পিঠে ব্যথা হওয়ার কারণ. পিঠের ব্যথায় আমরা কম বেশী সবাই কোনো না কোনো সময় ভুগে থাকি ,যা আমাদের জীবনের কর্ম ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা সৃষ্টি করে থাকে । পিঠে ব্যথার কারণ গুলি জানা শুধু মাত্র কার্যকর চিকিৎসার জন্যই নয় এটা রোগ প্রতিরোধ এবং জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের জন্যও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পিঠেব্যথা সাধারণত বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই কোমড় থেকে এসে থাকে। মানুষের মেরুদণ্ড একটি জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ । যার ৩৩ টা হাড় বা কশেরুকা থাকে,এই হাড়গুলো একটা সিরিজ আকারে সাজানো থাকে, যা মাথার খুলি থেকে কোমরের নিচ পর্যন্ত একসাথে বসানো থাকে। মেরুদণ্ডের ভিতরের স্পাইনাল কর্ড স্নায়ুতন্ত্রের একটি গুরুত্ব পূর্ণ অংশ, যা মস্তিস্ক থেকে শরীরের বাকি অংশের মধ্যে সংকেত পাঁঠিয়ে থাকে। মেরুদণ্ডের কাঠামোগত ত্রুটি বা আশেপাশের টিস্যুতে যেকোনো আঘাত বা প্যাথলজিক্যাল কারনে পিঠে ব্যথা হতে পারে । যা বিভিন্ন মাত্রায় ও তীব্রতায় প্রকাশ পায় । পিঠে ব্যথার ব্যায়াম
পিঠ ব্যথার জন্য যে সব কারণ বেশী দায়ী
যদিও পেশীর স্ট্রেন এবং ডিস্ক হার্নিয়েশন পিঠে ব্যথার মূখ্য কারণ হিসেবে দায়ি তবে এগুলো ছাড়াও আরো বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য কারণ রয়েছে যা পিঠের ব্যথার জন্য দায়ী হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে স্পাইনাল ইনফেকশন্স বা মেরুদণ্ডের প্রদাহ এবং ক্যান্সার , টিউমার, অটোইমিউন ডিজিজ যেমন এঙ্কাইলোজিং স্পন্ডাইলাইটিস এবং অস্টিওপোরোসিস-সম্পর্কিত ফ্র্যাকচার।
পেশী ছিরে যাওয়া এবং লিগামেন্টে টান লাগা
পেশীর স্ট্রেন এবং লিগামেন্টে টান লাগা পিঠে ব্যথার সবচেয়ে সাধারণ কারণগুলির মধ্যে একটি। এই আঘাত গুলো সাধারণত হঠাৎ নড়াচড়া, ভুলভাবে ভারী জিনিস তোলা বা দীর্ঘদিন যাবৎ ভারি কাজ একই ভাবে করার কারণে হয়ে থাকে । পেশীর স্ট্রেনগুলি পেশীর আঘাতের সাথে জড়িত, উভয় কারণেই ব্যথা হয়, জয়েন্ট ফুলে যায় এবং জয়েন্টের গতিশীলতা হ্রাস পায়, যা প্রায়ই তীব্র পিঠে ব্যথার দিকে পরিচালিত করে।
আরও পড়ুনঃ কোমর ব্যথার কারণ কি?
