরাপি ডাক্তারের সাথে দেখা করুন। পেশীর খিঁচুনি দূর করার জন্য বেশকিছু ঘরোয়া চিকিৎসার পরামর্শ দেওয়া হয়। তার মধ্যে কয়েকটি পদ্ধতি নিয়ে আমরা নিচে আলোচনা করছি:
১. স্ট্রেচিং
যে স্থানে মাসল স্পাজম হয়েছে, সেই স্থানটির পেশী যদি স্ট্রেচ করা হয়, তাহলে খিঁচুনির অবস্থার উন্নতি হওয়া ও পাশাপাশি পুনরায় যাতে স্পাজম না হয়, তা থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে।
- কাফ মাসল স্ট্রেচ
- থাই মাসল স্ট্রেচ
- ব্যাক মাসল স্ট্রেচ: টেনিস বল স্ট্রেচ, রোলার স্ট্রেচ, এক্সারসাইজ বল স্ট্রেচ।
- নেক স্ট্রেচ ইত্যাদি।
২. ম্যাসেজ
ম্যাসাজ হতে পারে শারীরিক ব্যথা এবং পেশীর ক্র্যাম্প উপশমের একটি দুর্দান্ত উপায়।
- খিঁচুনিতে থাকা পেশী আলতোভাবে ঘষুন।
- দীর্ঘদিনের পিঠের মাসল স্পাজমের জন্য, এর চারপাশের জায়গাটি শক্ত করে চিমটি কাটুন এবং কয়েক মিনিটের জন্য চিমটি ধরে রাখুন। আপনি যদি স্পাজমের এলাকায় নিজে পৌঁছাতে না পারেন তবে চিমটি করার জন্য আপনার অন্য কাউকে প্রয়োজন হতে পারে।
৩. বরফ বা তাপ
গরম বা ঠান্ডা থেরাপির মাধ্যমে ব্যথা এবং মাসল স্পাজমের চিকিৎসা অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে। ক্রমাগত স্পাজমের জন্য, দিনে কয়েকবার একবারে পনেরো থেকে বিশ মিনিটের জন্য পেশীতে বরফের প্যাক লাগান। বরফটিকে একটি পাতলা তোয়ালে বা কাপড়ে মুড়িয়ে রাখুন যাতে বরফ সরাসরি আপনার ত্বককে স্পর্শ না করে।
স্পাজমের এলাকায় একটি গরম করার প্যাড একবারে পনেরো থেকে বিশ মিনিটের জন্য কার্যকর হতে পারে, তবে গরম প্যাড ব্যবহারের পরপরই একটি বরফের প্যাক দিয়ে অনুসরণ করুন। কারণ গরম তাপ ব্যথার জন্য ভাল হলেও এটি প্রদাহকে আরও খারাপ করতে পারে। বরফ প্রদাহকে শান্ত করে। অন্যান্য তাপ বিকল্পগুলির মধ্যে রয়েছে একটি উষ্ণ স্নান, গরম ঝরনা, বা একটি গরম টব বা স্পা ইত্যাদি। এই পদ্ধতিগুলো আপনার পেশী শিথিল করতে সাহায্য করবে।
আরও পড়ুনঃ পিসিএল ইঞ্জুরিতে ফিজিওথেরাপি
৪. হাইড্রেশন
যখন আপনার খিঁচুনি হয়, কয়েক গ্লাস পানি পান করার চেষ্টা করুন। খিঁচুনি প্রতিরোধে সহায়তা করার জন্য, নিশ্চিত করুন যে আপনি হাইড্রেটেড থাকেন, বিশেষ করে যদি আপনি ব্যায়াম করেন বা আবহাওয়া গরম হয়।
আপনার ব্যক্তিগত চাহিদা, ক্রিয়াকলাপ, জীবনধারা এবং আবহাওয়ার মতো জিনিসগুলোর উপর ভিত্তি করে আপনার কয় গ্লাস পানি পান করা উচিত, তা বের করা হয়। ব্যক্তিভেদে এই পরিমাণ ভিন্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমাদের প্রয়োজনীয় প্রায় আশি শতাংশ খাবার পানীয় থেকে নিতে হবে এবং বাকি বি৳ শতাংশ আমরা যে খাবারগুলো খাই তা থেকে।
৫. হালকা ব্যায়াম
বেশ কিছু সমীক্ষায় উঠে এসেছে যে, ঘুমাতে যাওয়ার আগে যারা একটু হালকা ব্যায়াম করেন, তারা রাতে পায়ে ক্রাম্পিং হওয়া (যা প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ৬০ শতাংশের সাথে ঘটে থাকে) এড়াতে পারছেন।
