ট্রিগার ফিঙ্গার (Trigger Finger) হলো এমন একটি রোগ যেখানে আঙুল বাঁকানোর পর তা সোজা করতে গেলে আটকে যায় বা হঠাৎ লাফিয়ে সোজা হয়ে যায়। এটি সাধারণত আঙুলের টেন্ডনের প্রদাহ বা টাইট হয়ে যাওয়ার কারণে ঘটে, যা আঙুলের স্বাভাবিক গতিবিধি তে বাধা সৃষ্টি করে। সাধারণত এই সমস্যা হাতের মধ্য আঙুল, অনামিকা বা বুড়ো আঙুলে বেশি দেখা যায়।
লক্ষণ গুলো হলো আঙুল বাঁকানোর সময় ব্যথা অনুভব করা, আঙুল আটকে যাওয়া এবং সোজা করার সময় হঠাৎ করে লাফিয়ে ওঠার অনুভূতি হওয়া। সকালে বা দীর্ঘ সময় বিশ্রামের পরে এই লক্ষণ গুলো বেশি প্রকট হয়।
ট্রিগার ফিঙ্গার কেন হয়?
ট্রিগার ফিঙ্গার সাধারণত আঙুলের টেন্ডন বা টেন্ডনের চারপাশের আবরণে প্রদাহ বা সংকোচনের কারণে হয়। এই অবস্থায় টেন্ডন আঙুলের ভেতরে সহজে নড়াচড়া করতে পারে না, যার ফলে আঙুল বাঁকানো অবস্থায় আটকে যায় এবং সোজা করতে গেলে হঠাৎ করে লাফিয়ে ওঠে। ট্রিগার ফিঙ্গারের কিছু সাধারণ কারণ রয়েছে, যেমন
অতিরিক্ত ব্যবহার: যারা বারবার আঙুল বাঁকানো এবং সোজা করার মতো কাজ করেন, যেমন টাইপিস্ট, মিস্ত্রি, বা যে কোনো পেশায় যেখানে হাত মুষ্টিবদ্ধ করার প্রয়োজন হয়, তাদের মধ্যে ট্রিগার ফিঙ্গার হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। আঙুলের অতিরিক্ত ব্যবহার টেন্ডনের উপর চাপ সৃষ্টি করে, যা টেন্ডনের প্রদাহ বা সংকোচনের কারণ হতে পারে। আপনার কনুই ব্যথায় কী করবেন
এর ফলে আঙুলের টেন্ডনটি সঠিক ভাবে নড়াচড়া করতে পারে না এবং আঙুল বাঁকানো অবস্থায় আটকে যায়, যাকে লক হওয়া বলে। অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে টেন্ডনের চারপাশের শীথ সংকুচিত হয়ে যায়, ফলে আঙুল লক হয়ে যাওয়ার সমস্যা প্রকট হয়।
ট্রিগার ফিঙ্গার
দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহ: দীর্ঘ সময় ধরে আর্থ্রাইটিস বা গেঁটেবাতের মতো প্রদাহ জনিত রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে এই সমস্যা বেশি দেখা যায়। দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহ টেন্ডনের স্বাভাবিক কার্যকলাপ কে বাধাগ্রস্ত করে, যার ফলে টেন্ডন ফুলে যায় বা সংকুচিত হয়ে যায় এবং আঙুল ভাঁজ করার সময় লক হয়ে যায়। প্রদাহের কারণে টেন্ডন এবং টেন্ডন শীথের মধ্যে ঘর্ষণ বৃদ্ধি পায়, যা টেন্ডনকে আঙুলের ভেতরে স্বাভাবিক ভাবে চলাচল করতে দেয় না। এর ফলে আঙুল ভাঁজ বা সোজা করার সময় ব্যথা ও আটকে যাওয়ার অনুভূতি হয় (1)।
স্বাস্থ্যগত কারন: হাতের আঙুল লক হয়ে যাওয়ার পেছনে বেশ কিছু স্বাস্থ্যগত কারণ রয়েছে, বিশেষ করে ডায়াবেটিস, থাইরয়েড সমস্যা, এবং রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের মতো দীর্ঘ মেয়াদী রোগ গুলো। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ট্রিগার ফিঙ্গারের সমস্যা বেশি দেখা যায়, কারণ ডায়াবেটিস টেন্ডন এবং টিস্যুগুলোর মধ্যে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যা টেন্ডনকে শক্ত করে এবং প্রদাহ তৈরি করে। এই প্রদাহ আঙুলের গতিবিধি কে বাধাগ্রস্ত করে এবং লক হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। আপনার মাথা ব্যাথা হলে করণীয়
একই ভাবে, থাইরয়েডের সমস্যা থাকলে শরীরের টিস্যু মেটাবলিজমে পরিবর্তন আসে, যা টেন্ডন শীথের সংকোচন এবং প্রদাহের কারণ হতে পারে। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের ক্ষেত্রে শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা টেন্ডনকে আক্রমণ করে, যা টেন্ডন এবং তার আশেপাশের টিস্যু তে প্রদাহ এবং ক্ষতি সৃষ্টি করে, ফলে আঙুল লক হয়ে যাওয়ার সমস্যা দেখা দেয় (2)।
ট্রিগার ফিঙ্গার এর প্রথম চিকিৎসা কি?