হার্নিয়েটেড ডিস্ক বা স্লিপড ডিস্ক
হার্নিয়েটেড ডিস্ক, এটি একটি স্লিপড ডিস্ক নামেও পরিচিত। যখন ইন্টারভার্টেব্রাল ডিস্কের ভেতরের জেলির মতো পদার্থ বাইরের দিকে ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে এবং পার্শবর্তী নার্ভে চাপ দেয় বা বাধা দেয়, যার ফলে পিঠে ব্যথা বা দুর্বলতা সৃষ্টি হয়, যা প্রায়শই বাহু বা পায়ে ছড়িয়ে পড়ে। বার্ধক্য, ক্ষয় বা আঘাতের মতো কারণে ডিস্ক হার্নিয়েশন হয়ে থাকে, যা পিঠে ব্যথার প্রচলিত কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং এটি বিশেষ করে মধ্যবয়সী, বয়স্ক ও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে বেশী দেখা যায়। পিঠে ব্যথার অন্যতম কারণ অ্যাঙ্কাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিসঃ রোগের ধরণ এবং প্রতিকার
অস্টিওআর্থ্রাইটিস ও স্নায়ু চেপে যাওয়া
অস্টিওআর্থ্রাইটিস একটি ক্ষয়প্রাপ্ত জয়েন্টের রোগ, মেরুদন্ডের জয়েন্ট এবং ডিস্কের তরুণাস্থি বা সাদা অংশকে ভেঙে মেরুদণ্ডকে প্রভাবিত করে। এর কারনে মেরুদণ্ডের স্টেনোসিস হতে পারে বা স্নায়ু চেপে যাতে পারে,এটি এমন অবস্থা যেখানে মেরুদণ্ডের কলাম সংকীর্ণ হয় বা চেপে যায়, যার ফলে মেরুদণ্ড এবং স্নায়ুর উপর চাপ পড়ে। উভয় অবস্থার জন্য পিঠের মাংসপেশি শক্ত, ব্যথা এবং মেরুদণ্ডের গতিশীলতা বা মুভমেন্ট কমে যায়, এবং প্রায়ই সময়ের সাথে সাথে খারাপ হতে থাকে।
স্কোলিওসিস বা মেরুদণ্ড এক দিকে বেঁকে যাওয়া
স্কোলিওসিস হলে পিঠের মেরুদণ্ড অস্বাভাবিক ভাবে এক দিকে বেঁকে যায়,যা পিঠে ব্যথার কারণ হতে পারে। যদিও এটি শৈশব বা বয়ঃসন্ধিকালে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, তবে এর প্রভাবগুলি যৌবনে দীর্ঘস্থায়ী পিঠের ব্যথার কারন হতে পারে, বিশেষ করে যদি চিকিৎসা না করা হয় ভবিষ্যতে তা বেশী খারাপের দিকে যায় ।
কাইফোসিস বা মেরুদণ্ড সামনের দিকে ঝুকে যাওয়া
কাইফোসিস হলে মেরুদণ্ড সামনের দিকে ঝুকে যায় , যার ফলে মেরুদণ্ডের অস্বাভাবিক বক্রতার বা ভাঁজের কারণে পিঠের উপরের পেশীগুলিতে দীর্ঘ সময় ধরে টান পরে এর কারনে মেরুদণ্ডের পেশী শক্ত হয়ে যায় এবং মেরুদণ্ডের হারের অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখা দেয়,সময়ের সাথে সাথে এটি পেশীগুলো দুর্বল হয়ে যায় এবং পেশীতে স্ট্রেইন হতে পারে, যার ফলে পিঠে ব্যথা হতে পারে ।
স্পাইনাল ইনফেকশন্স, ক্যান্সার এবং টিউমার
স্পাইনাল ইনফেকশন্স বা মেরুদণ্ডের প্রদাহ, যেমন অস্টিওমাইলাইটিস, এপিডুরাল ফোড়া, যদিও এই সমস্যাগুলো বিরল, এর কারনে তীব্র পিঠে ব্যথা হতে পারে। এই সংক্রমণগুলি ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাক এর কারন থেকে হয়ে থাকে এবং আরও জটিলতা প্রতিরোধ করার জন্য প্রায়শই দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
একই ভাবে, টিউমার ভালো বা খারাপ যাই হোক না কেন, পিঠের মেরুদন্ড বা কশেরুকার উপরে বা কাছাকাছি বৃদ্ধি পেতে পারে। এই টিউমার গুলি পিঠের মেরুদণ্ডের স্নায়ু বা মেরুদন্ডকে চাপ দিতে পারে, যার ফলে পিঠে ব্যথা, বা দুর্বলতা দেখা দেয়।
ক্যান্সারের ধরন এবং এটি শরীরের কোথায় ছড়িয়ে পড়ে তার উপর নির্ভর করে পিঠে ব্যথা হতে পারে। কিছু ক্যান্সারের চিকিৎসা, যেমন রেডিয়েশন থেরাপি এবং কেমোথেরাপি এর কারনে ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে, যা পিঠে ব্যথার সাধারণ কারন হতে পারে ।
অটোইমিউন রোগ যেমন এঙ্কাইলোজিং স্পন্ডাইলাইটিস
এঙ্কাইলোজিং স্পন্ডাইলাইটিস একটি প্রদাহজনক ( ইনফ্লামেটিক কন্ডিশন) রোগ যা প্রধানত মেরুদণ্ড এবং স্যাক্রোইলিয়াক জয়েন্ট গুলিকে প্রভাবিত করে। এই রোগ দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ সৃষ্টি করে, যার কারনে মাংসপেশী শক্ত হয়ে যায় এবং শরীর ব্যথা করে । প্রথম দিকে কোমর বা কমরের নিচের দিকে বাথা শুরু হয় পরে ধিরে ধিরে তা পিঠের দিকে চলে আসে । সময়ের সাথে সাথে, মেরুদন্ডের হাড়গুলি ফিউজ হতে পারে বা চেপে যেতে পাড়ে এক সময়ে তা বাঁশ এর মতো হয়ে যেতে পারে, এবং শরীরের নমনীয়তা এবং অঙ্গভংগিকে প্রভাবিত করে বা পরিবর্তন করে ফেলে।
আরও পড়ুনঃ হাঁটু ব্যথার কারণ কি?