হালকা ব্যায়ামের কিছু উদাহরণের মধ্যে রয়েছে:
- জগিং করা
- সিঁড়িতে উঠানামা করা
- কয়েক মিনিটের জন্য একটি স্টেশনারি বাইক চালানো
- ট্রামপোলিনের উপর লাফানো ইত্যাদি
যদিও হালকা ব্যায়াম মাসল স্পাজম এড়াতে সাহায্য করতে পারে, তবে মাঝারি বা তীব্র ব্যায়াম আপনার ঘুমকে প্রভাবিত করতে পারে। তাই ঘুমানোর আগে হালকা তীব্রতার ব্যায়ামগুলোই বেছে নিন।
৬. নন-প্রেসক্রিপশন প্রতিকার
আপনি মুখ দিয়ে নিতে পারেন এমন বেশ কয়েকটি জিনিস রয়েছে যা আপনার পেশীর খিঁচুনিতে সহায়তা করতে পারে:
- এনএসএইডস
ওভার-দ্য-কাউন্টার (ওটিসি) ননস্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগস প্রায়ই প্রদাহ এবং ব্যথা কমিয়ে স্বস্তি নিয়ে আসে।
- আচারের রস
অল্প পরিমাণে আচারের রস পান করলে ৩০ থেকে ৩৫ সেকেন্ডের মধ্যে পেশীর ক্র্যাম্পিং উপশম হয়। এটি ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করে কাজ করে বলে মনে করা হয়।
- সাপ্লিমেন্ট বা সম্পূরক
অনেকেই সল্ট ট্যাবলেট, ভিটামিন বি-১২ এবং ম্যাগনেসিয়াম সাপ্লিমেন্ট খিঁচুনি চিকিৎসা এবং প্রতিরোধ করতে ব্যবহার করে। এটি লক্ষ্য করা গুরুত্বপূর্ণ যে এগুলি কার্যকর তা দেখানোর জন্য সীমিত প্রমাণ রয়েছে।
- প্রাকৃতিক পেশী শিথিলকারী
প্রাকৃতিক পেশী শিথিলকরণের মধ্যে রয়েছে ক্যামোমাইল চা পান করা, খাবারে ক্যাপসাইসিন যোগ করা এবং আপনার ঘুমের উন্নতি করা ইত্যাদি।
৭. টপিকাল ক্রিম যা প্রদাহ বিরোধী এবং ব্যথা উপশমকারী
ওভার-দ্য-কাউন্টার ব্যথা উপশমকারী ক্রিম সাহায্য করতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে লিডোকেইন, কর্পূর বা মেন্থল ইত্যাদি
কারকুমা লঙ্গা (হলুদ) এবং সেলারি বীজ থেকে তৈরি ইমোলিয়েন্ট জেল পেশীর খিঁচুনি ব্যথা এবং প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।
আরও পড়ুনঃ এসিএল ইনজুরি কি, এর চিকিৎসা ও প্রতিরোধ
৮. হাইপারভেন্টিলেশন
স্পাজম সম্পর্কিত ২০১৬ সালের একটি পর্যালোচনা নিবন্ধে তিনজন অংশগ্রহণকারীর সাথে একটি পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণার প্রতিবেদন করা হয়েছে, যার মূল ব্যাখ্যা ছিল: ব্যায়াম-সম্পর্কিত ক্র্যাম্প সমাধান করতে প্রতি মিনিটে ২০ থেকে ৩০ শ্বাসে হাইপারভেন্টিলেটিং ব্যবহার করে স্পাজম এর জটিলতা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
হাইপারভেন্টিলেশন হল যখন আপনি স্বাভাবিকের চেয়ে দ্রুত শ্বাস নেন। আপনার যদি উদ্বেগ থাকে তবে হাইপারভেন্টিলেশন আপনার জন্য ভাল পছন্দ নাও হতে পারে, কারণ এটি আতঙ্কের অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে।
৯. প্রেসক্রিপশন ওষুধ
আপনার যদি ক্রমাগত পেশীর খিঁচুনি থাকে, বিশেষত যদি এটি গুরুতর হয়, আপনার ডাক্তার একটি পেশী শিথিলকারী বা ব্যথার ওষুধ লিখে দিতে পারেন। পেশী খিঁচুনির জন্য ব্যবহৃত পেশী শিথিলকারী গুলো কে কেন্দ্রীয়ভাবে স্কেলেটাল পেশী শিথিলকারী (এসএমআর’স) বলা হয় এবং প্রায়শই শুধুমাত্র দুই থেকে তিন সপ্তাহের জন্য নিতে বলা হয়।
