কিডনি ভালো রাখার উপায়

কিডনি ভালো রাখার উপায়. মানব দেহের জরুরি অঙ্গ গুলির মধ্যে কিডনি অত্যন্ত গুরুত্ব পূর্ণ। মানুষের দেহে সাধারণত দুটি কিডনি থাকে যা রক্ত পরিষ্কার করার কাজ করে। কিডনি রক্তের মধ্যে থাকা বর্জ্য পদার্থ গুলি কে আলাদা করে এবং মূত্রের মাধ্যমে এই বর্জ্য গুলি দেহ থেকে বাহির করে দেয়। এভাবে কিডনি দেহের জল ভারসাম্য বজায় রাখার পাশাপাশি দূষিত পদার্থ গুলি বাছাই করে বের করে দেয়। কিডনি রোগীর খাবার

কিডনি ভালো রাখার উপায়

সুস্থ ও সচেতন জীবন যাপনে কিডনির ভালো থাকা অপরিহার্য। বিভিন্ন রোগ ও সমস্যার কারণে কিডনি ক্ষতি গ্রস্থ হতে পারে, এমনকি অকার্যকর হয়ে পড়তে পারে। কিডনির রোগ প্রায়শই ‘নীরব ঘাতক’ হিসেবে পরিচিত এবং এর চিকিৎসা ব্যয়বহুল। বর্তমানে কিডনি রোগের প্রকোপ বেড়ে চলেছে। তবে, সচেতনতার মাধ্যমে কিডনি সুস্থ রাখা সম্ভব। এই আর্টিকেলে আমরা কিডনি সুস্থ রাখার উপায় সম্পর্কে আলোচনা করব।

কিডনি রোগের কারণ

সাধারণত শরীরের অন্যান্য রোগের কারণে ও কিডনি তে সমস্যা দেখা দিতে পারে অথবা কিডনি বিকল হতে পারে। তাই সব সময় কিডনি রোগের লক্ষণ গুলি উপস্থিত হওয়ার অর্থ এই নয় যে কিডনি তে সমস্যা রয়েছে। কিডনি তে রোগ তখনই প্রকট আকার ধারণ করে যখন এক বা একাধিক রোগ কিডনির কার্যকারিতায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে হস্তক্ষেপ করে। এমত অবস্থায় ধীরে ধীরে কিডনি তার কার্যকারিতা হারাতে থাকে এবং এক সময় বিকল হয়ে যায়। কিডনি তে রোগ হওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে তারমধ্যে-

  • টাইপ ১ বা টাইপ ২ ডায়াবেটিস
  • উচ্চ রক্তচাপ
  • পলিসিস্টিক কিডনি রোগ
  • বংশগত কিডনি রোগ
  • বয়স জনিত কিডনির সমস্যা
  • প্রোস্টেট গ্রন্থি বড় হয়ে যাওয়া
  • কিডনি তে পাথর হওয়া
  • গ্লোমেরুলোনফ্রাইটিস
  • ইন্টারস্টিশিয়াল নেফ্রাইটিস
  • ক্যান্সার
  • মূত্রথলির প্রদাহ
  • পাইলোনেফ্রাইটিস
  • মূত্রথলি তে পাথর

আরও পড়ুনঃ ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকা

যে রোগ ও অভ্যাস গুলো কিডনি রোগের ঝুঁকি বাড়ায়

  • ডায়াবেটিস
  • উচ্চ রক্তচাপ
  • হূদরোগ
  • ধূমপান
  • অস্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধি
  • বার্ধক্য জনিত সমস্যা
  • নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে অধিক ব্যথা নাশক ওষুধ ব্যবহার করা
  • ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতীত ওষুধ ব্যবহার করা
  • জন্মগত কিডনির অস্বাভাবিক গঠন
  • পরিবারিক কিডনি রোগের ইতিহাস
  • জাতিগত সমস্যা (আমেরিকান আমেরিকান হওয়া)