বয়স ও লিঙ্গ: সাধারণত মধ্যবয়সী এবং বয়স্কদের মধ্যে ট্রিগার ফিঙ্গারের সমস্যা বেশি দেখা যায়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে টেন্ডন এবং টিস্যুগুলোর স্থিতিস্থাপকতা কমে যায়, যা টেন্ডনকে কঠিন এবং সংকুচিত করে তোলে। এর ফলে আঙুলের স্বাভাবিক চলাচলে বাধা সৃষ্টি হয় এবং লক হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও, নারীদের মধ্যে বিশেষ করে ৪০ থেকে ৬০ বছর বয়সের মধ্যে এই সমস্যা বেশি পরিলক্ষিত হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, নারীদের হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে টেন্ডনগুলো বেশি সংবেদনশীল হয়, যা প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে এবং ট্রিগার ফিঙ্গার হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। বিশেষত স্থায়ী ভাবে মাসিক বন্ধের পর নারীদের শরীরের হরমোন ভারসাম্য পরিবর্তনের কারণে এই সমস্যা আরও প্রকট হতে পারে (3)।
আঘাত: আঙুল বা হাতের কোনো অংশে সরাসরি আঘাত লাগলে টেন্ডন এবং এর আশেপাশের টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আঘাতের কারণে টেন্ডনের চারপাশে প্রদাহ সৃষ্টি হয়, যা টেন্ডনকে বাঁকানো বা সোজা করার সময় বাধা দেয়। বিশেষ করে, আঘাতের পর টেন্ডন শীথ সংকুচিত হয়ে যেতে পারে, যার ফলে টেন্ডনের স্বাভাবিক কার্যকলাপে ব্যাঘাত ঘটে এবং আঙুল বাঁকানোর পর তা লক হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে, আঘাতের পর টেন্ডন সঠিক ভাবে সেরে না উঠলে বা টিস্যুতে স্কার (scar tissue) তৈরি হলে ট্রিগার ফিঙ্গারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এই অবস্থায় আঙুলে লক হওয়ার পাশাপাশি ব্যথা, ফোলা ভাব, এবং শক্ত হয়ে যাওয়ার অনুভূতি দেখা দিতে পারে (4)।
হাতের আঙ্গুল লক হয়ে যাওয়ার চিকিৎসা
হাতের আঙুল লক হয়ে যাওয়া বা ট্রিগার ফিঙ্গার, এর চিকিৎসা মূলত সমস্যার তীব্রতা এবং রোগীর উপসর্গের উপর নির্ভর করে। চিকিৎসা সাধারণত কয়েক টি ধাপে করা হয়, যা নিচে উল্লেখ করা হলো
বিশ্রাম: আঙুলের অতিরিক্ত ব্যবহার টেন্ডনের উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে, যা প্রদাহ এবং আঙুলের লক হওয়ার সমস্যা বাড়িয়ে তোলে। আঙুল কে বিশ্রামে রাখার মাধ্যমে টেন্ডন এবং এর আশেপাশের টিস্যু গুলোর প্রদাহ কমে যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে আক্রান্ত আঙুল দিয়ে কাজ না করাই ভালো, বিশেষ করে যেসব কাজ আঙুল বারবার ভাঁজ এবং সোজা করার প্রয়োজন পড়ে। অনেক সময় স্প্লিন্ট বা অন্যান্য সাপোর্ট ব্যবহার করা হয়, যা আঙুল কে বাঁকানো থেকে বিরত রাখে এবং টেন্ডনের ওপর চাপ কমায় (5)।
প্রদাহ নাশক ওষুধ: সাধারণত নন-স্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ড্রাগস (NSAIDs) যেমন ইবুপ্রোফেন বা ন্যাপ্রোক্সেন ব্যবহার করা হয়। এই ওষুধ গুলো প্রদাহ কমায় এবং টেন্ডনের আশেপাশে সৃষ্ট ফোলা ভাব হ্রাস করে, ফলে ব্যথা এবং আঙুল লক হওয়ার সমস্যা অনেকাংশে উপশম হয়। NSAIDs দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহ কমানোর পাশাপাশি আঙুলের কার্য ক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।
যদিও এই ওষুধ গুলো সরাসরি সমস্যা নিরাময় করে না, তবে তারা প্রদাহ জনিত উপসর্গ কমাতে সহায়ক, বিশেষত যখন টেন্ডনের প্রদাহ থেকে আঙুল লক হয়ে যায়। তবে দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহারের ক্ষেত্রে, NSAIDs-এর কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকতে পারে, যেমন পাকস্থলীর সমস্যার ঝুঁকি, তাই চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে এগুলো ব্যবহার করা উচিত (6)।