মাসল স্পাজম সাধারণত স্বল্পস্থায়ী এবং স্ব-চিকিৎসা, বিশেষ করে স্ট্রেচিং, বেশিরভাগ মানুষের জন্য কাজ করে। আপনার যদি ঘন ঘন মাসল স্পাজম বা ক্র্যাম্পিং হয়, বা যদি সেগুলো খুব বেদনাদায়ক হয়, তাহলে খিঁচুনির কারণ কী, তা খুঁজে বের করতে একজন ডাক্তারের পরামর্শ নিন। দীর্ঘস্থায়ী মাসল স্পাজম সারাতে ফিজিওথেরাপি অত্যন্ত কার্যকর।
তথ্যসূত্রঃ
- Giuriato, G., Pedrinolla, A., Schena, F. and Venturelli, M., 2018. Muscle cramps: A comparison of the two-leading hypothesis. Journal of electromyography and kinesiology, 41, pp.89-95. https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S1050641118300919
- Allen, R.E. and Kirby, K.A., 2012. Nocturnal leg cramps. American family physician, 86(4), pp.350-355. https://www.aafp.org/pubs/afp/issues/2012/0815/p350.html?utm_source=Final+Version+of+E-Tips+02.19.19&utm_campaign=E-Tips++2-19-2019&utm_medium=email
- Girard, E., Lacour, A., Abi Rached, H., Ramdane, N., Templier, C., Dziwniel, V., Desmedt, E., Le Rhun, E. and Mortier, L., 2018. Occurrence of vismodegib-induced cramps (muscular spasms) in the treatment of basal cell carcinoma: A prospective study in 30 patients. Journal of the American Academy of Dermatology, 78(6), pp.1213-1216. https://www.jaad.org/article/S0190-9622(17)32744-5/abstract
- Katzberg, H., Kokokyi, S., Halpern, E., Lovblom, E., Barnett, C., Hume, D., Bril, V. and Perkins, B., 2014. Prevalence of muscle cramps in patients with diabetes. Diabetes care, 37(1), pp.e17-e18. https://diabetesjournals.org/care/article-abstract/37/1/e17/32017
- McCarberg, B.H., Ruoff, G.E., Tenzer‐Iglesias, P. and Weil, A.J., 2011. Diagnosis and Treatment of Low‐Back Pain Because of Paraspinous Muscle Spasm: A Physician Roundtable. Pain Medicine, 12, pp.S119-S127. https://onlinelibrary.wiley.com/doi/abs/10.1111/j.1526-4637.2011.01253.x
- Nelson, N.L. and Churilla, J.R., 2016. A narrative review of exercise‐associated muscle cramps: Factors that contribute to neuromuscular fatigue and management implications. Muscle & nerve, 54(2), pp.177-185. https://onlinelibrary.wiley.com/doi/abs/10.1002/mus.25176
- ডেঙ্গু জ্বরের ৭টি সতর্কীকরণ লক্ষণ ২০২৪ | ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার - November 28, 2024
- হাঁটু ব্যথার জন্য কার্যকারী ব্যায়াম গুলো জেনে নিন - November 28, 2024
- লাম্বার স্পন্ডাইলোসিস কমানোর উপায়? ও স্পন্ডাইলোসিস কি? - November 5, 2024