কিডনি রোগের লক্ষণ বা উপসর্গ

সাধারণত যখন কিডনির ক্ষমতা বেশ খানিক টা হ্রাস পায় তখন ও মানব শরীরে কিডনি তার কার্যক্রম ঠিক ভাবে চালাতে পারে ।তাই প্রাথমিক পর্যায়ে কিডনি রোগের লক্ষণ বা উপসর্গ গুলো অস্পষ্ট থাকে। কিডনি যখন ক্ষতিগ্রস্ত হয় এ সময় শরীরে প্রচুর বজ্র পদার্থ ইলেক্ট্রোলাইট তৈরি হতে পারে যা শরীরে বিষ এর মত কাজ করো শুরু করে এই লক্ষণ গুলি কিডনি রোগের শুরু তে দেখা দিতে পারে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা বৃদ্ধি পায়।

আরও পড়ুন  স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি কী, এর প্রকারভেদ এবং ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা

প্রাথমিক লক্ষণ বা উপসর্গ:

কিডনি রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে যা আপনার কাছে স্বাভাবিক মনে হতে পারে।

এইসব উপসর্গের মধ্যে-

  • বমি বমি ভাব
  • খাদ্যে অরুচি বা ক্ষুধা মন্দ্য
  • শুষ্ক ত্বক এবং চুলকানি
  • মাথা ধরা
  • ক্লান্তি
  • ওজন হ্রাস পাওয়া
  • ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ পাওয়া।

আরও পড়ুনঃ ডায়াবেটিস এর লক্ষণ গুলো জেনে নিন

পরবর্তী লক্ষণ বা উপসর্গ:

  • রক্তে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের মাত্রা অস্থিতিশীল থাকার ফলে হারে এবং জয়েন্টে ব্যথা অনুভব হওয়া।
  • শরীরে পানি জমে যাওয়ার ফলে গোড়ালি, পা এবং হাঁটু ফুলে যাওয়া।
  • শরীরে বর্জ্য পদার্থ জমে যাওয়ার ফলে নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধ এবং দুর্গন্ধ যুক্ত প্রস্রাব হাওয়া।
  • ক্ষুধা মন্দ্য এবং ওজন হ্রাস পাওয়া
  • বমি হওয়া এবং বার বার হিচকি তোলা
  • ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ পাওয়া প্রস্রাবের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া
  • শ্বাসকষ্ট
  • ক্লান্তি
  • মল মূত্রের সঙ্গে রক্ত ক্ষরণ হওয়া
  • বিষণ্ণতায় ভোগে
  • মাংসপেশির অস্বাভাবিক সংকোচন
  • ঘন ঘন তৃষ্ণা পাওয়া
  • ঋতুস্রাব বন্ধ
  • হাওয়া
  • অনিদ্রা
  • শরীরের ত্বকের রং পরিবর্তন হওয়া
  • যৌন ক্রিয়ায় অক্ষমতা

যেভাবে ভালো রাখতে পারি আমাদের কিডনি

পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা

হঠাৎ পানি শূন্যতা কিডনির কার্যকারিতায় গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে, এমনকি এটি কিডনির কাজ ব্যাহত করে তাকে অকার্যকর করে তুলতে পারে। ডায়রিয়া বা বমি হলে শরীরে পানির অভাব হয়, যা পানি শূন্যতার একটি প্রধান কারণ। তীব্র গরম, পুড়ে যাওয়া, অথবা গুরুতর দুর্ঘটনায় রক্তপাত ঘটলে শরীর থেকে প্রচুর লবণ ও পানি বের হয়ে যায়। এর ফলে কিডনির উপর চাপ বাড়ে।

কিডনি সুস্থ রাখতে পর্যাপ্ত পানি পান করা অত্যন্ত জরুরি। প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রতিদিন অন্তত ২-৩ লিটার পানি বা অন্যান্য তরল পান করা উচিত। অতিরিক্ত ঘাম হলে পানি পানের পরিমাণ আরও বাড়ানো দরকার।

পানি শূন্যতা চিহ্নিত করার একটি উপায় হলো প্রস্রাবের রং দেখা। পানি শূন্যতা থাকলে প্রস্রাবের রং গাঢ় হয়ে যায়। পর্যাপ্ত পানি পান করলে কিডনির স্বাভাবিক কার্যকারিতা বজায় থাকে এবং কিডনি পাথরের ঝুঁকি কমে। পানি শূন্যতা দ্রুত রোধ করতে প্রথমে বার বার ওরস্যালাইন পান করা উচিত এবং যদি পানি শূন্যতা তীব্র হয়, তাহলে ইনট্রাভেনাস স্যালাইন প্রয়োগ করতে হয়।