ফিজিওথেরাপি: হাতের আঙুল লক হয়ে যাওয়ার চিকিৎসায় ফিজিওথেরাপি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, বিশেষত রোগীর আঙুলের কার্যক্ষমতা পুনরুদ্ধার এবং ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসায় হালকা স্ট্রেচিং এবং মোবিলাইজেশন এক্সারসাইজের মাধ্যমে আঙুলের টেন্ডনের উপর চাপ কমানো এবং প্রদাহ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে ম্যানুয়াল থেরাপির মাধ্যমে আঙুলের গতিবিধি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে সার্জারির প্রয়োজনীয়তাও এড়ানো যায় (7)।
বাংলাদেশে ঢাকার মোহাম্মদপুরে অবস্থিত ASPC ম্যানিপুলেশন থেরাপি সেন্টার (House #U64, Noorjahan Road Mohammadpur, Dhaka-1207) উল্লেখযোগ্য একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত যেখানে আঙুল লক হয়ে যাওয়া বা ট্রিগার ফিঙ্গেরের চিকিৎসা করা হয় Structural Diagnosis & Management (SDM) টেকনিকের মাধ্যমে যেখানে রোগীদের আঙুলের অবস্থা পর্যবেক্ষন করে চিকিৎসা করা হয় এবং যা রোগ নিরাময় ও পুনর্বাসনে অত্যন্ত কার্যকর হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
সার্জারি: সার্জারির মাধ্যমে টেন্ডনের চারপাশের সংকুচিত শীথ কেটে ফেলা হয়, যা টেন্ডনের স্বাভাবিক নড়াচাড়ায় সাহায্য করে এবং আঙুলের লক হওয়ার সমস্যা দূর করে। এই পদ্ধতি কে টেন্ডন রিলিজ সার্জারি বলা হয়। এটি একটি ছোট সার্জারি এবং সামাণ্য জটিল একটি প্রক্রিয়া, যা লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া ব্যবহার করে সম্পন্ন করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে, সার্জারির পর রোগীরা দ্রুত স্বাভাবিক কাজে ফিরে যেতে পারেন এবং আঙুলের কার্যক্ষমতা পুনরুদ্ধার হয়।
তথ্যসূত্র
- Baumgarten, K.M., Gerlach, D. and Boyer, M.I., 2007. Corticosteroid injection in diabetic patients with trigger finger: a prospective, randomized, controlled double-blinded study. JBJS, 89(12), pp.2604-2611. https://journals.lww.com/jbjsjournal/fulltext/2007/12000/corticosteroid_injection_in_diabetic_patients_with.5.aspx
- Akhtar, S., Bradley, M.J., Quinton, D.N. and Burke, F.D., 2005. Management and referral for trigger finger/thumb. Bmj, 331(7507), pp.30-33. https://www.bmj.com/content/331/7507/30?ehom=
- Makkouk, A.H., Oetgen, M.E., Swigart, C.R. and Dodds, S.D., 2008. Trigger finger: etiology, evaluation, and treatment. Current reviews in musculoskeletal medicine, 1, pp.92-96. https://link.springer.com/article/10.1007/s12178-007-9012-1
- Ryzewicz, M. and Wolf, J.M., 2006. Trigger digits: principles, management, and complications. The Journal of hand surgery, 31(1), pp.135-146. https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S0363502305008099
- Makkouk, A.H., Oetgen, M.E., Swigart, C.R. and Dodds, S.D., 2008. Trigger finger: etiology, evaluation, and treatment. Current reviews in musculoskeletal medicine, 1, pp.92-96. https://link.springer.com/article/10.1007/s12178-007-9012-1
- Baumgarten, K.M., Gerlach, D. and Boyer, M.I., 2007. Corticosteroid injection in diabetic patients with trigger finger: a prospective, randomized, controlled double-blinded study. JBJS, 89(12), pp.2604-2611. https://journals.lww.com/jbjsjournal/fulltext/2007/12000/corticosteroid_injection_in_diabetic_patients_with.5.aspx
- Ryzewicz, M. and Wolf, J.M., 2006. Trigger digits: principles, management, and complications. The Journal of hand surgery, 31(1), pp.135-146. https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S0363502305008099
- ডেঙ্গু জ্বরের ৭টি সতর্কীকরণ লক্ষণ ২০২৪ | ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার - November 28, 2024
- হাঁটু ব্যথার জন্য কার্যকারী ব্যায়াম গুলো জেনে নিন - November 28, 2024
- লাম্বার স্পন্ডাইলোসিস কমানোর উপায়? ও স্পন্ডাইলোসিস কি? - November 5, 2024