অস্টিওপোরোসিস সম্পর্কিত ফ্র্যাকচার
অস্টিওপোরোসিস হলে হারের ঘনত্ব এবং পুরত্ব কমে যায়, যার ফলে হার দুর্বল হয় ও হারের শক্তি কমে যায়, এবং অল্প আঘাতে বা সামান্য চাপে বা পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে পিঠের হাড় ভেঙ্গে যেতে পারে বা কশেরুকাতে ফ্র্যাকচার হতে পারে। এ জন্য পিঠে দীর্ঘ স্থায়ি ব্যথা হতে পারে।
কারা কারা বেশী ঝুকিতে আছেন
পিঠে ব্যথা বয়স এর পরিবর্তন থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনের কার্যকালাপ এবং জেনেটিক প্রবণতা পর্যন্ত অনেক ঝুঁকির কারণ হতে পারে। পিঠের ব্যথা প্রতিরোধ এবং কার্যকর ব্যবস্থাপনা জানা এবং এই ঝুঁকির কারণগুলি বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বয়স-সম্পর্কিত ঝুঁকি
পিঠে ব্যথা হওয়া বয়স এর সঙ্গে উল্লেখযোগ্য । মানুষের বয়স বাড়ার সাথে সাথে মেরুদন্ডে ডিজেনারেটিভ পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে, যেমন ডিস্কের ক্ষয়, অস্টিওআর্থারাইটিস এবং অস্টিওপোরোসিস বা হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়া। এই পরিবর্তনগুলি পিঠে ব্যথা হয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলতে পারে, বিশেষ করে ৩০ বা ৪০ বছর বয়সের পরে।
অতিরিক্ত ওজন বা কম ওজন থাকা, ব্যায়ামের অভাব, খারাপ পোশচার
বিলাসবহুল জীবনধারা মানুষের শরীরকে অলস বানায় এবং শরীর দুর্বল হয়ে পরে ফলে পিঠে বাথা হতে পারে এবং যাদের ওজন স্বাভাবিকের থেকে অনেক বেশী বা অনেক কম হয় তাদের পিঠে বাথা হতে পারে। এবং যারা এলোমেলো ভঙ্গিতে অনেকক্ষণ ধরে দাড়িয়ে থাকে বা শুয়ে থাকার কারনে মেরুদণ্ডের হাড়ে চাপ পরে এবং পিঠে ব্যথা হতে পারে।
পেশাগত চাপ
কিছু পেশা আছে যেখানে ভারী বস্তু উত্তোলন করা লাগে, বা দীর্ঘক্ষণ বসে বা দারিয়ে থাকতে হয় যার কারনে পিঠে ব্যথার ঝুঁকি বাড়াতে পারে। যে কাজগুলির জন্য মেরুদণ্ড বাঁকানো বা ভারী জিনিসগুলিকে অনুপযুক্তভাবে তোলার প্রয়োজন হয় সেগুলির কারনে পিঠে স্ট্রেন হতে পারে বা পেশী বা লিগামেন্ট স্ট্রেন হতে পারে ফলে পিঠে ব্যথা হতে পারে।
মনস্তাত্ত্বিক কারণ: চাপ, উদ্বেগ, বিষণ্নতা
স্ট্রেস, উদ্বেগ এবং বিষন্নতা পিঠে ব্যথার সাথে যুক্ত। দীর্ঘস্থায়ী চাপ পেশীতে টান হতে পারে এবং ব্যথা বাড়িয়ে তুলতে পারে। অধিকন্তু, মনস্তাত্ত্বিক চিন্তা কারণগুলি ব্যথাকে প্রভাবিত করতে পারে
জিনগত প্রবণতা
জেনেটিক বা জিনগত সমস্যার কারনে পিঠে বাথা হতে পারে, যেমন আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, এবং জন্মগত মেরুদণ্ডের ব্যাধি। যাদের পিঠে ব্যথা বা মেরুদণ্ডের ব্যাধির পারিবারিক ইতিহাস রয়েছে তাদের পিঠে ব্যথার ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।
তথ্যসূত্র