আরও পড়ুনঃ ডায়াবেটিস কমানোর উপায়

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা

সাধারণত আমাদের দেশে বেশির ভাগ কিডনি রোগীরা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। অনিয়ন্ত্রিত এবং দীর্ঘদিনের ডায়াবেটিস কিডনির বিভিন্ন রোগ ও বিকলের অন্যতম কারণ। ডায়াবেটিকসে রোগীদের ডায়াবেটিস শনাক্ত হওয়ার সময় থেকেই সচেতন হতে হবে রক্তে শর্করা পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলে কিডনির বিভিন্ন জটিলতা এড়ানো সম্ভব।

আরও পড়ুন  ফুট ড্রপের কারণ এবং এর প্রতিকার

আমরা যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত তাদের মনে রাখা উচিত কিডনি অনেক টা বিকল হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তেমন কোনো উপসর্গ প্রকাশ পায় না এবং যখন উপসর্গ গুলো প্রকাশ পায় তখন অনেক টা দেরি হয়ে যায়। তাই নিয়মিত রক্তের সুগারের পরিমাণ পরীক্ষা করা এবং প্রতি ৬মাস পরপর সেরাম ক্রিয়েটিনিন ও প্রস্রাবের আমিষ আমিষের পরিমাণ পরীক্ষা করতে হবে।

রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখা

উচ্চ রক্তচাপ হলো কিডনি রোগের প্রধান দ্বিতীয় কারণ এবং এটি ডায়াবেটিসের মতোই নীরব ঘাতক হিসেবে কাজ করে। এটি নিশ্চুপে কিডনির ক্ষতি সাধন করতে থাকে। তাই, রক্তচাপ কে নিয়ন্ত্রণে রাখা কিডনি জটিলতা প্রতিরোধের একটি মূল উপায়। যদি রক্তচাপ ১৪০/৯০ বা তার বেশি হয়, তাহলে কিডনির সমস্যা বাড়ার ঝুঁকি থাকে।

কিডনি সুস্থ রাখার জন্য রক্তচাপের মাত্রা হলো ১৩০/৮০ অথবা তার নিচে। এর জন্য নিয়মিত ব্যায়াম করা এবং লবণ কম খাওয়া জরুরি। এই উপায় গুলো অনুসরণ করে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রেখে কিডনির সুস্বাস্থ্য বজায় রাখা সম্ভব।

স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলা

কিডনির স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সঠিক খাদ্যাভ্যাস অপরিহার্য। এর জন্য আমাদের খাবারের তালিকায় ফল মূল, শাক সবজি, ডালের মতো উদ্ভিজ্জ প্রোটিন এবং মাছ অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এগুলো কিডনির স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য উপকারী।

প্রাণিজ প্রোটিন এবং চর্বি যুক্ত খাবার, যেমন গরুর মাংস এবং অন্যান্য প্রাণিজ আমিষ, প্রক্রিয়াজাত খাবার, ইন্সট্যান্ট নুডলস, চিপস এবং ফাস্ট ফুড কিডনির উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে এবং ক্ষতিকারক হতে পারে। এই ধরণের খাবার গুলো কিডনির কার্যকারিতা ব্যাহত করে।

খাবারে অতিরিক্ত লবণের ব্যবহার কিডনির জন্য ক্ষতিকর। মানুষের শরীরের জন্য প্রতিদিন মাত্র এক চা চামচ লবণ যথেষ্ট। তাই কিডনির স্বাস্থ্য রক্ষা করতে অতিরিক্ত লবণ খাওয়া পরিহার করা উচিত।

গরমের দিনে পানির বদলে কোমল পানীয় বা এনার্জি ড্রিংকস খাওয়া কিডনির জন্য ক্ষতিকারক। এগুলোর পরিবর্তে পর্যাপ্ত পানি পান করা উচিত।

প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি প্রয়োজন হয় এবং ৫০০ মিলিগ্রামের বেশি ভিটামিন সি খাওয়া কিডনির পাথর হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। তাই প্রয়োজনের অধিক ভিটামিন সি খাওয়া পরিহার করা উচিত।

ভারতীয় উপমহাদেশে মানুষের শরীরে ভিটামিন ডি’র ঘাটতি খুবই সাধারণ এবং এর অভাব কিডনির অসুখ বাড়াতে পারে। অতিরিক্ত ওজন কিডনির রোগের ঝুঁকি বাড়ায়, তাই সুষম খাদ্যাভ্যাস মেনে চলা উচিত। শর্করা, আমিষ, চর্বি, ভিটামিন ও খনিজের সঠিক অনুপাত মেনে খাবার খাওয়া গুরুত্ব পূর্ণ। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ক্র্যাশ ডায়েটের মতো অতিরিক্ত প্রোটিন জাতীয় খাদ্যাভ্যাস এড়িয়ে চলা ভালো।

ধূমপান ও মাদকের সেবনের অভ্যাস ত্যাগ করা

ধূমপান ও মাদক সেবনের কারণে ধীরে ধীরে কিডনি রক্ত চলাচল কমে যেতে পারে। এতে করে কিডনির কার্য ক্ষমতা হ্রাস পায়। তাই আমাদের কিডনি ভালো রাখতে ধূমপান ও মাদক দ্রব্য গ্রহণের অভ্যাস পরিহার করতে হবে।

আরও পড়ুন  বার্ধক্য জনিত সমস্যায় ফিজিওথেরাপির প্রয়োজনীয়তা

নিয়মিত শরীর চর্চা করা

নিয়মিত শরীর চর্চা করলে কিডনি রোগের ঝুঁকি বহু অংশে কমে যায়। নিয়মিত শরীর চর্চার মাধ্যমে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রনে রাখা যায় যার ফলে কিডনি রোগের ঝুঁকি কমানো সম্ভব। তাছাড়া অতিরিক্ত শারীরিক ওজন হ্রাস পায় যা কিডনি রোগীর সাথে সাথে অন্যান্য রোগের ঝুঁকি কমিয়ে আমাদের শরীর ও মনকে সুস্থ সবল ও স্বাভাবিক রাখে।

আরও পড়ুনঃ ডায়াবেটিস বেড়ে গেলে করনীয়

ওষুধ সেবনের সতর্ক হওয়া

অনেক ওষুধ, বিশেষ করে ব্যথা নাশক ঔষধ গুলি, কিডনির উপর ক্ষতি কারক প্রভাব ফেলতে পারে এবং সেসব অত্যধিক বা অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার কিডনির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। ডাক্তারের নির্দেশনা ব্যতিরেকে নিজে নিজে ওষুধ সেবন করা কিডনির স্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। তাই যে কোনো ওষুধ সেবন করার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ অবশ্যই নেওয়া উচিত, যাতে কিডনির সুস্বাস্থ্য রক্ষা করা সম্ভব হয়।

নিয়মিত কিডনি পরীক্ষা করা

যেসব ব্যক্তিদের পরিবারে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, এবং অতিরিক্ত ওজনের ইতিহাস রয়েছে, তাদের কিডনির রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অন্যান্যদের তুলনায় অধিক থাকে। এই ঝুঁকি থাকা ব্যক্তিদের জন্য নিয়মিত কিডনি পরীক্ষা অত্যন্ত জরুরি। কারণ, যদি কিডনি সমস্যা অনাদৃত থাকে, তবে এটি শরীরের অন্যান্য মৌলিক অঙ্গ গুলির কার্যকারিতা ব্যাহত করে এবং গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। তাই, যাদের কিডনি রোগের ঝুঁকি রয়েছে, তাদের উচিত নিয়মিত কিডনি চেক-আপ করানো।

তথ্যসূত্রঃ

  1. American Heart Association. “Managing Blood Pressure with a Heart-Healthy Diet.”
  2. National Kidney Foundation. “Diet & Nutrition.”
  3. Mayo Clinic. “Kidney stones.”
Dr. M Shahadat Hossain
Follow me

Physiotherapist, Pain, Paralysis & Manipulative Therapy Specialist, Assistant Professor Dhaka College of Physiotherapy, Secretary-General(BPA), Secretary(CARD), Chief Consultant(ASPC), Conceptual Inventor(SDM), Faculty Member(CRP), Member-Bangladesh Rehabilitation Council

পরামর্শ নিতে 01877733322