1. Braun, J. and Sieper, J., 2007. Ankylosing spondylitis. The Lancet, 369(9570), pp.1379-1390. https://www.thelancet.com/article/S0140-6736(07)60635-7/abstract
2. Chou, R., Qaseem, A., Snow, V., Casey, D., Cross Jr, J.T., Shekelle, P., Owens, D.K. and Clinical Efficacy Assessment Subcommittee of the American College of Physicians and the American College of Physicians/American Pain Society Low Back Pain Guidelines Panel*, 2007. Diagnosis and treatment of low back pain: a joint clinical practice guideline from the American College of Physicians and the American Pain Society. Annals of internal medicine, 147(7), pp.478-491. https://www.acpjournals.org/doi/abs/10.7326/0003-4819-147-7-200710020-00006
3. Felson, D.T., Lawrence, R.C., Dieppe, P.A., Hirsch, R., Helmick, C.G., Jordan, J.M., Kington, R.S., Lane, N.E., Nevitt, M.C., Zhang, Y. and Sowers, M., 2000. Osteoarthritis: new insights. Part 1: the disease and its risk factors. Annals of internal medicine, 133(8), pp.635-646. https://www.acpjournals.org/doi/abs/10.7326/0003-4819-133-8-200010170-00016
4. Katzman, W.B., Wanek, L., Shepherd, J.A. and Sellmeyer, D.E., 2010. Age-related hyperkyphosis: its causes, consequences, and management. Journal of Orthopaedic & Sports Physical Therapy, 40(6), pp.352-360. https://www.jospt.org/doi/abs/10.2519/jospt.2010.3099
5. Luo, C.T. and Yee, J., 2020. Spinal Epidural Abscess. Journal of Education and Teaching in Emergency Medicine, 5(1). https://escholarship.org/content/qt15k9x81v/qt15k9x81v.pdf
6. Melton III, L.J., Thamer, M., Ray, N.F., Chan, J.K., Chesnut III, C.H., Einhorn, T.A., Johnston, C.C., Raisz, L.G., Silverman, S.L. and Siris, E.S., 1997. Fractures attributable to osteoporosis: report from the National Osteoporosis Foundation. Journal of Bone and Mineral Research, 12(1), pp.16-23. https://asbmr.onlinelibrary.wiley.com/doi/abs/10.1359/jbmr.1997.12.1.16
7. Weinstein, S.L., Dolan, L.A., Cheng, J.C., Danielsson, A. and Morcuende, J.A., 2008. Adolescent idiopathic scoliosis. The lancet, 371(9623), pp.1527-1537. https://www.thelancet.com/journals/lancet/article/PIIS0140673608606583/fulltext
- ডেঙ্গু জ্বরের ৭টি সতর্কীকরণ লক্ষণ ২০২৪ | ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার - November 28, 2024
- হাঁটু ব্যথার জন্য কার্যকারী ব্যায়াম গুলো জেনে নিন - November 28, 2024
- লাম্বার স্পন্ডাইলোসিস কমানোর উপায়? ও স্পন্ডাইলোসিস কি? - November 5, 2024